দোঁহা

ঐতিহ্যে অটল রক্ষাকালী পুজো

 



দিলীপ কুমার ঘোষ

দফরপুর। না, দাদাঠাকুর শরচ্চন্দ্র পন্ডিতের পৈতৃক নিবাস মুর্শিদাবাদ জেলার জঙ্গীপুর মহকুমার দফরপুর গ্রাম নয়। হাওড়া জেলার ডোমজুড় থানার অন্তর্গত দফরপুর গ্রাম। এই দফরপুর গ্রামের-ই একদম পূর্বপ্রান্তে অবস্থিত দফরপুর মনসাতলা বারোয়ারি। হাওড়া জেলার অন্যতম প্রাচীন এই বারোয়ারি আজ থেকে ১৫৮ বছর আগে ১২৭২ বঙ্গাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সার্ধশতবর্ষ অতিক্রান্ত প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে বড় আয়োজন প্রত্যেক বৎসর কার্তিকী অমাবস্যায় অনুষ্ঠিত শ্রী শ্রী রক্ষাকালী মাতা পুজো। এই পুজো মনসাতলা রক্ষাকালী মাতাতলা-কে হাওড়া তথা পশ্চিমবঙ্গের অনেক ভক্ত মানুষের কাছে দর্শনীয় স্থান হিসাবে তুলে ধরেছে। অবশ্য সারা বৎসর ধরেই ভক্তবৃন্দ প্রতি মঙ্গল ও শনিবার এবং অমাবস্যার মতো বিশেষ তিথিতে রক্ষাকালীমাতার কৃপা লাভের জন্য দফরপুর মনসাতলায় সমবেত হন।
 
চমকপ্রদ বিষয় হচ্ছে এখানে মায়ের কোনও স্থায়ী মন্দির নেই। মায়ের স্বপ্নাদেশ ব্যতিরেকে মন্দির স্থাপনের কথা বারোয়ারি কল্পনা পর্যন্ত করতে পারে না। অনেক ধনাঢ্য ব্যক্তির মন্দির তৈরি করে দেওয়ার প্রস্তাব, বারোয়ারি এর আগে সবিনয়ে ফিরিয়ে দিয়েছে। কার্তিকী অমাবস্যায় মায়ের পুজোর দিন মাতৃপ্রতিমাকে যে বেদীতে স্থাপন করা হয় সম্বৎসর সেই বেদী-ই ভক্তবৃন্দের কাছে মন্দির এবং প্রতিমার বিকল্প হিসাবে পরিগণিত হয়। লোহার রেলিং দিয়ে ঘিরে রাখা চাঁদোয়া আবৃত সেই বেদীর সামনে ভক্তজন প্রণত হন এবং মায়ের মাটি কপালে এবং জিভে ঠেকিয়ে পুণ্য লাভ করেন। কথিত জাগ্রত মা ভক্তজনের মনস্কামনা পূর্ণ করেন।
 
কার্তিকী অমাবস্যা তিথি ছাড়া বৎসরে আর কোনও দিন মায়ের পুজো হয় না বলে ভক্তবৃন্দ সাগ্রহে অপেক্ষা করে থাকেন কালীপুজোর দিনটির জন্য। এই দিন তাঁরা মাকে মনোমতো পুজো দেওয়ার সুযোগ পান। প্রাণভরে তাঁরা মাকে পুজো দেন। মনস্কামনা পূরণ হওয়ায় বা পূরণ হওয়ার আশায় অনেক মানুষ মানত-পুজো দেন, দন্ডি দেন, প্রায় আঠারো কিলোমিটার হেঁটে-প্রধানত পুজোর দিন- ভোরবেলা সালকিয়া বাঁধাঘাট থেকে গঙ্গাজল নিয়ে আসেন, ধুনো পোড়ান, বুক চিরে রক্ত দেন, ছাগ বলি দেন।

দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত মানুষ বা তাঁর প্রিয়জন এবং অনতিক্রম্য সমস্যার সম্মুখীন মানুষ মায়ের কৃপায় স্বপ্নাদেশের মাধ্যমে আরোগ্যলাভ অথবা সঙ্কটমুক্তির জন্য মায়ের কাছে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকেন।
 
পুজোর দিন-ই মাতৃপ্রতিমা নির্মিত হয় প্রায় ছ'কিলোমিটার দূরবর্তী প্রশস্থ গ্রামে। সূর্যোদয়ের পরে নির্মাণকার্য শুরু করে শেষ হয় বিকালে। বংশ পরম্পরায় একই প্রতিমা শিল্পীর পরিবার প্রতিমা নির্মাণ করে আসছেন। আসলে এই পুজোয় পরম্পরা একটা বিশেষ ব্যাপার। যে পরিবার প্রথমে মাতৃপ্রতিমা নির্মাণের ব্যয় বহন করত আজও সেই পরিবারের উত্তরসূরীরা সেই ব্যয় বহন করেন। যে পরিবারের সদস্য প্রতিমা মাথায় করে বহন করে আনতেন আজও মাকে আনয়নের ব্যাপারে সেই পরিবারের সদস্যরা মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। একইভাবে মাতৃবেদী নির্মাণে বা মাকে মূল নৈবেদ্য অর্পণের ক্ষেত্রেও পরম্পরা গুরুত্ব পেয়ে আসছে। পায়ে হেঁটে মাথায় করে- আগমনপথের পার্শ্বে সন্নিবিষ্ট মানুষের শঙ্খধ্বনির মধ্য দিয়ে- সূর্যাস্তের পরে গোধূলি বেলায় মাতৃপ্রতিমা মনসাতলায় নিয়ে আসা হয়।
 
এখানকার মাতৃপ্রতিমা এক অপূর্ব নির্মাণ। শিবের উপর আসীন এলোকেশী দেবী দ্বিহস্ত বিশিষ্টা, সংবৃত জিহ্বা। প্রহরণরিক্ত বরাভয় প্রদায়িনী কালিকার এই রূপ বড় মায়াবী। ভক্তজন তাঁর এই রূপের মধ্যে একই অঙ্গে খুঁজে পান কন্যার স্নেহ-ভালবাসা-কৌতুক, মাতার কৃপাসিন্ধু, কল্যাণী ভরসা এবং দেবীর পাপবিনাশক মঙ্গলজ্যোতি। হোগলা ছাওয়া পাটকাঠি নির্মিত ঘরে মাতৃবেদীর উপর মাকে স্থাপন করার পর, যখন প্রধানত স্বর্ণালঙ্কারে দেবী বিভূষিতা হয়ে ওঠেন তখন সেই সালঙ্করা কমনীয় কোমলকান্ত রূপ এক মনোরম বিভা নিয়ে প্রতীয়মান হয়।
 
যথাবিহিত ধর্মীয় শাস্ত্রবিধি মান্য করে দেবী পূজিতা হন। শুচিশুদ্ধ বস্ত্র পরিহিত উপবাসী কর্মীবৃন্দ মাতৃপূজার আয়োজনে নিযুক্ত থাকেন। পুরোহিত, তন্ত্রধারক এবং মহাকাল একযোগে মাতৃ আরাধনা সুচারুরূপে সম্পন্ন করেন। ষড়রিপুকে মাতৃচরণে বিসর্জন দেওয়ার নিমিত্তে যে সকল ভক্তবৃন্দ ছাগবলি মানত করেন, সেই মানত-ছাগবলি মাতৃপূজার একটি বিশেষ অঙ্গ। আরতি, হোম এবং শেষ লগ্নে শান্তিজল সিঞ্চনের মাধ্যমে মাতৃপূজার সমাপন ঘটে।
 
পূর্বাকাশে সূর্যোদয়ের পূর্বেই পাঁচশো মিটার দূরত্বে অবস্থিত শিউলি পুকুরে পায়ে হেঁটে মাথায় করে নিয়ে গিয়ে অনাড়ম্বরভাবে মাতৃপ্রতিমার নিরঞ্জন সম্পন্ন করা হয়। দেবীপ্রতিমা নিরঞ্জনের পর মনসাতলা থেকে বিতরিত চরণামৃত পান করে শত শত উপবাসী তাঁদের উপবাস ভঙ্গ করেন।
 
মনসাতলায় মাতৃমূর্তিরূপে রক্ষাকালীমাতাকে দর্শনের জন্য সূর্যাস্ত থেকে পরদিন সূর্যোদয়ের আগে পর্যন্ত কমবেশি বারোঘন্টা সময়কালে প্রায় লাখখানেক মানুষের সমাগম ঘটে। মায়ের ঘরের সন্নিহিত এলাকা খুব বড় না-হওয়ার কারণে খুব বেশি মানুষের একত্র জমায়েত সম্ভব নয়। তা সত্ত্বেও পুজোর রাতে মনসাতলা চত্বরে যে-কোনও সময় প্রায় দশ-বারো হাজার মানুষ অবস্থান করেন। বারোয়ারি নিযুক্ত স্বেচ্ছাসেবক এবং পুলিশ-প্রশাসনের নিরলস প্রচেষ্টায় এত বিশাল সংখ্যক দর্শক নিয়েও সমগ্র পুজা আয়োজন সুশৃঙ্খল এবং সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়। এ জন্য অবশ্য দর্শনার্থীদের ভূমিকাও সমান উল্লেখের দাবি রাখে। তাঁরা যেভাবে পুজো দেওয়া এবং মায়ের ঘরে প্রবেশ করে মাকে একবার কাছ থেকে দর্শন করার জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা লাইনে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করেন তা প্রশংসাযোগ্য।
 
রক্ষাকালীমাতার পুজো উপলক্ষে হাজার হাজার মানুষ মনসাতলায় আসেন। মাতৃপূজা উপলক্ষে মনসাতলার প্রবাসী ভূমিপুত্র ছাড়াও অন্য ভক্তরা মহারাষ্ট্র-দিল্লি-তামিলনাড়ু-তেলেঙ্গানা এবং মধ্য প্রাচ্য অথবা মিশর-সাইপ্রাস-আমেরিকা থেকে মনসাতলায় এসে উপস্থিত হন।
 
১৫৮ বৎসর আগে কলেরা মড়কের প্রকোপে যখন দেশ-গাঁ উজাড় হয়ে যাচ্ছিল তখন সেই বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য মনসাতলার মানুষ রক্ষাকালীমাতার পুজোয় ব্রতী হয়েছিল। নিরবচ্ছিন্নভাবে সেই পুজো এতদিন হয়ে এসেছে। সময় এবং যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তাল মিলিয়েছে উন্নত যোগাযোগব্যবস্থা এবং প্রযুক্তি। তাই যে পুজো একদিন ছিল গ্রামের কতিপয় পরিবার বা অল্প কিছু মানুষের পুজো আজ সেই পুজো হয়ে উঠেছে লক্ষাধিক মানুষের পুজো। এখানকার পুজোর একটি অবশ্যমান্য রীতি হল মাতৃ আরাধনা সম্পর্কিত যে কোনও বিষয়কে সরাসরি অথবা বিলম্বিত বৈদ্যুতিন সম্প্রচার থেকে সম্পূর্ণ ভাবে দূরে সরিয়ে রাখা। কোনও পরিস্থিতিতেই বারোয়ারি বিধিবদ্ধ নিয়ম থেকে একচুল সরতে প্রস্তুত নয়। কারণ ঐতিহ্যই এই পুজোর সবচেয়ে বড় আকর্ষণ। বারোয়ারি আশা করে মায়ের কৃপায় যে কোনও রকম প্রতিবন্ধকতার মোকাবিলা করেও সেই ঐতিহ্য বজায় রাখা সম্ভব।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন