![]() |
প্রচ্ছদ পরিকল্পনা: শর্মিলী মোস্তফী |
আরাত্রিকা ভট্টাচার্য
"ভগবান নিদ্রা গিয়েছেন গোলযোগ সইতে পারেন না”।
মঞ্চগানের ভক্তদের মুখে মুখে এই গান এক সময় শোরগোল ফেলে দিয়েছিল! না, মনোজ মিত্র নিয়ে আজ আলোচনা নয়! তবে আলোচনা শুরু করা যেতে পারে ভগবানের চিরনিদ্রা দিয়ে। বুঝলেন না? আরে বাবা! নীৎশের সেই বিখ্যাত ঘোষণা - “গড ইজ ডেড”! তা, ঈশ্বর মৃত যখন, এক অতিমানবের আগমন যে অবশ্যম্ভাবী! নইলে, তৎকালীন ইউরোপীয় নবজাগরণ পরবর্তী মানুষের নৈতিক মূল্য ব্যবস্থার দায়িত্ব নেবে কে? বৈজ্ঞানিক যৌক্তিকতার জেরে সেই মানুষজনের যে ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাসের মৃত্যু হয়েছে! নীৎশের অতিমানবই যে জন্ম দিতে পারে এক নবতর নৈতিকতা!
কিছুদিন আগেই পড়া শেষ করলাম জার্মান দার্শনিক, চিন্তাবিদ, কবি ও ভাষাতত্ত্ববিদ ফ্রেডরিক নীৎশের বাইবেলিও রচনভঙ্গিমায় লেখা জনপ্রিয় বই - Also Sprach Zarathustra: Ein Buch für Alle und Keinen- এর ইংরাজি অনুবাদ, “Thus Spoke Zarathustra- A Book for All and None”। ১৮৮৩ থেকে ১৮৮৫ সালের মধ্যে মূলত জার্মান ভাষায় লেখা বিখ্যাত এই দার্শনিক উপন্যাস যেন এক গদ্য-কবিতা; নীৎশের নিজের ভাষায় “symphony (ঐকতান)”; সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম ও ইউরোপীয় চিন্তাধারার সাহিত্যে এক অনন্য বিবৃতি! প্রাচীন পারস্যে অগ্নিউপাসক ধর্মপ্রবক্তা জরাথ্রুষ্টকেই নীৎশে বেছে নিয়েছেন তার কল্পকাহিনীর নায়ক হিসেবে; তার বয়ানেই দর্শন নৈতিকতা সম্বন্ধে বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন তিনি। তিনিই দশ বছর পাহাড়ের চূড়ায় একলা থেকে, একদিন মানবসমাজে নেমে এলেন জানাতে — ঈশ্বর মৃত। মানবজাতির লক্ষ হওয়া উচিত নিজেদের ভেঙে নিজের থেকেও এক নতুন উর্ধ্বস্থ জাতি নির্মাণ করা! সেই অতিমানবই ঈশ্বরের উত্তরসূরী!
মনে করি, ওঁনার লেখা সব বইয়ের মধ্যে এই বইটিই কেতাবি পণ্ডিত জগতের বাইরের মানুষও এত বেশি পড়েছেন! এই বইয়ের সাহিত্যিক, সাংগীতিক, স্মরণিক, রাজনৈতিক, দার্শনিক ও চলচ্চিত্র-শৈল্পিক প্রভাব যে সংস্কৃতির নানান দিকে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত! তবে যদি ভাবেন, অন্যান্য গল্পের বইয়ের মতন রাত জেগে নেশার ঘোরে পড়ে শেষ করে ফেলতে পারবেন এই তীব্র অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ দার্শনিক কল্পকাহিনী, তাহলে ভুল ভাবছেন! খটকা লাগবে, গুলিয়ে যাবে, বিরতি নেবেন, ভাববেন, জল খাবেন, আবার পড়বেন; অনুধাবন প্রক্রিয়ায় আবার সব গুলিয়ে যাবে! চারটে পর্বে বিভক্ত এই বই যেন বিনি সুতোয় গাঁথা এক এলোমেলো বিশ্বাসের মালা; তবে এই অসমতার মধ্যেও কোথাও যেন একটা যৌক্তিক ক্রম খুঁজে পাবেন! নীৎশের কাল্পনিক জরাথ্রুষ্টর বক্তব্য বুঝতে সময় লাগবে; সেই বক্তব্যেই যে মিশে আছে নীৎশের ব্যক্তিগত বিশ্বাস এবং মূল্যবোধ! Thus Spoke Zarathustra- A Book for All and None” যেন সেই নৈতিক সংকট কালে নিৎসের ব্যক্তিগত সাড়া; সেই হাহাকারে এই গ্রন্থ দিয়েই যেন তিনি সৃষ্টি করেছিলেন নিজস্ব পবিত্র (বা, অপবিত্র) পাঠ্য! এই গ্রন্থে জরাথ্রুষ্টকে দিয়ে নীৎশে দিয়েছেন 'Ubermensch' (overman) বা অতিমানবের ধারনা যা মানুষকে অতিক্রম করে যাবে! মানবসভ্যতা যে একটি যাত্রাপথ- পশু থেকে অতিমানব হবার সেতু মাত্র; চলমান! নিরবিচ্ছিন্ন মানব বিবর্তনের পরের ধাপ এই সুপারহিউম্যান 'Ubermensch'! “কিন্তু মানব থেকে অতিমানব হবার জন্য তুমি কি করছ?” জরাথ্রুষ্ট বললেন, “আমি তোমাদের অতিমানবতা শেখাচ্ছি”!
নীৎশে মনে করেন স্বর্গ এক অবাস্তব জগত! উনি অস্তিত্ববাদে বিশ্বাসী! ঐশ্বরিক ক্ষমতা মানুষের মধ্যেই বর্তমান, তাকে উত্তরণের ধীর-দুর্গম পথে যাত্রা করতে হবে, নিজেকে তৈরি করে নিতে হবে সেই যাত্রাপথ। নিজেকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করতে হবে, কষ্টসাধ্য শিখতে হবে, পরিত্যাগ করতে হবে জাগতিক সুখ-স্বস্তি, নিতে হবে জীবনের ঝুঁকি, হতে হবে সহনশীল, থাকতে হবে দায়ের ভার বইবার শক্তি। তাকে হতে হবে বীর, সাহসী যোদ্ধা, থাকতে হবে শিশুসুলভ বিস্মৃতি, শিশুর সারল্যও! “জীর্ণ পুরাতন যাক ভেসে যাক” বলে ভাঙনের জয়গান গাইতে গাইতে তাকে দুর্দাড় বেগে ধাইতে হবে, উঠতে হবে সেই উচ্চতায় যেখানে সে জীবনের মানে খুঁজে পাবে, পুরনো কে গুঁড়িয়ে দিয়ে সৃষ্টি হবে নবতর নৈতিকতা, যেখানে সে একা; অতিমানব! ঈশ্বরের অবর্তমানে সেই হবে মানুষের সহায়! মানব বিবর্তনের সামগ্রিক স্বার্থে তাকে এই ত্যাগ স্বীকার করতেই হবে। সে যে মানবকূলের কাছে ঈশ্বরের উত্তরসূরী!
মাস খানেক আগে অবধিও নিজের জীবনে একটা টালমাটাল সময় অতিক্রম করছিলাম। রোজই ঘুম থেকে উঠে মনে হ’ত, একটু একটু করে তলিয়ে যাচ্ছি! ঠিক সেই সময়েই এক বন্ধু এই বই হাতে তুলে দিয়ে বলেছিল, মন দিয়ে পড়, একটা Pedestal-এর হদিশ পাবি! ওখানে উঠে দাঁড়িয়ে দুনিয়াটাকে ঝুঁকে দেখ, জানাস কেমন লাগছে, এই রোজকার জাগতিক দুঃখ তুচ্ছ মনে হবে! ওখান থেকে তোর আশীর্বাদ ছুড়ে দিস বরং, আমাদের ওপর বর্ষিত হবে! তবে মনে রাখিস, ওখানে তুই নিজে আশীর্বাদ পাবিনা বিশেষ! দুঃখ কিসের ? আশীর্বাদ তো মানুষের লাগে! ভয় পাস না, আমিও যদি পারি, আমাদের পাহাড়েই দেখা হবে!
হে পাঠক, সময় করে পড়বেন, এ এক যুগান্তকারী বই বলে নয়! ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি, এ বই জীবনের বই; জীবনমুখী করে তোলার বই! গেয়ে-নেচে, আবেগে ভালবেসে, মুক্তির পথে বিপজ্জনক ভাবে বাঁচতে শেখার বই! — এই বই তীব্র জীবনশক্তি দিয়ে জীবন জোয়ারে ভেসে গিয়ে জীবনের মানে খুঁজে নেওয়ার হদিস দেয় ! পুণ্যে পূর্ণ জীবন চাইলে, ধর্মান্ধ না হয়ে, নিজের পায়ে হেঁটে এক ঊর্ধ্বগামী রাস্তা তৈরি করতে শেখায়! উত্তরণের পথ নিজের পা দিয়েই তৈরি করা যায়, স্তম্ভমূলে পৌঁছনো যায়, মানুষই তা পারে, এই দৃঢ় বিশ্বাস জাগায়!
...অনেকদিন হ'লো, আর নিচ থেকে কেউ পা টেনে ধরে না! পাহাড়ে উঠছি…
বইয়ের নামঃ 'Thus Spoke Zarathustra: A Book for All and None'.
লেখকঃ Friedrich Nietzsche
অনুবাদকঃ Thomas Common
প্রকাশকঃ FiNGERPRINT! CLASS!CS
ISBN: 978-93-8881-096-8
Tomar sokol maddhome onayas bichoron sudhu mugdhotai ene dei❤️
উত্তরমুছুন