দোঁহা

তৃষা হরিয়ে



নূপুর রায়

এই যে, সমস্ত সাজানোর অন্তরালে এক আগ্রাসী বিষাদ ধিকধিক করে, কারণ চিহ্নিত করতে পারি না! সে কুরে কুরে খায় ইহজীবনের অতলান্ত। উদগ্র বর্ষায় দু'চোখের তৃষা হরিয়ে বসিয়ে রাখে বৃষ্টিচ্ছায়ার দিকে। ওপরের টানা লাল বারান্দা জুড়ে আলপনা দিয়েছি, এলোপাতারি বৃষ্টিতে ধুয়ে যাচ্ছে চকিত চাউনির বাড়তি পুলকটুকু।

  খর আনন্দ বেপথু ছায়া ঘনিয়ে নামে আমার বিবর্ণ ফাটা আস্তিনে। ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা থমথমে মোড়। পা পিছলে, নাকি এমনিই চলে যায় ঢালের দিকে! ভালোবাসা টানে। নিজেকে মনে হয় যেন কলেজ করিডরে দাঁড়িয়ে থাকা সদ্য তরুণী। ভালো লাগে কলেজপড়ুয়া কোন ছেলেকে। না, তাকে আমার সন্তান মনে হয় না। দূরগামী প্রেমিকও না। শুধু এই বয়সটার, অই দু'চোখ ভরা, 'চল জাহান্নামে যাই' আচরণের প্রেমে পড়ে থাকি। হাজরা কেবিনে টেবিলের নিচে আবার কেউ যেন পায়ে পায়ে ঠোক্কর মারে। আবার ইচ্ছা করে লুকিয়ে এই স্বাদটুকু ছুঁয়ে দিতে। ভাবনার এই স্বাধীনতাটুকু আমার অন্দরে ফুটে থাকা শ্বেতকমল। কাউকে বলতে গেলে রে রে করে তেড়ে আসবে। দেশে দেশে স্বাধীনতার সংজ্ঞা যেমন আপেক্ষিক, জনে জনেও। বিত্তে বিত্তে। আর এই আপেক্ষিকতা সবচেয়ে প্রকট হয়ে ওঠে নারী পুরুষে। দু তিনটে সংকট যখন এক নারীকে বইতে হয়, পারমুটেশন কম্বিনেশনের মতো পরাধীনতার ভীমাকৃতি ছায়া পড়ে তার যাপনে। সার্বিক কল্যাণের কথা ভেবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারীই তার ইচ্ছাকে কোন এক ইছামতীর জলে চুপিচুপি জলাঞ্জলি দিয়ে আসে একদিন। দিতে হয় তাকে...

বাড়ি ফিরতে হবে। লম্বা চড়াই পেরিয়ে প্রবেশপথ। সেই সদ্য দাড়ি গজানো  ছেলেটা এসে আমার হাত ধরে। উঠে আসি। নিবিড় খুঁজে চলি কবেকার কলেজবেলা গল্প কানাকানি হইচই। বয়স থমকে দাঁড়ায়। নিভৃতে মনের সাজি অজানা ভুবনডাঙায় ভরে ওঠে। ভালো লেগে যায় কখনও কোন প্রৌঢ়কে, কোন যুবককে। কারোর কথায় মেধার ঝলক, কারোর বলার ভাঁজে স্নেহ মুড়ে রাখা ভঙ্গিমা, কারোর আপাত কাঠিন্যের আড়ালে পাখির নীড়ের মতো নরম ওমের হদিস। এসব ভালোলাগার কোন বিস্তৃতি নেই। খুচরো আনন্দের সাথী। একলা মনের স্বাধীন ঝাপটা। আমাদের শহরতলীর বারান্দায় দাঁড়িয়ে স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর উদযাপনের পরেও এ এক স্পর্ধার মানবজমিন হাতড়ানো। স্বাধীনতার এই গয়ংগচ্ছ মনোভাবে এখানে এখনও একজন পুরুষ বন্ধুর সঙ্গে জমিয়ে গল্প করা বেমানান। কোন ভালোলাগার উৎস খুঁড়তে পারবে না তুমি। উৎসুক দৃষ্টি পিছলে যাবে মুখের উপর দিয়ে।

    পাহাড়ের কানাচে কানাচে লেগে থাকা ছোপ ছোপ শ্যাওলা জলপ্রপাতের কাছাকাছি সহজে ছড়ায় যেখানে জল নয় জলের ভ্রম গেঁথে গেঁথে বরফ দোলে... তেষ্টা বাড়ে! বেড়ে বেড়ে চড়াই ভাঙা রাস্তায় আবার ঠেলে দেয়। ছায়া ছায়া একটা বিকাল নামে। সন্ধ্যার অন্তরবর্তী আরও এক সন্ধ্যা মিলিয়ে যায় অন্ধকারে, বোবা কান্নার মতো। স্বাধীনতা নামের দামী বার্তাটি আলগা প্রহসনে ব্যর্থ থিতিয়ে পড়ে তামাম নারীর সংশয়ে। আমেরিকার সুপ্রিম কোর্ট নারীর পাখা বিকট ছেঁটে দেয়।
 ভাবনার প্রসারিত ডানা আঘাত পেয়ে গুটিয়ে যখন এতটুকু হয়ে আসে
ভাবি, স্বাধীনতায় আমেরিকা হে, তুমিও!

 অন্যদিকে স্বাধীনতা হরিয়ে কিছু স্বাদ এখনও জাগে বিষণ্ণ বৃষ্টিফোঁটার মতো

কালচে জং ধরা সন্ধে নেমে আসে আমার অধিবাসে। কেউ বলে না, বাড়ি ফিরেছিস? এত দেরি করে ফিরিস কেন? ফোনটা আর বাজে না তবু মনে হয় পুরনো রিংটোন বেজে যাচ্ছে দূরে কোথাও...
ঘুপচি ঘুপচি অন্ধকারগুলো আলোর ওপর চেপে বসে। ক্রমশ টলায়মান আঁধার স্থির নিশ্চল নেশা কাটিয়ে ফেলে! কেউ আর খুঁটিনাটি খবর রাখে না। কেউ বলে না, ফোনটা দীর্ঘ সময় গল্প করার জন্য নয়। প্রয়োজনীয় কথা বলার জন্য। আমি বাড়ি ফিরেছি কিনা, সেই জরুরি প্রশ্ন একটা সময় অবান্তর হয়ে পড়ে। আমাদের ভারতীয় সমাজব্যবস্থায় প্রতিটা জেনারেশনে রোল মডেলের ভূমিকা বদলে বদলে যায়। পরবর্তীতে একটু শিথিল হয়। তবু এ জীবনে কিছু কিছু স্বাধীনতা হারাতেই ভালো লাগে। জমাট অন্ধকারে অনেক দূর থেকে  একটা পেনসিল টর্চের আলো ফোকাস হলে অন্ধকারের সমারোহ অভিভূত করে। হারিয়ে যাওয়া আলোর মতো এক অতল স্বাধীনতার স্বপ্ন যেমন দেখি, বর্ণময় এক পরাধীনতার স্বপ্নও তেমন আমাকে ভাসায়। এমন একজন কেউ আছে যে সব বাজি রেখে ভাববে আমার কথা। তার কঠিন সত্যের ভিতর আমার কোমল আবেগ জড়াবে তাকে। আমার ভালো থাকার দায় সে জীবিত যতদিন, সে পারঙ্গম যতদিন স্বেচ্ছায় বইবে। কাঁধে তার জোয়াল বয়ে বয়ে জীবনের ঘা, তবু সে বইবে। সে সাঁতার কাটতে দিতে চাইবে না, সে সাইকেল চালাতে মানা করবে, পার্কের পিছনের রাস্তায় কৃষ্ণচূড়া গাছটার দিকে পা বারানোয় তার আপত্তি থাকবে, সে চটুল ছেলেমেয়েদের সঙ্গ পছন্দ করবে না। ভারতীয় সংস্কৃতিতে কন্যা সন্তানের জন্য একটা বয়স পর্যন্ত এইসব বিধিনিষেধ  অপরিবর্তিত থাকে সাধারণ নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে। এছাড়াও ছেলে মেয়ে  উভয়ের ক্ষেত্রেই কোন সিনেমা দেখবে, কোনটা দেখবে না পুরনো মফস্বলী টানে একটা মোটা দাগ টেনে দেওয়া হয় এমনকি কোন বইটা পড়বে,  কোনটা নয় তাও!

  তরুলতা, আমাদের বারান্দার টবে যখন চারালতাটি, তার চলার গতিতে একটা নুয়ে পড়া ভাব ছিল। এই বর্ষায় তাকে জোর করে উচ্ছেদ না করলে সে আর থামবে না।

না, আমরা থামি না। বৃষ্টিধোয়া বারান্দা শুকিয়ে গেলে আবার আমার মনউড়ানের বাটি নিয়ে বসি। আবার চকিত চাউনির মতো বাড়তি পুলকটুকু তুলি দিয়ে টানি...যতবার মুছে দেবে তোমরা স্বাধীনতার স্বাদ, আমি কেন ততবার আস্কারার আলপনায় জড়াবো না আমার ইচ্ছেজমিন, বলো... এই স্বাধীনতাটুকু আমার থাক!


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন