দোঁহা

পূর্ণেন্দু পত্রী । অগ্রন্থিত প্রবন্ধ সংগ্রহ

প্রচ্ছদ পরিকল্পনা: শর্মিলী মোস্তফী

শুভদীপ সাহা


বহুমুখীতা শিল্পকে উৎকর্ষ দান করে। যদিও তা শিল্পীর ক্ষেত্রে অন্তরায়, এ কথা নিঃসঙ্কোচে বলা যায়। শিল্পের নানা ক্ষেত্রে সমান পারদর্শীতা সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথকে আমরা যেমন কবি, সুরকার, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক বা বড়োজোর নাট্যকারের ভূমিকাতে রাখি। অথচ অঙ্কনশিল্পী রবীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গ সেখানে আসে না। তেমনভাবেই সত্যজিৎ রায়। মূলত পরিচালক। আরেকটু এগোলে ইলাস্ট্রেটর। অথচ, ‘রাজ্যে রাজ্যে পরস্পরে দ্বন্দ্বে অমঙ্গল, তোরা যুদ্ধ ক’রে করবি কী তা বল !’-এর স্রষ্টা একজন দুর্দান্ত সঙ্গীতকার, সে প্রসঙ্গ লিখতে গেলে ‘অন্য আঙ্গিকে’ ধরা দেন সত্যজিৎ।
আমাদের এই দুঃখ কিছুটা ঘুচিয়েছেন পূর্ণেন্দু পত্রী। তাঁকে নিয়ে আলোচনা করতে গেলে কোনো নির্দিষ্ট ‘ফ্রেম’-এ তাঁকে ধরা যায় না। পূর্ণেন্দু বললেই একইসাথে কবি, ছড়াকার, প্রচ্ছদশিল্পী, অক্ষরশিল্পী, ক্যালিগ্রাফার, ইলাস্ট্রেটর, পেন্টার, প্রাবন্ধিক, সমালোচক, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, চলচ্চিত্র পরিচালক, কলকাতা সৃষ্টির ইতিহাস সংক্রান্ত বিষয়ের গবেষক সত্ত্বা প্রকট হয়ে ওঠে।
পূর্ণেন্দুর অন্যসত্ত্বাকে আপাতভাবে সরিয়ে রেখে আমরা আজ প্রাবন্ধিক পূর্ণেন্দু পত্রীকে নিয়ে আলোচনা করবো। আরও স্পষ্টভাবে বললে তাঁর লেখা ১৭ টি প্রবন্ধ, যা বিভিন্ন সময়ে নানা পত্রপত্রিকায় ছাপা হলেও কখনও দু’মলাটে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। পূর্ণেন্দু পত্রীর নব্বইতম জন্মদিনের প্রাক্কালে, ২০২১-এর ফেব্রুয়ারী মাসে এই আশ্চর্য বইখানি আমার হাতে আসে।

আশ্চর্য বলার একটা কারণ যদি হয়, এই প্রায় হারিয়ে যাওয়া লেখার পুনরুদ্ধার এবং যথাযথ সংরক্ষণ অন্য আরেকটি কারণ অবশ্যই বিষয় বৈচিত্র্য – বহুমুখীতা। বিষয়ের প্রেক্ষিতে মূলত চারভাগে ভাগ করা হলেও (চলচ্চিত্র, সাহিত্য, ভ্রমণ এবং বিবিধ) বিষয়ের গভীরে যখন যাওয়া যায় তখন লক্ষ করা যায়, কোনো নির্দিষ্ট ‘ছক’-এ ফেলা যায় না লেখাগুলোকে – পূর্ণেন্দুর মতোই লেখনগুণেই তা বিষয়ের সীমাকে অতিক্রম করেছে।
বইয়ের একটি ধারণা দেওয়ার জন্য আমি বইয়ের বিষয়গুলোকে তুলে নিচ্ছি এই লেখায়।

(প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ‘অশ্লীলতা অথবা চুম্বন অথবা নগ্নতার পক্ষে’ এই লেখাটি যদিও এক অর্থে ‘অগ্রন্থিত’ নয়, নিতান্ত ভুলবশত লেখাটি এই বইতে ছাপা হয়ে গেছে, তবুও কিছু কিছু ভুল ভালোই। এ প্রাপ্তি আমাদের। যে বইতে এই লেখাটি ছাপা হয়েছিল, সেই বইটি গত চল্লিশ বছর ধ’রে অমিল। ভুলবশত হলেও, এই লেখাটিকে এই বইতে সংরক্ষণ করার জন্য ধন্যবাদ জানাই সম্পাদককে।)

এখানে যদি সত্যজিৎ সম্পর্কিত তিনটি লেখা নিয়ে বসি, প্রথমেই চোখে পড়বে একজন শিল্পীর প্রতি আরেকজন শিল্পীর সম্মানজ্ঞাপন – আজকের দিনে যা বিরল। সমসাময়িক এক শিল্পীর প্রতি পূর্ণেন্দু প্রকাশ করছেন তাঁর মুগ্ধতা, ভালোবাসা, বিস্ময়; প্রয়োজনে সমালোচনা করছেন, যে সমালোচনায় অসূয়ার লেশমাত্র নেই। তাঁর লেখা থেকে আমরা জানতে পারছি, কীভাবে সত্যজিৎবাবুকে ‘যোগ্য’ সম্মানে ভূষিত করা যায়, যা দেখে যেন তিনিও মুগ্ধ হন, সেই ভাবনায় পূর্ণেন্দু তৈরী করছেন আদি-অনন্তকালের ছাপ রেখে যাওয়া মানপত্র। বইপাড়ায় পোকার দাগে পথরেখা তাঁর ভাবনায় উঠে আসছে মানপত্রে – তৈরি হচ্ছে নতুন শিল্প। আমরা অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করি তা। সত্যজিতের রেখাচিত্র নিয়ে আলোচনা যখন করছেন, আমরা টের পাই, পূর্ণেন্দু আমাদের পথ দেখাচ্ছেন, চেনাচ্ছেন। সত্যজিতের রেখাচিত্র নিয়ে আলোচনা করার যোগ্যতম ব্যক্তি যদি কেউ থেকে থাকেন তা পূর্ণেন্দু পত্রী, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। প্রয়োজনে কঠোর সমালোচনা করছেন আবার আমরা টের পাচ্ছি, ভালোলাগায় ভরে যাচ্ছে, যখন দেখছি অন্য কেউ সমালোচনা করতে এলে পূর্ণেন্দু সঙ্গে সঙ্গে সত্যজিতের পক্ষ নিচ্ছেন, যেন সমালোচনা করার সব অধিকার আমাদের আছে। অন্য কারোর নয়।   

পথের পাঁচালী দেখে এসে মুগ্ধকর সারারাত জাগা, পরশপাথরের পোষ্টার দেখতে ছুটে যাওয়া এবং তা ব্যক্ত করা, আজকের দিনে বিরল - পূর্ণেন্দুর লেখার মতোই।

‘ছবি করতে এসে’ যে ঝামেলা তাঁকে পোয়াতে হয়েছে সেখান থেকে সেই সময়ের ছবি করিয়ে-দের এক দুর্ভোগের রেখাচিত্র আমরা পাই। ‘ছোট বকুলপুরের যাত্রী’ যেমন আমাদের নানা ঘটনার সামনে দাঁড় করায় তেমনই এই বইতে আমরা পেয়ে যাই চিত্রনাট্যকার পূর্ণেন্দু পত্রীকে। অবাক হয়ে দেখি চিত্রনাট্য রচনায় তাঁর মুনশিয়ানা। শুধু লেখার টানে দৃশ্যকল্প তৈরী করেন তিনি। ছেলেমানুষী সুলভে স্বীকার করে নিচ্ছেন প্রথম রঙিন ছবি করার অভিজ্ঞতায় – লিখছেন, ‘রঙ সামলানো কী কঠিন !’। আবার অসহায় লাগে যখন জানতে পারি ‘ফিল্ম ফিনান্স কর্পোরেশন’-এর খামখেয়ালীপনার কথা। আবার শিখি, এই খামখেয়ালীপনাকেই তিনি ‘পজিটিভলি’ নিচ্ছেন। এক্সপেরিমেন্ট করছেন হ্যাজাকের আলোয় শ্যুটিং ক’রে – যে শ্যুটিং-এ খরচ হ’ত ছ’হাজার টাকা, শ্যুটিং শেষে তার বিল আসছে ৭৫ টাকা!

এক্সপেরিমেন্ট।
নানারকম পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়ে যাওয়া।
পূর্ণেন্দু পত্রী এক্সপেরিমেন্টের অপর নাম।  

‘অশ্লীলতা অথবা চুম্বন অথবা নগ্নতার পক্ষে’ লেখায় এসে আমাদের চিরাচরিত ধারণাকে ধাক্কা দিয়ে যান পূর্ণেন্দু। মানুষের দেহ মিথ্যে, যদি না তাতে ভাস্বর হয়ে ওঠে মানুষেরই অন্তর্নিহিত আশা আকাঙ্খা স্বপ্ন আবেগের জয় পরাজয়। নানান ক্ষেত্রে শ্লীল অশ্লীলের দোটানায় আমাদের যাদের পড়তে হয় তাদের জন্য অবশ্যপাঠ্য এই প্রবন্ধটুকু। পূর্ণেন্দু সোচ্চারে বলতে পারেন, অশ্লীলতার ইঙ্গিতই অশ্লীল। অশ্লীলতার লুকোচুরিহীন পূর্ণ প্রকাশ পবিত্র, শুদ্ধ, মহিমাময়।
নস্টালজিয়ার মোড়কে বেঁধে ফেলে ‘জীবনানন্দের ঘর’ প্রবন্ধটি। বারে বারে বাসা বদল করেছেন যিনি, বাস করেননি কোথাও – বলা ভালো করতে পারেননি, সেই জীবনানন্দ, কলকাতার একটা ঘরে, নিজের ঘরে পরবাস যাপন করেছেন। জীবনানন্দের লেখায় বারবার উঠে এসেছে ঘরের প্রসঙ্গ – আর সে বর্ণনা মিলে গেছে তাঁর আবাসের সাথে (মাল্যবান)। প্রত্নতাত্ত্বিকের মতো পূর্ণেন্দু তুলে এনেছেন জীবনানন্দের ঘরের খোঁজে ছুটে চলার সময়কে। পড়তে পড়তে মনে হয়, এই ঘরের খোঁজই হয়তো তাঁকে ট্রামলাইনে এনে ফেলেছিল!

ব্যক্তিগতভাবে আমার প্রিয় প্রবন্ধ ‘রঁদার আলোয় একটা দিন’। ভ্রমণপর্বে পূর্ণেন্দুর এই বিশ্লেষণ এবং তাকে ব্যাখ্যা – দেখানো, আমাকে মুগ্ধ করেছে। এই পর্বেই আমরা পেয়ে যাই রাইনের মারিয়া রিলকের সাথে রঁদার কথোপকথনের প্রসঙ্গ, পেয়ে যাই The Thinker –এর নান্দীমুখ, দান্তের ছোঁয়ায়। চিন্তাই সংগ্রাম। আর তাই, ভাস্কর্যমণ্ডিত ‘কবরখানায়’ পূর্ণেন্দু গেয়ে উঠতে পারেন, ‘জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ’। লোকশিল্পের শাখা ও শিকড়ে পূর্ণেন্দু সহজেই ভাঙতে পারেন চিরাচরিত প্রথা।
আবার বইমেলা পুড়ে ছারখার হয়ে গেলে, টের পাই, এক শিল্পীর কষ্ট।

একটু মিথ্যে কথা বলা হয়ে গেছিল। অজান্তেই। এই বইতে প্রিয় প্রবন্ধ ব’লে আলাদা ক’রে দাগিয়ে দেওয়া আমার পক্ষে মুশকিল। বইয়ের একদম শেষে এসে ধাক্কা দেয় ‘তোকে আমরা কী দিইনি শক্তি?’। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের চলে যাওয়ার পরে লিখেছিলেন পূর্ণেন্দু পত্রী। এ যদি প্রবন্ধ হয় তবে কবিতা কাকে বলে? এ যদি কবিতা হয়, তাহলে বন্ধুত্ব কাকে বলে?

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে পূর্ণেন্দুর প্রবন্ধ এক অন্য মাত্রা যোগ করেছে এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। কলকাতা বিষয়ক নানা প্রবন্ধের সাথে আমাদের আলাপ আগেই আছে, সম্পাদক এবং প্রকাশককে ধন্যবাদ, বিষয়বৈচিত্র্যময় এমন একটি বই আমাদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য। শিল্পের যে কোনো শাখায় যাঁরা আছেন, পূর্ণেন্দুর এই বই, প্রবন্ধ তাঁদের অবশ্যপাঠ্য।

অগ্রন্থিত প্রবন্ধ সংগ্রহ: পূর্ণেন্দু পত্রী
সম্পাদক: অয়ন দত্ত
প্রচ্ছদ: পুণ্যব্রত পত্রী
প্রকাশনা: বাণীশিল্প





একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন