দোঁহা

‘ধায় যেন মোর সকল ভালবাসা’

 

প্রচ্ছদ পরিকল্পনা: শর্মিলী মোস্তফী


শাশ্বতী গঙ্গোপাধ্যায়


মরণ হতে যে সত্যিই গানের সুরে জেগে ওঠা যায় অথবা কোনো একজনের সুধারসের ধারা যে গহন পথে এসে ব্যথাকে মধুর করতে পারে, সে বোধহয় আমরা সবাই অনুভব করি। উপলব্ধি করি। কিন্তু ব্যক্ত করতে পারি না। অথচ কী আশ্চর্য ভাবে 'এ আমির আবরণ' ভেদ করেছেন শঙ্খ ঘোষ। রবীন্দ্রনাথের গান যেন ভালেরির বলে যাওয়া আলোয় ধোয়া রাত্রির মতো। যা মানুষের মনকে সম্পূর্ণ পাল্টে দিতে পারে। এই বইটির বিন্যাস যেন রবীন্দ্রগানের অন্তরের মণিমুক্তো দিয়ে সাজানো। তুমিকে স্পর্শ করার ক্ষণই হল নিজেকে জানতে পারার মুহূর্ত। ডাকঘরের অমল তো জীবনের প্রতিটি টুকরোকে ভালবেসেছে, তাই তো সে সবার সাথে নিজেকে ভাসিয়ে দিতে পারে। বেদনার দিনযাপনও তার চোখে অপরূপ। প্রাবন্ধিক যখন কবি, তখন এক অনন্য ব্যাখ্যায় আমাদের বুঝিয়ে দেন যে,  রবীন্দ্রগানে ঈশ্বরধ্যান এসেছে ঈশ্বরমুগ্ধতা হয়ে। রবীন্দ্রগানে প্রেম আর পূজা যে মিলেমিশে একাকার, একথা আমরা সবাই বলে থাকি। কিন্তু কীভাবে? সে উপলব্ধি করতে হলে এই বইটির প্রতি অভিনিবেশ অপরিহার্য। কবি এখানে প্রাবন্ধিক হয়ে দেখিয়েছেন, কিভাবে নীৎসে আর রবীন্দ্রনাথের জগতের দুস্তর ব্যবধান হওয়া সত্ত্বেও এপার আর ওপারের মধ্যে মানুষ যেন এক সেতু। তাই গানের ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটির সাথে সেতুবন্ধ রচনা করে চলেছে সে। আমরা কখনো কি অনুভব করেছি প্রতিটি মানুষের মধ্যেও নিহিত থাকে এক নারী মনের উপলব্ধি, যা অনায়াসে নিজেকে প্রস্তুত করতে, অকুন্ঠিত চিত্তে বলতে পারে -

‘আমার এ ঘর বহু যতন করে/ ধুতে হবে মুছতে হবে মোরে/ আমারে যে জাগতে হবে/কী জানি সে আসবে কবে’

সুতরাং, যারা বলে এ গান মেয়েলি উচ্চারণের, তাদের  বুঝতে হবে আসলে এখানে নারীত্ব যেন এক সেতু। বস্তুত জীবন চেতনাই যেন ধর্ম চেতনা। 'এ আমির আবরণ' যেন  রবীন্দ্রগানের এক দিক-নির্দেশক। নতুন করে চিনতে শেখায়। আত্মজাগরণে উদ্বুদ্ধ হয়ে আমরা আমাদের আত্মচরিতের দিকে তাকাই। দেখি এমন ভাবে হৃদয় পদ্ম সাজাতে পারিনি যেখানে শ্রী, সৌন্দর্য এসে ঠাঁই পেতে পারে। স্থানের অকুলানে অপ্রস্তুত আমি কান পাতি সেই সুরে বাঁধা শব্দবন্ধে –‘লক্ষ্মী যখন আসবে তখন কোথায় তারে দিবি রে ঠাঁই/দেখরে চেয়ে পদ্মটি নাই।‘

ব্যথা সমর্পণের আবেগে রবীন্দ্রনাথ যে কোথায় আর সবার চেয়ে আলাদা, কেন যে তিনি অত্যন্ত সন্তর্পণে তার দুঃখের ভুবনকে গড়ে তোলেন, তারই সন্ধান পাওয়া যায় এই বইটির প্রতিটি অধ্যায়ে। এই বইয়ের প্রতিটি অলিগলি যেন মিশেছে রবীন্দ্র গানের প্রাঙ্গনে। সেই বনস্পতির ডালপালায় আমরা বিকশিত হয়ে উঠছি এক নতুন বোধে। চোখের জলে যে জোয়ার লাগে, তাই তো এপারে, ওপারে কানাকানি ঘটায়।

নিজের জন্য লিখলেই তা সকলের হয়ে যায়। এই উত্তরণে পৌঁছে যাই আমরা রবীন্দ্রকাব্যে। তাই গীতাঞ্জলির সেই নিভৃত প্রাণের দেবতা কখন যেন একা এসে দাঁড়ান। এখানে তার বীণা ও বাণী দুইই নীরব। এই অন্তর্মুখীনতার জন্যই ব্রুক ভেবেছিলেন যে, এই লেখাগুলোকে প্রকাশ করতে কি রাজি হবেন কবি? ছোটো ছোটো প্রাত্যহিকতার মধ্যে ডাকঘরের অমলের মতই জীবন খুঁজেছেন তিনি। আর তাই পথ এসে মিশেছে ঘরে। রবীন্দ্রগানে কবি এসে যেন তার কবিতার সব মেদ ঝরিয়ে তাকে সুরে বাহিত করে দিলেন। কবিতা এসে মিশে গেল গানের গহীন সমুদ্রে। এ ভাবেই গীতাঞ্জলির কবি আত্মার সঙ্গে মুখোমুখি হন। তাই গীতাঞ্জলি কবির মন্দির যেখানে সেখানে প্রভু আর ঈশ্বরের প্রতি ভালবাসার স্রোত ধাবমান। ঘরের কথা, আমির কথা ক্ষুদ্র গণ্ডীর বাইরে গিয়ে কখন যেন গানের আমি হয়ে ওঠে। অসামান্য ব্যাখ্যায় উঠে আসে চতুরঙ্গের শচীশের জীবনদর্শন। ঝড়ের রাত্রি রবীন্দ্রনাথের এক প্রিয় অনুষঙ্গ। গীতাঞ্জলির অভিসার তাই ঝড়ের রাতে, গীতিমাল্যর দুয়ার তাই ঝড়ের রাতেই ভেঙে পড়ে আর গীতালিতে একলা পথে বাতি নিভে গেলে ঝড়কেই সাথী করে পথ চলা যায়। গ্রন্থকার এভাবেই দেখিয়েছেন রবীন্দ্রভাবনার সম্প্রসারণ। প্রতিটি গানের শব্দবন্ধের সাথে এখানে একাত্ম কবিহৃদয়। না হলে এভাবে লেখা যায় না।

উপন্যাসেও শঙ্খ ঘোষ খুঁজে পেয়েছেন সেই অনুষঙ্গ, যেখানে বিপ্রদাস কুমুকে বলছে যে, গানে চিরকালটাই আসে সামনে। এভাবেই মন পায় মুক্তি। শঙ্খ ঘোষের হাত ধরে আমরা পৌঁছে যাই এক অন্য আত্মদীক্ষায়, যে সুর মধুসূদনের ক্লিন্ন আবেষ্টনের হাত থেকে কুমুকে বার করে আনতে চায়। এ গ্রন্থ তাই এক রূপসাগর, যাতে ডুব দিলে অরূপ রতনের খোঁজ পাওয়া যায়। এ এক অনন্ত পরিক্রমা। ছিল, আছে, থাকবে। জীবনসত্যের মতোই অম্লান এ গ্রন্থ। এ যেন আমাদের অন্তর্নিহিত  বোধের আবরণ উন্মোচন। এ যেন সেই মোহমুক্ত আমির যাত্রা ‘প্রভু তোমার পানে’।



এ আমির আবরণ
শঙ্খ ঘোষ
প্যাপিরাস, কলকাতা

 



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন