সুমি দত্তগুপ্ত
সময় টা ২০২১। তখন ঘোর করোনা কাল চলছে। চারিদিকে খালি মন খারাপ করা খবর। এরই মাঝে ২০২১ এর এপ্রিলের এক সকালে ছোট্ট একটা খবরে চোখ আটকে গেল, রাজ্যপাটহীন রাজনগরের রাজাবাবু মোহাম্মদ রফিকুল আলমের জীবনাবসান হয়েছে। রাজনগর, তার আবার রাজাসাহেব, খুব যে সবার কাছে আগ্রহের, কৌতূহলের খবর এমন নয়। রাজনগর আমার কাছে ও তখন পর্যন্ত শুধুই শ্রবণে, চাক্ষুষ পরিচয় ঘটেনি। বইয়ের পাতায় অবশ্য ঘটেছিল, যখন কিশোর বয়সে আনন্দমঠ উপন্যাস হাতে আসে, বাংলা প্রদেশের বর্ণনায় লেখক লেখেন, "বীরভূম প্রদেশ, বীরভূম রাজার অধীনে। রাজনগর বা নগর তাহাদেরই রাজধানী। বীরভূমের রাজারা পূর্বে স্বাধীন ছিলেন, সম্প্রতি মুর্শিদাবাদের অধীন হইয়াছিলেন। পূর্বে বীরভূমে হিন্দুরাই স্বাধীন রাজা ছিলেন। কিন্তু আধুনিক রাজবংশ মুসলমান।" রাজনগর নামটার সাথে ঐ প্রথম পরিচয় হলেও, তারপরে তা চলে গিয়েছিল স্মৃতির আড়ালে। এই খবরটা পড়েই আনন্দমঠ উপন্যাসের কথা আবার মনের মধ্যে এলো। হঠাৎ করেই কেন জানি না, মন উচাটন হলো শুধু একবার যাওয়ার জন্য।
অনেক দোলাচলের মধ্যে দিয়ে কার্তিকের মাঝামাঝি রওনা হলাম রাজনগরের পথে। বোলপুরে রাত্রিবাস করে সকালে চলেছি রাজনগর। সিউড়ি থেকে বড়কোন্ডা, চন্দ্রপুর, পাতাডাঙ্গা মোড়, করিধ্যা হয়ে গাড়ি ছুটে চলেছে। মাঠে কার্তিকের ধান, এখনও তেমন পাক ধরে নি, তাই যেদিকে দুচোখ যায় আদিগন্ত সবুজ, তারই মাঝে কোথাও সাদা বক ধ্যানীর মতো বসে আছে, চই চই শব্দে এগিয়ে চলা হাঁসের দল, দোয়েলের শিসের শব্দ, লাল মাটির গ্রামের রাস্তা, ছোট ছোট বাড়ী, উঠোনে শুকোতে দেওয়া অনেক রঙীন শাড়ী, সবুজ ঈদগাহ, ঈদগাহে সদ্য রঙের প্রলেপ পড়েছে, অনেক দূরের দৃষ্টিপথে চকমেলানো সাদা ধবধবে মসজিদ, দূর থেকে ভেসে আসা আজানের সুর, মাটি লেপা দেওয়ালে ভোটের দেওয়াল লিখন। সব ছাপিয়ে মন জুড়ে তখন রাজার নগরের প্রতীক্ষা ।
প্রথম দর্শনে রাজনগরকে দেখে কোনোভাবেই ভালো লাগার কথা নয়। ভাঙ্গা চোরা রাজবাড়ী, আগাছার জঙ্গল, দৈন্য দশার চিহ্ন সর্বত্র, বৈভব, প্রাচুর্য্য না থাকুক, মানুষের গ্রাসাচ্ছাদনের ন্যুনতম সুবিধাও যে নেই তার ছাপ একেবারে স্পষ্ট। চারিদিকে দারিদ্র্য, মলিনতা, নিঃস্ব অর্থনীতির চিহ্ন। রবিবারের হাট সেদিনও বসেছিল, কিন্তু সেখানেও ক্রেতা নেই বললেই চলে, জিনিসপত্র ও খুব সামান্য। কুণ্ডলী পাকিয়ে দোকানের মাচার নীচে কুকুর শুয়ে আছে। দোকানপাট যা কিছু আছে বড়ই টিমটিম করে অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে।
ইমামবাড়া ফেরত কয়েকজন মৌলবীর কাছে রাজবাড়ীর সুলুক সন্ধান পাওয়া গেল। চারিদিকে খন্ডহর, তবুও রাজনগরের আকাশ বাতাস ইতিহাসের কথা বলে। শহরে ঢুকেই মতিচুর মসজিদের প্রবেশদ্বারের ভগ্নাংশ, যার অলংকরণে হিন্দু ইসলামিয় ভাস্কর্য রীতির বৈশিষ্ট্য পরিস্ফুট। এখানেই আছে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার বোর্ড লাগানো। যদিও তত্ত্বাবধানের তেমন নজির চোখে পড়লো না।
নিস্তব্ধ দুপুরে, ইমামবাড়া জনমানবহীন। প্রাচীন ইমারত দাঁড়িয়ে আছে। মাঠে গরু চরে বেড়াচ্ছে। পাশেই বিরাট রাজনগর হাই স্কুলের বিল্ডিং। তার পাশেই রয়েছে নিম্ন বুনিয়াদী বিদ্যালয়ের সুন্দর , দেওয়ালে রঙীন চিত্রিত বাড়ী। এই এলাকায় যা বড়ই বেমানান। আছে প্রাচীন পাঠাগার। অনতিদূরে কালীদহ, তারই মাঝে অযত্নে, অবহেলায় পড়ে থাকা রাজবাড়ী।
রাজার গল্প শুনতে শুনতে চলছিলাম রাজনগরের পথে, নাম জানাতে অনিচ্ছুক ৯০ বছরের বৃদ্ধের কাছে। যে কাহিনী কখনও গৌরবের,কখনও অগৌরবের। তবুও বীরভূমের এই অঞ্চলে স্বাধীন শাসক হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে বীর রাজারা যে কৃতিত্বের পরিচয় রেখেছিলেন, আজও অঞ্চলের অধিবাসীরা তা নিয়ে গর্ব অনুভব করে। করবে নাই বা কেন?
অবস্থানগত দিক থেকে রাজনগরের রাজনৈতিক ও সামরিক গুরুত্ব যথেষ্ট ছিল। কারণ রাজনগর ছিল উত্তর ভারত থেকে বাংলায় ঢোকার প্রবেশদ্বার। রাজনগরের আকাশে বাতাসে ইতিহাসের হাতছানি। রাজবাড়ী, কালীদহ দীঘি, খন্ডহর, মতিচুড় মসজিদ সেই ইতিহাসের কথা বলে। কয়েক শতাব্দী ধরে এখানকার ইতিহাস তাই কখনও হিন্দু, কখনও মুসলমান শাসকের হাত ধরে আবর্তিত হয়েছে।
বীরভূম জেলার একসময়ের রাজধানী ছিল রাজনগর। কথিত আছে, সেনবংশীয় রাজা লক্ষণসেন ১২শ শতাব্দীতে এই নগরীর পত্তন করেন। এটি পরে নগর বা নাগর নামে জনপ্রিয় হয়। এই নগরই পরবর্তীকালের রাজনগর।
রাজনগরের কিছু কিছু ধ্বংসাবশেষে উড়িষ্যার স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন মেলে। জানা যায়, ত্রয়োদশ শতাব্দীতে উড়িষ্যার জাজপুরের রাজা এই নগর আক্রমণ ও দখল করেন।
প্রাচীন রাজনগর কে সুরক্ষিত করার জন্য নগরটির চারপাশে প্রাচীর তৈরি করা হয়েছিল। চারটি তোরণ ছিল চারপাশে। যার ফলে খিলজী থেকে বলবন বংশীয় শাসকেরা বারবার বাংলা আক্রমণ করলেও রাজনগরে অনুপ্রবেশ করতে পারে নি।
রাজা বীরসিংহের আমলেই নগরীর পত্তন। আবার তিনিই যখন রাজনগরের রাজা, তখন ১২০৫ খ্রিষ্টাব্দে বখতিয়ার খিলজী বীরভূম আক্রমণ করেন। আলী মর্দন, খিলজী সেনাপতি রাজনগর দখল করেন। কিন্তু খুব দীর্ঘস্থায়ী হলো না মুসলমানি শাসন। তবে মুঘল শাসনাধীনে ছিল এই অঞ্চল। টোডরমল যখন মুঘলদের রাজস্ব বিভাগের পরামর্শদাতা, অর্থমন্ত্রী তখন এই রাজনগর ছিল করদ অঞ্চল বা রাজ্য।
১৬০০ খ্রিষ্টাব্দে এলো সেই সুযোগ। বীর রাজার দুই সেনাপতি ছিলেন আসাদুল্লাহ খান, আর জুনাইদ খান। জুনাইদ খানের সাথে পরিকল্পনা করে রাণী বীর রাজাকে হত্যা করেন, সিংহাসনে আরোহণ করেন জুনাইদ খান, তারপর বাহাদুর খান, রণমস্ত খান, আসাদুল্লাহ খান বংশ পরম্পরায় চলতে থাকে মুসলমানি শাসন।
এরা রাজা উপাধি গ্রহণ করেন। মুর্শিদাবাদের নবাবের সাথে এদের সুসম্পর্ক ছিল। বড়ি উস জামান খান মুর্শিদকুলি খানের কাছ থেকে স্বীকৃতি পান। এই সময়ে রাজনগর খুবই গুরত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
ইংরেজ আমলের প্রথম দিকে রাজনগরের রাজারা স্বাধীনভাবেই বসবাস করতেন। বাংলার নবাব সিরাজোদ্দৌলার সাথেও তাদের সুসম্পর্ক ছিল। কিন্তু কর দেওয়া, না দেওয়া নিয়ে মিরকাশিমের সাথে তাদের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। ১৭৬১ সালে, আসাদ উর জামান খান ব্রিটিশ ও মীরকাশিমের যৌথ বাহিনীর কাছে পরাজিত হন, হেতমপুরের যুদ্ধে। চুক্তি অনুসারে তিনি তার রাজ্য ও হৃত মর্যাদা ফিরে পেলেও, শেষ পর্যন্ত হেতমপুরের রাজার অধীনতা স্বীকার করেন। ব্রিটিশরা বীরভূমের সদর শহর হিসেবে সিউড়ি কে প্রতিষ্ঠিত করেন। ঊনিশ শতকে রাজনগর তার মর্যাদা হারিয়ে এক পরিত্যক্ত নগরীতে পরিণত হয়। রাজনগরের সুদিনের ও অবসান ঘটে। বিস্মৃতির অন্তরালে চলে যেতে থাকে রাজনগর। তারপর ছিল শুধুই কালের অপেক্ষা।
ধীরে ধীরে রাজ কৌলিন্য হারায়। নবাব বাহাদুর আর ইংরেজ সরকারের নেক নজর থেকে অনেক দূরে সরে যায় রাজনগর। সব জৌলুস তখন অন্তর্হিত। রাজনগর রয়ে যায় শুধু স্মৃতির পাতায়।
কিছুদিন আগেও শেষ রাজা রফিকুল আলম খান রাজমহিমা হারিয়ে জীবিত ছিলেন। ঈদ, মহরমের সময়ে পুরনো রাজবেশ পরিহিত রাজা জনসাধারণ কে ফিরিয়ে নিয়ে যেতেন রাজনগরের সেই পুরনো দিনগুলি তে। রফিকুল আলম এর মৃত্যুর পরে, সবই এখন, ধূসর,মলিন, স্মৃতি, সুদূর নীহারিকা।
কিন্তু ইতিহাস পিপাসু ভ্রামনিকদের দৃষ্টিপথ থেকে রাজনগর কখনোই সরে যায় নি। তবুও কোনও অজানা কারণে রাজনগরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংরক্ষণে এক ঔদাসীন্য এলাকাবাসীর হতাশার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এলাকার মানোন্নয়ন ইতিহাসের হাত ধরেই হওয়া সম্ভব বলে তারা মনে করেন।