দোঁহা

আজ তাঁর জন্মদিনে…

 


 

পার্থজিৎ চন্দ

 
সেই বৃষ্টি-সন্ধ্যার কথা মনে পড়ছে, বছর দশেক আগের এক সন্ধ্যা। এক বন্ধুর সঙ্গে তীব্র তর্ক চলছে- নবারুণের কবিতা নিয়ে নয়, তাঁর গদ্য-ভাণ্ডার নিয়ে। বন্ধুটির মত, নবারুণ ‘প্রেডিক্টেবল’, নবারুণ তাঁর গদ্যে আসলে সোভিয়েত-উত্তর পৃথিবীতে কোনও ক্রমে টিঁকে থাকা ‘বিপ্লবের’ জনপ্রিয় ধারণাকে লিখে গেছেন। তার মতে এ-ধারণা বিপ্লবের নয়, এ ধারণা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেও ছুটে যায় না; এ ধারণা আসলে ইউনিপোলার বিশ্বে অনন্ত পুঁজির সামনে দুলতে থাকা এক মরিচিকা।
এবং তাঁর মত, নবারুণ তাত্ত্বিকভাবেও বেশ ‘দুর্বল’।

সেদিন বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বাড়ি ফিরে আসতে আসতে যা মনে হয়েছিল আজও তার থেকে বেরোতে পারিনি।
নবারুণ-কে নস্যাৎ করে দিতে উদাহরণের অভাব পড়বে না; কিন্তু তাঁকে স্বীকার করতে শুধু একটি উদাহরণই যথেষ্ট।
তিনি হাজারো স্রোত ও বিপরীতমুখী স্রোতের মধ্যে দাঁড়িয়ে, ভুবনায়ণের নগর-সংকীর্তণের মধ্যে দাঁড়িয়ে বাংলা গদ্যে সম-সময়ের বারুদ ও বুব্যি-ট্র্যাপ দান করে গেছেন।

 যে সময়ে ‘শশশৃঙ্গের’ সমনাম পড়ে চলেছে বাংলা-সাহিত্য সে সময়ে তিনি প্রবল এক ব্যতিক্রম; তিনি (শুধু স্থান-কাল-পাত্রের নামোল্লেখের কারণে নন) যথার্থ’ই একজন  কাঁটাতার পেরিয়ে যাওয়া লেখক।
গদ্যের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে বিষয়ের ক্ষেত্রে অনেক সময়েই বাংলা সাহিত্য তাঁকে কম্যুনিজমের ‘রোমান্টিসিজমে’ আক্রান্ত অক্ষর-কর্মী হিসাবে ভুল করল। তাঁর স্বপ্ন ও স্বপ্নের বিস্তার-কে ধ্বংসাত্মক ‘অ্যনার্কি’ হিসাবে মিথ্যা নিন্দিত হতে হল মাঝে মধ্যে। শুধু ভাবি, এই মিথ্যা নিন্দার যোগ্য যদি হয়ে উঠত আরও কেউ কেউ!

 


 সেই কবে পড়েছিলাম ‘পৃথিবীর শেষ কমিউনিস্ট’ (প্রকাশিত হয়েছিল কালান্তর পত্রিকায়, ২০০৩-এ), পড়েছিলাম, ‘আবার লেনিনগ্রাদ। সেই রাতেই ইন্দোনেশিয়ার কমিউনিস্টরা, আর বিনা বন্দুকে নয়, অভ্যুত্থান ঘটাবে। অস্ট্রেলিয়ায় একের পর এক বন্দরে ছড়িয়ে পড়বে ধর্মঘট। বলিভিয়ায় ফেটে পড়বে টিন শ্রমিকদের বিক্ষোভ-লেনিন ও চে-র ছবি নিয়ে লাতিন আমেরিকার প্রত্যেকটা রাজধানী অচল করে দেবে ছাত্র ও মধ্যবিত্ত মানুষ। শ্রমিক ধর্মঘটে অচল হয়ে যাবে ফ্রান্স, ইতালি, গ্রিস, স্পেন...খবর আসবে আফ্রিকা থেকে, আরব দুনিয়া...সারা দুনিয়া জুড়ে কমিউনিস্টরা ফিরে আসবে। হ্যাঁ। আসবে। তবে তার জন্যে আগামী সতেরো বছর বা তারও বেশি সময়ের প্রত্যেকটা ঘণ্টা ও প্রত্যেকটা মিনিট কাজে লাগাতে হবে। সারা পৃথিবী জুড়ে কমিউনিস্টরা ফিরে আসবে। আসবেই। আর দশ নয়, দশ হাজার দিন ধরে দুনিয়া কাঁপবে।
সেই কথাটাই এই গল্পে জানিয়ে দেওয়া হল’। 

এখানে স্মরণে রাখা প্রয়োজন গল্পটি লিখিত হচ্ছে ২০০৩-এ। সংশোধনের পথ ধরে রাশিয়ায় যা যা ঘটার ঘটে গেছে, আমেরিকার বিপুল পুঁজি ও প্রভাবের সামনে কাঁপছে সারা পৃথিবী। সে সময়ে নবারুণ তাঁর ম্যাজিকাল জগৎ তৈরি করছেন, সম্ভবত এ-জায়গা থেকেই অনেকের নবারুণ-কে নিয়ে অস্বস্তি’র শুরু ও শেষ। তারা কিছুতেই বুঝতে চান না, পৃথিবীর শেষ কমিউনিস্ট-এর স্বপ্ন হবে অতিকায় ও ঝকঝকে।

স্বপ্ন হত্যা করার এক সিস্টেমের মধ্যে দাঁড়িয়ে নবারুণ-কে লিখে যেতে হয়েছিল এ কথাগুলি।
যেমন তিনি লিখেছিলেন ও নগ্ন করে দিয়েছিলেন ‘সিস্টেম’কে তাঁর ‘৯৮৬৪৪’ গল্পে, ‘লিলিয়ান যা বলেছিল সেটা জানার আগে আমাদের একটু খেলার জুতোর সবচেয়ে বড়ো কোম্পানিগুলোর নাম জানা দরকার। অ্যাডিডাস, এলেস, ফিলা, নিউ ব্যালেন্স, নাইকি, পুমা, রিবক ও অ্যামব্রো। ১৯৬০-এর পরে বাজারে এলেও এখন এক নম্বর হচ্ছে 'নাইকি' যাদের বার্ষিক জুতো বিক্রির মোট মূল্য হল ৯.২ বিলিয়ন ডলার। ৮০ শতাংশ নাইকির জুতো খেলায় ব্যবহৃত হয় না। পরাটাই ফ্যাশন। বিশ্বের বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশে কনট্র্যাক্ট শ্রমিকরা এইসব জুতোর সিংহভাগ বানায়। ইন্দোনেশিয়াতে 'নাইকি' কোম্পানির শ্রমিকরা পায় দিনে ২.৬০ ডলার।
 ‘নাইকি'-র চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার ফিল নাইট এক বছরে যত টাকা কামান তত টাকা রোজগার করতে হলে একজন কনট্র্যাক্ট শ্রমিককে ৯৮,৬৪৪ বছর ধরে জুতো বানাতে হবে’।

নবারুণের এ-গল্পের সামনে দাঁড়িয়ে ক্রমশ স্বচ্ছ হয়ে আসে ইন্দোনেশিয়া থেকে সুইডেন পর্যন্ত (বা তাকেও অতিক্রম করে যাওয়া) রক্তে-ভেজা এক পথ। আর এর সঙ্গে সঙ্গে নবারুণ হয়ে উঠেছেন দ্বি’মুখী করাত, ‘রাজনৈতিক লেখা’ নামক অনেক শিশুতোষ লেখায় যেভাবে ডি-ক্লাসিফিকেশনের একমাত্রিক পথটিকে চিহ্নিত করা হয়, যে লেখায় মধ্যবিত্তের জীবনে পুঁজির ঘনিয়ে তোলা সংকটের দিকে দৃষ্টি দেওয়া হয় না (যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বলে মনেও করা হয় না, সম্ভবত) এবং যে সব লেখায় ‘যৌনতা’র বিষয়টিকে সযত্নে এড়িয়ে যাওয়া হয় নবারুণ সে লেখার থেকে বহুদূরে জ্বলে থাকা এক আগ্নেয়গিরি। দ্বিতীয়ত, তিনি ‘অন্য রকমের’ স্বপ্নসন্ধানী।

 


নবারুণের ‘জন্মদিন’-এ তাঁর গদ্যের ভুবন নিয়ে বিস্তারিত সন্ধান-প্রক্রিয়া নয় এটি; এটি মূলত এ এলোমেলো সফর তাঁর পৃথিবীর ভিতর দিয়ে।
এ-সফরকালে কানে বাজছে সেই বন্ধুর তীব্র যুক্তি, নবারুণ নাগরিক এবং নগর-জীবনে মধ্যেবিত্তের গুটিকয়েক সমস্যা... যা কোনওভাবেই পলিটিক্যাল ডিসকোর্স হয়ে ওঠার যোগ্য নয়... সেগুলি নিয়েই নাড়াচাড়া করেছিলেন নবারুণ!

নবারুণ যে শুধুমাত্র পোস্ট-সোভিয়েত যুগের মেট্রোপলিটনের প্রতিনিধিত্ব করতে জন্মাননি সে নিয়ে নিঃসংশয় হতে গেলে তাঁর কয়েকটি ছোট-গল্প পড়ে নিলেই হবে। কিন্তু যে কথাটা বলার, তলে তলে বিরুদ্ধতা ও সন্দেহের তীব্র দৃষ্টির পরেও নবারুণের জন্মদিনে আজও হাজার হাজার পাঠকের চোখের কোণ চিকচিক করে উঠছে কেন? তিনি নেই বলে? না কি তিনি বড্ড তীব্রভাবে আছেন, এ আশায় আনন্দের অশ্রু জমেছে তাঁদের চোখের কোণে?

আজ মনে হয় দু’টিই সমানভাবে সত্যি। তিনি ইচ্ছা করে গদ্যে বারুদ মিশিয়েছেন; অনেক সময়ে অস্বস্তি তৈরি করেছেন পাঠকের খোয়াব ভঙ্গ করতে। জুম-ইন, জুম-আউট করতে করতে, তুখোড় ফুটবলারের মতো ড্রিবল করতে করতে তিনি সময়-কে একবার সামনে থেকে, একবার পিছন থেকে দেখেছেন। ‘অলৌকিক’ ভাষ্যকারের মতো সদ্য রিলিজড হওয়া সিনেমা থেকে ট্রটস্কিজম পর্যন্ত প্রসারিত বধ্যভূমির বর্ণনা দিয়েছেন। এ নিদর্শন বাংলা সাহিত্যে সম-সময়ে বেশ দুর্লভ। নবারুণের গদ্য, বিশেষ করে তাঁর ছোটগল্প (এ গদ্যে উপন্যাসের কথা উল্লেখিত হল না ইচ্ছাকৃতভাবেই) আমার বা আমার মতো তাঁর হাজার হাজার পাঠকের কাছে ঠিক কী?

অন্যের অনুভূতির সন্ধান পাওয়া ও দেওয়া, বিশেষ করে নবারুণের বিষয়ে, বেশ বিপদজনক; কারণ লক্ষ করেছি ব্যক্তি-পাঠকের কাছে তিনি প্রিজমের মতো। ব্যক্তির কাছে তিনি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পৃথকভাবে ধরা দেন; তাঁর ক্ষেত্রে গ্রহণ ও বর্জন, স্বীকার ও অস্বীকারের হার তাই এত বেশি। তবে আমার কাছে তিনি ‘আমার কোনো ভয় নেই তো’ গল্পের শেষ প্যারাগ্রাফের মতো, ‘চাইনিজ রিভলভারটা সালমানকে রাখতে দিয়েছিল হরি দত্ত। হরি দত্ত জানত না। সালমানও জানত না। ওই মডেলের রিভলভারের ম্যাগাজিন খুলে নিলেও একটা গুলি চেম্বারে থেকে যায়। একাত্তর-বাহাত্তরে এরকম বেশ কিছু রিভলভার কলকাতায় এসেছিল’।
তিনি আমার কাছে ওই ম্যাগাজিন খুলে নিলেও থেকে যাওয়া একটা গুলির মতো; মাথার কাছে রেখে দেওয়া।

 এ মানুষের খুলি ভর্তি একদিন ডুববে, কমরেড।
ছোট ডিঙি-নৌকা থেকে সেদিন আকাশের সে গুলিটি ছুড়ে দেবে কেউ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন