দোঁহা

স্থবির তোমার বন্ধুটিকে আঁকড়ে ধরে রেখো

 

প্রচ্ছদ পরিকল্পনা: শর্মিলী মোস্তফী


শুদ্ধায়ন চট্টোপাধ্যায়


সারা সপ্তাহ কাজ করে ছুটি পাই মাত্র দু’ দিন। তাও নামমাত্র। চলতি ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলোতে টুকটাক ছবি দেখা আর একটু এদিক ওদিক বেরিয়ে আসা ছাড়া আর কিছু করার উপায় নেই। দু’ বছর হল চাকরি করছি। এই দু’ বছরে বইপত্র খাতা কলম এদের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক চুকে গেছে। দুই একবার বই পড়ার চেষ্টা করিনি যে তা নয়। কিন্তু ওই ত্রিশ বত্রিশ পাতার ওপারে চোখ আর কিছুতে গড়াতেই চায় না। তার মধ্যেই গোটা বিশ্বটা এসে কড়া নাড়ে আমার দরজায়। আর অনিচ্ছা সত্ত্বেও আঙ্গুলের এক ছোঁয়াতেই দরজা খুলে যায়। কত ছবি, গান, কবিতা, মতামত, আনন্দ! তারপর এ প্রান্ত সে প্রান্ত থেকে অসংখ্য ‘বন্ধু’ চেনা-অচেনার বেড়া টপকে ‘Hi-ও’ Hey-ও’ করতে করতে সমস্ত আমেজটা ভেঙে চুরমার করে ফেলে। আধখোলা বই উপুর হয়ে পরে থাকে বিছানার এক কোনে। আর আমি ডুবতে থাকি কোন এক ঘূর্ণায়মান আবর্তে। পরের দিন আবার অফিস। চোখে ঘুম জড়িয়ে আসে। অ্যালার্ম দিয়ে ঘুমিয়ে পরি। কিন্তু আমি ডুবতে থাকি।

দিব্যি চলতে থাকলেও, বই পড়ার বদখেয়ালটা মাঝেমাঝেই মনে চাগাড় দিয়ে ওঠে। সেক্ষেত্রেও বিশ্বের দরবারে দ্বারস্থ হতে হয় বইকি! চট করে ফোন বের করে গুগল সার্চ করে দেখে নিলাম কী বই পড়া যায়, কার কেমন ‘রিভিউ’ কেমন ‘রেটিং’। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও এবার খুব একটা আগ্রহ পেলাম না। ফোনের মধ্যেও বই রয়েছে বটে কিন্তু মনোযোগ কতদূর করতে পারব তা নিয়ে আমার যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। এককালে বই পড়বার অভ্যাস ছিল বলে বাড়িতে বেশ কিছু বই রয়েছে। অগত্যা তাদেরই শরণাপন্ন হতে হল। বেশ ঘাঁটাঘাটির পর একটা বই হাতে এল- হলদে মলাটে লেখা, “মহাস্থবির জাতক”, লেখক- প্রেমাঙ্কুর আতর্থী। বলাই বাহুল্য, বইটি বাবার সংগ্রহ। প্রেমাঙ্কুর আতর্থী নামটার সঙ্গে পরিচয় হয় “নিউ থিয়েটারস” - এর ইতিহাস পড়ার সময়। উনি যে একটা আস্ত উপন্যাস লিখেছেন সে ধারণাও আমার ছিল না। বেশ বুঝতে পারছিলাম যে অদূর ভবিষ্যতে এর পরিণতিও এর অগ্রজদের মতই হবে। কিন্তু আবার মনের এক কোণে অনেক আশা যে একমাত্র এই লেখকই পারবেন আমার ডান হাতের কব্জি ধরে এক হ্যাঁচকা টানে এই আবর্ত থেকে তুলে আনতে। আর না ভেবে ভূমিকাকে ভণিতার মত বর্জন করে সোজা ঢুকে পড়লাম প্রথম পর্বে। নামের সঙ্গে মিলিয়ে ভেবেছিলাম খুব খটমট ভাষায় জীবনের কোন এক নিহিত অর্থকে তুলে ধরেছেন কিন্তু সেরকম কিছুই দেখতে পেলাম না। বিশ্বকবির মৃত্যুর কিছু ঘন্টা আগে মধ্যরাতে, অনিদ্রায় আক্রান্ত লেখক নিজের কিছু কথা বলতে শুরু করলেন। তারপরেই হঠাৎ করে তাঁর শৈশবের দুটো বিচ্ছিন্ন ঘটনা। কি অদ্ভুত সাবলীল ভঙ্গীতে সহজ ভাষায় স্মৃতিচারণা করে চলেছেন লেখক। আমি অবাক হয়ে পাতার পর পাতা উলটে চলেছি। সমস্ত ক্লান্তি উদ্বেগ নিমেষের মধ্যে উধাও।

চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি একটা জীবন্ত শৈশব। যে শৈশব এই ইঁদুর দৌড়ে পড়ে কবে আমার আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে গলে গেছে আমি টেরও পাইনি। স্থির, স্থবির আর অস্থির - তিন ভাই মিলে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে আমার মনের আঙিনায়। ঠিক আমার মত, বাবাকে তাদের খুব ভয়। যে বাবাকে ইংরেজিতে formidable বললেও হয়ত কম বলা হয়। একাল সেকাল কোন এক দিগন্তে এসে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। কখনও কখনও খেই হারিয়ে ফেলে ফিরে যাচ্ছিলাম লেখক পরিচিতির পাতায়। সব কিছু তো আমারই সামনে এই মুহূর্তে ঘটে চলেছে। আমার সমস্ত আনন্দ, দুঃখ, অস্বস্তি, গুমরে থাকা সব কেমন লেখকের কলমের আঁচড়ে প্রাণ ফিরে পেয়ে বিস্মৃতির আড়াল থেকে উঁকি দিতে শুরু করেছে। ইস্কুলে মিথ্যে পয়সা চুরির দায়ে অপদস্থ হওয়া স্থবির আমায় মনে করিয়ে দিল একবার সপ্তম শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষা চলাকালীন আমার এক সহপাঠী তার নিজের সঙ্গে করে আনা চিরকুট আমার বেঞ্চিতে রেখে আমায় নকলের দায় ফাঁসিয়ে দিয়েছিল। আমি নিজের হয়ে কিচ্ছু বলতে পারিনি। রাগে দুঃখে গলা দিয়ে কথা বেরচ্ছিল না, চোখ ফেটে জল আসছিল। বন্ধুদের সহযোগিতায় সে যাত্রা মুক্তি পেয়েছিলাম। কিন্তু সেই অপমানের যন্ত্রণা এতটাই প্রবল ছিল যে সেই সহপাঠীকে আজও ক্ষমা করতে পারিনি। স্থবির তাঁর জীবন দিয়ে, উপলব্ধি দিয়ে আমায় ক্ষমা করতে শিখিয়ে দিলো। মন ভারমুক্ত হল। আমি আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরলাম স্থবিরকে। পনের বছর বয়েসের অসফল প্রেম, মা, বাবা, ভাই সবাইকে ছেড়ে স্থবির বেরিয়ে পরল পথে। ততক্ষণে আমিও ফোন ইন্টারনেটের মায়া কাটিয়ে পা বারিয়ে দিয়েছি তার পিছু পিছু। আমার মত ভীরু অসহায় মানুষদের সহায় হয়ে স্থবির এগিয়ে চলে মহাস্থবির হওয়ার পথে।

কোথা থেকে অচেনা হাওয়া পথ ভুলে আমার ঘরের দেওয়ালে বীজ বপন করে গেছে। তার থেকে অঙ্কুর বেরিয়ে ফাটল ধরাতে শুরু করেছে একটু একটু করে। নিরুদ্দেশ স্থবির ছুটে চলেছে কোন অজানার খোঁজে। যার সান্নিধ্যে অন্তরের সমস্ত ঝর উদ্বেগ কোথায় উধাও হয়ে যায় ঘরে তার মন টেকেনি কখনও। যখন যাকে সঙ্গী পেয়েছে তার সঙ্গেই মিশে গিয়েছে অসংখ্য নর নারীর মিছিলে। লেখক নিজেও বেশ কয়েকবার দাবি করেছেন যে স্থবির পরম শক্তিমান সেই অদৃষ্টের সন্ধানে বারবার ঘর ছেড়েছে। কখনও বা বলেছেন ভাগ্যের অন্বেষণে। কিন্তু তাকে অনুসরণ করতে করতে আমার ধারণা বদলাতে লাগল। কত অগুন্তি মানুষের সঙ্গে তার পরিচয়, তাদের সুখ দুঃখের কথা, তাদের জীবনের কথা, কখনও কাশীর ঘাটে কোন যোগিনীর বাড়িতে আশ্রয় পেয়েছে, কখনও বা কোন জমিদারের বাড়ি ফাইফরমাস কাজ করেছে। কেউ ভালোবেসে আশ্রয় দিয়েছে তো কেউ অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছে। আবার কখনও কোনো ধর্মশালায় দিনের পর দিন রাতের পর রাত অনাহারে অনিদ্রায় কেটেছে। অজস্র অলৌকিক ঘটনার সাক্ষী হয়ে স্থবির অঙ্কুর থেকে লতায় পাতায় সজ্জিত হয়ে মহাস্থবির হয়ে উঠেছেন। প্রত্যেকবার মনে হয়েছে এবার বুঝি পথিকের পথ চলা শেষ হল। কিন্তু না। কোন এক অজানা হাতছানি বারবার চঞ্চল করেছে স্থবিরকে। অন্তর থেকে ধ্বনিত হয়েছে, “আমার আর এখানে থাকা চলবে না”। আমোদপ্রমোদে ভরা বিলাসবহুল জীবনে তিনি কখনও শান্তি খুঁজে পাননি। তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠেছে বারবার—

“বহুমূল্য স্বর্ণ ও রৌপ্যপাত্রে স্তরে স্তরে সজ্জিত বিবিধ সুস্বাদু ভোজ্য ও পানীয়ের উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে নিরন্ন শ্রমিকের দল—যাদের সবার পিছনে আছে আমার সেই কৈশোরের অরণ্যমাতা—দীর্ঘ কৃশদেহ, জীবনব্যাপী কঠোর শ্রম ও অর্ধ-উপবাসজনিত কঠিন মুখমণ্ডল—দেহ প্রায় উলঙ্গ—দৃষ্টি সম্মুখে প্রসারিত, যেন বর্তমানকে উপেক্ষা করে কোন সুদূর ভবিষ্যতে সে-দৃষ্টি গিয়ে পড়েছে।“

বিচিত্র মানবজীবনের এক সাক্ষ্য এই জাতক। আর মহাস্থবির তার এই স্মৃতি-চারণায় খুঁজে ফিরেছেন আরও বিচিত্র মানব-সম্পর্কের অসহায় রূপটিকে। যে অসহায়তা অবিনশ্বর, চিরস্থায়ী হয়ে রয়েছে পৃথিবীর বুকে। তাই হয়তো দেশ কালের সীমা পার করে এই জাতক হয়ে উঠেছে বাংলা সাহিত্যের এক অবিস্বরণীয় গ্রন্থ। মীমাংসা বা পরিণতির ঘেরাটোপ পেরিয়ে মহাস্থবির জীবনের জয় গান গাইতে শিখিয়ে দিলেন।


মহাস্থবির জাতক
প্রেমাঙ্কুর আতর্থী
দে'জ প্রকাশনা, কলকাতা

 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন