দোঁহা

ওরা চার যুবক আর দুই যুবতী

 


সুনির্মল বসু 

পাড়ার মোড়ে দাঁড়িয়ে অনিমেষ বিগ বিগ ডায়লগ মারছিল। 

এর পেছনে কারণ হলো, ও গতকাল মামা কাকার প্যানটুল ধরে চাকরির অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পেয়েছে। 
শর্মিলা বলল, আমাদের সকলকে খাওয়াতে হবে কিন্তু!
সুদীপ্ত এখনো চাকরি যোগাড় করতে পারেনি। বলল, কেহ মরে বিল সেঁচে, কেহ খায় কই। 

পুলকেশ হঠাৎ হেসে উঠলো। বলল, আমার শালা জীবনে চাকরি হবে না। মামা কাকা নেই। 
তারপর অনিমেষের দিকে তাকিয়ে বলল, তোর তো মহিলা মহলে খুব নাম ডাক। আমাকে একটা ব্যবস্থা করে দে না মাইরি, চাকরি হবে না জানি, একটু জমিয়ে প্রেম করতে চাই। 

বিভাস বলল, মারবো পোনদে এক লাথ, বাপের নাম ইয়াদ করতে পারবি না। 

জয়া বলল, কোথায় খাওয়াবি রে? বাদশা, না আহার? 
অনিমেষ বলল, আহারে চল। 
শর্মিলা বলল, প্রেম করতে হলে, পকেটে রেস্ত থাকা চাই।

পুলকেশ বলল, টিউশনি করে এভাবে মাসের খরচ চালানো যায় না। আমি তো সিগারেট ছেড়ে দিয়েছি, 
দেশীয় কুটির শিল্পের উন্নতির জন্য শেষ পর্যন্ত খাঁকি শিল্পে আশ্রয় নিয়েছি।

বিভাস বলল, অ্যাই খবরদার, মেয়েদের সামনে বিড়ি ফুকবি না।

সুদীপ্ত বলল, অনিমেষ, তুই চাকরি পেয়েছিস, সবাইকে একটা করে ফিল্টার উইলস খাইয়ে দে!

শর্মিলা বলল, আর আমরা মেয়েরা বাদ যাবো?

অনিমেষ বলল, চ, কালভার্টের পাশে ফুচকাওয়ালা বসেছে। তোরা মেয়েরা ওখানে ফুচকা খা। আমরা সিগারেট ফুঁকে ওখানে আসছি। 
আমি বিল পেমেন্ট করবো।

সুদীপ্তর মনে পড়ল, ও ক্লাসের ফার্স্ট বয় ছিল। বিভাস ক্লাসের থার্ড বয়। অথচ, চাকরি পেল অনিমেষ। পিছনে মামা কাকা না থাকলে, এই বাজারে চাকরি জোটানো মুশকিল। 

অনিমেষের আগে থেকেই অনেক মেয়ে বন্ধু ছিল। চাকরি পাবার পর সেই সংখ্যাটা আরো বেড়ে গেল। 

জয়া ভাবছিল, ওর বয়স আঠাশ পেরিয়ে গেছে, চার বছর আগে গ্রাজুয়েশন করেছিল। বিয়ের চেষ্টা চলছিল। কিন্তু পাত্রপক্ষের দাবি দাওয়ার জন্য বারবার বিয়ে ভেঙে গেছে। 

অথচ, জয়াকে যথেষ্ট সুন্দরী বলতে হবে। ও ভাবে,
আজকালকার ছেলেগুলো অত্যন্ত ধূর্ত। 

তাই পাওনা গন্ডা আদায়ের সময় বাপের সুবোধ বালক হয়ে যায়। 

শর্মিলা শাল পাতার মধ্যে ফুচকা তেঁতুল গোলা জল
সুদ্ধ মুখে পুরে বলে, আমার একজন অবলাকান্ত আছে বটে, সেটা একেবারে পাথর, মুখে কোন কথা নেই। গুড বয় এর মতো অফিস করে, বাড়ি চলে আসে। বাকি সময়টা গান শুনে কাটায়। 

জয়া বলল, তোকে পুজোর সময় কলকাতায় ঠাকুর দেখাতে নিয়ে যায় নি?
শর্মিলা বলল, কলেজ স্কোয়ার, মোহাম্মদ আলী পার্ক, সন্তোষ মিত্র স্কোয়ারের ঠাকুর দেখিয়ে আমাকে আইসক্রিম খাওয়াতে নিয়ে গেল। তারপর হেঁটে হেঁটে আমার পা ফুলে ঢোল। 
বিভাস বলল, তারপর? 
শর্মিলা উত্তর দিল, তারপর একটা উবের বুক করে 
আর্সেনালে মটন বিরিয়ানি খাওয়াতে নিয়ে গেল।

সুদীপ্ত বলল, মালটা ভালোই জুটিয়েছিস। 

অনিমেষ বলল, আমি কিন্তু পুজোর সময় প্যান্ডেলের ঠাকুর বেশি দেখি না, রাস্তার ঠাকুর দেখার ব্যাপারে আমার বেশি ঝোঁক।

বিভাস সিগারেটটা দূরে ছুঁড়ে ফেলে বলল, পুলকেশ,
ওই শালার পশ্চাৎ দেশে কষিয়ে একটা লাথি মার তো! 
জয়া বলল, একদম নয়। চল ওকে রেস্টুরেন্টে ঢুকিয়ে মুরগি বানাবো। 

ওরা আহার রেস্টুরেন্টে ঢুকে পড়ল।

পুলকেশ জয়ার মুখোমুখি বসলো। মেনু চার্ট একটু বাদেই বেহারা দিয়ে গেল। 

অনিমেষ বলল, তোরা যে যা খেতে চাস, অর্ডার কর। 
শর্মিলা বলল, এক যাত্রায় কখনোই পৃথক ফল নয়। 
সকলে একটা করে মটন বিরিয়ানি নিয়ে নিই।
রাত সাড়ে নটায় ওরা পথে নেমে এলো। 

জয়া বললো, বাড়ি ফিরতে দেরি হল। আমাদের রাস্তাটা অন্ধকার। এখন কি হবে? 

পুলকেশ বলল, আমি এগিয়ে দিই। 
জয়া খুশি হল। বলল, থ্যাঙ্ক ইউ। 

ওরা কালিকার মোড় দিয়ে বাড়ি ফিরছিল। দুজন 
লক্কা মার্কা ছেলে ওদের পথ আটকে দাঁড়ালো। একজন বলল, কিরে এত রাতে প্রেম করতে বেরিয়েছিস? 
পুলকেশ বলল, কেন কোন প্রবলেম আছে? 
অন্যজন জয়ার গায়ের সামনে এগিয়ে গেল। পুলকেশ বলল, সরে দাঁড়া। 
না হলে কি করবি? 
পুলকেশ প্রথম জনের নাকে একটা তীব্র ঘুষ চালিয়ে দিল। অন্যজন এগিয়ে আসতেই, ও আগেভাগে ওরদিকে একটা তীব্র বাঁ পায়ের লাথি কষিয়ে দিল। 

ওরা দুজনে বিধ্বস্ত হয়ে মাথা নিচু করে সরে গেল। 
যাওয়ার সময় বলল, পরে হিসেব হবে। 

পুলকেশ বলল, এই এরিয়ায় যেন আর কোনদিন না দেখি। যদি দেখি, এমন ক্যালাবো, ফটো তুললে নেগেটিভ আসবেনা। 

জয়া বলল, ভাগ্যিস, তুমি সঙ্গে ছিলে, তা না হলে, কি হতো? 
পুলকেশ বলল, না না, একটু কড়া ডোজের ওষুধ পড়লে, ওরা এই পথে আর আসবে না।

জয়াকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে পুলকেশ ফিরে এলো।
এই ঘটনার পর থেকে জয়া মনে মনে পুলকেশকে ভালোবেসে ফেলল। 

দুদিন পরে নিউল্যান্ড বটতলায় সন্ধ্যেবেলায় ওদের সবার দেখা হল। 
বিভাস বলল, আজ আমি টিউশনি টাকা পেয়েছি। সবাইকে নিবেদনীতে কচুরি খাওয়াবো। এবং সবশেষে দুটো গরম জিলিপি। 

শর্মিলা বলল, দারুন আইডিয়া! গরম জিলিপি আমি ভীষণ পছন্দ করি। 

অনিমেষ বলল, আজ অফিসে আমাদের রিসেপশনিস্ট মেয়েটার সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে। আমি এখন ঘোরের মধ্যে আছি। 

সুদীপ্ত জিজ্ঞাসা করল, এটা তোর কত নম্বর প্রেম? 
অনিমেষ বলল, এভাবে বলছিস কেন? প্রেমের আবার সংখ্যা? প্রেমের আবার বয়েস?
বিভাস বলল, প্রেমের ভুবনে তোর এত রমরমা, ভাই আমরা কিছু পাবো না? 

পুলকেশ বলল, ট্রাই এন্ড ট্রাই এগেইন বয়েজ, ইউ উইল সাকসিড অ্যাট লাস্ট। 

ওরা সবাই একসঙ্গে হেসে উঠলো। 

শাল পাতায় কচুরি খেতে খেতে ওরা কথা বলছিল। 
সুদীপ্ত বলল, আজ আমার চাকরির এপয়েন্টমেন্ট লেটার এসেছে। একটা প্রাইভেট ফার্মে কাজ। সামনের সপ্তাহে জয়েন করবো।

শর্মিলা বলল, গুড নিউজ। এতক্ষণ পরে জানলাম। 
খাওয়া-দাওয়ার পর পুলকেশ জয়াকে এগিয়ে দিতে গেল।

কালিকার মোড় পার হতেই, আগের দিনের সেই দুটি লক্কা মার্কা ছেলে ছুরি নিয়ে পুলকেশ কে আক্রমণ করল। পিঠে এবং পেটে ছুরি চালিয়ে দিল। 

জয়া ডাকাডাকি করতে, অনেকে এসে ওকে হাসপাতালে নিয়ে গেল। 
আঘাত গুরুতর নয়। ডাক্তার বাবু জানালেন। 
চারদিন পর ও হাসপাতাল থেকে ছুটি পেল।

থানা থেকে পুলিশ এসেছিল। পুলিশ দুই অপরাধীকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যায়। 

সুদীপ্ত, বিভাস, অনিমেষ, শর্মিলা, জয়া, সবার আজ মন খারাপ। পুলকেশের জন্য।

বিভাস বলছিল, আমরা অস্থির সময়ের সন্তান। 
অনিমেষ বলল, আমরা ট্রাপিজের তারের উপর দিয়ে হাঁটছি। 

সুদীপ্ত বলল, একটু সাবধান না হলে, সামনে বিপদ। 
শর্মিলা বলল, এরই মধ্যে আমাদের বেঁচে থাকা, আমাদের জীবন যন্ত্রণা, আমাদের ভালোবাসা, আমাদের কষ্ট। 

জয়া বললো, পুলকেশকে আমি এই অবস্থায় ফেলে যেতে পারবো না। আমি ওকে ভালোবাসি। আমি ওকে বিয়ে করব। দুজনে মিলে টিউশনি করে সংসার চালাবো। 

ওদিক থেকে বিশুদা টলমলে পায়ে বাড়ি ফিরছিলেন। তিনি আজ একটু বেশি খেয়ে ফেলেছেন। 

সবার দিকে চেয়ে বললেন, এই যে ব্রাদারস এন্ড সিস্টার্স, একটা কথা বলা জরুরী, 
এটা খুব কঠিন সময়, আমাদের সকলকে নিজের নিজের মতো করে ভালো থাকতে হবে।

শর্মিলা বলল, ঠিক বলেছেন দাদা। 

সুদীপ্ত বলল, আমি কি আপনাকে একটু এগিয়ে দেবো? 

বিশুদা বললেন, নট নেসেসারি। মাল খেয়ে আজ অব্দি শাললা কখনো আমার পা টলে নি।





একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন