দোঁহা

দেশভাগ: কারণ ও তার প্রভাব



বোধিব্রত সেনগুপ্ত

১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট ভারতবাসীকে পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্ত করলেও দেশভাগ বিপুল সংখ্যক জনগণের মনে যে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছিল, এখনও তা মানুষের মন থেকে মুছে যায়নি। এই দেশভাগ অনেকেই মেনে নিতে পারেন নি। বিশেষতঃ যারা জমিদার শ্রেণীর বা উচ্চবিত্ত অবস্থাপন্ন ছিলেন, মুসলমান প্রজাদের অত্যাচারে প্রাণভ­য়ে ভিটেমাটি ছেড়ে নিঃস্ব অবস্থায় এদেশে চলে আসেন। স্বভাবতই তাদের মনে মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষ এখনও রয়ে গিয়েছে। আবার একশ্রেণীর মানুষ এর জন্য ইংরেজদের শাসননীতি এবং কংগ্রেসের ভূমিকা বিশেষ করে নেহেরু, গান্ধীজীর ভূমিকাকে দায়ী করেন।

প্রকৃতপক্ষে, দেশভাগের বীজটা রোপন করা হয়েছিল বঙ্গভঙ্গ আইনকে কার্যকর করার মধ্য দিয়ে। উনিশ শতকের বিদেশী শাসনের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন সংগঠিত হয় তা মূলত কলকাতা কেন্দ্রিক এবং উচ্চবর্ণের হিন্দুদের দ্বারা পরিচালিত। এই আন্দোলনকে দুর্বল করার লক্ষ্য এই বিভাজনের পরিকল্পনা করা হয়। প্রশাসনিক অসুবিধা ছিল একটা অজুহাত মাত্র।
 
১৮৯৬ সালে চট্টগ্রামের কমিশনার ওল্ডহাম প্রস্তাব করেন যে, মুসলমান অধ্যুষিত পূর্ববঙ্গকে পৃথক করলে পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুদের আধিপত্য অনেকটাই খর্ব হবে। কয়েকবছর পর ফ্রেজারও একই ধরনের প্রস্তাব দিলে লর্ড কার্জনের কাছে তা গ্রহণযোগ্য মনে হয়।
 
প্রস্তাবে বলা হয়, বাংলার রাজশাহী, ঢাকা ও চট্টগ্রাম এবং আসাম নিয়ে নতুন প্রদেশ 'পূর্ববঙ্গ' ও 'অসম' গঠিত হবে যার রাজধানী হবে ঢাকা এবং প্রেসিডেন্সি বিভাগ, বিহার ও ওড়িশা নিয়ে গঠিত হবে অপর একটি প্রদেশ যার রাজধানী হবে কলকাতা। ১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর একটি নোটিফিকেশনের মাধ্যমে জারি করা হয় এই আদেশ।
 
ইংরেজ প্রশাসকরা প্রশাসনিক সুবিধার কারণ দেখালেও এর পেছনে লুকিয়ে ছিল এক গভীর ষড়যন্ত্র। এই আদেশ কার্যকর হলে প্রথম প্রদেশে হিন্দুরা হবে ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং দ্বিতীয় প্রদেশে বাঙালী ভাষাভাষী হিন্দুরা হবে সংখ্যালঘু।
 
কংগ্রেস এই আদেশের তীব্র বিরোধিতা করে। সারাদেশে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন শুরু হয় এবং ধীরে ধীরে তা তীব্র আকার ধারণ করে। সর্বত্র মিটিং, মিছিল, বিদেশী দ্রব্য বয়কট এবং সন্ত্রাসের সৃষ্টি হয়। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধির ফলে দেখা দেয় অর্থনৈতিক সঙ্কট-যা এই আন্দোলনে এক নতুন মাত্রা এনে দেয়।
 
প্রথমদিকে মুসলমান সম্প্রদায়ের লোকেরা এই আন্দোলনে যোগ দিলেও ক্রমে এই আন্দোলন হিংসা ও হিন্দুত্ব দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার ফলে মুসলমান সমাজের আস্থা হারায়। মুসলিমদের একটি বড় অংশ নিজেদের এই আন্দোলন থেকে সরিয়ে নেয়।
 
অক্টোবর মাসে বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হলে সরকারকে সহযোগিতা করবার জন্য গঠিত হয় 'মহামেডান প্রভিন্সিয়াল অ্যাসোসিয়েশন' এবং ৩০শে ডিসেম্বর ঢাকায় গঠিত হয় 'অল ইণ্ডিয়া মুসলিম লীগ'। এই দুই সংগঠনই বঙ্গভঙ্গ সমর্থন করে এবং বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের তীব্র নিন্দা করে প্রচার চালায়।
 
দুই সম্প্রদায়ের এই পরস্পর বিরোধী আন্দোলন ক্রমশ প্রকট হয়ে পড়ে, হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের অবনতি হয় এবং দিকে দিকে দাঙ্গা বেঁধে যাবার ফলে শান্তি-শৃঙ্খলার চরম অবনতি ঘটে।
 
পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে লর্ড হার্ডিঞ্জ প্রদেশ পুনর্গঠনের পরিকল্পনা করে প্রস্তাব পাঠালে তা ব্রিটিশ কাউন্সিল দ্বারা গৃহীত হয়। ১৯১১ সালের ১২ই ডিসেম্বর বঙ্গভঙ্গ প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।
 
বঙ্গভঙ্গ রদ হয়ে গেলেও ভারতবর্ষের হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কে ফাটল ধরাতে ইংরেজরা সফল হয়েছিল। এই দুই সম্প্রদায়ের মিলিত শক্তি যে তাদের শাসনকার্যে প্রধান বাধা হয়ে উঠেছিল সেটা শাসকরা বুঝতে পেরেই যে এই পদক্ষেপ নিয়েছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
 
১৯৩৭ সাল থেকেই পাকিস্তান জন্ম নেওয়ার বীজ রোপিত হয়। মুসলিম লীগকে উত্তরপ্রদেশে ব্রাত্য করে কংগ্রেস বুঝিয়ে দেয় তারাই মুসলিম সমাজের একমাত্র প্রতিনিধি নয়।
 
ইংরেজ শাসকরা দেশভাগের দায় নিতে চাননি। সেই কারণে ২১ শে আগস্ট ১৯৪৫, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অ্যাটলি ঘোষণা করেন যে, স্বাধীন ভারতের সংবিধান রচনার জন্য একটি কনফারেন্স আহ্বান করা হবে। তার প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক বিধানসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ১৯৪৫ ও ১৯৪৬ সালে নির্বাচনগুলি সম্পন্ন হয়। নির্বাচনে কংগ্রেস পূর্ণ স্বরাজ এবং অখণ্ড ভারতের দাবিতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেও হিন্দুমহাসভা ও মুসলিম লীগ সাম্প্রদায়িক স্বার্থের দাবিতে অংশগ্রহণ করে।
 
১৯৪৬ সালের ১৬ই মে ক্রিপসের নেতৃত্বে সিমলার সম্মেলনে প্রস্তাব দেয় -গোটা দেশকে তিনটি জোনে ভাগ করতে। প্রত্যেকটি জোনে কতগুলি স্টেট থাকবে এবং থাকবে কেন্দ্রীয় সরকার, যেগুলি কনস্টিটিউশন দ্বারা পরিচালিত হবে। কংগ্রেস এই প্রস্তাব মানতে রাজী হলেও মুসলিম লীগ এই প্রস্তাব না মানায় আলোচনা ভেস্তে যায়।
 
অবশেষে, ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট মধ্যরাতে গণপরিষদের বিশেষ অধিবেশনে লর্ড মাউন্টব্যাটেন ক্ষমতা হস্তান্তরের বা স্বাধীনতার ঘোষণা করেন।
 
ইতিপূর্বে ১৯৪৭ সালের ২৩শে জুন, লর্ড মাউন্টব্যাটেন ব্রিটেনের শ্রমিক সরকারের অনুমোদন নিয়ে ভারত ভাগের যে পরিকল্পনা করেন তার প্রথম শর্ত ছিল মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকার লোকেরা চাইলে পৃথক রাষ্ট্র গঠন করতে পারে তবে সেক্ষেত্রে বাংলা এবং পাঞ্জাব বিভক্ত হবে। এখানে উল্লেখনীয় যে, জিন্না প্রাথমিক স্তরে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় স্বায়ত্ব শাসন চাইলেও ১৯৩৭ সালের পর থেকেই আলাদা রাষ্ট্রের দাবিতে অনড় থাকেন।
 
দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে অখণ্ড ভারত ভেঙ্গে দু-টুকরো হয়ে যায়। আসলে এই দেশভাগ ছিল সহিংস দেশভাগ। লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু এবং কয়েকলাখ মানুষের নিজস্ব বাড়িঘর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছোটা এই বিভাজনকে কলঙ্কিত করেছিল। সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে অনৈক্য ও অবিশ্বাসের যুক্তি দিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের জন্ম।
 
শুধু সাম্প্রদায়িকতাই নয় দেশভাগের পর থেকেই শুরু হয় কাশ্মীর নিয়ে দ্বন্দ্ব। যা আজও চলছে এবং দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। তিন তিনবার যুদ্ধ হয়েছে দুদেশের মধ্যে এবং এই সীমান্ত প্রদেশে হিংসা আজও অব্যাহত। আন্তর্জাতিক স্তরেও এর রেশ ছড়িয়ে পড়েছে। চীন ও বিভিন্ন বৈদেশিক শক্তি এর লাভ তুলতে চেয়েছে। প্রতিরক্ষা খাতে প্রচুর পরিমানে অর্থব্যয় দেশের আর্থিক ও বিভিন্ন উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছে। প্রাণহানি এক নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
 
অপরদিকে সংখ্যালঘুরা নিরাপত্তা হীনতায় ভোগার দরুন ভারতবর্ষে এসে আশ্রয় নেওয়াতে জনসংখ্যার বৃদ্ধি ঘটছে এবং সীমান্তবর্তী এলাকায় অসামাজিক কার্যকলাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
 
কৃষি, শিল্প, যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সাধারণ মানুষের উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে এবং রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক ইস্যুকে হাতিয়ার করে সুযোগ সন্ধানী মানুষ ও রাজনৈতিক নেতারা তার ফায়দা লুটছে।
 
ভারত বিভাজন ভারতীয় সমাজ, রাজনীতি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কে এক সুদূরপ্রসারী ছাপ ফেলেছে। এই বিভাজন ছিল হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের ফলস্বরূপ। লক্ষ লক্ষ মানুষের সহিংস বাস্তুচ্যুতি, নিরাপত্তা হীনতার উত্তরাধিকার ও ভীতি তৈরী করে যা আজও ভারতীয় সমাজকে প্রভাবিত করে চলেছে। দুই দেশের মধ্যে চলমান সংঘাত পারমানবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা অবধি পৌঁছে গিয়েছে। সর্বোপরি ধর্মীয় বিভেদ বা সাম্প্রদায়িকতার এক কলুষপূর্ণ ফলাফল হল দেশভাগ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন