দোঁহা

তুমি তো সেই যাবেই চলে



http://www.pinterest.com

প্রসেনজিৎ  দাশগুপ্ত 


আজও স্বপ্নের মতো ভেসে ওঠে সেই দৃশ্য...

প্রকাণ্ড জনমানবহীন স্টুডিও ফ্লোর, ডিরেক্টরের চেয়ার, ক্রেইন, ক্যামেরা, লাইট, আলো-আঁধারির হাতছানি, ব্রহ্মাণ্ড ফুঁড়ে নেমে আসা সেই রহস্যময় আলো আর দুটি মানুষ...একলা, নিঃসঙ্গ, অসহায়।

পরিচালক সুরেশ সিনহা ও অভিনেত্রী শান্তি। গুরু দত্তের 'কাগজ কে ফুল'-র দুই অবিস্মরণীয় চরিত্র।

চরিত্রায়নে ওয়াহিদা রহমান এবং গুরু দত্ত স্বয়ং।

সিনেমার চরিত্র দুটি একে অন্যকে ভালবেসেছিল৷ বাস্তবের চরিত্র দুটিও তা-ই৷ তাঁরা মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছেন, ভালবাসতে চেয়েছেন, চেষ্টা করেছেন একে অন্যকে, যেন না-পেয়েও ছুঁয়ে থাকা যায়। এই ভালোবাসা-প্রেম-নির্ভরতা কবে, কোন সমাজের বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ মেনেছে? 

তবু নিদারুণ, নিষ্ঠুর নিয়তির মতো নেমে এসেছে বিচ্ছেদ৷ নেমে এসেছে সব কিছু খুইয়ে ফেলার ও একাকীত্বের প্রহর। ভেসে উঠেছে অপ্রাপ্তি, অ'দেখা, বঞ্চনা ও প্রতারণার ধ্বস্ত কাঠামো। সাক্ষী থেকেছে নেপথ্যে ভেসে আসা গীতা দত্তের সেই গান - 

"ওয়াক্ত নে কিয়া ক্যয়া হাসিন সিতম 
তুম রহে না তুম, হাম রহে না হাম..."
 
 
 মুখোমুখি গুরু-ওয়াহিদা

 
অথচ এই গান, এই মুহূর্ত নাকি সৃষ্টি হওয়ার কথাই ছিল না। কথা ছিল না এমন অবিশ্বাস্য দৃশ্য-নির্মাণের। অরিজিনাল স্ক্রিপ্টেও উল্লেখ ছিল না তা। কিন্তু হয়েছিল তারই উল্টো।

নয়ের দশকে রেডিও'য় এক সাক্ষাৎকারে গীতিকার ও শায়ের কইফি আজমি জানিয়েছেন, 'কাগজ কে ফুল' (১৯৫৯) এর শুটিং তখন প্রায় শেষের মুখে। ছবির জন্য দরকার ছিল পাঁচটি গান। পাঁচটি গানের মধ্যে চারটি লিখেছিলেন আজমি, একটি শৈলেন্দ্র। সুর দিয়েছিলেন শচীন দেব বর্মন।

গুরু দত্তের টিমে সেই প্রথম এসেছেন আজমি। প্রথম দিকে ছবির গান লেখার কথা ছিল শাহীর লুধিয়ানভির। ঠিক দু'বছর আগে 'প্যায়সা' (১৯৫৭) তে অবিশ্বাস্য সব গান লিখে যিনি সাড়া ফেলে দিয়ে ছিলেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে শচীন কত্তার সাথে কোনো এক বিষয়ে মতান্তর হওয়ায় 'কাগজ কে ফুল' থেকে সরে দাঁড়ান লুধিয়ানভি। দলে আসেন আজমি। 

আজমি জানিয়েছেন, 'কাগজ কে ফুল' করতে গুরু দত্তকে বারণ করেছিলেন শচীন দেব বর্মন। কারণ, তাঁর মনে হয়েছিল কাহিনি'টি গুরু দত্তের ব্যক্তিগত জীবন, তাঁর অসুখী দাম্পত্য, ওয়াহিদার সঙ্গে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক ও যাবতীয় ভাঙাগড়া নিয়ে তৈরি। এহেন 'আত্মজীবনীমূলক' এক্সপেরিমেন্ট না করাই ভালো। যদিও সে কথা কানে তোলেননি গুরু দত্ত। রেগেমেগে শচীন দেব বর্মন জানিয়েছিলেন, 'কাগজ কে ফুল'ই হবে গুরু দত্তের সঙ্গে তাঁর শেষ কাজ৷ এর পর আর কখনও তাঁরা আর জুটি বাঁধেননি। 

কইফি জানিয়েছেন, ১৯৫৮ সালের শেষদিক তখন। সিনেমার পাঁচটি গানে সুর দেওয়ার কাজ শেষ। এক সন্ধ্যায় শচীন দেব বর্মনের বাড়িতে বসেছে আড্ডার আসর। রয়েছেন স্বয়ং পরিচালক গুরু দত্ত, আজমি, সিনেমাটোগ্রাফার ভি কে মূর্তি সহ বেশ কয়েকজন৷ 'কাগজ কে ফুল' নিয়েই চলছে আলাপ আলোচনা।

কইফি জানাচ্ছেন, আলোচনার মধ্যেই বর্মন সাহেব কী যেন গুনগুন করছিলেন৷ অদ্ভুত সেই সুর। মাঝে মধ্যে কথা কথা বলছেন, অন্যমনস্ক হচ্ছেন, আবার গুনগুন করছেন। বিষয়টি নজর এড়ায়নি গুরু দত্তের। শচীন কত্তা'কে বলতেই হারমনিয়াম নিয়ে বসে পড়েন তিনি। শোনান তাঁর তৎক্ষণাৎ রেডিমেড কম্পোজিশন। সেই মনকেমন করা সুরে নিমেষে আচ্ছন্ন সকলে৷ 

'ডেমো' শেষ হতে লাফিয়ে ওঠেন গুরু দত্ত৷ জড়িয়ে ধরেন শচীন কত্তা'কে৷ এই সুর তাঁর চাই৷ 'কাগজ কে ফুলে' রাখবেন এই সুর। এবার দু'জনেই পাকরাও করলেন ঘরের এককোনে চুপটি করে বসে থাকা কইফি আজমিকে। এক্ষুনি কথা বসাও এই সুরে। 

এভাবে 'র‍্যাণ্ডমলি' কোনও সুরে কথা বসানো ছিল যথেষ্ট দুরূহ কাজ। কইফি এমন কোনো পদ্ধতিতে স্বচ্ছন্দ ছিলেন না। কিন্তু গুরু দত্ত নাছোড়বান্দা। তাঁর জেদাজেদি'তেই কইফি তুলে নেন কাগজ কলম। কয়েক মুহূর্ত চোখ বন্ধ করে সুর আত্মস্থ করার চেষ্টা করলেন। তার পর তা লিখে ফেললেন কাগজে৷ কিন্তু এর পরেই শুরু হল বিপত্তি। 

গানের প্রথম 'মুখরা' গুরু দত্তের পছন্দ হল না। অথচ শচীন দেব বর্মনের তা পছন্দ। ফলে 'নট ওকে' হয়ে গেল সেই লেখা। আবারও গান লিখলেন আজমি। এবার তা গুরু দত্তের মনে ধরলো৷ কিন্তু বেঁকে বসলেন শচীন কত্তা। ফের 'ক্যানসেল'। মহা বিড়ম্বনায় পড়লেন কইফি। এ কী ছেলেমানুষী শুরু করেছেন দত্ত সাহেব আর শচীন দাদা! এভাবে গান লেখা সম্ভব নাকি? যদিও পরিচালক ও সংগীত পরিচালক দুজনেই আশাবাদী - "এক আখরি ট্রাই হো জায়ে! আপ হী কর সকতে হো।" 

সেই 'আখরি কোশিসে' বাজি মারলেন কইফি। 'থার্ড  এটেম্পটে' ইতিহাস গড়লেন তিনি। গান শুনে গুরু দত্ত শিশুর মতো কেঁদেছিলেন। শচীন দেব বর্মনের সুর আর কইফি আজমির কথা মিলেমিশে সৃষ্টি হল - "ওয়াক্ত নে কিয়া ক্যয়া হাসিন সিতম"। শচীন কত্তা কইফির পিঠ চাপড়ে বলেছিলেন, "জিতে রহো"! 

তারপরেই শচীন দেব বর্মন ঘোষণা করলেন গানটি গীতা (দত্ত) গাইবে। সেই কথা শুনে এক মুহূর্ত চুপ হয়ে যান গুরু দত্ত। ভি কে মূর্তি লিখেছেন, শচীন কত্তার সেই কথা শুনে এক অদ্ভুত অস্থিরতা ছড়ায় গুরু দত্তের মধ্যে৷ মাথা নিচু করে পায়চারি শুরু করেন ঘরের মধ্যে। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এই গান তাঁর স্ত্রী'কে দিয়ে গাওয়ানো কতটা কঠিন, কতটা অস্বস্তিকর। 
 
 
শচীন কর্তার সঙ্গে গুরু দত্ত, গীতা দত্ত ও রাহুল দেব বর্মন

 
ওয়াহিদার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নিয়ে তখন গোটা ইন্ডাস্ট্রি উত্তাল। 'কাগজ কে ফুল' তা নিয়ে জল্পনা আরও উস্কে দিয়েছে। সম্পর্কের লেলিহান হলকা লেগেছে দত্ত পরিবারেও। গীতা রীতিমতো ব্যথিত, মর্মাহত, ভগ্নহৃদয়...দূরত্ব বাড়ছে দুজনের সম্পর্কে। তার মধ্যে এই ঘোষণা৷ শচীন কত্তাকে অন্য বিকল্প দেওয়ার আর্জি দিলেন গুরু দত্ত৷ সরাসরি নস্যাৎ করলেন বর্মন সাহেব৷ এই গান গীতা দত্ত ছাড়া অন্য কেউ গাইতে পারবেন না৷ গীতা না গাইলে এই গান রাখা হবে না৷ শান্ত শীতলকণ্ঠে জানিয়ে দেন শচীন দেব বর্মন। অস্বস্তি সত্ত্বেও রাজি হন গুরু দত্ত। 

এক দশকের বেশি সময় গুরু দত্তের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা নিয়ে, পরিচালক, লেখক ও চিত্র নাট্যকার অবরার আলভি তাঁর বই "গুরু দত্ত কে সাথ এক দশক" এ উল্লেখ করেছেন গীতা দত্ত-ও এই গান গাইতে চাননি। বারবার ফিরিয়ে দিয়েছেন গুরু দত্ত'কে৷ শেষে শচীন দেব বর্মনের অনুরোধে এই গান গাইতে রাজি হয়েছিলেন গীতা। বাকিটা ইতিহাস। 

সিনেমাটোগ্রাফার ভি কে মূর্তি জানিয়েছেন, গোটা গানের দৃশ্য নতুন করে শ্যুট করা হয়। সেই দৃশ্যই পরবর্তী কালে বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসে, আজও এক অবিস্মরণীয় মাইলফলক হয়ে আছে। 

সেই আলো-আঁধারি সেট, না জানি কার অপেক্ষায় বসে থাকা খালি চেয়ার, ক্রেইন, ক্যামেরা আর ছাদ ফুঁড়ে নেমে আসা সেই অতীন্দ্রিয়, রহস্যময় আলো;  ক্যামেরাম্যান ভি কে মূর্তি তিলতিল করে তা নির্মাণ করেছিলেন। গুরু দত্ত আর ওয়াহিদা রহমানের অন স্ক্রিন প্রেজেন্স তা আরও মোহময় করে তোলে।

আর সব কিছু ছাপিয়ে সেই গান, গীতা দত্তের কণ্ঠে "ওয়াক্ত নে কিয়া..."। গীতা দত্ত ছাড়া এই গান অন্য কেউ গাইতে পারতেন বলে মনে হয় না। এক নারী যার ঘর ভেসে গেছে, চিড় ধরেছে দাম্পত্যে, স্বামীর সঙ্গে অন্য এক মহিলার সম্পর্ক মেনে নিতে না পেরে আলাদা হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সন্তানদের মানুষ করছেন একা হাতে; অথচ তিনিই কিনা তাঁর স্বামী ও তাঁর প্রেমিকার উপর চিত্রায়িত দৃশ্যে কণ্ঠের জাদু ঢেলে দিচ্ছেন। 

গান নয়, এক অখণ্ড বিষাদকাব্য রচনা করেছিলেন শচীন দেব বর্মন ও কইফি আজমি। সেই মহাকাব্যের সার্থক রূপদান করেছিলেন গীতা দত্ত। তাঁর নিজস্ব বুকভাঙা বেদনা, হাহাকার, নিঃসঙ্গতা, বিষাদ, আর একাকীত্ব, সব মিলেমিশে এক হয়ে গিয়েছিল সেই গানে। মেহবুব স্টুডিও'তে সেই গান বারবার ধ্বনিত, প্রতিধ্বনিত হয়ে মিলিয়ে ছিল মহাশূন্যে, অনন্তে...

অবশেষে আসে সেই ভয়াবহ দিন। ১০ অক্টোবর ১৯৬৪ সাল। 

বম্বের পেডার রোডে গুরু দত্তের বাড়িতে উপচে পড়েছে ভিড়। ড্রাগ ওভারডোজে মারা গেছেন কিংবদন্তি পরিচালক গুরু দত্ত। মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপানের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ খেয়েছিলেন সেই রাতে। 

এ কি দূর্ঘটনা নাকি আত্মহত্যা, আজও তার সদুত্তর মেলেনি। কারণ যাই হোক মাত্র ৩৯ বছর বয়সে পৃথিবীর সব মায়া কাটিয়ে সুরলোকে পাড়ি দিয়ে ছিলেন বসন্তকুমার শিবশঙ্কর পাড়ুকোন, যাকে গোটা ইন্ডাস্ট্রি চিনতো 'গুরু দত্ত' নামে। 

গুরু দত্তের মৃত্যুর খবরে শোকাহত হয়েছিলেন কইফি আজমি। ভগ্নহৃদয়ে 'দত্ত সাহেবে'র উদ্দেশ্যে লিখেছিলেন এক শোকগাঁথা - 

"একবার তো খুদ মউত ভি ঘবড়া গয়ী হোগি
ইয়ুঁ মউত কো সিনে সে লগাতা নহী কোঁই..."

হেমন্ত জায়া বেলা মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, পেডার রোডের বাড়িতে যখন ছুটে গেছেন তাঁরা, সোফায় অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন গীতা দত্ত। বেলা মুখার্জি বলেছিলেন, নিয়তির কী অদ্ভুত পরিহাস। যাকে ফিরে পাওয়ার জন্য আকুল হয়েছেন, আশায় বুক বেঁধেছেন গীতা, সেই মানুষটি তাঁকে ছেড়ে পাড়ি দিয়েছেন তখন না-ফেরার দেশে। পিছনে ফেলে রেখে স্মৃতির অ্যালবাম। 

সে সময় এই গানটির কথাই মনে পড়েছিল বেলা দেবীর। শত বিষাদের মধ্যে যেন হারানো সংসার, হারানো ভালোবাসা নতুন করে ফিরে পাওয়ার প্রার্থনা জড়িয়েছিল তাতে।
 


  গীতা-ই সব উজার করে গাইতে পেরেছিলেন - 

"জায়েঙ্গে কঁহা সুঝতা নেহী
চল পড়ে মগর রাস্তা নেহী ---
ক্যয়া তলাশ হ্যায় কুছ পতা নেহী
বুন রহে হ্যায় দিল খোয়াব দম ব দম

ওয়াক্ত নে কিয়া..." 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন