![]() |
প্রচ্ছদ পরিকল্পনা: শর্মিলী মোস্তফী |
শাল্মলী রায়
যবে থেকে বৈষ্ণব সাহিত্যের প্রেমে পড়েছি, তবে থেকেই রাধাকে নিয়ে আমার কৌতুহলের শেষ নেই। কে এই রাধা? কেন তার কৃষ্ণের জীবনে আসা? কেনই বা হঠাৎ হারিয়ে যাওয়া? আর কেনই বা হারিয়ে গিয়ে অসম্পূর্ণ প্রেমের পরেও সে থেকে যায় ছায়ার মত? কেন তাকেই ভুলে ফেলে ছেড়ে চলে যাওয়া শ্রীকৃষ্ণের জীবনে এরপরে আর মাধুর্যের বিন্দুমাত্র ছোঁয়াও নেই? সাধারণ হয়েও কি করে এমন অসাধারণ সে? এত সব প্রশ্ন ভিড় করে থাকত মনের মধ্যে। তারপরেই হঠাৎ করে হাতে এসে পড়েছিল তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'রাধা'।
আজও মনে আছে প্রথম পড়ার পরে এর মোহ কাটতে সাতদিন সময় লেগেছিল। মাধবানন্দ, মোহিনী, কৃষ্ণদাসী, গোঁসাই, বৈষ্ণব আখড়া এই সবকিছু মিলে যেন এক ঘোরের মধ্যে নিয়ে ফেলেছিল আমাকে। ইলামবাজার আর অজয়নদের তীর, জয়দেব পদ্মাবতীর উপাখ্যানে কেমন মিলেমিশে একাকার তা আমায় চিনিয়েছিল 'রাধা'। আমি আক্ষরিক অর্থেই অবসেসড হয়ে গিয়েছিলাম এই উপন্যাসটিতে। হয়তো আমি অতিরিক্ত আবেগপ্রবণ বলেই এরকম হয়েছিল। কিন্তু এরপরেও যতবার পড়েছি তাতে মুগ্ধতা কমেনি একবারও।
এর কারণ হিসেবে আমার মনে হয়েছে এই বইটার মধ্যেই রাধাকে পেয়েছি তত্ত্ব এবং তথ্যের জটিলতার ঊর্ধে গিয়ে। 'রাধা' নামটি এই উপন্যাসে একটি প্রতীক। এই উপন্যাস বিশ্বাস করায় নিরন্তর পুরুষ এবং প্রকৃতির লীলায় রাধাই জীবনীশক্তি। সে না থাকলে এই পৃথিবী সব ঐশ্বর্যের ভাণ্ডার নিয়েও শূন্য। এর কারণ? কারণ উপন্যাসেই লেখক বলেছেন পাগলিনী কৃষ্ণদাসীর শেষ অমোঘ উক্তিতে,
"তৃষ্ণার বুক-ফাটা যন্ত্রণার মধ্যে তুমি তৃষ্ণার জলকে চিনো! বুকের মধ্যে দেহের রোমকূপে-কূপে তোমার আগুন জ্বলবে, যেমন আমার জ্বলছে। সেই দিন তুমি বুক ফাটিয়ে চিৎকার করবে রাধা রাধা বলে।" রাধা এই পৃথিবীর তৃষ্ণার জল।
বৈষ্ণব সাহিত্য মানেই আবেগ। সে আবেগ মন থেকে শরীর বেয়ে প্রবাহিত হয়ে যায় মননে, অস্তিত্বে। তাই জয়দেবের 'গীতগোবিন্দ'-ই হোক বা বিদ্যাপতির অভিসারের পদ কিংবা চণ্ডীদাসের গভীর অথচ আতিশয্যহীন বিরহের পদ, সবেতেই যেন নান্দনিকতা পূজিত। কিন্তু তথ্য এবং তত্ত্ব সেখানে কাব্যের সঙ্গে সমান্তরালভাবে গুরুত্ব পেয়ে এসেছে। তাই সবটাই শেষপর্যন্ত মিলেছে ভক্তিরসে। কিন্তু 'রাধা' উপন্যাসে তা নয়। সে এখানে প্রতীকী। তাই মোহিনীর মত পবিত্র এক ষোড়শী যখন তাঁর নবীন গোঁসাই মাধবানন্দের প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে ঘটনাচক্রে বাঈজি হবার জীবনে পৌঁছেও তার গুরু হিসেবে দীর্ঘ ষোল বছর বয়ে নিয়ে চলে প্রেমের গৌরব তখন যেন কোথায় সে অনুভব করায় রাধা আর প্রেম সমার্থক। সেখানে সে দায়িত্ব সহকারে পালন করেছে তার কলঙ্কিত হবার গৌরব। নেমেছে এক অন্যতর যুদ্ধে। তার নারীত্বের অহঙ্কার রক্ষার যুদ্ধে; যে যুদ্ধে সে জয়ী শেষপর্যন্ত। সেই তার অভিসার। অথচ এর মধ্যে নেই কোনো উগ্রতা। রাধার প্রতিবাদী রূপ এমনভাবে আর কোথাও নেই। সে বুঝিয়েছে কেন মুক্ত হবেনা রাধা ভক্তিরসের শিকল থেকে? কেন সে শ্বাস নেবে না মুক্ত আকাশে? রাধা কি সত্যি সত্যিই ফিরে আসে না যুগে যুগে? আধুনিক যুগেও কি তার প্রতিবিম্ব নেই? বৈষ্ণবধর্ম এবং সাহিত্য , বাউল তত্ত্ব, দেহতত্ত্ব কিংবা আধুনিক সাহিত্য;-সর্বত্রই রাধার অবাধ বিচরণ। তাকে ছাড়া অসম্পূর্ন বৈষ্ণব সাহিত্য। তাই তো তার শ্যামকে প্রমাণ করতে হয় নিজের ভালবাসা তবেই মিলনের রাস্তা প্রস্তুত হয়। তাকে গ্রহণ নয়, অর্জন করতে হয় প্রেমিক হিসেবে। এই তার নারীত্বের শক্তি। সে এই সৃষ্টির মূল এই স্বীকৃতি তার প্রাপ্য এই কথা সে তার প্রতি পদক্ষেপে প্রমাণ করে। ঠিক এইখানেই সম্পূর্ণভাবে প্রকাশিত হয় চিরন্তন 'রাধা' নামের ব্যঞ্জনা। সেই কারণেই তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'রাধা' এক ব্যতিক্রমী উপন্যাস, বাংলা সাহিত্যে যার জুড়ি মেলা ভার। এই উপন্যাস নারীত্বের চিরায়ত মাধুর্যের অন্যতর সৃষ্টি।
তাই তার সামনেই হয়তো কেবল মাথা ঝুঁকিয়ে প্রেমিক পুরুষ বলে উঠতে পারে,
"সত্যমেবাসি যদি সুদতি ময়ি কোপিনী দেহি খরনয়নশরঘাতম্ |
ঘটয় ভুজবন্ধনং জনয় রদখণ্ডনম্ যেন বা ভবতি সুখজাতম্ ||
ত্বমসি মম ভূষণং ত্বমসি মম জীবনম্ ত্বমসি মম জলধিরত্নম্ |
ভবতু ভবতীহ ময়ি সততমনুরোধিনী তত্র মম হৃদয়মতিযত্নম্।।"
গ্রন্থ: রাধা ( উপন্যাস)
লেখক: তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়।
প্রকাশক: মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড
প্রথম প্রকাশ:১৯৫৯