দোঁহা

কালের কালিকাময়ী


মৌসম সামন্ত

কালী-উমা-পার্বতী-দুর্গা-চণ্ডী সবই এক মায়ের রূপ। দশ মহাবিদ্যার প্রথম মহাবিদ্যা কালী। তার ভৈরব মহাকাল। কৃষ্ণবর্ণা, ভাস্করী, করালবদনা, মুক্তকেশী, চতুর্ভুজা, লোলজিহ্বা, রক্তাক্ত মুণ্ডমালা গলে বিলম্বিত, বিবসনা, ত্রিনয়না বিকট দর্শন। কালীর উৎপত্তি নিয়ে বিভিন্ন কাহিনী আছে। শুম্ভ-নিশুম্ভকে বধ করবার সময় দেবী চণ্ডী তথা পার্বতীর শরীর-কোষ থেকে কৌশিকী দেবীর সৃষ্টি হলে মূল দেবী পার্বতী তথা দুর্গা কৃষ্ণবর্ণা কালী বা কালিকা হয়ে যান।

দুর্গাপূজার মতো কালীপূজার উৎপত্তিও বাংলায়। নবদ্বীপের প্রথিতযশা তান্ত্রিক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশকে বাংলায় কালীমূর্তি ও কালীপূজার প্রবর্তক মনে করা হয়। মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেবের (১৪৮৬-১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দ) সমসাময়িক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ স্বয়ং কালীমূর্তি গড়ে কালীপূজা করতেন। তার লেখা ‘তন্ত্রসার’ নামক গ্রন্থে কালীপূজার বিভিন্ন পদ্ধতির বর্ণনা আছে। মোঘল আমলে বাংলায় বৈষ্ণবমতের প্রাধান্য থাকায় কালীপূজার তেমন প্রসার ঘটেনি।
আঠারো শতকে কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় (১৭১০-১৭৮২ খিস্ট্রাব্দ) কালীপূজাকে জনপ্রিয় করে তোলেন। উনিশশতকে কলকাতা-কেন্দ্রিক হিন্দু নবজাগরণের সময় কালীপূজার প্রসার ঘটে। সে সময়ে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পৌত্র ঈশানচন্দ্র ও বাংলার ধনী জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় কালীপূজা ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে।

দশজন বাঙালি মানেই কালীবাড়ি অর্থাৎ মায়ের মন্দির। কালী এমন এক দেবী যিনি বাঙালির চিন্তা-চেতনায়, স্মরণে-মননে নিবিড়ভাবে মিশে রয়েছেন। বাঙালির কাব্য-সাহিত্য-সংগীতাদিতেও মা কালী বিপুল প্রভাব বিস্তার লাভ করে আছেন। বিভিন্ন যুগে মা কালীকে নিয়ে গান বেঁধেছেন বাঙলি উপাসকেরা। সাধক রামপ্রসাদ, সাধক কমলাকান্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, গিরীশ ঘোষ, কাজী নজরুল ইসলাম, সাধক ভবা পাগলা, প্রমুখরা মা কালীকে ঘরের মেয়ে ভেবে নিয়ে গান রচনা করেছেন। অসংখ্য গায়ক-গায়িকা তাদের কণ্ঠ-মাধুরী দিয়ে সেসব গান অমর করে রেখেছেন। বলা যায়, মা কালী বাঙালির মনে-প্রাণে ও আস্তানাসমূহের সর্বত্র বিরাজমান। এখন শুধু বাংলা (বর্তমান বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ সহ) নয়, ভারতও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাঙালি বিশেষ করে বাঙালি হিন্দু যেখানেই রয়েছে সেখানকার অধিকাংশ স্থানেই কালীপূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।

'কাল'-কে যিনি হরণ করেন তিনিই কালী। যিনি সকল প্রাণীকে গ্রাস করেন তিনিই হলেন 'কাল'। এই কালই মহাকাল অর্থাৎ মহাদেব বা শিব। এই কাল শব্দের উত্তরে স্ত্রীলিঙ্গে ‘ই’ প্রত্যয় করে কালী শব্দটি সৃষ্টি হয়েছে। কালী হলেন মহাকালের বিশেষ শক্তি। যাঁর কৃপায় সমস্ত বিরুদ্ধ গ্রহের প্রভাব কেটে শক্তি সঞ্চয় করা যায় এবং রোগ,শোক,ভয় ও দুঃখ নিবারণ, সম্পদ প্রাপ্তি, মুক্তিলাভ ও জয়লাভ করা যায়।

মা কালীকে নিয়ে এদেশে যে বিশেষ উৎসবটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে সেটি হল দীপান্বিতা বা দেওয়ালি উৎসব। অবশ্য, দীপান্বিতা তথা কার্তিকী অমাবস্যায় মা কালীর পূজা বিশেষভাবে অনুষ্ঠিত হলেও সারাবছর ধরেই তিনি বিশেষ করে বাঙালি-গৃহে পূজিত হয়ে থাকেন। শ্রীরামচন্দ্র শরৎকালে অর্থাৎ অকালে দেবী দুর্গার বোধন করার পর রাবণবধ সমাপনান্তে সীতা উদ্ধার করে যখন নিজ রাজ্য অযোধ্যায় ফিরে এলেন, তখন সেই বিজয় উৎসবকে ঘিরে আলোকসজ্জা তথা নানা বাজি পোড়ানোর উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছিল। গবেষকদের ধারণা - দীপান্বিতা বা দীপাবলি উৎসবের কালীপূজার নিশি তপস্যার সঙ্গে পরবর্তীকালে আলোকসজ্জা তথা নানা বাজি পোড়ানোর ব্যাপারটা একীভূত হয়ে যায়। ফলস্বরূপ কার্তিকী অমাবস্যায় কালীপূজা ও দীপাবলি একসঙ্গে উদযাপিত হতে থাকে। বাংলায় দেবতাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা অধিক প্রসিদ্ধ ও সমধিক আদৃত দেবতা হচ্ছেন কালী বা কালিকা। বাংলার গ্রামে, গঞ্জে, শহরে, বন্দরে প্রতিষ্ঠিত কালীমূর্তি নিত্য-পূজিত।

কালীর বিভিন্ন রূপের বিস্তৃত বিবরণ তন্ত্রসাহিত্যে পাওয়া যায়। দক্ষিণাকালী, সিদ্ধকালী, গুহ্যকালী, ভদ্রকালী, চামণ্ডকালী, রক্ষাকালী, শ্রীকালী, শ্বেতকালী, মহাকালী, নিত্যকালী, শ্যামাকালী, শ্মশানকালী ইত্যাদির উপাসনা ও বৈশিষ্ট্য বিভিন্ন গ্রন্থে উল্লেখিত হয়েছে। বাংলার বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন নামে এই দেবী পরিচিত। যেমন - ঢাকেশ্বরী, চট্টেশ্বরী, যশোরেশ্বরী, ভবতারিণী, সিদ্ধেশ্বরী, আনন্দময়ী, করুণাময়ী ইত্যাদি। সাধারণত কালী বা কালিকার চতুর্ভুজা, খড়গ-নরমুণ্ডধারী, বরাভয়দায়িনী, মুণ্ডমালা বিভূষিতা, লোলজিহ্বা, কৃষ্ণবর্ণ,মুক্তকেশী ও শিবের বক্ষোপরি দণ্ডায়মান মূর্তিটিই পূজিত হয়ে থাকেন।

পরিশেষে বলা যায় – কালীপূজা তথা কালীসাধনা এদেশের শিল্প-সংস্কৃতি-সাহিত্যকে সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর করেছে। সমাজজীবনে বাঙালির দৃষ্টিতে নারী মহামায়ার প্রতীক। কন্যা ও জায়ার মধ্যেও বাঙালি জননীত্বকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। দেশমাতৃকাকেও তারা দেখেছেন মাতৃরূপে। দেবী মহামায়া তথা কালী সর্বদাই অসুর নিধনে তৎপর। আবার দেবভাবনার প্রতি তার অভয়মুদ্রা সর্বদাই উদ্যত। আমাদের মধ্যেই যে ভাল এবং মন্দের অস্তিত্ব রয়েছে, সেখান থেকে ভালোকে রক্ষা করেন দেবী এবং মন্দকে ধ্বংস করেন পলে, পলে। আমাদের মঙ্গলের জন্যেই মা কালী উগ্রা, আমাদের কল্যাণের জন্যেই তিনি ভয়ঙ্করী। আমরা তার শ্রীচরণে প্রার্থনা জানাই - 'মা তুমি আমাদের অন্তরের আসুরিক শক্তিকে বিনাশ করো, শুভ শক্তির উদ্বোধন করো।'

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন