![]() |
প্রচ্ছদ পরিকল্পনা: শর্মিলী মোস্তফী |
অরুন্ধতী দাস
অবোধ শিশু আর মুখর তরুণীর মাঝখানে যে স্পর্শকাতর কিশোরীবেলা অনাদরে পড়ে থাকে, ঝকঝকে নয়, দুরস্ত নয়, জীবনের উড়ো হাওয়ায় ভেসে-আসা ধারালো আক্রমণের টুকরোগুলোকে ফ্রকের কোণ থেকে চোরকাঁটার মতো বেছে ফেলে দিতে তখনও না-শেখা সেই বুঝভুম্বুল বয়ঃসন্ধির সামনে এক আশ্চর্য আয়না ধরেছেন অহনা বিশ্বাস, তাঁর ‘আমার বস্তি-জীবন’ বইয়ে। পরিচ্ছেদ ভেঙে ভেঙে লিখে যাওয়া স্মৃতিমুখর কাহিনির ঢঙে। যে-কোনো শহুরে মধ্যবিত্ত বাড়িতে, শুধু ‘বস্তি’ শব্দটুকুকে কেন্দ্র করেই ভূরিপরিমাণ রক্ষণশীলতা এবং আড়চোখে এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা তলে তলে রয়ে যায়। ঠিক তেমনই চোরাস্রোতে বাঁধা একটি বাড়ির মেয়ের চোখে যখন ধরা পড়ে বাড়িরই লাগোয়া বস্তির সেই ‘অন্য’দের ‘অপর’ জীবন, তখন নিষিদ্ধ কুপথ্য খাওয়ার মতোই নিঃশব্দে, নিশ্চুপে কিন্তু গোগ্রাসে সেই অতটুকু নিরীক্ষণকে উপভোগ করে নেয় সে।
যে অধরা পৃথিবীর খবর তার কাছে সরাসরি এসে পৌঁছোয় না, কিন্তু ঠারেঠোরে জানান দিতে থাকে দরজার বাইরে থেকে, সেই ‘বড়ো’দের দুনিয়ারই একটুখানি ঝলক তার চোখে ধাঁধা লাগিয়ে দিয়ে যায় এই বস্তির মানুষগুলোর সৌজন্যে। আব্রুর শৌখিনতা তাদের নেই, জীবনকে বেঁধে রাখার দায়ও নেই, উচ্চকিত যাপনের মধ্যে নিভৃতির নেই কোনো অবসর। ছেলেবেলা থেকে মধ্যবিত্ত বাঙালি ভদ্রতার ঘেরাটোপে বেড়ে-ওঠা মেয়েটির কাছে ওই জীবন তাই যে অবাধ্য হাতছানির ইশারায় ডাক দিয়ে যায়, মায়ের কুঁচকে–যাওয়া ভুরুকেও উপেক্ষা করে সে ডাকে সে সাড়া দেয় যখন-তখন।
স্কুল থেকে ফেরার পর, কিংবা কিচ্ছু-না-করতে-চাওয়া একলা অবসরে তার ঠিকানা হয়ে ওঠে বাড়ির অর্ধেক তৈরি হওয়া সিঁড়ির চুড়োটি। পাখির নজরে যেখান থেকে ধরা পড়ে যায় বাড়ি ঘিরে ফেলা বস্তির ঘর, তাদের অনর্গল জীবন, সুখ, দুঃখ, যৌনতা, অপ্রেম, ব্যর্থতা, নিরাপত্তাহীনতা—সব। কিন্তু এই দেখার মধ্যে নিরীক্ষণের যে মেজাজটি ধরা পড়েছে, তার চরিত্রটি অদ্ভুত। বেড়ে ওঠার এক লাজুক মুহূর্তে, কিশোরীর কৌতূহল আর বয়ঃসন্ধির আড়ষ্টতা যখন প্রতি পদক্ষেপে, ঠিক তেমন দিনগুলোয় মেয়েটি শুধু দেখার সূত্রে জড়িয়ে পড়ে এমন একদল মানুষের সঙ্গে, যাদের সঙ্গে তার রুচি, মনমেজাজ, বলাকওয়ার কোনো সম্বন্ধই নেই! আর এইরকম নিঃসম্পর্কতার সম্পর্কে তো কোনো দায়ভার থাকে না, তাই সেই সব সম্পর্কের কথা বলার সময় নির্মোহ হওয়া যায় অনেক বেশি। সত্যি কথা বলা যায় অনেক গভীরে গিয়ে, তার আঁচ টের পাওয়া যায় বহুগুণ বেশি।
আর ওই যে টলটলে পদ্মপাতার জলের মতো বয়স, যে বয়সে চোখ সোজাসুজি তাকিয়ে যতটুকু দেখে, আড়চোখে দেখে ঢের বেশি, তেমন দিনগুলোতে এমন সুযোগ যদি পাওয়া যায়, যা কিনা বড়োদের লুকিয়ে রাখা নিজস্ব গোপনীয়তার মতোই আকাঙ্ক্ষিত, তখন সেই সদ্য বালিকাবেলা পেরিয়ে-আসা মেয়েটির কাছে তা-ই হয়ে ওঠে বড়ো হয়ে উঠতে শেখার প্রথম অভিজ্ঞান, প্রাপ্তবয়স ছুঁতে চাওয়ার শুরুর পাঠ। সে পাঠের মধ্যে তীর্থযাত্রায় মৃত গীতার ঠাকুমার গল্প থাকে, অন্যের ঘুড়ি নামাতে গিয়ে অপমানিত কৈশোরের প্রথম জ্বালা থাকে, ছেড়ে-যাওয়া প্রেমিকের আশায় বসে-থাকা লতার ফ্রকের আড়ালে বয়স ঢাকতে চাওয়ার বিসদৃশ বর্ণনা থাকে আর থাকে শেষপর্যন্ত বাড়িওয়ালার প্রতারণায় গোটা বস্তির উৎখাত হয়ে যাওয়ার কিস্সা।
নৈর্ব্যক্তিক ঔদাসীন্য আর কিশোরীর প্রথম কৌতূহলের আবেগ—এই দুই টান আর পোড়েনের সুতোয় অহনা বিশ্বাস অসাধারণ একটি কাহিনি বুনেছেন। তাঁর এই বই আসলে দেখার গল্প, যে দেখার একদিকে যেমন কিশোরীর চোখে বস্তির জীবনটি ধরা থাকে, তারই অন্যদিকে থাকে এক পরিণত নারীর স্মৃতিচারণের ছলে নিজের কৈশোরক দিনগুলিকে ছুঁয়ে থাকা। এখানে দেখার তাই দুটি স্তর রয়ে গেছে। একটি স্তরে কিশোরীর যাতায়াত, অন্য স্তরটিতে সেই কিশোরীকে ভেবে যান কথক নিজে, তাঁরই হারানো দিনের কথা বলতে বসে, যে দিনগুলো তাঁর চোখে নিজের ফেলে-আসা জীবনের মতো গভীর প্রত্যয় পায়। বইয়ের নামটি সেইজন্যেই বোধহয় ‘আমার চোখে বস্তি-জীবন’ নয়, বরং ‘আমার বস্তি-জীবন’।
আলাদা করে চোখ টানে এই বইয়ের অলংকরণ। প্রচ্ছদ থেকে শুরু করে পাতায় পাতায় এঁকে যাওয়া সাদা কালো ছবিগুলির মধ্যে দিয়ে অনুষ্কা দত্ত আশ্চর্যরকম সাফল্যের সঙ্গে অহনার কথনভঙ্গিটির চালে মিলিয়ে দিয়েছেন তাঁর রেখার চলন। অহনার প্রতিটি অনুভূতি যেন প্রখর হয়ে উঠেছে তাঁর ছবির গভীর ভাষায়। রূপে আর কথায়, এ বই পাঠককে এক বিধুর মায়াময় দৃশ্যপটের গল্প বলবে, যে দুনিয়ায় সবাই কখনও না কখনও গেছে, কিন্তু তাকে ফিরে পায়নি, কেউ না, কোনোদিন না।
আমার বস্তি-জীবন
অহনা বিশ্বাস
ঌঋকাল বুকস, কলকাতা