দোঁহা

দেশভাগ এবং একটি অসাম্প্রদায়িক প্রশ্ন

 


 অভিজিৎ দাশগুপ্ত

সালটা ১৯৪০-এর ২২ শে মার্চ। মুসলিম লীগের ২৭ তম অধিবেশন। অধিবেশনের স্থান লাহোর। সেদিন মহম্মদ আলি জিন্নাহ তাঁর সভাপতির ভাষণে হিন্দু ও মুসলমান যে দুটো আলাদা জাতি সে নিয়ে বিস্তারিত বক্তব্য রাখেন। তিনি দুই জাতির ধর্ম, দর্শন, সামাজিক প্রথা, সাহিত্য, শিল্প-সংস্কৃতির পৃথক রূপকে তুলে ধরেন। তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গি সেদিন পরিষ্কার করে দেয় পরবর্তী সময়ের ভারতবর্ষের ইতিহাসকে।

এখন প্রশ্ন, দেশভাগ হওয়ার আগে এবং পরে যে বিরাট এক সংকটের জন্ম হল ভারতীয় উপমহাদেশে, তার দায়িত্ব কার? এই দায়িত্বের শিরোভাগে যেমন মুসলিম লীগ রয়েছে, তেমনি আছে ভারতের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলি এবং বড়লাট লর্ড মাউন্টব্যাটেন।

মাউন্টব্যাটেন ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়াকে এক বছর এগিয়ে এনেছিলেন কিছুটা নিজের স্বার্থে। অমলেশ ত্রিপাঠী তাঁর 'স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস'(১৮৮৫ - ১৯৪৭) গ্রন্থে লিখছেন-"তাঁদের মনে হয়েছিল অবস্থা এমনই অগ্নিগর্ভ যে দ্রুততর ক্ষমতা হস্তান্তর ছাড়া তা সামাল দেওয়া যাবে না। কংগ্রেস চাপ দিচ্ছিল তখনই অন্তর্বর্তী সরকারকে ডোমিনিয়ান স্বীকার করা হোক...এখানেই উচিত ছিল তাঁর (মাউন্টব্যাটেন) কংগ্রেসকে বুঝিয়ে বলা যে সীমানা নির্ধারণে সময় লাগবে। হিন্দু, মুসলিম, শিখ সবাইকে বুঝিয়ে তবে দেশভাগ করা সম্ভব। যদি না বোঝে, তবে জনহস্তান্তরের ব্যবস্থা করতে হবে। অতএব ১৯৪৮–এর জুন পর্যন্ত কিছু করা যাবে না।" কিন্তু এখানেই প্রশ্ন, মাউন্টব্যাটেন কেন তা এক বছর এগিয়ে এনে ৪৭-এ ক্ষমতা দিয়ে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। অমলেশ ত্রিপাঠী তারও উত্তর দিয়েছেন। আসলে রয়্যাল নেভিতে ফিরে যাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়েছিলেন বড়লাট। সেই উচ্চাকাঙ্খা থেকেই তিনি লক্ষ লক্ষ ভারতীয়কে দেশ বিভাগের যন্ত্রণা মাথায় নিয়ে চিরতরে হারিয়ে যেতে দেখেও নিশ্চুপ ছিলেন। নিশ্চুপ ছিলেন লক্ষ লক্ষ মানুষের অসহায় কান্না আর হাজার হাজার নারীর অপহৃত হওয়ার সংবাদেও।

দেশ বিভাগের ফলে সৃষ্টি হয়েছিল নানাবিধ সমস্যা। তার মধ্যে একটি অবশ্যই উদ্বাস্তু সমস্যা। দেশ বিভাগ জনিত এই যে উদ্বাস্তু সমস্যা তা কি শুধুই ধর্ম নির্ভর ছিল! পূর্ব সীমান্তের ক্ষেত্রে আলাদা হলেও পশ্চিম সীমান্তের ক্ষেত্রে কিন্তু তার সঙ্গে মিশেছিল সম্পদের একটি বিরাট প্রশ্ন চিহ্ন। কয়েক শত বছরের ক্ষমতার লড়াই, ভালো গম আর সেচ অঞ্চল ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়া ইত্যাদি বিষয়গুলি এই অঞ্চলের মানুষের পক্ষে ছিল যন্ত্রণাদায়ক। পশ্চিম সীমান্তের এই উদ্বাস্তু সমস্যার মধ্যে একটি ঘটনার কথা অবশ্যই স্মরণীয়। ১৯৪৮ সালের ১২-ই জানুয়ারি গান্ধীজী দিল্লিতে অনশন করছিলেন। তিনি সেই অনশন ভঙ্গের শর্ত দিয়েছিলেন এমনটা, যেসব মুসলমান দিল্লি ছেড়ে পাকিস্তানে গেছে তাদের আবার ফিরিয়ে এনে পুরানো ঘরবাড়িতেই পুনর্বাসন দিতে হবে। কিন্তু এ দাবি যে অসম্ভব এবং অবাস্তব তা সেদিন সকলেই বুঝেছিলেন। কারণ মুসলমানদের ফিরিয়ে এনে তাদের পূর্বের পরিত্যক্ত ঘরবাড়িতে পুনর্বাসন দিলে আজ যারা আশ্রয়প্রাপ্ত হয়ে আছে অর্থাৎ হিন্দু ও শিখ, সেই উদ্বাস্তুদের তাহলে ঘরছাড়া করতে হয়। সুতরাং গান্ধীকে বোঝানো শুরু হয় এবং শেষ পর্যন্ত তিনি ছটি শর্তে অনশন ভঙ্গ করেছিলেন। যার একটি হল; ভাঙা দরগা সারিয়ে দিতে হবে এবং মুসলমানরা বসবাস করত যে সমস্ত জায়গায়, সেখানে তাদের পুনর্বাসন দিতে হবে। আর মুসলিম উদ্বাস্ত নিয়ে যে ট্রেন যাচ্ছে তার উপর আক্রমণ করা চলবে না। পশ্চিমাঞ্চলের মুসলিমদের জন্য গান্ধীর এই ভূমিকা পরবর্তীকালে কংগ্রেসের অন্যান্য নেতাদের ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলেছিল, বলা যায়। তা না হলে পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত শরণার্থীদের যে সমস্ত সাহায্য এবং পুনর্বাসন দেওয়া হয়েছিল, তার মধ্যে পার্থক্য ছিল এতটাই বিরাট যে তাকে 'আকাশ-পাতাল' বললেও অত্যুক্তি হয় না।

এ বিষয়ে তপন কুমার দাস তাঁর 'সাংবাদিকের চোখে উদ্বাস্তু' প্রবন্ধে বিস্তারিত তথ্য দিয়েছেন। "১৯৭৩ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত পূর্ব বঙ্গের উদ্বাস্তুদের জন্য ৮৫ কোটি টাকা খরচ হয় যখন পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্বাস্তুদের জন্য ১১৫ কোটি টাকা খরচ হয়েছিল। কিন্তু পূর্ববঙ্গে ফেলে আসা সম্পত্তির জন্য পূর্বোক্ত উদ্বাস্তুদের কোনরকম ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়নি…পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্বাস্তরা ১৯৭১ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত ২০১ কোটি টাকা পর্যন্ত এই ক্ষতিপূরণ পেয়েছে। এর মূল কারণ হিসেবে উল্লিখিত আছে যে, ১৯৫০ সালের নেহেরু-লিয়াকত আলি চুক্তি অনুসারে পূর্ববঙ্গ থেকে আগত উদ্বাস্তুরা মূলত পূর্ববঙ্গে ফেলে আসা সম্পত্তির তাত্ত্বিক অধিকারী ছিল। এই চুক্তির দ্বিচারিতা হয়েছে—পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তুরা কিছুই পায়নি অথচ যারা এখান থেকে গেলেন তারা সবই পেলেন।"('বহুস্বরে উদ্বাস্তু সত্তায় বাঙালি'। পরিকল্পনা ও চিন্তন রূপকল্প এবং সম্পাদনা: সৌমেন চক্রবর্তী)

তাহলে কি দাঁড়াল! পশ্চিম পাকিস্তানি উদ্বাস্তুদের বিভিন্নভাবে সাহায্য করতে সেদিন খরচ হয়েছিল প্রায় ৪৭০ কোটি টাকা। অথচ পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তুদের জুটে ছিল মাত্র ৮৫ কোটি টাকা। সদ্য স্বাধীন হওয়া সরকারের এই সিদ্ধান্তের পেছনেও ছিল এমন একটি অভিমত যা নেহেরুকে সুখী করেছিল, বলাই বাহুল্য। অধ্যাপক প্রফুল্ল চক্রবর্তীর 'দি মার্জিন্যাল মেন' গ্রন্থে রয়েছে, পূর্ব পাকিস্তান সফর করে এসে প্রফুল্ল ঘোষ নেহেরুকে একটি মেমোরেন্ডাম পাঠান। তাতে তিনি লিখেছিলেন, বাঙালি উদ্বাস্তুগণ পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতির পরিবর্তন হলেই তাদের পরিত্যক্ত গৃহে ফিরে যাবার যৌক্তিকতা মেনে নেবে।( তথ্যসূত্র:  তপন কুমার দাস)। প্রসঙ্গত বলা যায় ১৯৪৮ সালের এপ্রিল মাসে ইন্টার ডোমিনিয়ন  কনফারেন্স ডাকা হলে, সেখানে নেহেরু পার্লামেন্টে বলেছিলেন, "সরকার অবহিত আছে যে পূর্ব-বাংলা থেকে পশ্চিমবঙ্গে বেশ কিছু শরণার্থী এসেছে। কিন্তু এইভাবে দেশান্তর বাঞ্ছনীয় নয় এবং এই কাজে উৎসাহ দেওয়া ঠিক নয়— কারণ এতে শরণার্থীগণকে বহু ক্লেশ ভোগ করতে হবে…।" আর এই ধরনের মন্তব্যই (প্রফুল্ল ঘোষ, নেহেরু) সেদিন হয়তো বা পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তুদের জন্য খরচের পরিমাণকে কমিয়ে দেয়। ফলে যা হবার ছিল তাই হল। রাইটার্স বিল্ডিং-এ পূর্বাঞ্চলীয় পুনর্বাসন মন্ত্রীদের সভায় কেন্দ্রীয় পুনর্বাসন মন্ত্রী মোহনলাল শাকসেনা একটি কথা ঘোষণা করেন— "নতুন উদ্বাস্তুদের সম্পর্কে আমাদের দায়িত্ব কেবল ত্রাণকার্যে সীমাবদ্ধ থাকবে তাদের জন্য পুনর্বাসনের কোন ব্যবস্থা হবে না।" ('পশ্চিমবঙ্গে শরণার্থী সমস্যা', অনিল সিংহ)।

এবার সেই শুরুর প্রশ্নে আসা যাক। দেশভাগ কি সত্যিই অনিবার্য ছিল? অনেকেরই মত, কংগ্রেস যদি বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী শক্তিকে এক করে ১৯৪৬ সালে এক ব্যাপক গণ আন্দোলন শুরু করত, তাহলে হয়তো এই বিভাজন আটকানো যেত। আসলে কংগ্রেস তখন কিছুটা পিছনে সরে আসে। তারা 'কৃষক-মজুর শ্রেণীর নানা ন্যায্য দাবি মেটাতে অসম্মত বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনায় জড়িয়ে পড়ে' এবং তাতেই সময় অনেকটা নষ্ট হয়, যা শেষ পর্যন্ত দেশকে চরম ক্ষতির মুখে ঠেলে দেয়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন