স্থবির দাশগুপ্ত
না-মালুম থেকে বে-মালুম
মনে হয়, খুব একটা ভুল হবে না যদি বলি, স্বাধীনতার লাগি, কেবল স্বাধীনতার জন্যই আমাদের ‘প্রাণ করে হায় হায়’। সে এমন এক স্বাধীনতা যেখানে আমার জীবনের অযুত সম্ভাবনার বিকাশ ঘটতে পারে, যেখানে আমার যা কিছু প্রিয়, যা কিছু কাঙ্ক্ষিত, তার স্বাদ নিতে পারব। আলোয় আলোয় আমার মুক্তি ঘটবে, মহামুক্তির দুয়ার খুলে যাবে।
যে-শাসন আমার ইচ্ছাকে মর্যাদা দেয় না, যে-শাসনে আমার স্থান থাকে শাসকের নিচে, আমি কারোর না-কারোর অধস্তন হয়ে থাকি, তা পরাধীনতা। পরাধীনতা মানে, প্রতিটি দিন প্রতি মুহূর্তে দগ্ধ হয়ে যাওয়া, প্রতিটি দিনের আর্তনাদ। পরাধীনতা মানে, প্রতিটি ব্যর্থ কবির, ব্যর্থ প্রেমিকের অশ্রুসিক্ত দীর্ঘশ্বাস, প্রতিটি ব্যর্থ গায়কের বে-মালুম বিপথগামী সুর, প্রতিটি শিল্পীর না-আঁকা, শ্রেষ্ঠ ছবি। এক দিগন্তবিস্তৃত হাহাকারের নাম, পরাধীনতা। তার সম্পূর্ণ বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকে স্বাধীনতা, সে এক মহামুক্তি। অপরের উচ্ছিষ্ট হয়ে বেঁচে থাকার অপমান থেকে, এমনকি, প্রতিদিন মুচলেখা দিয়ে উৎপাদন, শুধু বেঁচে থাকার রসদ সংগ্রহ করার দায় থেকেও মুক্তি। অমন স্বাধীনতা আমরা পাইনি, তত্ত্বগত আর ব্যবহারিক কোনও অর্থেই তা পাই না। আমরা পরাধীন।
স্বাধীনতার ফিরিস্তি বড্ড লম্বাই হল। তাই তত্ত্বের কথা না-হয় থাক, শুধু সর্বজনগ্রাহ্য ব্যবহারিক কথায় আসা যাক। সেদিক থেকে ভাবতে গেলে ‘না-মালুম’ কথাটা খুব প্রাসঙ্গিক, সেই সূত্রে ‘বে-মালুম’ কথাটাও। যেমন ধরা যাক, ১৭৫৭ – ‘পোহালে শর্বরী’, আমরা ব্রিটিশের উপনিবেশ বনে গেলাম, না-মালুম থেকে বে-মালুম। মালুম হল ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের পরে (ইং ১৭৭০)। মারা গিয়েছিল প্রায় ৭০ লক্ষ থেকে এক কোটি বাঙালি। আজকাল অবশ্য বলা হয়, অতটা না তবে ১০ থেকে ২০ লক্ষ হবেই। তখন থেকে আমরা উপনিবেশের জীব, ব্রিটিশের উপনিবেশ। রবীন্দ্রনাথ বলতেন, ‘সাতশ’ বছরের বিদেশী শাসন’; কিন্তু কারা যে বিদেশী তা বোঝা মুশকিল, কেননা তিনিই আবার বললেন, শক থেকে মুঘল সক্কলে ‘এক দেহে হল লীন’। তাই সেই তর্কে আপাতত না-ঢোকাই ভাল।
উপ-তে উপনীত
তার চেয়ে ভাল, উপনিবেশ চর্চায় মনোযোগ দেওয়া। উপ নিবাস থেকে উপ নিবেশ। উপপত্নী, উপজাতি শব্দগুলো খুব সম্মানার্থে ব্যবহার করা হয় না, হয় ছোট অথবা হীন অর্থে। ব্রিটিশ আমাদের হীন অর্থেই দেখেছে, বুঝেছে। উপপত্নী যেমন পত্নীর মর্যাদা পায় না, তেমনি উপ নিবাসও নিবাসের সমান না। তাই এই দেশ তাদের দেশ না। অবশ্য প্রখ্যাত, নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ স্যার জন রিচার্ডস হিক্স তাঁর ‘এ থিয়োরি অফ ইকনমিক হিস্ট্রি’ বইতে (১৯৬৯) জানিয়েছিলেন, উপনিবেশ বা কলোনি দুই প্রকার, ‘সেটলার’ ও ‘ট্রেড’। অর্থাৎ কখনও কখনও উপনিবেশও নিবাস হয়ে যায়, আবার কখনও তা শুধু রয়ে যায় বাণিজ্যের আধার হয়ে। দুটোরই দৃষ্টান্ত আছে; আমাদের দেশ হয়ে গেল একটা লুঠযোগ্য, হাটুরে উপনিবেশ মাত্র।
অনেকে তাতে ক্ষুব্ধ হয়েছেন, বিশেষ করে আমাদের বাংলার কৃষক সমাজ, যাঁরা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন, কত ধানে কত তুষ। আবার অনেকের কাছে উপনিবেশ তেমন খারাপ কিছু ছিল না, আজও নেই। তাদেরকে যদি বলা হয়, উপনিবেশ তৈরি করে ব্রিটিশ আমাদের কী দিয়েছে, তাহলে তাদের আহ্লাদ দেখবার মতো-কেন, রেলগাড়ি দিয়েছে না! দূর যে অমন নিকট বন্ধু হয়ে যাবে, আমরা কি ভাবতে পেরেছিলাম? কথাটা মিথ্যে না, ব্রিটিশ আমাদের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় দিয়েছে, এশিয়াটিক সোসাইটি দিয়েছে, ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম দিয়েছে, প্রেসিডেন্সি কলেজ দিয়েছে…আর কত দেবে! আর দিয়েছে ‘ডিসিপ্লিন’। তার কাছে বাস্তবিক, আমাদের অশেষ ঋণ। মিথ্যে না, উপনিবেশ আমাদের দিয়েছে এক বিরাট, বিশাল, অতি উৎকৃষ্ট সাহিত্য সম্ভার। তার রসে আমরা আজও অবগাহন করি, বিনিদ্র রজনী কেটে যায়!
কিন্তু যদি বলি, আর কী দিয়েছে? তাহলে বলতেই হবে, উপনিবেশ আমাদের দিয়েছে এক ঔপনিবেশিক মন, এক ছলনাময়ী দৃষ্টিভঙ্গি। এমন সে মন আর দৃষ্টিভঙ্গি যা আজও আমাদের ‘শিক্ষিত’, পরিশীলিত মস্তিষ্কের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যেন স্থায়ী হয়ে আছে। তা থেকে যেন আমাদের মুক্তি নেই; আসলে উপিনিবেশ আমাদের এক পরাধীন সত্তা দিয়েছে। তাই আমরা দেশভাগের যুক্তি বুঝি না, শুধু দোষী কে আর কতটা তার হিসেব করি, নিক্তি মেপে –মুসলমান কতটা, হিন্দুই বা কতটা। উপনিবেশ আমাদের এই হিসেব শিখিয়েছে। আর ব্রিটিশ উপনিবেশবাদী কখনও এর পিঠ চাপড়েছে, কখনও ওর। এজন্যেই বুঝি কবি ইকবাল লিখেছিলেন, হে ভগবান, তুমি একবার আমাদের দয়া কর, আরেকবার ওদের…তুমি তো দেখছি, বহুগামী! কথাটা ছিল ‘হরজায়ী’, মানে সর্বগামী; তবে বহুগামী বললে জমে ভাল!
ব্রিটিশ আমাদের সাম্প্রদায়িকতা দিয়েছে। তার আগে, বহু আগে থেকেই সম্প্রদায় ছিল, তাদের মধ্যে বিরোধাভাসও ছিল, যেমন থাকবার কথা, কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা? ছিল না। প্রমাণ? ওয়ারেন হেস্টিংস-এর আমলের প্রখ্যাত ঐতিহাসিক সৈয়দ গোলাম হুসেন তাবাতাবাই-এর লেখা ‘সিয়ার-উল-মুতাক্ষারিন’ গ্রন্থটির অন্তত প্রথম খণ্ডই তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। পৌরাণিক যুগ থেকে আওরংজেব-এর আমল পর্যন্ত ভারতের ইতিহাস এখানে বিধৃত। তবে সেই ইতিহাস আমরা ভুলেছি, এই গ্রন্থও দুর্লভ। আমাদের বিস্মৃতির এই অভ্যাসও উপনিবেশের অবদান। কিন্তু এই অভ্যাস ভয়ঙ্কর। দুশো বছরের ব্রিটিশ শাসন এমন একটা দশকও যায়নি যখন ভারতের কোনও না-কোনও অঞ্চলে ছোট বা বড় দুর্ভিক্ষ হয়নি; তারা শুরু করেছিল ছিয়াত্তরের মন্বন্তর দিয়ে, শেষ করেছে তেতাল্লিশের মন্বন্তরে, সে আর এক বিভীষিকা। ভুললাম কীকরে?
ঔপনিবেশিকতা আর উপ-মন
অর্থাৎ আমরা এখনও বে-মালুম, ঔপনিবেশিক মন নিয়ে দিনাতিপাত করি। কোনও কিছুতেই আমাদের স্পষ্টতা নেই। আমরা অনবরত শত্রু খুঁজে বেড়াই, চিনতে পারি না। উপনিবেশবাদ যাকে শত্রু বলে দেখায় তাকেই আমরা শত্রু বলে প্রতিপন্ন করি। উপ-মন নিজের মতো করে ভাবতে পারে না। চাপে পড়ে, চক্ষুলজ্জায় আমরা বলি, ঔপনিবেশিক শাসন নিন্দনীয়। কিন্তু নিজেরাই যদি নিজেদের শাসন করি তা তো নিন্দনীয় না। তার মানে, ঠিক শাসন না, যা নিন্দনীয় তা হল, ঔপনিবেশিক শোষণ। কিন্তু শোষণ তো উপনিবেশের আগেও ছিল। সেও নিশ্চয়ই নিন্দনীয়ই ছিল। ঠিক যেমন নরনারীর যৌন সঙ্গম নিন্দনীয় না, কিন্তু বলাৎকার নিন্দনীয়। সব বলাৎকারই নিন্দনীয়। আমরা কিন্তু তা বললাম না, বললাম, মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গনারীর উপর পাকিস্তানী সৈন্যদের বলাৎকার নিন্দনীয়! যেন তার আগে বা পরে সেখানে অমন ঘটনা ঘটেইনি।
এই যে ভাবের ঘরে চুরি, এটা ঔপনিবেশিকতার দান। অমন চুরি থাকলে আমরা স্বাধীনতা কাকে বলে, বুঝব কীকরে? না-বুঝেই আমরা এখন ‘পোস্ট কলোনিয়ালিজম’ চর্চা করি, উত্তর উপনিবেশ, মানে উপনিবেশের পরে কী দাঁড়াল? কী দাঁড়াবার কথা ছিল? ‘উপ’ ছেঁটে দিয়ে শুধু নিবাস থাকবার কথা ছিল, পরাধীনতার পরে তো স্বাধীনতাই হবে। অথচ তা তো হল না। আমরা উপনিবেশই রয়ে গেলাম, নতুন প্রকরণে। কিন্তু সেকথা স্বীকার করি না, কেননা ‘অ্যান্টি কলোনিয়াল’ না-হয়ে ‘পোস্ট কলোনিয়াল’ হওয়াটা নিরাপদ। ‘ম্যাজিস্ট্রেট’ শব্দটা আজও আমাদের বড় প্রিয়। অথচ এক অর্থে ‘ম্যাজিস্টার’ তো প্রভুই। কী আর করা, সবই বে-মালুম। আরও সরেশ কেউ কেউ বলেন, আমরা নিকৃষ্ট জাতি বলেই দুশো বছর ধরে ইংরেজের অধীনে ছিলাম। তাহলে, ইংরেজরা যে সব মিলিয়ে প্রায় চারশো বছর ধরে রোমানদের অধীনে ছিল, তার বেলা?
নিরুত্তর। এই দ্বিধাকাতর, পরাধীনতার ব্যাধিগ্রস্ত মন নিয়ে আমরা যেমন ১৭৫৭ বুঝিনি, সিরাজের চরিত্র নিয়ে, লাম্পট্য আর নিষ্ঠুরতার নমুনা দেখাতে দেখাতে হায় হায় করে গেছি, তেমনি ১৮৫৭ও বুঝিনি। তাকে ‘মিউটিনি’, বিদ্রোহ বলব, নাকি রেবেল্লিয়ান -- মহাবিদ্রোহ, নাকি ভারতের প্রথম স্বাধীনতার যুদ্ধ, তা আজও ঠাহর করে উঠতে পারিনি। ব্রিটিশ বলেছিল, সে ছিল উত্তর ভারতের তালুকদারদের বিদ্রোহ। কেউ কেউ বলেছিল, স্বাধীনতার যুদ্ধ কোথায়, দক্ষিণ আর পূর্ব ভারত তো এতে যোগই দেয়নি। ঠিক কথা; কিন্তু সক্কলে সমস্বরে না-বললে যে স্বাধীনতা কথাটার ব্যঞ্জনা থাকে না, একথা কে শেখাল? ব্রিটিশই তো। আমাদের ইতিহাসবেত্তারা এইরকম ঠিক শিক্ষা যথাস্থানেই পেয়েছেন। ওদিকে লর্ড ক্যানিং জানাল, উত্তর প্রদেশের প্রতিটি ঘর থেকে অন্তত একজন এই বিদ্রোহে যোগ দিয়েছিল। উল্লেখযোগ্য, তাদের বিপুল অধিকাংশই ছিল বর্ণহিন্দু।
সেই সিপাহীসম্ভার মিরাট থেকে মার্চ করে দিল্লিতে এসে বাহাদুর শাহকে স্বাধীন সম্রাট বানিয়েছিল। স্বাধীনতা, মাত্র চার মাসের জন্য হলেও। সে ছিল এক গৌরবময় ইতিহাস যেখানে হিন্দু মুসলমান ঐক্যবদ্ধ হতে পেরেছিল। কথাটা বলেছিলেন, স্বয়ং স্যার সৈয়দ আহমেদ, যিনি আবার ছিলেন ব্রিটিশদেরই খয়ের খাঁ! কিন্তু মিথ্যের যেমন বৈচিত্র্য থাকে, সত্যেরও তাই। আমাদের দেশের শিল্পীরা, সাহিত্যিকরা অনেকে কিন্তু বলতে পেরেছিলেন, ১৭৫৭ সালে বাংলার স্বাধীনতা নষ্টশক্তির হাতে চলে গেল। অথচ পণ্ডিত ইতিহাসবিদরা এখনও ঢোঁক গেলে। ১৮৫৭ নিয়েও তাদের একই সসেমিরা অবস্থা। কলকাতার হিন্দু পেট্রিয়টের এক হরিশ মুখার্জি তো ব্যতিক্রম মাত্র। ওদিকে তখন ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বিরোধী নেতা বেঞ্জামিন ডিজ্রায়েলি বলছেন, আরে এ তো স্বাধীনতার লড়াই, গণ অভ্যুত্থান, মোটেই নিছক ‘মিউটিনি’ না, দেখতে পাচ্ছ না? দেখতে পেয়েছিলেন একজন, তিনি কার্ল মার্ক্স।
আরও একজন সত্যি কথাটা বলতে পেরেছিলেন। সহজপাচ্য না-হলেও, তিনি বিনায়ক দামোদর সাভারকার। তার বই বেরিয়েছিল ১৯০৯ সালে, মারাঠিতে, পরে ইংরাজিতে, ‘দি ইন্ডিয়ান ওয়ার অফ ইন্ডিপেন্ডেন্স’। এমনকী, আমাদের কমিউনিস্ট নেতারাও তা বোঝেননি। ভারত সরকার ১৮৫৭ উদযাপনের জন্য একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস রচনার ভার দিলেন রমেশচন্দ্র মজুমদারকে। ওই ঘটনাবলীকে স্বাধীনতার যুদ্ধ বলতে অস্বীকার করে তিনি অব্যাহতি নিলেন। ভার পড়ল ঐতিহাসিক সুরেন্দ্রনাথ সেন-এর উপর। ভূমিকা লিখলেন মৌলানা আবুল কালাম আজাদ। কিন্তু বইয়ের নাম কী হবে? শুধু বিদ্রোহ, নাকি কমিউনিস্টরা যেমন চেয়েছিলেন, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মহাবিদ্রোহ? অবশেষে বইয়ের নাম হল, ১৮৫৭। সব দিক রক্ষা পেল, শ্যাম আর কুল দুইই দিক রক্ষার এই শিক্ষা তো ব্রিটিশেরই দান। রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে হয়তো আবার বলতেন, ‘মেয়েটা তো রক্ষে পেল, আমি তথৈবচ’!
তো এসব হল, ইতিহাস দখলের লড়াই। আর দেশ পুনর্দখলের সেই লড়াই পরাজিত হয়েছে। কিন্তু ১৯৪৭ সালে কি আমরা জিতে গেছি? এই প্রশ্ন বড় গোলমেলে। উপনিবেশবাদ তো মনুষ্যত্বকেই নষ্ট করে দেয়, তাই তাকেই পুনরুদ্ধার করার নাম, স্বাধীনতা। তা কি করতে পেরেছি? জেনেশুনেই আমাদের শিক্ষিতজনার মনে বিষ ঢুকিয়ে দিয়েছিল ব্রিটিশ, আমরা কেউ জেনেশুনে আর কেউ বে-মালুম তা পান করে ফেলেছি। এখন কী করা? তাই এই স্বাধীনতা নিয়েও আমাদের ভাবতে হবে। কিন্তু ঔপনিবেশিক মন নিয়ে কি আমরা ভাবতে পারব? স্বাধীনতার আন্দোলন তো জানি। কংগ্রেস ব্রিটিশ-এর বিরোধিতা করেছিল, উপনিবেশের না। তাই আজকের সংকটে আমরা উপনিবেশবাদের দোষ খুঁজি না… যেন, ভাসুরের নাম মুখে নেওয়ার উপায় নেই!
ঘরের ভিতর উপনিবেশ
আজও আমাদের বুদ্ধিজীবীরা নিজেদেরকে নিয়ে কাতরপ্রায়। জহরলাল নেহেরুর ক্ষোভ ছিল, আদিবাসী জনসমাজ আমাদের নবলব্ধ স্বাধীনতা নিয়ে মাথা ঘামায় না। অথচ এই ক্ষোভ অবান্তর। দুশো বছর ধরে আমরাও তো আদিবাসী, কৃষকদের মনোবাঞ্ছার খবর নিইনি। আজও নিই না। বরং তাদের জল, জঙ্গল আর বাসভূমি ছত্রখান করি, নির্দ্বিধায়, কোনও এক বিকট, ভয়াল উন্নয়নের মোহচ্ছায়ায়। অনেকের ভরসা ছিল কমিউনিস্টদের উপর। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টি করলেই যে প্রলেতারিয়েত হয় না, তার দৃষ্টিভঙ্গি যে মধ্যবিত্ত, ঔপনিবেশিক থেকে যেতে পারে, তা বুঝতে তেমন কাঠখড় পোড়াতে হয়নি। গাছ আর গাছতলার মধ্যে তারা দোদুল্যমান। শুধু খাতায় কলমে এইটুকু বুঝেছে, আমরাও বুঝেছি যে, এখন আর উপনিবেশ তৈরি করতে হয় না, আমাদের দেশেই তার উৎপত্তির সমস্ত উপাদান মজুত আছে।
তাই উপনিবেশবাদ শেষ হয় না, থেকেই যায়। উপরন্তু এখন হল, কর্পোরেটের যুগ, ভয়ঙ্কর বিষফোঁড়া। কর্পোরেটশক্তি আর রাষ্ট্রশক্তির মিলনে যা তৈরি হয় তার নাম, ফ্যাসিবাদ। কথাটা স্বয়ং মুসোলিনির, তবে বর্ণে বর্ণে সত্যি। তাই যারা আজকাল উত্তর আধুনিকতা, উত্তর উপনিবেশ এইসব গালভরা শব্দবন্ধে আপাদমস্তক বন্দি থাকেন তাদের উচিত দেশটাকে ‘পোস্ট’ বা উত্তর না-বলে দ্বিতীয় উপনিবেশ বলা বা যাকে বলে, সার্ফডম… ‘সেকেন্ড সার্ফডম’, মহামতি এঙ্গেলস-এর ভাষায়। কারণ, রাষ্ট্র এখন নিজেই কর্পোরেটের পদতলে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করছে। ইংরেজ ভাবত, মানুষ আর বানরের মধ্যে একটা ‘মিসিং লিঙ্ক’ আছে, একটা প্রজাতি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, সেটা হল নিগ্রো। কর্পোরেটও এখন আমাদের এর চেয়ে বেশি পরিচয় দিতে নারাজ। সেই আমাদের স্বাস্থ্য আর শিক্ষার সংজ্ঞা বোঝাবে, সেগুলোর ভার নিয়ে নেবে। আমরা যে আনপাড়।
পরাধীন মন
অন্ধ কী চায়? সে চায় তার চোখ। নারী কী চায় সে হয়তো নিজেই তা জানে না। আমরাও জানি না। ‘বুঝতে নারি, নারী কী চায়’! আমরা স্বাধীনতা নিয়ে বড্ড উচ্ছ্বল; কিন্তু স্বাধীনতা কী? যেমন অর্ধেক গর্ভবতী হওয়া যায় না, তেমনি আধো আধো স্বাধীনতা বলেও তো কিছু হয় না। তাই ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। ফরাসিরা বলত, ‘লিবার্টি ইজ দি আলটিমেট ভ্যালু’। ওরা লিবার্টি নিয়ে বড্ড বেশি উদ্বেল হয়, কারণ অন্যদের কাছে তারা বড্ড বেশিদিন বড্ড বেশি অপমানিত হয়েছিল। আমাদের মান-অপমান বোধ অবশ্য অত তীব্র না। তবুও স্বাধীনতা নিয়ে আমাদের নতুন করে ভাবতেই হবে। আসলে স্বাধীনতা এমন একটা মূল্যবোধ যার জন্য আমি আর সমস্ত কিছু ত্যাগ করতে রাজী আছি। তাই আমরা বলি, স্বাধীনতার জন্য প্রাণও ত্যাগ করতে রাজী আছি।
তবে নিজের কাছে আরও একটু স্বচ্ছ হওয়া দরকার। কারণ, যদি বলি স্বাধীনতার জন্য কি ন্যায়বিচার ত্যাগ করা যাবে? গোলমেলে প্রশ্ন, আমাদের মনও বড্ড গোলমেলে, কেননা পরাধীন মানুষের দুই সত্তা। সে নিজের লোকের সঙ্গে যে-আচরণ করে, প্রভুর সঙ্গে তা করে না। তখন সে লোভাতুর। তাই ৪৭ সালে আমাদের মুক্তি ঘটেনি, আমাদের ব্যক্তি মানুষের নগ্ন স্বার্থপরতার মুক্তি ঘটে গেছে। মানুষ স্বাধীন হয়নি, তার ভিতরকার লোভ স্বাধীন হয়ে গেছে। তাই যাদের ন্যায়বিচার দরকার ছিল তারা তা পায়নি। আদিবাসী-জনজাতি পায়নি, সংখ্যালঘু পায় নি, যে-দুর্বল সে পায় না। তার মানে, একটা লোভসিঞ্জিত, উৎকট স্বাধীনতার জন্য ন্যায়বিচার ত্যাগ করা যায়। ত্যাগ করে আমরা একটা ‘সিস্টেম’ চালু করে দিলাম, তারপর নিজেরাই তার দাস হয়ে রইলাম।
এককালের প্রসিদ্ধ দার্শনিক হেগেল বলতেন, এটাই মানবেতিহাসের নিয়ম। মানুষ নতুন নতুন ‘সিস্টেম’ চালু করে। অবশ্য তিনি শুধু এটুকু বলেই থামেননি। এরপর বলেছিলেন, মানুষ নিজের তৈরি ‘সিস্টেম’ একসময় নিজেই ভেঙে ফেলে। এইভাবে ভাঙতে ভাঙতে সে নিজেকে চিনতে পারে, এভাবেই সে এগিয়ে চলে। এর বিরাম নেই। মার্ক্স বললেন, ঠিক। তবে এই এগিয়ে চলার পিছনে থাকে, শ্রম। সেকথা ভুললে কিছুই বলা হয় না। কিন্তু শ্রম তো কেবল মানুষই করে না, পশুও করে। তার সঙ্গে তফাৎ এই যে, মানুষের শ্রম সৃষ্টিশীল আর পশুর শ্রম রিপিটিটিভ, পুনরাবৃত্তি। মানুষ একই কাজ একইভাবে দু’বার করে না, করলে তা হবে ট্র্যাজেডি নয়তো প্রহসন। এক লক্ষ বছর আগে বাঘ যেভাবে হরিণশিশুকে ধরত আজও সেভাবেই ধরে। বাঘ আজও শিককাবাব খেতে শিখল না। মানুষ কিন্তু রূপান্তরশীল, সৃজনশীল।
কিন্তু পরাধীন মন শুধু পুনরাবৃত্তি বোঝে।
বাবুই পাখির বাসা আর মৌমাছির তৈরি মৌচাক পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম স্থপতিকেও বিস্ময়ে নির্বাক করে দেয়। কোটি কোটি বছর ধরে সে একই কর্ম একইভাবে করে যায়, শুধু প্রবৃত্তির টানে। অন্যদিকে, এবরোখেবরো উঠোনে ক্ষণভঙ্গুর ঘর বানিয়ে দরিদ্র চাষি কোনওক্রমে দিনাতিপাত করে। দুটোই নির্মাণ, কিন্তু চাষির নির্মাণ মৌমাছি আর বাবুইয়ের চেয়ে নিকৃষ্ট না, বরং মহত্তর। কারণ, চাষির নির্মাণে পুনরাবৃত্তি নেই, সৃজনশীলতা আছে, দুর্বল হলেও। বাসা বানানোর আগে তার মাথায় একটা কল্পনা আসে, সে তাকে রূপ দেয়। দিতে গিয়ে তার ভুল হয়, তারপর তা শুধরে নিতে চায়। কিন্তু মানুষ মাত্রেই মহত্তের দাবিদার হতে পারে না। যে-মানুষের মনে সৃষ্টিশীলতার আকুতি নেই সে মহৎ না, পরাধীন মন মহৎ হয় না, কেননা সে শুধু পুনরাবৃত্তি বোঝে; তাই সে বারবার উপনিবেশ তৈরির মালমশলা যোগাড় করতে থাকে। বে-মালুম!
না-লালসার স্বাধীনতা
আমরা ভেবেছিলাম, গণতন্ত্র খুব উপাদেয়। ভাবলাম, স্বাধীনতারই অপর নাম নাকি গণতন্ত্র। তা পেলাম, কিন্তু সে কোন গণতন্ত্র? ভাবলাম, ডিসিপ্লিন রাখতে হলে একটা জবরদস্ত শাসক দরকার। রাখলাম। কিন্তু…‘অ্যালসেসিয়য়ান ভেবে যে সারমেয় শাবকটিকে / আমরা তিনমাস বকলস পরিয়ে মাংস খাওয়ালাম / ক্রমশ তার খেঁকিভাব প্রবল হয়ে উঠছে’। অথচ গণতন্ত্রের তো অন্য একটা সংজ্ঞাও ছিল। সেখানে মানুষের সঙ্গে মানুষের নিরবচ্ছিন্ন সম্পর্ক থাকবে, একে অপরের উপর নির্ভর করবে, দু’জনের মধ্যে সেতু থাকবে। হ্যাঁ, প্রতিটি মানুষই স্বতন্ত্র, সে আপন বৈশিষ্ট্যে অনুপম, তাই তার স্বাতন্ত্র্যও বজায় থাকবে। তা তো হল না, বরং সেতুর বদলে দেওয়াল তুলে দিলাম-এল নিঃসঙ্গতা, অ্যালিয়েনেশন। বৈচিত্রের বদলে আনলাম অসাম্য, বিভাজন। শ্রমের স্বাধীনতা চেয়েছিলাম, তার বদলে পেলাম বাধ্যবাধকতা। ভাবলাম, উৎপাদনের মালিকানা থাকবে আমাদের হাতে। তা তো হল না।
ভেবেছিলাম, আমি আজ যা করি, আগামিকাল তা না-করে অন্য কিছু করতে পারব। সকালে গেলাম শিকারে, দুপুরে গেলাম মাছ ধরতে, বিকেলে না-হয় যাব ছাগল চরাতে, আর রাত্তিরে কায়িক শ্রম ছেড়ে বসব তর্ক আর সাহিত আলোচনায়। এই ছিল স্বাধীনতার সংজ্ঞা, ধারণাটা পেয়েছিলাম কার্ল মার্কস-এর কাছে। তাতে বুঝেছিলাম, আমার বুকে কোনও নির্দিষ্ট ছাপ থাকবে না; আমি না হব শিকারী অথবা জেলে অথবা পশুপালক অথবা তার্কিক, কোনওটাই না। আমি কিছুই না, অথচ সবকিছুই, কেননা আমার একটা মুক্ত মন আছে, মুক্ত চিন্তা আছে, তাই আমি শুধু মুক্ত মানুষ। গণতন্ত্র সম্পর্কেও এই ছিল ভাবনা। বড্ড বেশি তাত্ত্বিক বুঝি! তাহলে বলতেই হয়, ‘হে অনন্ত প্রেম! / এই জীবনের সান্ধ্যসভায় / তোমার আসর শূন্য হলো / হে প্রেম শূন্য হলো, বিরস গানে / ভরলো আকাশ’।
কারণ, যা ভেবেছিলাম, যা ভাবা যায় তার কোনওটাই ঘটেনি। তার বদলে এখন তো নির্জন পথিক হাঁটে শীর্ণ একতারা হাতে। ‘দ্বৈপায়ন হ্রদে ডোবা ভগ্নজানু মন’ নিয়ে আমরা বেঁচে আছি…না-মালুম। সত্যি করে বললে, এই তো আমাদের ‘আততায়ী জীবনের’ রোজনামচা। এখনও তো একটা নিতান্ত উপযুক্ত চাকরির জন্য আমাদের হা-পিত্যেশ করতে হয়, নিতান্ত কুকুরের মতো। ওদিকে, কল্পকথা না গল্পকথা জানি না, তবে অর্থনীতিবিদরাই বলেন, পৃথিবীতে নাকি যত ধনসম্ভার আছে, যে প্রাচুর্য আছে তা যদি ঠিকমতো বণ্টন হত তাহলে কয়েক হাজার কোটি মানুষ অনায়াসে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকতে পারত। তাহলে কেন আমাদের দেশে আজও, অন্তত কুড়ি শতাংশ মানুষ রাত্রে না-খেয়ে ঘুমোতে যায়? কারণ, আমরা স্বাধীন না।
আমাদের আত্মশ্রীকাতর, বুদ্ধিগর্বিত পরিশীলিত মানুষজন সমাজে কোনও গণতান্ত্রিক মনোভূমি রচনা করেননি, স্বাধীনতা শব্দটা উচ্চারণ করতেও শেখেননি; চর্বিতচর্বণ করতে করতে অবান্তর আত্মশ্লাঘায় সময় কাটিয়ে দিয়েছেন, বড্ড বেশিকাল। ইউরোপ থেকে শেখা বুলি দিয়ে আর কতদিন চালানো যায়, নিজের ভিতর থেকে তো কিছু গড়ে উঠল না। মনে হয়, তেমন কিছু গড়ে উঠতে হলে একটা বিস্ফোরণ দরকার হবে। কিন্তু বড্ড দেরি হয়ে গেল না? তাই বা কেন? ইতিহাসে আবার দেরি কীসের, কীসেরই বা তাড়া? তাড়া কি নেই, একেবারে? জানি না।
তবে অনবরত লুণ্ঠিত, ধর্ষিত, এই ‘বৃদ্ধযুগের গলিত শবের পাশে’ দাঁড়িয়েও কেন জানি না মনে হয়, আমাদের এই দেশ বড় সুন্দর, বড় লাস্যময়ী, আজও। ‘এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে’। কোথাও, অতি ক্ষীণ সুরে কোনও নবজীবনের স্তোত্রপাঠ যেন শুনতে পাই, আজও। তাই মনে হয়, আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস এখনও লেখা শুরুই হয়নি, এখনও। যে-ইতিহাস আমরা জানি তা নিছক একটি প্রাণীর ইতিহাস, মহাপ্রকৃতিতে এক অভিনব জানোয়ারের ইতিহাস। সে পুনরাবৃত্তির ইতিহাস, সৃজনশীলতার ইতিহাস না। নতুন ইতিহাস লেখা শুরু হবে যখন আমরা কপট বিশ্বাসের হাত ছাড়িয়ে স্বাধীন হব, লালসার জতুগৃহ থেকে যেদিন আমাদের মুক্তি ঘটবে।
* ঋণ স্বীকার. বাংলাদেশের প্রখ্যাত অধ্যাপক জনাব সলিমুল্লাহ খান-এর বিভিন্ন প্রবন্ধ এবং বক্তৃতাবলী।
অতি উপাদেয় এবং সত্যভাষী, তাই কটু। কেবল একটা আপত্তি। হরিশ্চন্দ্র মুখার্জি নীলবিদ্রোহ সমর্থন করেছিলেন, কিন্তু মহাবিদ্রোহের বিরোধিতা করেছিলেন।
উত্তরমুছুনআপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। আপনি ঠিকই বলেছেন, হরিশ মুখার্জি নীলবিদ্রোহের সমর্থক ছিলেন, কিন্তু ১৮৫৭-এর বিদ্রোহ সমর্থন করেননি। আমি ইতিহাসের ছাত্র না, সামান্য চিকিৎসক। তবু এখান ওখান থেকে কুড়িয়ে-বাড়িয়ে কিছু বুঝবার চেষ্টা করি, এইমাত্র। আমি যতদূর বুঝেছি, হিন্দু পেট্রিয়ট পত্রিকায় মহাবিদ্রোহের খবরাখবর নিয়মিত বেরতো। মুঘলদের পরিচালনায় এই বিদ্রোহ চলছে, এই কারণে হরিশচন্দ্রের বিরক্তি ছিল। কিন্তু আবার, তাঁতিয়া টোপির মৃত্যুর পর ওই পত্রিকা তাঁকে শহীদের মর্যাদা দিয়েছিল, লক্ষ্মী বাইকেও। এও তো সত্যি। তাই মনে হয়, অকালমৃত্যুর কবলে পড়া এই সাংবাদিকের মনোভাব একমাত্রিক ছিল না। একথা আমার বক্তব্যের সমর্থনে বলছি না, বলছি আপনার দেখিয়ে দেওয়া ভুলটি মেনে নিয়েই। আমার সশ্রদ্ধ নমস্কার জানবেন।
উত্তরমুছুনএই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।
উত্তরমুছুন16 August 2022 at 13:42
মুছুনবিনায়ক দামোদর সাভারকারের স্মৃতি কথাটি কি - এটা কি ওনার ব্যাখ্যা? বিষয়টি একটু বিশদে বলবেন ?
পোস্ট কলোনিয়াল আর সেকেন্ড কলোনিয়ালিজম এর পার্থক্যটি খুবই খুবই দরকার ছিল? কারণ পোস্ট কলোনিয়ালিজমের মূল বৈশিষ্ট্য হলো যে মুখে স্বাধিনতার কথা বলি , মনেমনেও কিন্তু , তবে পোস্ট কলোনিয়ালে এই যে মনের পাঠ এটাও দাসত্বের পাঠ।তাই তো? আরেকটু বলুন