দোঁহা

কার্তিকপূজা: বঙ্গদেশে উৎপত্তি ও রূপান্তর

 

অভিষেক চট্টোপাধ্যায়

 ষোড়শ শতকের প্রথমদিকের ঘটনা, বাণিজ্য বিপুলা সরস্বতী নদীর তখন পড়তি অবস্থা। স্রোতের পরিবর্তনে বণিকদের ত্রাহি ত্রাহি রব। নাব্যতা কমতে কমতে একেবারে তলানিতে ঠেকেছে আর তার অবশ্যাম্ভাবী ফল হিসেবে ভেঙে পড়ছে সরস্বতী নদীকেন্দ্রিক ব্যবসা বাণিজ্যের আতুরঘর সপ্তগ্রাম বন্দর। দীপ্তিহীন সরস্বতীর স্থান প্রতিস্থাপিত করতে ধীরে ধীরে সমৃদ্ধ হয়ে উঠছে হুগলী নদীবন্দর। মোগলদের হাতে বলাগড় অঞ্চলে গড়ে উঠছে নতুন বন্দর -পর্তুগীজদের নামকরণ “ব্যান্ডেল"! কিন্তু ব্যবসা বাণিজ্য চালু হলেই তো আর হবেনা, বণিকদের সুযোগ-সুবিধা, আর খরিদারির বন্দোবস্তও তো থাকতে হবে, সেই মুহূর্তে ধীরেধীরে গড়ে উঠল “শাহ আজিমগঞ্জ"-আজকের সাহাগঞ্জ!

এই ঘটনার পর প্রায় পঞ্চাশ বছর অতিক্রান্ত। সন ১৬৭৩, দিল্লীর মসনদে তখন শাহেনশাহ বাদশাহ আলমগীর ঔরঙ্গজেব। রাজা রামেশ্বর রায়ের প্রাপ্ত বিস্তীর্ণ জমির উপর গড়ে উঠল বংশবাটি বা আজকের বাঁশবেড়িয়া। আর শুরু হল কার্তিকের আরাধনা। সংলগ্ন অঞ্চল চুঁচুড়ায় কার্তিক পুজোর প্রচলন ছিল সম্ভবত আগেই।

    এই অবধি পড়ে মনে হতেই পারে বাঁশবেড়িয়ার জন্ম ইতিহাস নিয়েই কী এই প্রবন্ধের অবতারণা? না, বাঁশবেড়িয়ার জন্ম ইতিহাস নয়, বরং প্রসঙ্গের অবতারণা সম্পূর্ণ অন্য একটি কারণে, তা হল স্কন্দদেব তথা দেবসেনাপতি কার্তিকেয়র হুগলী জেলায় পুজোর ইতিহাস অনুসন্ধান।

    ভারতীয় ঈশ্বর সাধনার প্রাথমিক দেবদেবীদের কল্পনায় কার্তিকের স্থান কোনোদিনই প্রথম বর্গভূত নয়। বরং পঞ্চ উপাসনার অন্তর্ভুক্ত সূর্য, শক্তি, শিব, বিষ্ণু বা গণপতির বাইরে তার স্থান। কিন্তু যদি উৎপত্তির কথা বিবেচনা করা হয় বিপত্তি সেখানেও কম নয় নেহাত। বিভিন্ন জনসমাজে তার উৎপত্তি এবং নামের অজস্র পার্থক্য। কোথাও স্কন্দ, কোথাও মুরুগণ আবার কোথাও বা বিশাখ, ষড়ানন, মহাসেন। কিন্তু নাম পার্থক্য বা উৎপত্তি বিষয়ে যতই থাকুক বিভিন্ন মতামত, একটা বিষয় প্রশ্নাতীত, তা হল প্রাচীনত্ত্ব। একদিকে দক্ষিণ ভারতীয় সংস্কৃতির মুরুগণের সাথে সাজুয্য আবার অপরদিকে অদুম্বরা জনগোষ্ঠীর মুদ্রায় কার্তিকেয়র যোদ্ধা মূর্তি, কুষাণ রাজ হুবিস্কের মুদ্রা কিংবা পাঞ্জাব অঞ্চলের অনার্য্য জনগোষ্ঠী যৌধেয়দের মুদ্রায় ষড়ানন কার্তিকের মূর্তি নিঃসন্দেহে প্রাচীনত্বের এবং অনার্য্য যোগের  প্রমাণ বহন করে। আবার হরপ্পা-মহেঞ্জোদারো থেকে প্রাপ্ত বেশ কিছু ফলকেও যোদ্ধা নরমূর্তিকে কার্তিকেয় বলে ধারণা করেছেন ঐতিহাসিকরা। কিন্তু সবথেকে মজার বিষয় হল গ্রিক বীর আলেক্সান্ডারের নামের সাথেও স্কন্দ শব্দের উচ্চারণগত মিল খুঁজে পেয়েছেন ভাষা তাত্ত্বিকরা! যদিও এর বহু পূর্বেই উপনিষদ বর্ণনা করেছে স্কন্দ ও ব্রহ্মাপুত্র সনৎ কুমার এক ও অভিন্ন, তাহলে আলেক্সান্ডারের সাথে মিলের প্রশ্ন আসছে কেন?

 

এহেন স্কন্দদেবের ধারণার সাথে কিন্তু বাংলায় পূজিত কার্তিকের যথেষ্ট পার্থক্যও বর্তমান। বৈদিক রচনায় দেবসেনাপতি মোটেও মা দুর্গার সন্তান হিসেবে পরিচিত নন। বরং শিবপুত্র কার্তিকের প্রথম আবির্ভাব ঘটেছিলো পৌরাণিক সময়ে অর্থাৎ বৈদিক যুগের শেষদিকে। যেখানে কার্তিকের পিতা মাতা হিসেবে ব্রহ্মা, মহেশ্বর অর্থাৎ শিব, অগ্নি এবং উমার উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়। আর বৈদিকযুগের কার্তিকের স্থান যোদ্ধা, অস্ত্রধারী, আয়ুধজীবিদের উপাস্য হিসেবে।  পুরাণে শিবপুত্র হিসেবে কার্তিকের উল্লেখ এবং তার জন্মকথা বিস্তারিত বিবৃত হয় মৎসপুরাণে। যেখানে উল্লেখ করা হয়েছে শিব বীর্য থেকে কার্তিকের জন্মকথা। কৌতূহল উদ্রেককারী সে কাহিনি অনুসারে দেবী উমা সেই শিব বীর্যের তেজ সহ্য করতে না পেরে তা নিঃক্ষেপ করেন গঙ্গায়, আর দেবী গঙ্গা সেই বীর্য রেখে আসেন হিমালয়ের শরবনে। সেখানেই জন্ম কার্তিকের। ছয় কৃত্তিকার যত্নে লালিত ষড়ানন কার্তিক। জন্মের ষষ্ঠ দিবসে দেবসেনাকে বিবাহ করে দেবগনের প্রদত্ত আয়ুধে সুসজ্জিত কার্তিক নিধন করেন তারকাসুরকে। আর তখন থেকেই তিঁনি দেবসেনাপতি!

    কার্তিকের জন্ম এবং পূজা সংক্রান্ত আরো বহু তথ্যাবলী সংগৃহিত হলেও বহুক্ষেত্রে সেগুলি পরস্পর বিরোধী। তার বেশ কিছুকে আর্য -অনার্য্য সাংঘাত এবং অনার্য্য দেবদেবীর আর্য্য সংস্কৃতিতে উত্তরণের কাহিনি বলে মনে করা যেতে পারে। যেমন একটি মতানুসারে স্কন্দের উদ্ভব দেব-বিরোধিতায়। কিন্তু তার নিধনের জন্য নিযুক্ত মাতৃকাগণের দ্বারা মৃত্যু প্রদানের পরিবর্তে দেবশিশু লাভ করে পরম মমতা, আর দেবরাজ ইন্দ্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইন্দ্রের বজ্রঘাতে বিদীর্ণ দক্ষিণদিকের পাঁজর থেকেই উৎপত্তি কার্তিকের আর  নানা সাংঘাতের মধ্যে দেবকূলে অন্তর্ভুক্তি। এক্ষেত্রে একটা বিষয় পরিষ্কার বোঝা যায়, স্কন্দদেব, যিনি প্রধানত অনার্য্যদের দ্বারা পূজিত, তিঁনি স্থান পাচ্ছেন দেবকূলে, কিন্তু ভিন্ননামে, পূর্বনামের ধ্বংসসাধনের মাধ্যমে। অর্থাৎ নিঃসন্দেহে এর থেকে অনার্য্য দেবদেবীর ক্রমশ যে আর্য্য সংস্কৃতিতে আত্মিকরণ ঘটছে তা পরিস্কার।

    আবার ঐতিহাসিকভাবেও কার্তিক পূজার প্রচলনের কথা জানা যায় পঞ্চম শতকেও রাজা স্কন্দগুপ্তের সময়কালে। গুপ্তযুগের স্বর্ণমুদ্রাতেও ময়ূরবাহন কার্তিকের উপস্থিতি উজ্জ্বল। শোনা যায় বৃত্রাসুর বিজয়ী কার্তিকের পুজো করেই পরাক্রমী হুনদের প্রতিরোধ করতে সক্ষম হন রাজা স্কন্দগুপ্ত।

   কিন্তু বাংলাদেশে পৌঁছে কার্তিকের রূপের পরিবর্তন ঘটে আকাশপাতাল। এ জেলায় কার্তিক পূজার যে চল গড়ে উঠল, তার উৎপত্তি কোথায় -বাঁশবেড়িয়া নাকী চুঁচুড়া সে প্রশ্নে না গিয়েও একটা কথা পরিষ্কার বলা যায় পৌরাণিক স্কন্দ বা ষড়াননের যে চিত্র বা ধারণা পাওয়া যায় তার থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। এক্ষেত্রে যে ধারাটি গড়ে ওঠে তা নেহাতই লৌকিক ধারণায় পুষ্ট সে কথা বললেও অত্যুক্তি হয়না। চুঁচুড়ার দক্ষিনে চন্দননগর সীমানা থেকে উত্তরে বাঁশবেড়িয়া পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চল এই পূজার জন্য বিখ্যাত। বিখ্যাত জেলা বিশেষজ্ঞ ডঃ নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচাৰ্য মহাশয় উল্লেখ করেছেন কার্তিক যেহেতু সন্তান উৎপাদনের সাথে ক্ষীণভাবে হলেও সম্পর্কযুক্ত, তাই এটিও বঙ্গদেশে পূজার প্রচলনের একটি কারণ হতে পারে।

   চুঁচুড়ার বিখ্যাত সোমবংশে ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ কার্তিক পূজার প্রচলন হলেও, চুঁচুড়ার বারাঙ্গনা সমাজে এই পূজার প্রচলন সম্ভবত ভ্রুনমোচনকারী দেবতা হিসেবে। আবার ভিন্নমতে একথাও স্বীকার করতেই হয় সেখান থেকেই সম্ভবত কার্তিকের রূপ পরিবর্তন! কার্তিকের মত রূপসম্পন্ন ক্রেতা তাদের পছন্দের তালিকায় থাকবে, তা আর অস্বাভাবিক কী! সুতরাং কার্তিকের রূপান্তর ঘটে ‘বাবু কার্তিক' হিসেবে। এই প্রসঙ্গে প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের লেখাটি পড়ে দেখলে দেব কার্তিকের পূজার সাথে শহর কলকাতা বা অন্য শহরের বারাঙ্গনা বা বারনারীর যোগাযোগের কিছুটা ধারণা পাওয়া সম্ভব হয়।

"কার্তিক পুজো ভদ্রলোকের বাড়ি হতো বলে মনে হচ্ছে না।...পুজো করতেন শহরের "মেয়েমানুষে" অর্থাৎ বারবনিতারা, সমাজের এরা বাসবদত্তা, ঊর্বশী, মেনকা, রম্ভা, কার্তিককে তাঁরা গড়তেন নিজেদের আদর্শ বাঙালি বাবু করে। গোলগাল নাদুস-নুদুস মানুষটি, গোঁপ পাকিয়ে তোলা। খালি গা, কোঁচানো চাদর পাকিয়ে গলায় দেওয়া, ব্রাহ্মণের উপবীত আছে। কোঁচানো ধুতি পায়ে কালো পাম্পসু। চড়েছেন ময়ূরে, হাতে আছে ধনুক বাণ। এই অপরূপ বীরের পুজো করতেন বাসবদত্তারা যৌথভাবে, বিসর্জনের সময় তাঁরা যেতেন প্রতিমার সঙ্গে সঙ্গে।"

কার্তিক পুজোর সূচনা নিয়ে বিশিষ্ট সমাজ গবেষক শ্রী শঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য ভিন্নমত পোষণ করেন। তাঁর মতে কার্তিকপুজোর প্রচলন বঙ্গদেশে হয় দক্ষিণ ভারতের তামিল দেশ থেকে। ঘটনাক্রমে রাজা রাজেন্দ্র চোল ছিলেন শিবপুত্র স্কন্দের পরমভক্ত এবং রাজেন্দ্র চোলের অনুগামী। বণিকদের দ্বারাই বঙ্গদেশের  হুগলী জেলায় চুঁচুড়া ও বাঁশবেড়িয়া অঞ্চলে প্রথম কার্তিক পূজার উৎপত্তি। যদিও বিভিন্ন ঐতিহাসিক এই মতের বিপরীত মতের উত্থাপন করে বলেন রাজেন্দ্র চোলের অভিযানের সরাসরি প্রভাব বঙ্গদেশে পড়েনি, তথাপি এই মত পুরোপুরি ফেলে দেওয়া সম্ভব নয় কারণ এই অভিযানের সূত্রেই সেন বংশের প্রতিষ্ঠাতাগণের পূর্বপুরুষরা এই দেশে আসেন এবং শৈব সাংস্কৃতির সূচনাও হয়।


 যাইহোক, যে সময় চুঁচুড়া অঞ্চলে এই পুজোর প্রচলন হয়, সেই সময় এই অঞ্চল ছিল মিশ্র সাংস্কৃতিক আখড়া। আর তার সাথে ছিল ওলন্দাজ বণিকদের রমরমা। শুধু বাঙালী বাবুরাই নয়, বিদেশী বাবুরাও তাদের দেশি বিবিদের সন্তুষ্ট রাখতে আকচা আকচিতে কম যেতেননা। এই প্রতিযোগিতা, আড়ম্বর দেখানোর একটা জায়গা অচিরেই হয়ে ওঠে কার্তিক পুজো। বিভিন্ন প্রকার কার্তিকের মধ্যে বাবু কার্তিকের উৎপত্তির কথা আগেই বলা হয়েছে, আর ছিল‘ লড়াই কার্তিক' আর রাজা কার্তিক। রাজা কার্তিকের পোষাক -বাদশাহী চোগা -চাপকান, রঙ্গীন ঝলমলে আংরাখা, নাগরা জুতো সেই আমলের ইউরোপীয় পোষাকরীতির অনুকরণ বলেই ধারণা করা যায়। আর বাবু কার্তিক নিপাট বাঙালী বাবু কালচারের অনুকরণ-অবশ্যই নবীনতর।

চুঁচুড়ার প্রথম বারোয়ারি পুজোর শুরু হয় মাধবীতলার কাছে গোলাবাগানে। প্রায় আড়াইশো বছরের পুরোনো এই পুজোয় দেবসেনাপতি যুদ্ধসাজে সজ্জিত। বারোয়ারি পূজার বিসর্জন উপলক্ষে ছিল সং এর ব্যবহার। পরবর্তীকালে এই প্রথা কলকাতায় চালু হয়। এই প্রসঙ্গে একটি গানের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।

”জুটে বার-ভূতে বারোয়ারি ঠাকুর তুলেছে
গাঁয়ে প্রচন্ড এক লন্ড-ভন্ড, দোর্দন্ড কাণ্ড বাঁধিয়েছে!
দুপুরে মাতনের মতন গুন্ডা সব মেতে উঠেছে!
ছ্যাঁচারাম বোঁচার সনে, ছি ছি দাস ধিক জীবুনে,
ষন্ডামার্কা মন্ডামারা পান্ডা সেজেছে!..."

সং অর্থে মজাদার সাজ সজ্জায় সকলকে আনন্দিত করার যে প্রচেষ্টা শুরু হয় চুঁচুড়ায় কার্তিকপুজো উপলক্ষে তাই পরে গিয়ে পৌছয় কলকাতায়। বারোয়ারি পুজোর প্রচলনও সম্ভবত গুপ্তিপাড়ার পরে এখানেই চালু হয় এবং ক্রমে কার্তিক পুজো উপলক্ষে এই পুজোগুলি জাঁকজমকে সবকিছু ছাড়িয়ে যায়। হুতোম প্যাঁচার নকশায় কালীপ্রসন্ন সিংহের লেখায় সেই প্রমাণই পাওয়া যায় -“পূর্বে চুঁচুড়ার মত বারোয়ারি পুজো আর কোথাও হত না।”
             পৌরাণিক স্কন্দ বা  কার্তিকেয় মহাসমারোহের সাথে আজও পূজিত হয়ে চলেছে হুগলীর এই প্রাচীন শহরে। দেবসেনাপতি কার্তিকের  উৎপত্তির বিষয়ে নানা মতভেদ থাকলেও লৌকিক আচারে বাংলার ঘরের দেবতা, প্রাণের উৎসবে পরিণত হয়ে যে জেলার অন্যতম প্রধান উৎসবে পরিণত হয়েছে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই।

তথ্যসূত্র :

১. হুগলী চুঁচুড়ার নানা কথা -অক্ষয়কুমার আঢ্য -রেডিয়ান্স
২. প্রসঙ্গ হুগলী চুঁচুড়া -সম্পাদনা শ্যামল কুমার সিংহ
৩. হুগলী জেলার দেব দেউল -সুধীর কুমার মিত্র
৪. হুগলী জেলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ -সুধীর কুমার মিত্র -দে'জ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন