দোঁহা

প্রেম আর হাঁচির সমীকরণ

 


 আজব বুকশেল্‌ফ  [প্রথম কিস্তি]


ঋত্বিক মল্লিক


“হৃদয়ের নিভৃত অন্দরে প্রেমকে অবরুদ্ধ রাখার চেষ্টা করি, কিন্তু আচমকা হাঁচির মতো সেই প্রেম প্রকাশ হয়ে পড়ে।” আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে ‘ধর্ম’ আর ‘অর্থ’ সংক্রান্ত নীতিকাব্য লিখতে বসে গার্হস্থ্য জীবন আর দাম্পত্য নিয়ে এমন সব সমীকরণ তৈরি করেছিলেন তিরুবল্লুবর। তাঁর ‘কুরল’ কাব্যটিকে যতই ‘তামিল বেদ’ বলে প্রচার করা হোক, এই বইটি সংস্কৃত সাহিত্য ও সংস্কৃতির সমান্তরালে তামিল সংস্কৃতির এক বিশুদ্ধ প্রকাশ। আমরা যদিও ওই সব সিরিয়াস বিষয়ের মধ্যে ঢুকব না।

    ‘ধর্ম’ অংশে গৃহস্থ মানুষ আর তপস্বীর কথা আর ‘অর্থ’ অংশে রাজনীতির কথা বলার পর, যখন তিনি জীবনে প্রেমের কথা বলতে শুরু করেন, তখন তাঁর লেখার ধরনই যায় পালটে, মনে হয় এই অংশে ক্রমশই তিনি ঢুকে পড়ছেন এক বাস্তব প্রেমের গল্পে।

    এই গল্পে দেখা যায় কোনো এক নির্জন বাগানে এক পুরুষ দেখে ফেলেন এক নারীকে। আর দেখামাত্রই পুরুষটির মনে হয়, যে যমের কথা এতদিন তিনি শুনেছেন, সেই যম রীতিমতো রণকুশলীভাবে রয়েছে ওই নারীর দু-চোখ জুড়ে। ওই চকিত কটাক্ষেই যেন লেখা আছে পুরুষের চরম সর্বনাশ। প্রিয়দর্শনের যে আনন্দ, তা গোপন রাখেন তিরুবল্লুবর, বরং ক্রমশ সামনে নিয়ে আসতে থাকেন এমন এক তীব্র রোমাঞ্চকে। সে এমন এক মদকতা যা শুধু পান করলেই মাতাল হয় না, চোখে দেখলেও হয়—“মদের আনন্দ পানে, দেখায় নয়; কিন্তু এ নারীকে দেখেও আনন্দ।”

    কিন্তু নায়িকা যে দেখেও দেখেন না। কখনও আবার রুক্ষভাব দেখান। পুরুষটি কিন্তু জানেন, “যিনি ভালোবেসে ফেলেন, তাঁর মুখেই থাকে ঔদাসীন্যের মুখোশ।” তাই তাঁর মনে যে চারাগাছটির জন্ম হয়েছে তার উপরে আসলে জলবর্ষণ করছে এই অপরিচিতের মতো ব্যবহার আর রুক্ষভাব। তিরুবল্লবর মনে করিয়ে দেন “আন্তরিকতাশূন্য পরুষবাক্য আর বিরক্তিজনিত অপ্রসন্নতার ভাব প্রেমেরই চিহ্ন, তারা প্রত্যাখ্যানের অভিনয় করে, কিন্তু মনে গভীর প্রেম প্রকাশ করে।” এই নারীও সত্যিই হৃদয় হারিয়ে বসেছেন। তিনি মনে মনে ভাবেন যে এই পুরুষটি এমন ভাবে তাঁর চোখ জুড়ে বসে আছেন, যে কাজল পরতেও ভয় পান পাছে মুহূর্তের জন্যেও সে পুরুষ তাঁর চোখ ছেড়ে যান!

    দুজন ধরা পড়লেন দুজনের কাছে। তাঁদের ‘গুপ্ত বিবাহ’ হল। এই গুপ্ত বিবাহ গান্ধর্ব বিবাহের মতো। গোপনে বিয়ের কথা জানতে পারলেন না এঁদের আত্মীয়স্বজন। কিন্তু আচারে ব্যবহারে ফুটে উঠতে লাগল অস্বাভাবিকতা; গ্রামবাসীদের মধ্যেও শুরু হল নানা জল্পনা। এই জল্পনা আরও বাড়িয়ে তুলল তাঁদের মধ্যে মিলনের আগ্রহ। তাঁদের মনে হল এই জল্পনা এমন এক অমূল্য সম্পদ, এই জল্পনার কারণেই প্রিয়কে না পেয়েও যেন ‘পেয়েছি’ বলে মনে হয়। এই জল্পনা যেন এক তীব্র মদ যা পান করলে তেষ্টাই বাড়ে, নিবারণ হয় না। “যেমন ঘৃতাহুতি দিয়ে অগ্নি নির্বাপণ অসম্ভব, তেমনই লোকনিন্দা দ্বারা আমার বাসনার নিরোধও সম্ভব নয়।” তিরুবল্লুবর লিখেছেন, “অজ্ঞ জনগণের দ্বারা উৎক্ষিপ্ত এই পরিবাদ আমি ভালোবাসি। নিশ্চয়ই প্রিয়তমের কাছে আমার প্রার্থনা নিষ্ফল হবে না।”

    প্রেমের এমন সব গূঢ় কথা কী করে জানলেন কবি তিরুবল্লুবর! ‘বল্লুবর’ শব্দটার মধ্যে যে ‘বল্লবা’ কথাটা আছে, সেই বল্লবা জাতিকে অস্পৃশ্য জাতি হিসেবে ধরা হয়। আজ যে জায়গাটা চেন্নাই শহর, আড়াই হাজার বছর আগে, সেই জায়গারই কাছে মলয়াপুর গ্রামে তাঁর বাবা-মা আসেন এবং এখানেই কোনো-এক বাগানে তাঁর জন্ম হয়। তিনি এখানেই বড়ো হন এবং তাঁতি হিসেবে জীবন যাপন করেন। বিবাহ করেন বাসুকী নামে এক মহিলাকে। তাঁর বিবাহিত জীবন ছিল আনন্দের, গার্হস্থ্য জীবনের সুখে পরিপূর্ণ। তাঁর জীবনে বিরহের কোনো অভিজ্ঞতা ছিল বলে কেউ কখনও বলে নি। অথচ তিরুবল্লুবর এমন সব মান আর বিরহের কথা বলেন, যা তাঁর অনেক পরে লেখা বৈষ্ণব পদাবলিকে মনে পড়িয়ে দেয়।

তাঁর সময়ে তামিল দেশে গুপ্ত বিয়েকে প্রকাশ্যে আনার ক্ষেত্রে নায়ককে এক ভয়ংকর আচারের মধ্য দিয়ে যেতে হত। প্রেমিককে দারুণ শারীরিক কষ্ট স্বীকার করে এবং চূড়ান্ত অপমানকে মেনে নিয়ে অপেক্ষা করতে হত কখন সমাজ তাঁদের এই ধৃষ্টতা ক্ষমা করবে এবং এই গুপ্ত বিয়ের প্রতি সম্মতি জানাবে। কিন্তু তিরুবল্লুবর-এর নায়ক-নায়িকা এই ভাবেই মিলিত হয়েছেন এবং অতি আনন্দে জীবন কাটিয়েছেন। যদিও গল্পে, এরপরেই আসবে যুদ্ধে যাওয়ার ডাক। তীব্র বিরহ গ্রাস করবে দুজনকেই। বিদায়ের সময় নায়িকা বললেন, “তুমি আমাকে ছেড়ে গেলে আমার মৃত্যু নিশ্চিত। ফেরার কথা আমাকে বোলো না। এ কথা তাকেই বোলো যে ততদিন জীবিত থাকবে।” তিরুবল্লুবর মন্তব্য করেছেন, “অগ্নিকে স্পর্শ করলে তবে সে দগ্ধ করে, কিন্তু দূর থেকে দগ্ধ করে প্রেম।” গল্পে আছে, একদিন এই নায়ক ফিরে এলে দুজনের মিলন হয়।

    প্রথমে যে হাঁচির কথা বলেছিলাম, আবার ফিরে আসি সে প্রসঙ্গেই। হাঁচি আর প্রেম এক গভীর সমীকরণে বাঁধা পড়েছে এই কাব্যগ্রন্থে। হাঁচি মানেই যেন প্রেমের প্রকাশ এবং ভালোবাসার মানুষকে স্মরণ। এদিকে নায়ক ফিরে এসে নায়িকার কাছেই একবার হেঁচে ফেলেন। স্বভাববশত, নায়িকা দীর্ঘ আয়ুষ্কামনা জানালেও এই হাঁচিই তাঁর মনের কোণে ঘনিয়ে তুলল সন্দেহ। তাঁর মনে হল, প্রবাসকালে কোন্‌ নারীর সঙ্গে তৈরি হয়েছিল সম্পর্ক? কোন্‌ নারী এখন স্মরণ করছে তাঁর নায়ককে, যার জন্যই এই হাঁচি? শুরু হয়ে গেল এক কল্পিত বিচ্ছেদজনিত মানপর্ব। বড়ো সুন্দর আর মধুর সেই আপাতবিচ্ছেদের মুহূর্তগুলো।

    ‘কুরল’ পড়তে পড়তে পাঠক একসময় ভুলে যাবেন যে এটি মূলত একটি নীতিকাব্য। অন্যান্য নীতিকাব্যে মানুষের জীবনের কঙ্কালটা পড়ে থাকে, চতুর্দিকে নেচে বেড়ায় কঠোর উপদেশ আর অনুশাসন। আর তিরুবল্লুবরের লেখা পড়লে মনে হয় ‘জীবন-সংসার’ বিষয়টা খুব একটা উপেক্ষা করার মতো নয়, সহজ-কঠিন দ্বন্দ্বে-ছন্দে বেশ উপভোগ্য, মশলাদার। মহর্ষি চমন নাকি চিন্তা করার সময়ে লেখনী দিয়ে নিজের মাথায় আঘাত করতেন। সেই ব্যাপারে কটাক্ষ করে এক বৈদ্যশাস্ত্রী বলেছিলেন যে, মধুর সঙ্গে এক বিশেষ লবণ আর শুকনো আদা মিশিয়ে খেলেও যাঁর শিরঃপীড়া কমে না, তিরুবল্লুবরের লেখা পড়ে সেই চমনেরও মাথা ব্যথা কমে যায়।

    চমনের মতো না হলেও জীবন এখন আমারও শিরঃপীড়ার কারণ। কলকাতার ধুলো-ধোঁয়ায় মাথার যন্ত্রণা হয়, মাঝে মাঝেই অ্যালার্জির কারণে প্রবল হাঁচি হয় আর তখুনি মনে পড়ে — “হাঁচি এসেছিল, কিন্তু হঠাৎ থেমে গেল। এ যেন আমার জীবন-সর্বস্ব আমাকে মনে করতে করতে হঠাৎ ভুলে গেলেন।” আমার অ্যালার্জির হাঁচি অবশ্য থামে না। তার মানে কি আমার জীবন-সর্বস্ব সর্বদাই আমাকে মনে করেন? কে জানে…


কুরল
কবি তিরুবল্লবর
নলিনীমোহন সান্যাল (অনুবাদ)
জিজ্ঞাসা পাবলিশিং হাউস, কলকাতা


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন