ঊর্ণনাভ তন্তু ঘোষ
জীবনানন্দ দাশ, তাঁর কবিতায়, ১৯৪৬-৪৭ এ একটা প্রশ্ন রেখেছিলেন — 'সকলকে ফাঁকি দিয়ে স্বর্গে পৌঁছবে / সকলের আগে সকলেই তাই?' তা এই সকলকে মারিয়ে সকলের আগে স্বর্গে যাবার সাধ সমসাময়িক এবং পরবর্তী জেনারেশনের অনেক লেখকই বেশ কায়দা করে আয়ত্ত করতে পেরেছিলেন বৈকি। যেমনটা নীলকন্ঠ বাগচীর চোখে 'কাপুরুষ হয়ে পালিয়ে যাওয়ার মিছিল'। সময়ের উত্তাল স্রোতে দম-না-দেওয়া রিষ্ট ওয়াচের মতন আড়াআড়ি শুয়ে থেকে গা-বাঁচিয়ে সটকে পড়ার তাগিদ তাদের সেদিনও ছিল আজও আছে। আফটার অল পলিটিক্যালি কারেক্ট বলে যে একটা শব্দ আছে যেটা সভ্য সমাজে আজও ম্যাটার করে হুইচ কূড অফেন্ড পলিটিক্যাল সেনসিবিলিটিজ সূড বী এলিমিনেটেড।
অথচ পঞ্চাশের কলকাতায় চূড়ান্ত ভীতিপ্রদ ক্ষমতা দখলের চেহারা আমরা দেখলাম। দেখলাম, উপনিবেশবাদের গাম্বুটে পিষ্ট পরাজিত মানুষের ঘাড়ের ওপর কীভাবে ভাপবাষ্প ঢেলে দিতে হয়। এমন অবস্থা যেখানে বেঁচে থাকাটাই যেন অতিজীবিত পৃথিবীতে এক অস্বস্তিকর প্রশ্ন। আর এই অস্বস্তিকর প্রশ্ন, জীবনযাপনের সাবভারশন, অন্তর্লীন দ্বন্দ্বে যারা অনন্যোপায় ঘুরে দাঁড়ালেন, রাষ্ট্রের মুখোমুখি সওয়াল জানালেন, রাষ্ট্র তাঁদেরকেই চিহ্নিত করল একএকজন প্রোটাগনিস্ট হিসেবে। এইখানেই ট্রাপিজের উল্টোবাজি। হাইপারইরিটেটিভ স্পট। 'আমি আছি' অর্থাৎ অ্যাবসোলুট নাথিংনেসের আর কোনো জায়গা নেই আছে শুধু প্রশ্নচিহ্ন (?) — "একটা কুঁড়ি বারুদগন্ধে মাতাল করে ফুটবে কবে / সারা শহর উঠাল পাথাল ভীষণ রাগে যুদ্ধ হবে।" সার্ত্র যাকে বলেছেন একটি তীব্র আকাঙ্ক্ষার, স্বাধীনতার চাহিদামাত্র। কিন্তু কেমন এই স্বাধীনতা! কী এই চাহিদা! যা মানুষকে নির্মম নির্বিকার মেশিনগানের সামনে পেট্রলবোমা হাতে দাঁড় করিয়ে দেয়। ম্যান ইন হিজ ঔন ট্রান'সেনডানস। সবদিক দিয়ে পরাজিত, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মানুষের সীমাবদ্ধতা এই, অন্ধকারের ভিতর যখন আরও শাশ্বত অন্ধকার ছেয়ে আসে, স্বর্গ তছনছ হয়ে যায় তখনই বোধহয় জাতিঙ্গার দিশাহীন মৃত্যুগামী পাখিদের মতন আগুনে উল্কা খুঁজে নেয়। বিপ্লব জানিয়ে যায়।প্রতিনিয়ত পথকুকুরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মৃত্যুহীন বিড়ম্বনায় পিষ্ট মানুষের এইসব কান্না চিৎকার অনির্দিষ্ট যাপন ডিঙিয়ে যারা মোটরগাড়িতে চড়ে স্বর্গের জমি ক্রোক করেছেন তাদের এমন কৌলিন্য ইজ্জত বজায় থাকুক!
নবারুণ ভট্টাচার্য তাদের কেউ না। 'আমি সেই মানুষ যার কাঁধের ওপর সূর্য ডুবে যায়'। প্রান্তিক মানুষের পাশে, চাষার অবর্তমানে ফসলের পাহারাদার হয়ে যে মানুষটা একা আমৃত্যু দাঁড়িয়ে রাজনীতির কাকপক্ষীদের কাকতাড়ুয়া সেজে ভয় দেখান, তিনি নবারুণ ভট্টাচার্য। তাঁর জবাব— 'যখন একটা লোকের সাতশোটা লড়ি ভাড়া খাটে / আর একটা লোক ক্রাচ নিয়ে রাস্তা পার হয়...এই যদি সমাজ হয় তবে আমি সমাজবিরোধী'। শহরের মধ্যিখানে একগাদা নিচু জাতের লাশ, অন্ধকার গ্রামে মেশিনগানের জলন্ত তোতলামি এসব দেখেও যদি শহরের মানুষের, বুদ্ধিজীবীদের ঘুম না উড়ে যায় তাহলে তাদের 'বাঞ্চোত', 'শুয়োরের বাচ্চা' বলে ডাকলে সভ্য সমাজের কানে তা অশালীন ঠেকবে কেন?
তাঁর উদ্দেশ্য সোজা, বর্শার সূচীমুখের মতন সোজা। 'হারবার্ট', 'ভোগী' দেখলাম নৈরাশ্য এবং সিদ্ধান্তহীনতার অ্যাবসার্ড আইডিয়াগুলোকে কেমন স্পৃহায় পরিণত করে রাষ্ট্র ও ক্ষমতার দিকে ছুঁড়ে দিতে হয় তা বুঝিয়ে দিয়েছেন সভ্য সমাজের মাঝে ফ্যাতাড়ু, বিটিক্যাওড়াদের ঢুকিয়ে দিয়ে। কঙ্কালসার একটা সমাজ, স্বদেশ যেটা প্রকাশ্যে মানুষের চোখের ওপর পুড়ছে সেটা ধরিয়ে দিতে কোনো কসমিক অ্যাবসার্ডিটি, বেকেটীয় নীরবতা , নৈরাশ্যের দ্যোতনা অথবা এস্তাগনের মতো আলো আলেয়ার মাঝে সন্দিহান হয়ে কুঁকড়ে যেতে হয়না বরং সোজাসাপ্টা কথায় প্রান্তিক, নিম্নবর্গের মৌলিক স্বাধীনতার সওয়ালগুলো নির্ভীক কণ্ঠে চিৎকরে বলে দেওয়া যায়—
❝ যে কথাগুলো আমি বলব সেগুলো পুড়ে ছাই হয়ে উড়ে যাচ্ছে আর সেই গুঁড়ো গুঁড়ো কথার ছাই জলের ওপর পড়ছে, আপনাদের ইজ্জতের ওপর পড়ছে, আপনাদের সাফ চকচকে জুতোর ওপর পড়ছে, শহরের ওপর পড়ছে, খাবারের ওপর পড়ছে...আকাশের লালার সঙ্গে মিশে রোদ্দুরের ছবির ফলার ওপর মরচে হয়ে জমছে কথাগুলো, কিন্তু এর চেয়েও বড় সওয়াল থেকেই যায়... ইজ্জত আউর রুস্তমি কা সওয়াল...❞
এখন এই কাঁচা রক্তের গন্ধ দুধ ও ভাতের গন্ধ দিয়ে ঢাকা যায় সম্ভব? '৪+১' এ তাঁর চরিত্ররা উঠে এসে যখন প্রশ্ন করে — ওই মৃতদেহটি কার? তার নাম কি? তার কেউ আছে? কীভাবে সে মারা গিয়েছিল? ওই চারজন শববাহকের পরিচয় কি? — এখানেই উঠে আসে প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতির ন্যাংটা মুখোশ। অন্তঃসারশূন্য ন্যাংটা। ন্যাংটা! যে মানুষটা মৃত সে নয়, যার চোয়াল বুলেটে বিদ্ধ, সে তার অস্তিত্বের যাবতীয় সওয়াল করেছে বিস্ফারিত চোখদুটিতে। ও'দুটি বড় ছোঁয়াচে। মার্কস-এঙ্গেলসের চেয়েও ছোঁয়াচে। চোখদুটি উপড়ে গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দিলেও মহাকালের সীমান্ত হতে আপনাকে প্রশ্ন করবে — আপনি কে? আজ নয়তো দেড়শো বছর পরে জীবিত মানুষের এসি রুমের ছাদে, ব্যাঙ্কের লকারে, এলসিডির স্ক্রিনে, বান্ধবীর নিতম্বে, স্কাইস্ক্রাপারের উইন্ডস্ক্রীনে একদিন এইসব মৃত মানুষের চোখে চোখে ভরে যাবে বিস্ফারিত চোখে শুধু একটিই সওয়াল — আপনি কে?
❝ বোমা ফাটায় ধোঁয়ায় হাঁপাতে হাঁপাতে মুখের মধ্যে জলন্ত কয়লা নিয়ে ছোটে...সিসেতে ভারী হয়ে বিষিয়ে যায় লাশ। খুলি ফাটিয়ে, গলা চিরে, পেট ভুক ফেঁড়ে ফেলে ফাৎরা ফাই করে ফেলেছে মর্গের ফাড়াইবাবু। শেয়াল কুকুরে ছিঁড়ে খায় কাউকে; কিন্তু সওয়াল তারা ফিরিয়ে নেয়না।❞
এভাবেই একটা ফ্রাস্ট্রেশন আমাদের সাব-কনশাসে ঢুকে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। ভবিষ্যতে আরও শান্তি থেকে বঞ্চিত হবার অপেক্ষা আমাদের। আরও আনয়াইডেন্টিফায়েড ট্রমা। তখন ঘুম থেকে উঠে মৃত্যু যন্ত্রনার চেয়েও তীব্র চিৎকারে জানাব — আমি কেন জন্মালাম? মাতৃজঠরে বেশ ছিলাম। পৃথিবীর চূড়ান্ত সুখ, চূড়ান্ত শান্তি থেকে বঞ্চিত হলাম৷
'কাঙাল মালসাট' আরেকটি উপন্যাসে লিখছেন, 'এই বাঙালি ভবিষ্যতে ল্যাকটোজেন দিয়ে ভাত মেখে খাবে আর যৌবনে বগলে পাউডার দিয়ে সরকারি নন্দন চত্বরে গিয়ে ঝোপঝাড়ে ঠেক খুঁজবে। অথচ এই বাঙালিই হেভি মারাকু টাইপের ছিল'। এতটাই প্রতিক্রিয়াহীন নির্বিকার ও নিস্পৃহ হয়ে উঠছি আমরা। এই স্বভাবটাই একটা গোটা জাতিকে ঠেলে দিচ্ছে মৃত্যু মুখে। আর এখানেই উঠে আসে যত আপত্তি। সেই একই প্রশ্ন আবারও এভাবে ফুরিয়ে যাওয়া কি ভালো?
❝মানুষ যদি বিদ্রোহ করতে ভুলে যায়, তখন তাকে মনে করিয়ে দেওয়া কি পাপ?❞
Tags:
প্রবন্ধ
দারুণ সুন্দর লেখা। কবিকে শ্রদ্ধা ও কুর্নিশ...
উত্তরমুছুন