দোঁহা

শ্রীশ্রীশ্যামাপূজা



অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়
         
কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে পালিত হয় শ্রীশ্রীকালী পূজা। পুরাকালে প্রাকৃতিক দুর্যোগকে মানুষ অশুভ সঙ্কেত বলে স্বীকার করতো। বিপণ্ণ, অসহায় ও সাধারণ গোবেচারা মানুষ সেই অশুভ শক্তির হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার আশায় সৃষ্টি করেছিল ঈশ্বর সম্পর্কিত ধ্যান-ধারণা। শোকে তাপে জর্জরিত নিরুপায় মানুষ যখন দিশেহারা হয়ে ওঠে তখনই বোধহয় মনে জাগে ঈশ্বর চিন্তা। তাই কাউকে অবলম্বন করে সে সাময়িক দুঃখ-শোক ভুলে থাকতে চায়। মানব সভ্যতার আদিপর্ব থেকেই ঈশ্বর বলে কেউ আছেন কি নেই বা তাঁর স্বরূপ কি এই প্রকার নানাবিধ প্রশ্ন তাঁকে অপার কৌতূহলী করে রেখেছে আজও। তবুও সেই অদৃষ্ট দেবতার শ্রীচরণেই তাঁর যত প্রার্থনা ও আকুতি। সেই পুরাতন অভ্যেস বশতঃ এখনো মানুষ তাঁর আরাধ্য দেবতার শ্রীচরণকমলে মানত করেন, পুজো দেন বা ধর্ণা দেন আসন্ন বিপদমুক্ত হওয়ার অভিপ্রায়। প্রকৃতির বিচিত্র লীলায় মানুষ কখনও ভীত, কখনও বিস্মিত আবার কখনও মুগ্ধ। কার পুজো করলে সে শান্তি পাবে বা বিপদমুক্ত হবে তাঁর মনে কেবল এই চিন্তা। সেই কারণে মানুষ জড়, জীব এবং প্রকৃতিকে স্বেচ্ছায় দেবতার আসনে অধিষ্ঠিত করেছিল। আর তখন থেকেই পৃথিবীর মানুষ বিভিন্ন নামে বিভিন্ন দেবতার পুজো করে চলেছেন।
       
বৈজ্ঞানিকরা যেমন একের পর এক অভিনব পদ্ধতিতে মানুষের দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োজনীয় নিত্য নতূন নানান সামগ্রী আবিস্কার করে চলেছেন, সৃষ্টিতত্ত্বের রহস্য উন্মোচনে তাঁরা সদাই ব্যস্ত; ঠিক তেমনই আধ্যাত্মিক জগতের ক্ষেত্রেও সেই একই কথা। অর্থাৎ ঈশ্বরকে জানার নামই জ্ঞান। তাই যোগী ঋষিরা ঈশ্বরকে জানার খোঁজে সদাই ব্যস্ত৷ আপাতদৃষ্টিতে পৃথক মনে হলেও উভয়ের খোঁজই এক এবং অনির্বচনীয়। উভয়েরই উদ্দেশ্য এক। একজন বহির্মুখী অর্থাৎ বাহ্যিক অন্যজন অন্তর্মুখী অর্থাৎ আত্মিক।
         
কালীতত্ত্ব নিয়েও সাধকদের কৌতূহলের শেষ নেই। পূর্বে কালীরূপী শক্তির আরাধনা হতো ঘট বসিয়ে, মূর্তিবিহীন।  তখনো কালীর মূর্তি আবিস্কার হয়নি। বর্তমানে কালীর যে ভীষণা আগ্রাসী করাল রূপিণী, এলোকেশী উলঙ্গিনী, পতিদেহ পেষণকারী মূর্তি আমরা কার্ত্তিক অমাবস্যা তিথিতে দেখতে পাই সেই রূপ উপস্থাপিত হয়েছিল   নবদ্বীপবাসী তন্ত্রসাধক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের দ্বারা। তিনি ছিলেন সপ্তদশ শতাব্দীর একজন বাঙালি তন্ত্রসাধক এবং সাধককবি রামপ্রসাদ সেনের তন্ত্রসাধনার দীক্ষাগুরু। তন্ত্রসাধক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশই সর্বপ্রথম কালীরূপী শক্তিকে মূর্তি আকারে প্রকাশ করেন।  কথিত আছে স্বয়ং মা কালী তাঁর ভাবী নিজ রূপের বিষয় সম্পর্কে ভক্ত আগমবাগীশকে স্বপ্নে নির্দেশ দিয়েছিলেন। ঘুমের মধ্যে তিনি মা কালীর রূপ সম্পর্কে স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন – 'ভোরে ঘুম থেকে উঠে সর্বপ্রথম যার দর্শন পাবি তাঁরই মধ্যে দেখতে পাবি আমার রূপ’। মায়ের  স্বপ্নাদেশ অনুযায়ী পরের দিন ঘুম থেকে উঠে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে আসতেই তিনি দেখতে পান অল্পবয়সী কালো একটি মেয়ে বিচিত্র ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে ঘুটে দিচ্ছে।  তন্ত্রসাধক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশকে এক ঝলক দেখতে পেয়েই মেয়েটি লজ্জায় জিভ বের করে তৎক্ষনাৎ ছুটে পালিয়ে যায়৷ এই দৃশ্য সন্দর্শনে তাঁর এতদিনের চিন্তা-ভাবনার অবসান ঘটে। তাঁর নিরলস প্রচেষ্টার মাধ্যমে অবশেষে একদিন ফুটে ওঠে মা কালীর প্রকল্পিত রূপকল্প। সেই রূপের নামকরণ হয় ‘দক্ষিণাকালী’। চির আকাঙ্ক্ষিত ও আরাধ্য নিরাকার দেবী কালী এর পরে সাকারে পরিবর্তিত হন। এরপর নবদ্বীপের রাজা মায়ের মন্দির তৈরী করে প্রতিষ্ঠা করেন মায়ের মূর্তি। আগমবাগীশ দ্বারা তৈরী দক্ষিণাকালী নবদ্বীপে রাজার প্রতিষ্ঠিত মন্দিরে আজও পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে পূজিত হয়। সামাজিক ভাবে মায়ের মূর্তি পুজোর প্রচলন হলেও দক্ষিণাকালী মায়ের বিধ্বংসী ভয়াবহ রক্তাক্ত মুন্ডমালা পরিহিতা ও  রক্তপায়ী  মুক্তকেশী কালী সর্বজনপ্রিয় হয়ে ওঠায় বঞ্চিতা ছিলেন।  ভাবের ঘরে কোথাও যেন একটু অভাব থেকে গিয়েছিল। যদিও এই ভীষণাকার মূর্তির সন্মুখে দাঁড়িয়ে আমাদের দেশের বীর স্বাধীনতা সংগ্রামী বাঙালিরা ব্রিটিশ আমলে জীবন উৎসর্গ করার শপথগ্রহণ করতেন। ভয়ঙ্করী আগ্রাসী কালীর রূপ থেকে মা কালীকে সাধারণের গ্রহণযোগ্য ও স্নেহময়ী করে তোলার পক্ষে যার কথা সর্বাগ্রে স্মরণে আসে বা যার অবদান অনস্বীকার্য সে আর কেউ নয়, সেও নবদ্বীপবাসী তন্ত্রসাধক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ মহাশয়েরই যোগ্য শিষ্য, হালিশহর বাসী সাধককবি রামপ্রসাদ সেন (১৭২০ - ১৭ ৮১)।                                                     
         
হিন্দুশাস্ত্রমতে আদ্যাশক্তি বা মহাশক্তি বিভিন্ন রূপে প্রকাশিত হলেও তিনি এক এবং অদ্বিতীয়। মানুষ নিজের বৈশিষ্ট অনুযায়ী তাঁদের দেব-দেবীদের সৃষ্টি করে নিয়েছেন। সেইজন্যে কথায় বলে – Man made his God in his own image. মূলত আমরা সকলেই অখন্ড পরমেশ্বরকেই আরাধনা করি।  শ্রীশ্রীচন্ডীতে সেই মহাশক্তিরূপিণী কালীকে  বিভিন্ন নামে সম্বোধন করা হয়েছে। যেমন – চন্ডীকা, চামুন্ডা, তামসী, খড়িগনী, রক্তদন্তিকা, ভদ্রকালী ইত্যাদি।
         
দেবীপুরাণ ব্যখ্যা অনুযায়ী দেবী দুর্গম অসুরের পিতা রুরুকে হত্যা করে তাঁর চর্ম ও মুন্ড বাম হস্তে ধারণ করেছিলেন বলে তিনি  চামুন্ডা নামে পরিচিতা। তিনি কালক্রমে সৃষ্টি স্থিতি বিনাশিনী বলে দেবতারা তাঁর নামকরণ করেছিলেন কালী।  আবার অন্যমতে 'কাল'-কে নিয়ন্ত্রণ করেন বলে তিনি কালী নামে পরিচিতা। কালী শুধুমাত্র কাল হরণকারিনী নন, ইনি জ্ঞানতত্ত্ব প্রদায়িনী। চতুবর্গ লাভেরও সহায়ক।  ভক্তি ও মুক্তি কামনাতেও ভক্তগণ সর্বাগ্রে কালীকেই স্মরণ করেন।
         
কালী নামের উৎপত্তি সম্পর্কে নানা মুনির নানা মত প্রচলিত। ব্রহ্মার মানসপুত্র রাজা দক্ষের দ্বারা অনুষ্ঠিত শিবহীন যজ্ঞস্থলে সতী পতি নিন্দা শুনতে না পেরে দেহহত্যা করেছিলেন। সেই সময় গিরিরাজ হিমালয় পত্নী মেনকা একটি কন্যালাভের আশায় হিমালয়ে বসে তপস্যা করছিলেন। মহামায়া সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে বর দিয়ে বলেছিলেন – মানুষ, দেবতা, অসুর ও সকল জীব জগতের কল্যান হেতু আমি তোমার কন্যা হয়ে জন্মগ্রহণ করবো।
         
পদ্মপুরাণ অনুসারে, পাবর্তী গর্ভাবস্থায় থাকাকালীন ব্রহ্মা রাত্রি দেবীকে মেনকা গর্ভে  প্রেরণ পূর্বক তাঁর গাত্রবর্ণ কালো করে দেন। যথাসময়ে মেনকা এক অপরূপ রূপসী কন্যার জন্ম দেন কিন্তু তিনি ছিলেন শ্যামবর্ণা। কন্যার প্রকৃত গাত্রবর্ণ ছিল নীল পদ্মের মতো। সেই কারণে কন্যার নামকরণ করা হয় কালী।
       
আবার অন্য দিক থেকে, পর্বত গুহায় তপস্যার ফলে জন্ম হওয়ার কারণে কন্যার আরেক নাম হয় পাবর্তী।  যৌবনপ্রাপ্ত হলে পরে পাবর্তী শিবকে পতি রূপে পাওয়ার কামনায় কালিকা রূপেই ঘোর তপস্যা করেছিলেন। অতঃপর পাবর্তীর তপস্যায় শিব প্রসন্ন হন। উত্তরকালে এই কালী বা পাবর্তীর বিবাহ সম্পণ্ণ হয় দেবাদিদেব মহাদেব শিবের সাথে।
         
একবার দেবরাজ ইন্দ্রের আদেশানুসারে কয়েকজন অপ্সরা এসেছিলেন শিব সমীপে কৈলাশে। সেই গৌরবর্ণা সুন্দরী অপ্সরাগণ মহাদেবের স্তবপাঠ করতে শুরু করলে মহাদেব তাঁদের উদ্দেশ্যে বলেন – পুরুষের অতিথি পুরুষ আর নারীর অতিথি নারী হওয়াই বাঞ্ছনীয়। অতএব আপনারা কালিকার কাছে গমণ করুন। এই কথা বলে মহাদেব পাবর্তীর নিকটে গিয়ে নিজের বক্তব্য পেশ করলেন – ‘হে অঞ্জনসদৃশ শ্যামলা কালী’। সুন্দরী অপ্সরাদের সন্মুখে এইভাবে স্বামীর দ্বারা সম্বোধিত হওয়ার কারণে দেবী পাবর্তী অতিশয় ক্রদ্ধ হয়ে ওঠেন। স্বামীর উপর তাঁর অভিমানও হয়। তিনি গাত্রবর্ণ পরিবর্তিত করার অভিপ্রায় আবার তপস্যা শুরু করেন।  ব্রহ্মার বরেই তিনি পুনরায় কৃষ্ণ কোষ থেকে পরিত্রাণ পান। কঠোর তপস্যার ফলে শ্যামাঙ্গী দেবী নিজ দেহের কৃষ্ণকোষগুলি ত্যাগ করে হন গৌরবর্ণা। আর তাঁর পুরাতন কোষ থেকে সৃষ্টি হয় দেবী কৌশিকী।
         
মার্কন্ডেয় পুরাণ অনুসারে, একদা দেবী কৌশিকী বা দেবী চন্ডী যখন স্নানরতা ঠিক সেই সময় সমস্ত দেবতারা একত্রিত হয়ে তাঁর কাছে গিয়ে বলেন যে, অসুরপতি তাঁকে বেঁধে নিয়ে যাওয়ার জন্যে নির্দেশ দিয়েছেন। এই অপ্রত্যাশিত দুঃসংবাদ শ্রবণ মাত্র ক্রোধে তিনি কৃষ্ণবর্ণা কালীতে রূপান্তরিত হয়ে যান। অসুরপতি প্রেরিত ধূম্রলোচনকে তিনি ভস্ম করে দেন। এরপর রক্তবীজের রুধির পান করে দেবী তাঁকে বধ করেন। অবশেষে চন্ড-মুন্ড নামে পরাক্রান্ত অসুরদ্বয়কে বধ করার পর তিনি উন্মত্ত পদক্ষেপে মেদিনী কাঁপিয়ে উলঙ্গিনী অবস্থায় তাঁর দুই বাম হস্তে খড়্গ ও ছিণ্ণমুন্ড এবং দুই দক্ষিণ হস্তে অভয় ও বরদামুদ্রা সহযোগে খন্ডিত বাহুমালায় কটি বেষ্টিত ও রক্তজবা সম নয়নযুগল বিশিষ্ট মুক্তকেশী কালী চন্ড – মুন্ডের ছিন্ন মুন্ড দেবী কৌশিকীকে উপহার দেওয়ার অভিপ্রায় রওনা হলেন। উন্মত্ত, উলঙ্গিনী ও রুদ্রানী কালীকে বাঁধা দেওয়ার অভিপ্রায় অনন্যোপায় দেবাদিদেব মহাদেব শব হয়ে দেবীর পদতলে লুটিয়ে পড়েন। এই অত্যাশর্য  ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণ মানুষের অন্তঃকরণে নানান জটিল প্রশ্নের উদয় হওয়াটা খুব একটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। পদতলে শিবের নিশ্চল অধিষ্ঠান সম্পর্কে মানুষের অপার কৌতূহল দেখা দেয়। সুতরাং এই প্রশ্নের উত্তরে বলা যেতে পারে –   
         প্রথমতঃ ক্রোধে উন্মত্তা দেবীর ক্রোধ প্রশমিত করার চেষ্টায় দেবাদিদেব মহেশ্বর দেবী কালীর পদতলে স্বেচ্ছায় স্থান গ্রহণ করেছিলেন এবং দেবীর উলঙ্গিনী অবস্থার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষিত করাটাও ছিল তাঁর প্রধান ও অন্যতম কারণ। হঠাৎ অসাবধানতাবশতঃ স্বামীর বুকে পা রাখতেই দেবী কালী সম্বিৎ ফিরে পান আর নিজ কৃতকর্মের দরুণ তিনি লজ্জায় জিভ কাটেন।
         দ্বিতীয়তঃ বলা যেতে পারে, কালীর পদতলে শায়িত শিবকে শবরূপে গণ্য করা হয়। অর্থাৎ মা কালীর পদস্পর্শে পিষ্ট অসুরের শিবত্ব প্রাপ্তি লাভের ইঙ্গিত বহন করে এই ঘটনা। শিবত্ব প্রাপ্তির অর্থ শুভ বুদ্ধির জাগরণ। শক্তিরূপিণী মহামায়ার কৃপায় আসুরিক বৃত্তি অপসারিত হয়ে শিবত্ব প্রাপ্তিও যে ঘটতে পারে এটা তারই প্রতীক।
         তৃতীয়তঃ নারীশক্তির অধীনে বিরাজ করে পুরুষশক্তি। পুরুষের যাবতীয় শক্তির উৎস নিহিত থাকে নারীশক্তির সত্ত্বায়। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত পৃথিবীর প্রত্যেকটি পুরুষ নারী জাতির কাছে ঋণী। যেই দেশ বা সংসারে নারীরা সন্মান পান না, সেই দেশ বা সংসারে কখনও উন্নতিও হয় না ।  
         
কালীর বিভিন্ন মূর্ত্তির পায়ের তলায় শবরূপী শিবের উপস্থিতি দেখতে পাওয়া যায়। যেমন – কালী, তারা, ষোড়শী, ভূবনেশ্বরী, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, ধূমাবতী, বগলা, মাতঙ্গী ও কমলা। আবার শিবহীন মূর্ত্তিও দেখতে পাওয়া যায়। যেমন – ভদ্রকালী, রক্ষাকালী, শ্মশানকালী এবং মহাকালী প্রভৃতি। এছাড়া আরো বিভিণ্ণ রূপে কালীর সাক্ষাৎ মেলে কার্ত্তিক মাসের পূর্ণিমা তিথিতে অনুষ্ঠিত নবদ্বীপের রাসের শোভাযাত্রায়। যেমন ফিরিঙ্গি কালী, কৃষ্ণকালী প্রভৃতি।    
        
কালী অনার্যদের দেবী হিসেবে স্বীকৃত। আর্যরা ভারতে আসার বহুপূর্বে মানব সভ্যতার প্রথম পীঠস্থান মহেঞ্জোদড়ো খননকালে পাওয়া গিয়েছিল কালী মুর্ত্তির নিদর্শন। সেই যুগের বিভিন্ন স্থানে আদিম অধিবাসীরা বনে-জঙ্গলে, পাহাড়-পর্বতে বা গিরিগুহায় থাকাকালীন পরোক্ষ বা অপরোক্ষ ভাবে যে দেবী প্রতিমার শ্রীচরণতলে বসে কায়মনোবাক্যে ভক্তি নিবেদন করতো সে আর কেউ নন আমাদের আজকের দিনের পরম আরাধ্যা দেবী মা কালী। উলঙ্গিনী, বিধ্বংসী ও ভয়াবহ নৃশংস করালরূপিণী মাতৃ আরাধনা হতো তন্ত্রমতে পঞ্চ ম-কার সহযোগে। নরবলি বা পশুবলি দেওয়ারও প্রচলিত রীতি ছিল সেই কালে। শক্তিরূপিণী মহামায়া কালীকে প্রসন্ন করার অছিলায় নিজের মনোস্কাম চরিতার্থ করার উপায় স্বরূপ এই প্রথা প্রচলিত ছিল। মা কালী বিভিন্ন রূপে বিভিন্ন স্থানে অধিষ্ঠিতা। যেমন – মহীশূর, মাদুরাই, কাঞ্চী, কামাক্ষা এবং উজ্জয়িনীতে। বহির্ভারতেও কালী আরাধনার প্রকৃষ্ট নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে। যেমন – দক্ষিণ আমেরিকায় স্থিত গুয়াতেমালায়, মেসোপটেমিয়া অর্থাৎ ইরাকে এবং আফ্রিকা মহাদেশে।  এতদ্বারা স্পষ্ট প্রমাণিত যে, মাতৃশক্তির উপাসনা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দেশগুলিতেও প্রচলন ছিল। অযোধ্যার রাজা দশরথের কুলগুরু ও ব্রহ্মার মানসপুত্র বশিষ্ঠ মুনি বহুযুগ ধরে নীলাচলে তারা মায়ের সাধনা করে সিদ্ধিলাভে ব্যর্থ হয়ে পিতার কাছে গিয়ে অভিমান করে ব্যর্থতা প্রকাশ করলে, পিতা তাঁকে কামাখ্যা যোনিমন্ডল সাধনা করবার উপদেশ দেন। সেখানেও বশিষ্ঠ মুনি সিদ্ধিলাভে অক্ষম হলে ক্রোধে ব্রক্ষদত্ত তারাবীজকে অভিসম্পাত করেন। একদা এই কামরূপ কামাখ্যা অঞ্চলেই ছিল বশিষ্ঠ মুনির আশ্রম নাম – বশিষ্ঠাশ্রম। সেই স্থান এখনও স্বমহিমায় সাক্ষীবৎ বিরাজমান। তখন দৈববাণী শুনতে পান – বশিষ্ঠ, তুমি আমার সাধনার আচার জানো না, তাই ব্যর্থ হয়েছো।  মহাচীনে বুদ্ধরূপী জনার্দন তোমাকে সাধনার পথনির্দেশ করবেন, তুমি তাঁর কাছে যাও।

বশিষ্ঠদেব তখন মহাচীনে বুদ্ধরূপী জনার্দনের কাছে গিয়ে অভিপ্রায় ব্যক্ত করতে তিনি সকল উপদেশ দিয়ে বললেন – বক্রেশ্বরের ঈশান কোনে বৈদ্যনাথধামের পূর্বদিকে দ্বারকা নদীর পূর্বতীরে যেখানে শ্বেত শিমুলবৃক্ষ আছে, সেখানেই তোমার আরাধিতা তারা আছেন। সেই তারা শিলাময়ী। দেবী দ্বিভূজা, সর্পময় যজ্ঞোপবীত ভূষিতা, বাম-ক্রোড়ে পুত্ররূপে স্বয়ং মহাদেব শায়িত – এইরূপ চিন্তা করে সাধনা করো। জনার্দনের এই শিক্ষা ও সাধনার বিধিকে বলা হয় চীনাচার। অতঃপর বশিষ্ঠদেব এইখানে বসে তারা মায়ের সাধনা করে কোজাগরী লক্ষ্মী পূজোর পূর্বদিনে শুক্লা চতুর্দশীর দিন তাঁর পরম আরাধ্যা তারা মায়ের দর্শন লাভ করে সিদ্ধিলাভ করেন।  তারা মায়ের আটটি রূপ যথা – তারা, উগ্রতারা, মহোগ্রতারা, বজ্রা, নীলা, স্বরস্বতী, কামেশ্বরী ও ভদ্রকালী। এই কারণে তারা মাকে অষ্টতারিণীও বলা হয়। বশিষ্ঠদেব ব্যতীত পরশুরাম, ভৃগু, দত্তাত্রেয় ও দুর্বাসা প্রমুখ মহর্ষিগণও তারাবিদ্যায় সিদ্ধ ছিলেন।         
          
বৌদ্ধতন্ত্র হিন্দুতন্ত্র অপেক্ষা বহু প্রাচীন। বৌদ্ধতন্ত্র থেকেই উদ্ভুত হয়েছিল হিন্দুতন্ত্রের যাবতীয় আচার ও নিয়ম কানুন। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে বলিরাজার বংশধর রাজা বিসফানীর আদেশে আজকের আসাম প্রদেশে তন্ত্রসাধনার উৎপত্তি হয়। তিনি বৌদ্ধধর্ম নির্মূলের জন্য এখানে কামাখ্যা মন্দির স্থাপন করেন এবং প্রাগজ্যোতিষপুরের নাম পরিবর্তন করে দেবী কামাখ্যার নামে নতুন নামকরণ করেন কামরূপ কামাখ্যা।        
         
আমরা যারা আদ্যাশক্তি চিন্ময়ীকে জগন্মাতা রূপে আরাধনা করি তিনি হলেন নারীমূর্তি। নারী মূর্তির স্নেহময়ী মাতৃরূপ আমাদের স্মরণ–মনন–চিন্তা-ভাবনার চরমতম প্রকাশ। ‘স্ত্রীয়ং সমস্তাঃ সকলা জগৎসু’। এই মন্ত্র পৃথিবীর সমস্ত নারীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তাই প্রকৃত সাধক জগতের প্রত্যেকটি নারীর মধ্যে আদ্যাশক্তি মহামায়ার প্রতিচ্ছবি দেখতে পান বা দেখার চেষ্টা করেন। মনটাকে মাতৃময় করতে না পারলে মহামায়ার দর্শন পাওয়া কঠিন। সাধারণ বিচারে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শিক্ষা ব্যতীত যেমন ভাল গায়ক হওয়া যায় না, ঠিক সেইরকম তন্ত্রসাধনা ব্যতীত মাতৃদর্শনও অসম্ভব। আচার্য শঙ্কর, মহামানব যীশু থেকে শুরু করে উনবিংশ শতাব্দীর অবতার পুরুষ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস দেবকেও তন্ত্রসাধনায় সিদ্ধিলাভ করতে হয়েছিল। এমন আরো অনেকে অর্থাৎ নিকৃষ্টতম সত্ত্বা নিয়ে কখনও উৎকৃষ্টতম শিক্ষার অধিকারী হওয়া যায় না।
          
জগৎব্যাপী সর্বত্রই মাতৃমহিমার কীর্তন। তাই মাতৃশক্তির আরাধনায় আমরা তিথি অনুযায়ী পূজো করি মা দূর্গা বা গৌরীর, মা কালীর, মা লক্ষ্মীর বা মা সরস্বতীর। দেবাদিদেব মহেশ্বরের দুই ঘরণী দূর্গা বা কালী, এরা যথাক্রমে সাত্ত্বিক এবং তামসিক ভাবের প্রতিরূপ। দুই বিপরীতধর্মী মাতৃশক্তি নিরন্তর এই পৃথিবীকে চালনা করে চলেছেন। সুতরাং আমরা স্বীকার করতে বাধ্য যে, আমাদের মা বিনে গতি নেই।  জন্ম  থেকে মৃত্যু পর্যন্ত আমরা  মা’য়ের কাছে চিরঋণী। যেমন অনেক সময় আমরা কথাচ্ছলে বলে থাকি - ‘আমার মা আছেন আর আমি আছি, ভাবনা কি আছে আমার? আমি মায়ের হাতে খাই-পরি, মা নিয়েছেন আমার ভার’। সুতরাং বলা বাহুল্য আমাদের জীবনে মা-ই একমাত্র আরাধ্যা দেবী।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন