কণাদ চৌধুরী
ভুক্তভোগী মানুষের চোখ দিয়ে দেখতে গেলে দেশভাগের সেই রাজনৈতিক সিদ্ধান্তটা ছিল খুব সংক্ষেপে এই রকম- “দেখ বাপু, এই যে জায়গাটায় তুমি বিগত কয়েক দশক ধরে বসবাস করছো, সেই জায়গাটা আজ মধ্যরাত্রির পর থেকে হয়ে যাবে অন্য একটা দেশ। যে নতুন দেশে তুমি হবে সম্পূর্ণ অবাঞ্ছিত একজন মানুষ। অতএব নিজের এবং পরিবারের জীবন ও সন্মান বাঁচাতে হলে সহায়সম্বলহীন, কপর্দকশূন্য অবস্থায় একবস্ত্রে নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে বেরিয়ে পড়ো, যাত্রা শুরু করো এক অনির্দিষ্ট ভবিষ্যতের দিকে।” সেই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের ফলেই শুরু হয়েছিল the largest and the bloodiest human migration in the history of civilization, যা অগণিত মানুষের জীবন এবং ভবিষ্যত্ কে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল এক চরম বিপর্যয়ের সামনে। সেই দেশভাগের প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছিল আমার পিতামহ এবং মাতামহ, উভয়েরই পরিবারের ওপর। ভারতবর্ষের ম্যাপের ওপর দিয়ে র্যাডক্লিফ সাহেবের টেনে দেওয়া একটা দাগ দেড়-কোটি মানুষের মতো আমার পূর্বপুরুষদেরকেও রাতারাতি নিজভুমে পরবাসী করে দিয়েছিলো। দুটো দেশের স্বাধীনতাপ্রাপ্তির ইতিহাসে শুধুমাত্র একটা কো-ল্যাটেরল ড্যামেজ হিসাবেই থেকে গেল সেই সব অগণিত মানুষের ভাগ্য-বিপর্যয়ের কাহিনী।
বাঙালির ইতিহাসে ঘটে যাওয়া সব চাইতে বড় সেই অঘটনের বিবরণ পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরেছিলেন পরিবারের পূর্ববর্তী প্রজন্মের মানুষরা, তাদের স্মৃতিচারণের মাধ্যমে। 'পার্টিশন’ কথাটা শুনলেই যে রক্তাক্ত বীভত্সতার কথা মনে ভেসে ওঠে, ‘রিফিউজি’ শব্দের মধ্যে উদ্বাস্তু-জীবনের যে দারিদ্র্য-ক্লিষ্ট কঠোর সংগ্রাম লুকিয়ে আছে, তার বেশ কিছু বর্ণনাও বিধৃত আছে অনেক ছিন্নমূল মানুষের জীবনের অভিজ্ঞতার কাহিনীতে, দেশভাগ-সংক্রান্ত সাহিত্যের পাতায়-পাতায় এবং কিছু বাংলা সিনেমার সেলুলয়েডে। অসীম সৌভাগ্যবশত আমার পূর্ববর্তী প্রজন্মকে হুবহু সেইরকম দুর্বিষহ অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়নি। অনিবার্য এই রাজনৈতিক পরিণতির মুখোমুখি দাঁড়ানোর জন্যে নিজেদেরকে প্রস্তুত করার মতো হয়তো কিছুটা সময় পেয়েছিলেন তাঁরা। সরকারি কলেজের অধ্যাপক হওয়ার সুবাদে দেশভাগের পরে কলকাতায় এসে আমার পিতামহ এপারেও সেই অধ্যাপনার কাজেই নিযুক্ত হয়েছিলেন, নিজেদের যোগ্যতায় আমার বাবা-কাকা-জেঠারাও খুব দ্রুতই নিজেদের পায়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন। সুতরাং অধিকাংশ উদ্বাস্তু পরিবারকে যে চরম আর্থিক অনটন, জীবিকার জটিলতা এবং মানবিক সংকটের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছিল, আমার পিতৃ-পিতামহকে ঠিক সেই রকম দুর্দশার মধ্যে পড়তে হয়নি। তা সত্ত্বেও নিজেদের পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংগ্রাম তাঁদের পক্ষে কঠিন ছিলো তো বটেই, কিন্তু সেই কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা করার পরেও কাঁটাতারের ওপারে ফেলে আসা ভিটেমাটি কিন্তু কখনোই তাঁদের কাছে অর্থহীন একটা অলীক অস্তিত্বে পর্যবসিত হয়ে পড়েনি। দেশভাগ-পূর্ববর্তী জীবনের যে স্মৃতি তারা আমাদের সামনে তুলে ধরেছিলেন, সেই স্মৃতির মধ্যে কোনও তিক্ততা ছিলো না, ছিলো না কোনওরকম হা-হুতাশ। বরং ছেড়ে আসা সেই দেশ আর ফেলে আসা সেই ঘরবাড়ি তাঁদের অন্তরের মধ্যে একটা কল্পিত আশ্রয় হয়ে থেকে গিয়েছিল আজীবন, যে আশ্রয়ের কাছে তারা মনে মনে ফিরে যেতেন বারংবার। প্রখর তপন তাপে পথিক যেমন খুঁজে ফেরে পথের পাশে ছায়াতরুর নির্ভরতা, দেশভাগ-পরবর্তী জীবনে নিজেদের চলার পথে সেই সুশীতল তরুছায়াকেই তাঁরা খুঁজে পেতেন তাঁদের দেশের বাড়ির গল্পকথায়। আমরা যারা দেখিনি সেই দেশ, তারা পূর্বপ্রজন্মের স্মৃতি রোমন্থনের মধ্যে দিয়েই তাঁদের ফেলে আসা সেই জন্মভূমির কিছুটা আভাস পেয়েছি শুধু।
আন্তর্জাতিক সীমান্তের ওপারে থেকে যাওয়া সেই দেশ, সেখানকার ভাষা আর ফেলে আসা জীবনের প্রতি এই যে অমোঘ একটা টান, তাকে জিইয়ে রাখার জন্য উদ্বাস্তু বা ‘রেপুচি’দের আজও নেহাত কম কথা শুনতে হয় না। ওপার বাংলা থেকে সর্বস্বান্ত হয়ে এপারে আসা প্রায় প্রত্যেক উদ্বাস্তুকেই কোনও না কোনও সময় শুনতে হয়েছে সব বাঙালেরই নাকি ‘দ্যাশে’ একটা করে জমিদারি ছিল। আমার পিতামহ যদিও ছিলেন এক ভূস্বামী পরিবারের বংশধর, আমি ছোটবেলা থেকে তাঁকে একজন আদ্যন্ত অধ্যাপক মানুষ হিসাবেই দেখেছি। তিনি অথবা তাঁর পুত্র-কন্যাদের কেউই আমাদের তৃতীয় প্রজন্মকে কোনোদিন বিঘা বিঘা জমির কোনও গল্প শোনাননি, কোনও নায়েব-গোমস্তা অথবা কোনও প্রাসাদোপম জমিদারবাড়ির গল্পও কোনোদিন শুনিনি তাঁদের মুখে। পিত্রালয় এবং মাতুলালয়, এই দুইদিকের ‘পার্টিশন-আক্রান্ত’ মানুষদের কাছে আমি বরং ছোটোবেলা থেকে শুনে এসেছি দুটো গ্রামের কথা। তার একটা হ’লো রাজশাহি শহরের সন্নিকটে অবস্থিত হরগ্রাম বা হরগাঁ, যেখানে রাজশাহি কলেজের অধ্যাপক আমার পিতামহ একটি বসতবাড়ি বানিয়েছিলেন। আমার বাপ-জেঠা-কাকাদের শৈশবের কিছুটা, স্কুল এবং কলেজ-জীবন কেটেছিল ওই হরগাঁয়। অপর গ্রামটি হল নাটোরের সন্নিকটে আমার মাতামহের গ্রাম বাসুদেবপুর। বাবারা ভাই-বোনেরা একত্র হলে তাদের গল্পগাছার অনেকটাই জুড়ে থাকতো তাদের সেই হরগাঁর বাড়ির কথা। তাঁদের আলাপচারিতায় ফিরে ফিরে আসতো হরগাঁর বাড়ির বাগানের আম-কাঁঠালের কথা, যেখানে আমার ঠাকুমার নামে একটা আমের নাম রাখা হয়েছিল ‘সাবিত্রীপসন্দ’। শুনতাম বাবা-কাকাদের স্কুল-কলেজের সহপাঠীদের আর তাদের পরিবারের গল্প, তাঁদের কঠোর সংযমী এবং নিয়মানুবর্তী বিধবা ঠাকুমা, অর্থাত্ আমার প্রপিতামহীর দোর্দন্ডপ্রতাপের নানা কাহিনী আর বাড়ির গৃহকর্মের সহায়ক সুখদেব আর সহায়িকা কুসুমের কথা। বাবাদের ভোলানাথ ইস্কুলের ছাত্র-বৎসল শিক্ষকদের আর রাজশাহি কলেজে আমার অধ্যাপক ঠাকুর্দার কয়েকজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সহকর্মী এবং তাঁদের কৃতী ছাত্রদের গল্পও যেমন শোনাতেন তাঁরা, আবার ঠাকুর্দার কলেজে যাওয়ার টমটমগাড়ি আর সেই গাড়ির গাড়োয়ানের গল্পও বাদ থাকতো না। আমার মাতামহী আমাকে শুনিয়েছিলেন চলন বিলের নৌকায় ডাকাতদের গল্প, আর বাবার কাছে শুনেছি দুকূল ছাপানো পদ্মা নদীতে তাঁদের ঝাঁপান দেওয়ার কথা। কলকাতা থেকে ট্রেনে চড়ে রাজশাহি যাওয়ার বিবরণ তাঁদের মুখে শুনে শুনে পাকশি, ভেড়ামারা, গোয়ালন্দ, সান্তাহার, এই সব নামগুলো মনের মধ্যে গেঁথে গিয়েছিল। আর শুনেছি তখনকার দিনে কী ভাবে নদীপথে তাঁরা যাতায়াত করতেন তাঁদের মামার বাড়ির দেশ টাঙ্গাইলে। ফেলে আসা ভিটে-মাটির ওপর এক সযত্নে লালিত স্মৃতিমেদুর মমতা তাঁরা ধরে রেখেছিলেন আজীবন। অবশ্য পর্যটক হিসাবে সেই ‘বিদেশে’ গিয়ে হরগাঁ-কে ফিরে দেখার ব্যাপারে পরিবারের মধ্যে স্পষ্ট দুটো ভিন্ন মানসিকতা লক্ষ করেছিলাম। আমার পিতৃদেব যদিও খুবই আগ্রহী ছিলেন এই ব্যাপারে, কিন্তু তাঁর সেই ইচ্ছা বাস্তবায়িত হয়নি। অপরদিকে আমার জ্যেষ্ঠতাত আবার সেই ইচ্ছেকে একেবারেই আমল দিতেন না। অতি উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মী হিসাবে তিনি নিজে চাইলে একবার নয়, একাধিকবার ঘুরে আসতেই পারতেন তাঁর জন্মভূমি থেকে। কিন্তু তাঁর ভাইকে নিরস্ত করার জন্য তিনি বোঝাতেন–“কী দেখবি গিয়ে? যা মনে আছে, সেটাই বরং মনের মধ্যে থাক।”
জীবনের শেষ কয়েকটা বছর বার্ধক্যজনিত তীব্র স্মৃতিভ্রংশতায় আক্রান্ত আমার পিতা তাঁর চারপাশের বাস্তব জগত থেকে সম্পূর্ণ দূরে সরে গিয়েছিলেন। মনে মনে তিনি তখন বসবাস করতেন ষাট বছর আগে তাঁর ফেলে আসা সেই হরগ্রামে, গভীর অসুখ হরগাঁকে আরও গভীর ভাবে প্রোথিত করেছিলো তাঁর মনে। ষাট দশকেরও বেশি সময় আগে যে হরগাঁ থেকে তিনি শেষবারের মতো চলে এসেছিলেন, জীবনের শেষ প্রান্তে উপনীত হয়ে তিনি যেন তাঁর চোখের সামনে দেখতে পেতেন সেই ফেলে আসা হরগাঁ। তাঁর কথা শুনলে মনে হতো এই তো সেদিনই তিনি ঘুরে এলেন তাঁর জন্মভূমি থেকে, পায়ে পায়ে হেঁটে ঘুরে এলেন রাজশাহি শহর আর তাঁর সাধের হরগাঁ। দেখে এলেন ছেড়ে আসা সেই বাড়ি, সেই আমগাছ, সেই পদ্মার পাড় আর সেই ভোলানাথ ইস্কুল। এখন দুঃখ হয় ভেবে, সময় থাকতে তাঁদের স্মৃতির টুকরো টুকরো ছবিগুলো কেন যে লিপিবদ্ধ করে রাখিনি কোথাও। বাস্তবে হরগাঁকে দেখার ইচ্ছে আমার হয়নি কোনদিনও। আমি জানিও না সেই গ্রাম এখনো আর আছে কি না, জানার কোনো অভিপ্রায়ও আমার নেই। হরগাঁর অস্তিত্ব থেকে যাবে কেবলমাত্র শুধু আমার কল্পনায়।