দোঁহা

একটি রোমান্সের অপমৃত্যু


 

প্রচ্ছদ পরিকল্পনা: শর্মিলী মোস্তফী

প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত

 
হাসির বই অনেক দেখেছি। পড়ে দুঃখ হয় এমন বইও আছে বিস্তর। ভয়ের বই তো আছেই। সত্যি বলতে কী, শিল্পের যে নয়টি রস তার সবই সাহিত্যে পাওয়া যাবে কোনো না কোনো চেহারায়। শুনেছি এমন বইও কিছু লেখা হয়েছে যেগুলির কোনো একটি পড়ে কারো জীবনের গতিপথ নাকি বদলে গিয়েছে। কিন্তু একটা বই পড়ে যে আজীবনের ভালোলাগা কোনো বিষয়ের উপর দুস্তর ঘৃণার উদ্রেক হতে পারে, আফসোস হতে পারে কেন এই বস্তুটিকে ভালবেসে তার পিছনে এত সময় এত ভাবনা এত চিন্তা নষ্ট করলাম, সেটা এই পঞ্চাশোর্ধ জীবনে বুঝলাম এই প্রথম।

একটি বাংলা বই। পৃষ্ঠাসংখ্যা আড়াইশোর কাছাকাছি। নাম ‘তৃতীয় রিপু’। লেখক সোমনাথ সেনগুপ্ত। দাম তিনশো টাকা। প্রকাশক বইচই পাবলিকেশন। অত্যন্ত ভালো কাগজের সুন্দর বাঁধাই করা বই হলে কী হবে, বইয়ের পাতাগুলো বিন্যাস যাকে বলে ‘লে-আউট’ অতি জঘন্য। দৃষ্টিকে পীড়া দেয়। কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। কারণ একেবার পড়তে শুরু করলে শেষ না করে উপায় থাকে না, এমনই আকর্ষণীয় বইটির বিষয়বস্ত, যাকে বলে কনটেন্ট, আর তাকে পাঠকের কাছে পেশ করায় লেখকের লিখনশৈলী।

বইটির শিরোনাম ‘তৃতীয় রিপু’র নীচে মলাটে এবং টাইটেল পেজ-এ ক্ষুদ্রতর হরফে লেখা আছে ‘ক্রিকেটীয় কিন্তু ক্রিকেট নয়’। আসলে ক্রিকেট খেলার সঙ্গে জড়িত অন্য একটি খেলার অন্ধকার জগতকে নিয়ে সোমনাথ লিখেছেন এই বইটি। সেই খেলা যে জুয়া সেটা নিশ্চয়ই বলে দেওয়ার দরকার নেই। জুয়াড়ি, বুকি, কর্মকর্তা আর ক্রিকেটার সকলে কীভাবে খেলাটিকে নিজেদের ইচ্ছেমতো পরিচালনা করে, খেলোয়াড়দের মধ্যে কে টাকার লোভে স্বেচ্ছায় খারাপ খেলেছে, বা বিপক্ষের খেলোয়ারকে ভালো খেলতে সহায়তা করেছে, যাতে সেই খেলার ফলাফলে আর্থিক লাভ করতে পারে জুয়ার সঙ্গে যুক্ত অসাধু মানুষরা তার বর্ণনা দিয়েছেন লেখক। সঙ্গে প্রয়োজনমতো দেওয়া হয়েছে ইউটিউব-এর লিংক, যাতে খেলার মাঠে ঠিক কী ঘটেছিল পাঠক দেখে নিতে পারেন।

হ্যান্সি ক্রোনিয়ে, অজয় জাদেজা, মনোজ প্রভাকর, আজহারউদ্দিন, নয়ন মোঙ্গিয়া, হার্শেল গিবস, শ্রীসন্থ, অজয় শর্মা, সালমান বাট, শেন ওয়ার্ন, মার্ক ওয়া প্রভৃতির কাণ্ডকারখানা তো এমন বইতে থাকতেই হবে। সেই সঙ্গে বইয়ের আলোচনা থেকে বাদ পড়েনি নর্তকী তারান্নুম, শ্রীনিবাসনের জামাই গুরুনাথ, আম্পায়ার আসাদ রউফ প্রমুখের ঘটনা, বা বব উলমার এবং সুনন্দা পুষ্করের হত্যা সম্পর্কিত বিষয়।

ক্রিকেট জুয়ার জন্য ম্যাচ ফিক্সিং বা স্পট ফিক্সিংয়ের ঘটনার প্রমাণ সব সময় পাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু একটা আন্দাজ তো করাই যায়। কখনও অনুভূতি হয় যে ডেনমার্কে কিছু একটা পচেছে। সেই জায়গাগুলোই যথাসম্ভব যুক্তিসঙ্গতভাবে ব্যাখ্যা করেছেন লেখক। আর সেখানেই হয়েছে যত গোলমাল। এগুলি পড়ার পর মনে হয় তিরাশির বিশ্বকাপের পর যত ক্রিকেট খেলা হয়েছে তার প্রায় সবই বোধহয় আগে থেকে ফিক্স করা। সাধারণ ক্রিকেটারদের তো বটেই, সুনীল গাভাস্কার, কপিল দেব, রাহুল দ্রাবিড়, ভিভিএস লক্ষ্মণ বা সচিন তেন্ডুলকারের মত ক্রিকেট দেবতাদের সম্পর্কেও সন্দেহ জাগাতে বাধ্য করে এই বইয়ের যুক্তিপূর্ণ অনুসিদ্ধান্ত আর অনুমানগুলি। তাঁরা সরাসরি জুয়ার সঙ্গে বা ম্যাচ ফিক্সিংয়ের সঙ্গে যুক্ত যদি নাও থাকেন, ঘটনাগুলি যে তাঁদের চোখের সামনে এবং জ্ঞাতসারে ঘটেছে তাতে কোনো সন্দেহ থাকে না। অন্যায় যে সহে তার দোষও তো কিছু কম নয়! এসব ভেবে তখন দুঃখ যেমন হয়, রাগও হয় যথেষ্ট। মনে হয় তিরাশির জুন-জুলাইয়ের পরবর্তী যাবতীয় ক্রিকেট স্মৃতি মন থেকে ডিলিট বা ইরেজ করার মত মুছে ফেলতে পারলে ভালো হত। বৃথাই ক্রিকেট দেখে শুনে আর তা নিয়ে পড়ে বা ভেবে নষ্ট করেছি এত সময়।

ক্রিকেট খেলা এখনও হয়ে চলেছে। এমনকি শ্রীলংকার মত দেশ, যেখানে এই মুহূর্তে তুমুল অরাজকতা, অনাহার, অর্ধাহারে আর অভাবে দেশবাসীরা জর্জরিত সেই দেশও আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলে চলেছে। আর আই পি এল, যেটা আসলে অনেকটা ক্রিকেটের মত একটা তামাশা— সামথিং লাইক ক্রিকেট— তা তো চলেছে রমরমিয়ে।

শুনেছি সোমনাথবাবু এখনকার ক্রিকেট নিয়ে আর একখানা বই লেখার মতলব আঁটছেন। তবে তা নিয়ে আমার অন্তত মাথাব্যথা নেই। 'তৃতীয় রিপু' পড়ার পরই ক্রিকেটের সঙ্গে সম্পর্ক চুকে গিয়েছে। ক্রিকেট নামে যে রোমান্টিক ব্যাপারটা মনের মধ্যে অনেকটা অংশ আমোদিত করে রাখত সেটা একেবারে পচে নষ্ট হয়ে গিয়েছে।


তৃতীয় রিপু: ক্রিকেটীয় কিন্তু ক্রিকেট নয়
সোমনাথ সেনগুপ্ত
বইচই পাবলিকেশন
মূল্য ৩০০/-

 


 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন