দোঁহা

অমিয়ভূষণ মজুমদারের মহিষকুড়ার উপকথায় ‘ডারিঘর’


 

প্রচ্ছদ পরিকল্পনা: শর্মিলী মোস্তফী

 রিমি মুৎসুদ্দি

 
‘ডারিঘর’ শব্দটা অমিয়ভূষণ মজুমদারের ‘মহিষকুড়ার উপকথা’-য় এসেছে বেশ কয়েকবার। ডারিঘর মানে বৈঠকখানা।

অমিয়ভূষণ লিখেছেন ‘দ্বারিঘর’। উপন্যাসের শেষের দিকে কয়েকবার ‘ডারিঘর’। ‘দ্বারিঘর’ আর ‘ডারিঘর’ যে একই শব্দের ভিন্ন বানানরূপ তা জেনেছি অধ্যাপক অলোক রায়-এর প্রবন্ধে।

মহিষকুড়ার জাফরুল্লার এই দ্বারিঘরে/ডারিঘরে-ই হাকিমের বিচারসভা বসত। যে বিচারসভায় আসফাক তার নায্য দাবীর কথা বলেছিল। জাফরুল্লার নামে নালিশ করেছিল। জাফরুল্লা মহিষকুড়ার পঞ্চায়েত প্রধান হবে বলেই তারই ডারিঘরে এই বিচারসভার আয়োজন। যে বিচারসভা সভ্য আধুনিক মানুষের ন্যায় বিচার, দাবী দাওয়া ইত্যাদির এক আশ্রয়স্থল হবে।

আদিম অরণ্যের বুনো মর্দা সব মোষ যেমন আজ শৃঙ্খলিত পোষ্যে পরিণত হয়েছে। সেইসব মোষেদের আশ্রয়স্থল অরণ্যও আজ পরিণত হয়েছে ধানি জমিতে, বাথানে, গোয়ালে, গ্রামে, জাফরুল্লা ও তার তিনবিবির জন্য নির্মিত সম্পন্ন গেরস্থ বাড়িতে এবং শেষ পর্যন্ত ডারিঘরে। শহর থেকে সরকারি অফিসার কি হাকিম অথবা যে কোনও গণমান্য ব্যক্তি এলেই তাদের আমোদপ্রমোদ, খাওয়াদাওয়া সবকিছুর আয়োজনই হয় এই ডারিঘরে।

‘মহিষকুড়ার উপখ্যান’-এ একদিকে যেমন অরণ্য, পাকা সড়ক থেকে মোষ বাথান সবই কাহিনীর অংশ হয়ে যায়। এই ডারিঘরও যেন কাহিনীর এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ জুড়ে রয়েছে।

যে মহিষকুড়ায় বুনো বাইসন আর বাথানের ডাক-পারা মাদি মোষের মিলনে আসা সন্তানের গল্প রূপকথার মতো বাতাসে ভাসে। উপকথার গায়ে এসে লাগে ‘পায়োর’ শব্দটা। ‘পায়োর’ মানে পাওয়ার। জমির মালিক জাফরুল্লার পাওয়ার বা ‘পায়োর’।

আসফাক, যার জমি ও আরও অনেককিছু কৌশলে কেড়ে নিয়ে যাকে চাকরে পরিণত করা হল, সেই আসফাক আর জাফরুল্লার পায়োর-এ বিস্তর ফারাক। আসফাক-এর পায়োর তাকে দিয়ে মোষের মতো ডাক পাড়ায় ‘আঁ-আঁ-ড়’। আবার হাকিমের কাছে জাফরুল্লার বিরুদ্ধে নালিশ করতে পাঠায়। নালিশ জাফরুল্লার বিরুদ্ধেই। যে জাফরুল্লা নাকি পঞ্চায়েত প্রধান হবে বলেই এই শহুরে বিচার সভার আয়োজন। যাতে ভোটবাবুরা সন্তুষ্ট হন। মহিষকুড়ায় অনায্য কিছুই হয় না। সেখানে আসফাক নালিশ করে বসে, সে বেতন পায় না। কেবল খোড়াকি।

নালিশ কি ওই অতটুকু? আসফাকের বিবি বা প্রেমিকা কমরুন জাফরুল্লার সন্তানের মা। যে জাফরুল্লা পরপর তিন বিবি ধারণ করেও সন্তানের পিতা হতে পারেনি।

জাফরুল্লার খামারের আরেক চাকর ছমিরকে ভয় পায় আসফাক। ছমির জাফরুল্লার নির্দেশে মোষ ছাগল পাঠা বনের হরিণ সবই জবাই করে শহুরে বাবুদের গাড়িতে টিনে ভরে মাংস তুলে দেয়। ছমির ধান-চাল ছিটিয়ে মুরগী ধরে আর গভীর ফাঁদ পেতে জবেহর জন্য মোষ ধরে। আসফাকের নিজেকে সেই মোষ মনে হয়। যেন ছমিরের ছুরি অপেক্ষা করে আছে ওর জন্যও।
জাফরের খামারের মতো সংসারেও আসফাক মিশে আছে। অথচ সে জানেও না। সে জানে কেবল তার কমরুন যে এখন জাফরের স্ত্রী, সেই কমরুনের সন্তান মুন্নাফ তাকে সম্মান দিয়ে ‘মিয়াঁ’ বলে। এ ডাক নাকি মুন্নাফকে তার মা কমরুন বিবি শিখিয়েছে।

অমিয়ভূষণ উপন্যাসে গল্প বলতে চান না। অথচ ‘মহিষকুড়ার উপকথা’-য় প্রতিটা বাক্যে গল্প রয়েছে। এই যেমন জাফরুল্লার বড় বিবি আসফাককে বলছে, ‘তা আসফাক, এই পিথিমিতে যত জমি দেখো, তা সবই কোনো না কোনো জাফরের। এই যে বন দেখো তাও একজনের।’

আবার,

‘কমরুনকে লাগে কেনে? মুই আর বড় বিবি নাই তো পতিত থাকলং। তুই পতিত কেনে, সোহাগি।’

এইরকম অজস্র উদাহারণ দেওয়া যায়। প্রতিটা লাইনই যে উপকথার অথবা গল্পের জন্ম দেয় তার এক অনন্য দৃষ্টান্ত এই উপন্যাস। গল্পকে এড়াতে চেয়েও গল্প ধরা দেয়। আর শব্দ? এই ডারিঘর অথবা দ্বারিঘর-কে কি বিপ্লবের আঁতুড়ঘরও বলা যায় না? যদিও হাকিমের কাছে নালিশ জানিয়ে আসফাক ভয় পেয়েছে। কিন্তু মানুষের তৈরি সভ্যতার, অরণ্যচারী মানুষ থেকে গেরস্থ সম্পন্ন মানুষ যাদের ‘পায়োর’ (পাওয়ার অথবা ক্ষমতা শব্দটার কি অসম্ভব এক স্যারকাস্টিক প্রয়োগ!) আছে তাদের তৈরি এই ডারিঘরই বুনো মোষের মতো সরল আসফাককে জানায়,

‘...শহরের রাজারা, যারা রাজ্য চালায়, তারা পোষ না-মানা কোনও মর্দা মোষকে নিজের ইচ্ছেমতো বনে চরতে আর কোনোদিনই দেবে না। যদিও হঠাৎ তোমার রক্তের মধ্যে এক বুনা বাইসন আঁ-আঁ-ড় করে ডেকে ওঠে।’



মহিষকুড়ার উপকথা ও একটি খামারের গল্প
অমিয়ভূষণ মজুমদার
প্রকাশকঃ দে'জ, কলকাতা

 


 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন