![]() |
প্রচ্ছদ পরিকল্পনা: শর্মিলী মোস্তফী |
সৌরাংশু
আপাতত দুটি লাইন তুলে ধরছিঃ
'দাঙ্গা পরবর্তী' থেকেঃ "...ভেতরের পরাগথলি থেকে মিহি পরাগের গুঁড়ো আশীর্বাদের মতো নেমে আসছে তাদের ঢেকে দিতে। বাতাসে কী সুগন্ধ!"
'ভাইবোন' থেকেঃ "...পা বদলে বসার অস্বস্তিতে মাটিতে মৃদু কাঁপন হচ্ছিল নিশ্চয়ই, যা শুধু পিঁপড়ে আর মৃতেরা টের পায়।"
শ্রীছাঁদ গদ্যে যখন কবিতা খুঁজে পাওয়া যায় তখন গদ্যের চলনে রঙ লাগে। গল্পের কাঠামোয় লাগে প্রলেপ, আমেজের প্রলেপ।
‘চড়াই পাখির মাংস’ থেকেঃ “কাল কী হবে কালই দেখব, আজ তো কতদিন পর ঘুমোচ্ছি শান্তিতে, আমার চারপাশ ঘিরে বসে আছে শুধু সারাজীবন সঙ্গোপনে পুষে রাখা গল্পেরা। যত চড়াইপাখি আন্দাজ মাংস কমেছে শরীর থেকে সব যেন এই এক রাতেই হাসিল করে নেব, এইরকম আশা নিয়ে আমি ঘুমের সমুদ্রে টুপ করে পড়া ভারী পাথরের মতো তলিয়ে গেলাম।”
‘খেড়া’ থেকেঃ “খেড়াটি যেদিকে গেছে, হতভম্বের মতো সেই সুঁড়িপথটির দিকে তাকায় ফুলমণি। ডুবন্ত সূর্যের কমলা রঙে সব কেমন লতুন সোনার পারা হয়ে আছে। মহুল ফুলের তীব্র ভালুক-ডাকা গন্ধ, পুটুস ফুলের ঝোপে একটা বোঁটাতেই তিন-চার রঙা ফুল বাতাসে মাথা দোলায়। তার গন্ধও বড়ো সতেজ। আর রাস্তার পাশে চিরুনি পাতার অজস্র বাঁশঝাড়। ঘন অভেদ্য। এরা যেন সব লইতুন মনে হয়, চিরকালের অদেখা।”
কী পরম যত্নে শব্দের পিঠে শব্দ বিছিয়ে গল্পকাঁথা বোনা।
স্বীকার করতেই হয়, প্রতিভা সরকারকে আমি পড়িনি আগে। গুরুচণ্ডালী থেকে প্রকাশিত ‘ফেরেশতা ও মেয়েরা’-র কথা শুনেছিলাম। কিন্তু পড়া হয়নি। কীভাবে কেন যে কোভিডকালে সৃষ্টিসুখের ‘সদাবাহার’ হাতে তুলে নিলাম তা আর মনে নেই। তবে মনে যেটা গেঁথে রইল সেটা হল গল্পের বুনন।
১৪টি গল্পের একটি বৈঁচিগাথা এই ‘সদাবাহার’।
‘কাকচরিত’ থেকেঃ “যেটুকু আলো লেগে আছে তাতে ডানাগুলো শুকিয়ে যাক, না হলে বোকা মানুষের মতো ভেজা চোখে সে ঘুমুতে যেতে পারবে না।”
‘সীমানা’ থেকেঃ “আমগাছের লক্ষ্মী প্যাঁচাটি রাতের অভিযান শেষ করবার আগে নিচের ডালে বসে ঘাড় কাত করে এদিক ওদিক। আগাছার জঙ্গলের দিকে ঝুঁকে পড়ে কী যেন দ্যাখে গভীর মনোযোগের সঙ্গে। তারপর নিঃশব্দে মেলে দেয় দুটো ছড়ানো ডানা। ওর লম্বা শক্ত নখগুলো মুহূর্তের মধ্যে অব্যর্থনেমে আসে শিকারের ঘাড়ের ওপর।”
গল্পগুলোর মধ্যে পেলবতা নেই, বাস্তব ছেঁকে স্বপ্নকে মেলে ধরা পরাবাস্তবতা নেই। কিন্তু পেঁয়াজের খোসার মতো পরত সরালেই রুক্ষ বঞ্জর অনুভূতির মতো তিরতির করে কাঁপতে থাকে জীবন। এই জীবন থেকেই উঠে আসা গল্প বলেন প্রতিভা সরকার।
বইটিতে ১৪টি গল্প। হয় তো প্রথম থেকেই নয়, ধীরে ধীরে মেহফিলে রঙ ধরে, ওম ছড়ায় তারপর চমকের পর চমক। রাজবংশী ভাষা, উত্তরবঙ্গের ডুয়ার্সের জঙ্গল অথবা মরমিয়া জীবনবোধ চোখের আঙিনায় বৃষ্টি নামায়। অবাক হয়ে ভাবতে হয়, কতদূর চোখ চলে গেলে দিগন্ত আঁকা যায়।
প্রতিভা সরকার জীবন আঁকেন, দিগন্তের তুলি দিয়ে। রঙ তো প্রাত্যহিকীর ঠুকুরঠাকুরেই পড়ে থাকে। প্রতিভা সরকার ছাঁকনি দিয়ে ছেঁকে তোলেন রঙ। সমগ্র অভিজ্ঞতা দিয়ে মানুষের গল্প লেখেন প্রতিভা সরকার। ‘সদাবাহার’ সেই গল্পের ভিসুভিয়সের ১৪টি ফুলকি। রোকুর প্রচ্ছদ চিন্তাও একইরকম অনবদ্য। স্বপ্নের ভিতর থেকে অন্তদৃষ্টির যে জীবন নকশা গল্পের পাতায় পাতায়, প্রচ্ছদে তাই প্রতিষ্ঠিত হয়।
‘প্রেম’ থেকেঃ “পারুল তাকে নিজের দিকে আকর্ষণ করতেই পাটকাঠির বেড়া চুঁইয়ে পড়া জ্যোৎস্নায় সঙ্গিনীর মুখ চুম্বন করল অঙ্গলাল। নিজের শিরদাঁড়া বেয়ে জলের ফোঁটার মতো গড়িয়ে নামছিল যে সুখ তার শিরিশিরানি উপভোগ করতে করতেই ঠোঁট ডুবিয়ে দিল গিত্থানীর নরম বুকে।”
কবিতা তো এভাবে খুঁজতে হয় না। হাত বাড়ালেই দুহাত ভরে ঢেলে দেন প্রতিভা সরকার।
সদাবাহার
প্রতিভা সরকার
সৃষ্টিসুখ প্রকাশন
মুদ্রিত মূল্যঃ ১৬০ টাকা