দোঁহা

কালীপূজা


টুম্পা পাল

কালী শব্দটি 'কাল' শব্দের স্ত্রীর রূপ, যার অর্থ হল কৃষ্ণ বর্ণ বা গুরু বর্ণ। পুরাণ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, মা দুর্গার অন্য একটি রূপ হল কালী। প্রাচীন গ্রন্থে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী কালী একটি দানবীর রূপ। মহাভারতে কালীর উল্লেখ রয়েছে, সেখানে যোদ্ধা এবং পশুদের আত্মা বহন করেন যিনি, সেই তিনিই কাল রাত্রি কালী নামে পরিচিত।

পুরাণে দেবী কালীর একাধিক রূপের বর্ণনা পাওয়া যায়। যেমন দক্ষিণা কালী, শ্মশান কালী, ভদ্রকালী, রক্ষাকালী, গ্রহকালী, চামুণ্ডা, ছিন্নমস্তা প্রভৃতি। 'মহাকাল সংহিতা' অনুসারে মা কালীর আবার নবরূপের পরিচয় পাওয়া যায়। যেমন কালকালী, কঙ্কালকালী, চিকাকালী এমন সব রূপ। এছাড়াও বিভিন্ন মন্দিরে ব্রহ্মময়ী, আনন্দময়ী, ভবতারিণী, ইত্যাদি নামেও মা কালীর পূজা বা উপাসনা হয়।
শক্তির আরাধ্য দেবী কালীর উগ্র ও ভয়ংকর রূপ সৃষ্টির পেছনে আছে পৌরাণিক ব্যাখ্যা। ভারতে কালীপুজোর উত্‍পত্তি বিকাশ এবং প্রচলন প্রথা সম্পর্কে নানান তথ্য চারিদিকে ছড়িয়ে রয়েছে।  কালী মায়ের রূপের বর্ণনায় আমরা সাধারণত কালীর যে রূপের দর্শন পাই, তিনি চতুর্ভূজা অর্থাত্‍ তার চারটি হাতযুক্ত মূর্তি। একটি হাতে খড়গ, অন্যটিতে অসুর মুণ্ড, অন্য হাতগুলিতে তিনি বর এবং অভয়প্রদান করেন। গলায় নরমুণ্ডের মালা, প্রতিকৃতি ঘন কালো বর্ণের এবং রক্তবর্ণ জিভ মুখ থেকে বাইরের দিকে বেরিয়ে আছে। এছাড়াও তিনি এলোকেশি এবং দেখা যায় শিবের বুকের উপর পা দিয়ে জিভ বার করে দাঁড়িয়ে আছেন।

কালীর উত্‍পত্তির পৌরাণিক ব্যাখ্যা সনাতন ধর্মীয় শাস্ত্র অনুযায়ী মা কালীর আবির্ভাব সম্পর্কে যে তথ্য পাওয়া যায় তা হল পুরাকালে শুম্ভ এবং নিশুম্ভ নামক দুই দৈত্য সারা পৃথিবী জুড়ে তাদের ভয়ঙ্কর ত্রাসের সৃষ্টি করেছিল। দেবতারাও এই দুই দৈত্যের কাছে যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করে ফলে দেবলোক তাদের হাতছাড়া হয়ে যায়, তখন দেবরাজ ইন্দ্র দেবলোক ফিরে পাওয়ার জন্য আদ্যশক্তি মা মহামায়ার তপস্যা করতে থাকেন। তখন দেবী সন্তুষ্ট হয়ে তাঁর কাছে আবির্ভূত হন এবং দেবীর শরীর কোষ থেকে অন্য এক দেবী সৃষ্টি হয় যা কৌশিকী নামে ভক্তদের কাছে পরিচিত। দেবী কৌশিকী মা মহামায়ার দেহ থেকে নিঃসৃত হলে কালো বর্ণ ধারণ করে যা দেবী কালীর আদিরূপ বলে ধরা হয়। কালী পূজার বিভিন্ন পদ্ধতি। তান্ত্রিক পদ্ধতিতে মধ্যরাত্রে অর্থাত্‍ অমাবস্যার রাত্রে মন্ত্র উচ্চারণের মাধ্যমে কালী পূজা করা হয়। আগেকার দিনে দেবীকে সন্তুষ্ট করতে পশু রক্ত বা পশু বলি করে উত্‍সর্গ করা হত। এছাড়াও প্রসাদ হিসেবে লুচি এবং নানা ফল ভোগ দেওয়া হয়ে থাকে। গৃহস্থ বাড়িতে সাধারণত অতান্ত্রিক ব্রাহ্মণ মতে মা কালীর পুজা দেখা যায়। এক্ষেত্রে অনেক সময় জমিদার বাড়িতে ছাগ বা ছাগল অথবা মহিষ বলি দেওয়া হত এবং বর্তমানেও অনেক জায়গায় পশু বলির মাধ্যমে পূজার প্রচলন দেখা যায়। পুরাকালে বা প্রাচীন সময়ে বিভিন্ন ডাকাতের দল নরবলির মাধ্যমে কালী পূজা করত বলে শোনা যায়।

কালী পূজা বা শ্যামা পূজা বা মহানীষা পূজা নামেও পরিচিত, ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে উদ্ভূত একটি উৎসব, যা হিন্দু দেবী কালীকে উৎসর্গ করা হয়। এটি হিন্দু ক্যালেন্ডার মাসের অশ্বযুজ (আমন্ত ঐতিহ্য অনুসারে ) বা কার্তিকা (পূর্ণিমন্ত ঐতিহ্য অনুসারে ) অনুসারে কার্ত্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে অনুষ্ঠিত সাংবাৎসরিক দীপান্বিতা কালীপূজা বিশেষ জনপ্রিয়। এই দিন আলোকসজ্জা মণ্ডপসজ্জা ও আতসবাজির উৎসবের মধ্য দিয়ে সারা রাত্রিব্যাপী মণ্ডপে, বাড়িতে এবং মন্দিরগুলিতে কালীপূজা অনুষ্ঠিত হয়।
কালীপূজা বা শ্যামাপূজা হিন্দু দেবী কালীর পূজাকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত একটি হিন্দু উৎসব। প্রধানত বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে এই উৎসব উপলক্ষে প্রবল উৎসাহ উদ্দীপনা লক্ষিত হয়। বাংলায় গৃহে বা মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত কালীপ্রতিমার নিত্যপূজা হয়ে থাকে। উল্লেখ্য, দীপান্বিতা কালীপূজার দিনটিতে ভারতের অন্যান্য জায়গায় দীপাবলি উৎসব পালিত হয়। এটি দীপাবলি, দীপান্বিতা, দীপালিকা, সুখরাত্রি, সুখসুপ্তিকা এবং যক্ষরাত্রি নামেও অভিহিত হয়। সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে এই দিন লক্ষ্মীপূজা অনুষ্ঠিত হলেও বাঙালি, অসমীয়া ও ওড়িয়ারা এই দিন কালীপূজা করে থাকেন। উৎসবটি বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে এবং অন্যান্য জায়গা যেমন বিহার, ওড়িশা , অসম,ত্রিপুরার এবং প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ, এছাড়াও মহারাষ্ট্রের টিটওয়ালা শহরেও জনপ্রিয়। রাতে তন্ত্রাচার ও মন্ত্রউচ্চারণে এই পূজা করা হয়। লাল জবা ফুল, মিষ্টি, চাল এবং মসুর ডাল  ইত্যাদি দেওয়া হয়। এটি নির্ধারিত হয় যে একজন উপাসককে ভোর পর্যন্ত সারা রাত ধ্যান করতে হবে।
ব্রাহ্মণ্য (মূলধারার হিন্দু-শৈলী, অ-তান্ত্রিক) ঐতিহ্যে কালীকে আদ্য শক্তি কালী রূপে পূজা করা হয় এবং কোনও প্রাণী বলি দেওয়া হয় না। তাকে চাল, ডাল এবং ফল দিয়ে তৈরি খাবার এবং মিষ্টান্ন দেওয়া হয়। তান্ত্রিক ঐতিহ্যে, কালী পূজার দিনে পশুবলি দেওয়া হয় এবং দেবীকে নিবেদন করা হয়।

কখনও কখনও কালী 'দশ কালী' বা মহাবিদ্যা হিসাবে বিবেচিত হন। মহাবিদ্যা হল কালীর নেতৃত্বে দশ তান্ত্রিক দেবীর একটি দল। তন্ত্র অনুসারে কালী দশমহাবিদ্যার প্রথম দেবী। কেরালা ব্যতীত সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং ভারতীয় উপমহাদেশে কালীকে ভগবান শিবের স্ত্রী পার্বতীর রূপ হিসাবে বিশ্বাস করা হয়। কেরালার লোকবিশ্বাস অনুসারে— ভগবান শিবের তৃতীয় নয়ন থেকে রাক্ষসদের ধ্বংস করার জন্য তিনি আবির্ভূতা হন, তাই কেরালায় তাঁকে ভৈরব পত্নী মহাকালী বলা হয়।
আগমেশ্বরী মাতা রূপে পূজিত হন নবদ্বীপের  কালী প্রতিমা। নবদ্বীপের সুপণ্ডিত তথা কালীসাধক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ এই পুজো শুরু করেন। তিনিই দক্ষিণা কালীর রূপকার। এই পুজো প্রায় ৪০০ বছরের প্রাচীন।
চামুণ্ডাচর্চিকা কালীর পূজা বাংলা ও বহির্বঙ্গে প্রাচীন উৎসব হলেও বর্তমান আকারে কালীপূজা আধুনিক কালের। ষোড়শ শতাব্দীতে নবদ্বীপের প্রসিদ্ধ স্মার্ত পণ্ডিত তথা নব্যস্মৃতির স্রষ্টা রঘুনন্দন দীপান্বিতা অমাবস্যায় লক্ষ্মীপূজার বিধান দিলেও, কালীপূজার উল্লেখ করেননি। ১৭৬৮ সালে রচিত কাশীনাথের কালী 'সপর্যাসবিধি' গ্রন্থে দীপান্বিতা অমাবস্যায় কালীপূজার বিধান পাওয়া যায়। ডঃ শশীভূষণ দাশগুপ্তের মতে, 'কাশীনাথ এই গ্রন্থে কালীপূজার পক্ষে যে ভাবে যুক্তিতর্কের অবতারণা করিয়াছেন, তাহা দেখিলেই মনে হয়, কালীপূজা তখনও পর্যন্ত বাঙলা দেশে সুগৃহীত ছিল না। তবে খ্রিষ্টীয় সপ্তদশ শতাব্দীতে বাংলায় কালীপূজার প্রচলনের কিছু কিছু প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে।'
সপ্তদশ শতকের নবদ্বীপের প্রথিতযশা তান্ত্রিক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশকে বাংলায় কালীমূর্তি ও কালীপূজার প্রবর্তক মনে করা হয়। তাঁর পূর্বে কালী উপাসকগণ তাম্র পটে ইষ্টদেবীর যন্ত্র এঁকে বা খোদাই করে পূজা করতেন। পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, 'কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ স্বয়ং কালীমূর্তি গড়ে পুজো করতেন।' আগমবাগীশের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে বাংলার সাধক সমাজ অনেকদিন চলেনি; লোকে ‘আগমবাগিশী’ কাণ্ড বলে তার পদ্ধতিকে উপেক্ষা করতে থাকে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় কালীপূজাকে জনপ্রিয় করে তোলেন। এই সময় রামপ্রসাদ সেনও আগমবাগীশের পদ্ধতি অনুসারে কালীপূজা করতেন।  ঊনবিংশ শতাব্দীতে কৃষ্ণচন্দ্রের পৌত্র ঈশানচন্দ্র ও বাংলার ধনী জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় কালীপূজা ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। বর্তমানে কালীপূজা বাংলায় দুর্গাপূজার মতোই এক বিরাট উৎসব।

কলকাতার কুমোরটুলিতে দেবী কালীর মূর্তি তৈরি করছেন কারিগর। কালী পূজার সময় (দুর্গাপূজার মতো) উপাসকরা তাদের বাড়িতে মাটির ভাস্কর্যের আকারে এবং প্যান্ডেলগুলিতে (অস্থায়ী মন্দির বা খোলা মণ্ডপ) দেবী কালীকে সম্মান করেন।
কলকাতার কালীঘাট মন্দিরে এই দিনে কালীকে লক্ষ্মী রূপে পূজা করা হয়। কলকাতায় কালীকে উৎসর্গ করা আরেকটি বিখ্যাত মন্দির হল দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দির , যেখানে শ্রীরামকৃষ্ণ আচার অনুষ্ঠান করেছিলেন। এছাড়া কাটোয়ায় খেপা কালীতলার (খেপি মা) পূজাও বিখ্যাত।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন