দোঁহা

তৃতীয় পৃথিবীর নিঃসঙ্গতা

 

প্রচ্ছদ পরিকল্পনা: শর্মিলী মোস্তফী

দীপাঞ্জন দাস


সর্বমোট দশটি গল্প নিয়ে গঠিত এই বইটির প্রথম গল্প ‘লাবণ্য নীচের পোশাক খুলে দেয়’। ধারালো ছুরি, নর্দমার নোংরায় মাখানো একটা দেহ মানিক চক্রবর্তীর। বাম শাসনের অবসানের আগে অস্ত যায় এমন বহু মানিক্য। তাঁর সাথেই ভেসে যায় কত-শত প্রেম, ত্রাসের পেয়ালা। আমার মতে, এখানে নিচের পোষাক আসলে কেবলমাত্র যৌনতার স্বরূপ উদ্ঘাটিত করে না। বরং ইঙ্গিত করে একটা যুগের, যাকে পেরোতে পারলে সহস্র মানিকদের দেখা মেলে লাবণ্যের সাথে, পিস্তলের বিপরীতে নেমে আসে সময়, একটুকরো পোশাকের দড়ি।

দ্বিতীয় গল্প ‘অপলা বলে আসলে কেউ নেই’। সঠিক পরিচয়পত্র লুকিয়ে অপালা ও কুন্তল ঠাঁই নিয়েছে এক কামরার ঘরে। কেয়ারটেকার আছে কেয়ারের বিপরীতে, আর আছে এক লম্বা করিডর। যেখানে জলের রঙ কখনও লাল, কখনও বা ঈষৎ গোলাপী। কখনও আবার মিলিয়ে গিয়েছে ভূত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ। কলেজের দিনগুলোর শেষে, রাজনীতি ও প্রেমের সুসময় কাটিয়ে জীবনের দিকে এগিয়ে যাওয়া যেন এক লম্বা করিডরের অনন্ত যাত্রাপথ। বয়স্কা, শিশু সব কিছুই যেন রূপক। আপাত শান্ত এই হোটেল যেন জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ যেখানের নৈঃশব্দ চিরকাল স্থায়ী নয়। কুন্তল তো কুন্তল নয়। অপলাও এক চরিত্র মাত্র, লেখকের গল্পের চরিত্র।

তৃতীয় গল্প ‘একটি কালো বেড়ালের আয়ু’। কাহিনিতে রয়েছে অ্যানি বলে একটি চরিত্র। কথকের ভালোবাসা, কথকের জীবনের এক অতীত। কিন্তু, অস্তিত্ববিহীন এক বাস্তব কি? লেখক নিজেই বলেছেন, ‘আমাদের সম্পর্কটা একটা কালো বেড়ালের আয়ুর ভেতর, যা দ্রুত ফুরিয়েছিল’। গন্তব্যে নিয়ে যায় যে ট্রেন, যেখানে আটকে পড়েছে অভিনন্দনের মত অনেকেই, সে সব নিছক কল্পনাও হতে পারে। সমস্ত অলৌকিক প্রাণীদের মত বিড়ালেরও নয়টি জন্ম রয়েছে। যে জন্ম-মৃত্যুর মধ্যে বিভাজন রেখা টেনে দেয় নাম-না জানা ট্রেন, মাঠ, ক্ষেত। মস্তিষ্ক কখনও এর সত্যতা নিয়ে গর্ব  করে, আবার কখনও সন্দিহান। অ্যানিদের বাড়ি তাই মনের ভিতরে বাঁচুক, বিজ্ঞাপনী চমক থেকে অনেক দূরে। লেখক এমনটাই চেয়েছেন।

চতুর্থ গল্প ‘আসবাবপত্র’। এই গল্পটিকে তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন লেখক- আলমারি, আয়না ও আলনা। জীবনের বিভিন্ন অংশের সাথে যার তুলনা চলে। আবদ্ধ জীবন, বাস্তবতা ও আবরণের আকাশ। লেখক লিখেছেন- ‘বিকেলের মাঠগুলো চলে গিয়েছে এখন ওদের দখলে। রাস্তায় রাস্তায় বসেছে গোপন ক্যামেরা। সঙ্গে চোখ ধাঁধানো আলো। গাছের প্রেতেরা দাঁড়িয়ে রয়েছে পথে পথে। প্রেতেদের ছায়া নেই। তাদের মৃত্যুদৃশ্য লেগে থাকে কিছু কিছু রিকশাওয়ালার দু’চোখে।’

পঞ্চম গল্প ‘শেষ উপহার’। কবরস্থানে কবর দেওয়া হয় মৃত মানুষদের। সেখানে জেগে উঠেছে যে মেলা সেখানে রঙের সাথেই শোভা পায় রঙহীনদের গল্প। ভাব্য, দীপ, নাগরদোলা, চিতাবাঘ-সব কিছুই বাজাচ্ছে অন্তিম সুর। বৃদ্ধ, বৃদ্ধা ও জীবনের গল্পের থেকে শেষ উপহার আর কীই বা হতে পারে?

ষষ্ঠ গল্প ‘সমুদ্রের একদিন’। প্রতিটি দিনযাপনের শেষে স্রোতের বিপরীতে যেতে চাই আমরা সবাই। সেই পথেই লেখকের যাওয়া-আসা। সমুদ্র যাত্রা কিছু নতুনের খোঁজে, ফিরে আসা রোজকার জগতে- ‘দূরে শুনি ক্লাবের ওপরে মঞ্চ, জোরে জোরে স্বাধীনতার গান বাজে, কেউ খুব জোরে হেসে ওঠে হঠাৎ।

সপ্তম গল্প ‘একটি আত্মকথা সম্পর্কিত’। এটি অন্ধকার বারান্দার গল্প, আলো থেকে মুছে ফেলার গল্প। অর্পিতা নামের একটি মেয়ে বলে চলেছে তাঁর জীবনের গল্প। বলছে বলা ভুল, বরং লিখে চলেছে। ভাস্কর, দীপ প্রতিটা নাম যেখানে একাত্ম হয়ে যায়। হারিয়ে যায় মেয়েটি চিরতরে, রেখে যায় একটুকরো কাগজ, আত্মহত্যার আগে।

অষ্টম গল্প ‘সতেরো বছরের নিঃসঙ্গতা’। এই গল্পে যে সত্যের কথা তুলে ধরা হয়েছে তা হল- আমরা আমাদের ভবিষ্যতের স্মৃতি ছাড়া কিছুই নই। মৃত্যুর পরেও কাছের মানুষের যে ছায়া থেকে যায়, তা ছবি হয়ে ফুটে ওঠে ক্যানভাসে। সেখানে, তিতির, দীপ কেবলমাত্র চরিত্র বলেই মনে হয়েছে। আসলে, এইসবই জীবনের গল্প বলে।

নবম গল্প ‘যে দেখা করতে এসেছিল’। দৈনন্দিন জীবন থেকে অনেক দূরে অরণ্য আবিষ্কার করে দীপ, যেখানের রাস্তা বদলে যায় অকারণেই। সেখানে দীপের সাথে দেখা করতে আসে মৃত্যু, যার প্রবেশপথ খোঁজা  দুস্কর। শুধু ছড়িয়ে দেয় এক অলৌকিক গন্ধ, পাশে পরে থাকে সৌভাগ্যের পোশাক।

দশম গল্প ‘নিঃসঙ্গ দশকের পুরুষেরা’। অনির্বাণ এখানে যেন পুরুষদের অনেক না বলা কথা বলে চলেছে। অভিষপ্ত সেই সব গাছেদের কাহিনি লিখেছে যাদের কোনও শিকড় নেই, যারা নির্বাসিত, পর্যুদস্ত।

দশটি গল্পের সমাহারে রচিত এই বইটিকে কেবল সাধারণ কিছু গল্পের সমষ্টি বলা ঠিক হবে না। এ এক অদ্ভূত দর্শন, অদ্ভূত যাপন। মন, শরীর, বাস্তবতা, পরা-বাস্তবতা যেখানে ঠাঁই পেয়েছে, তা স্নিগ্ধ, পবিত্র…


বই: তৃতীয় পৃথিবীর নিঃসঙ্গতা
লেখক: দীপশেখর চক্রবর্তী
প্রকাশক: বইওয়ালা বুক ক্যাফে
মূল্য: ৩০০/-

 



 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন