দোঁহা

ভাঙা তীরের কিউপিড

 



ঋষভ চট্টোপাধ্যায় 

প্রেমের বাজারে একটা নতুন শব্দ বা বলা যায় "টার্ম" এসেছে--- "Situationship" ! অনেকেই হয়তো শুনেছেন ইতিমধ্যে। ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউবে মিম, পোস্ট, হ্যাশট্যাগ, রিলসে প্রায়শই এই নতুন চালু হওয়া শব্দটা দেখতে বা শুনতে পাবেন। এখন ভার্চুয়াল মিডিয়ার রমরমায় নিয়মই তাই। প্রখ্যাত উত্তর-আধুনিক ফরাসি চিন্তাবিদ জা লিওটার্ড ১৯৭৯ সালের একটি লেখায় সেই কোনকালে এরকমই একটা যুগের আগমনের ভবিষৎবাণী করে গিয়েছিলেন। 'দা পোস্টমডার্ন কন্ডিশন' লেখাটিতে লিওটার্ড বলছেন যে সমকালীন পুঁজিবাদী সমাজে আমরা ধীরে ধীরে এমন এক আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির মধ্যে ঢুকে পড়ছি যেখানে কেও বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো থাকবে না | থাকবে না শুধু না, থাকতে পারবে না | প্রত্যেকে তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা ব্যতিরেকে, এমনকি অজ্ঞাতসারেও একটি সদা-পরিবর্তনশীল ও সঞ্চরণশীল নেটওয়ার্কের অংশ হয়ে যাবে। সেই নেটওয়ার্কের মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া যে কোনো প্রবাহ প্রতিটা মানুষের উপরই প্রভাব ফেলবে। নেটওয়ার্কে সৃষ্টি হওয়া কম্পনের আঁচ ধরা পড়বে তাঁর মধ্যে থাকা প্রতিটা মানুষের চেতনায়, ভাবনায়, আদর্শে। সোজা কথায় একটা বিশাল মাকড়সার জালের কোনো একটি বিন্দুতে আপনি দাঁড়িয়ে, জালের অন্য যে কোনো কোনায় তৈরী হওয়া মৃদুতম কম্পনও আপনাকে অল্প হলেও নাড়িয়ে দিয়ে যাবে।
               যে কোনো জিনিস জনমানসে জনপ্রিয় হলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সোশ্যাল মিডিয়ায় তার স্পন্দন ধরা পড়ে। বা হয়তো স্রোতের প্রবাহ আসলে উল্টোপথে যায়। সমাজমাধ্যমে জনপ্রিয়তায় তাকে জনমানসে জনপ্রিয় করে তোলে | যে কোনো সামাজিক (বা অসামাজিক) শব্দবন্ধও তার বাইরে নয়।
             সে যাই হোক, প্রেমের বাজারে শব্দের আমদানি আজকাল লেগেই থাকে। মজার ব্যাপার হল, এই শব্দগুলোর অস্তিত্ব অনেক ক্ষেত্রেই নেহাত শব্দ হিসেবেই শেষ হয়ে যায়না। অনেক সময়ই এদের পিছনে মানুষের প্রেমজ সম্পর্কের সমীকরণ নিয়ে ভাবিয়ে দেওয়ার মতো সব পর্যবেক্ষণ লুকিয়ে থাকে। যদি ভার্চুয়াল জনপ্রিয়তার আস্তরণ সরিয়ে ভেতরে দেখেন, দেখবেন শব্দটা এমনি এমনি জনপ্রিয় হয়নি। শব্দের জন্ম যে ধারণাটা থেকে সেইটা আসলে সমাজে বহুল পরিমানে ঘটে চলেছে। বহু মানুষ শব্দটাকে নিজের জীবনের সঙ্গে মেলাতে পারছে বলেই, শব্দটার বহুল ব্যবহার হচ্ছে। শব্দের পিছনের আইডিয়াটা নিয়ে ফিল্ম তৈরি হচ্ছে, অডিও স্টোরি হচ্ছে। অন্য সব সামাজিক বিষয়ের মতো প্রেমের চরিত্র, তাকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি এসবও যুগের সাথে সাথে নতুন রূপ নেয়। অতঃকিম কোনো নতুন শব্দের আমদানি আসলে সমাজনিহিত সেই রূপবদলেরই দ্যোতক।

যেমন আরো একটা শব্দবন্ধ আজকাল খুব শোনা যায় - 'ওপেন ম্যারেজ' বা 'উন্মুক্ত বিবাহ' ! দাঁড়ান, দাঁড়ান, আঁতকে উঠবেন না। তবে আপনি যা ভাবছেন, ব্যাপারখানা  সেরকমই। উন্মুক্ত সম্পর্ক বহু পুরোনো ধারণা; উন্মুক্ত বিবাহ সেই একই জিনিসকে বিয়েতে পর্যবসিত করে। আমার প্রজন্মের জন্মের আগে পশ্চিমে আর আমাদের বয়সন্ধিকালে এদেশে উন্মুক্ত সম্পর্ক গা সওয়া হয়ে গিয়েছিল। আমি মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কে কোনো ধরণকেই নীতিপুলিশির আতশকাচে ধরতে পছন্দ করিনা। তাই উন্মুক্ত সম্পর্ককে যারা ব্যাভিচার মনে করেন, আমি তাদের দলে কোনোভাবেই নেই। তাছাড়া, উন্মুক্ত সম্পর্কের মূলগত ভাবনাটা আমার কাছে ভীষণ যুক্তিসঙ্গত। বহুগামিতা একটা বাস্তব ছিল, আছে, থাকবে - সে আমরা মানি বা না মানি। হতেই পারে কোনো মানুষের একাধিক প্রিয় মানুষ লাগে, হতেই পারে কারোর সঙ্গে শারীরিক দিকটা বেশি স্বতঃস্ফূর্ত, আর কারোর সাথে কবিতা পড়তে ভালোলাগে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা সবাই জ্ঞানত ভাবে সম্মতি দিলে আমরা বা সমাজ রায় দেওয়ার কেও নয়।
             তবে হ্যাঁ, উন্মুক্ত বিবাহের যুক্তিটা আমি সত্যিই বুঝিনা। নীতিপুলিশি দূরে রেখেও বলছি উন্মুক্ত সম্পর্ক রাখতে হলে প্রচুর স্বাধীনতা প্রয়োজন। বিয়ে একটা সামাজিক চুক্তি, তার মধ্যে ঢুকলে হাজার রকম আইনি ও সামাজিক নিয়মে আপনি বাঁধা পড়বেনই। তাহলে নিজের স্বাধীনতার উপর এই অতিরিক্ত চাপটা আপনি নেবেন কেন?
            যাই হোক, এই লেখাটা উন্মুক্ত বিবাহ নিয়ে নয়। সে আরেকদিন হবে। আজ Situationship নিয়ে কয়েকটা ভাবনা ভাগ করি। প্রথমে যেটা বলতেই হবে সেটা হল, যে বা যারা শব্দটা বানালো, তাদেরকে সেলাম। ভাবের নিখুঁত প্রকাশ হচ্ছে শব্দের মধ্যে। 'Situationship' ব্যাপারটা ঠিক কী রকম ? বোঝাই যাচ্ছে, শব্দটার বুৎপত্তি 'relationship' থেকেই । 'relation' কে সরিয়ে ঢুকে পড়ছে 'situation' ! অর্থাৎ এটা এমন একটা সম্পর্কের কথা বলে যার জন্য সম্পর্কের থেকে বেশি জরুরি পরিস্থিতিটা- যে পরিস্থিতিতে সম্পর্কটা হচ্ছে। সেই পরিস্থিতির মধ্যেই তার জন্ম ও অস্তিত্ব। সেই পরিস্থিতিই তার জন্মের কারণ ও বাঁচার অক্সিজেন। এই একটি পরিস্থিতি বাদে আর বুঝি কোনো পরিস্থিতিতেই সে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। সে ভেতরে এতোই দুর্বল যে পরিস্থিতি পাল্টে গেলেই তার প্রাণবায়ু বেরিয়ে যাবে। অনেকটা ওই ল্যাবরেটরিতে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে রাসায়নিক বানানোর মতো। অর্থাৎ, জিনিসখানা সুক্ষ ও ভঙ্গুর।
           একটু উদাহরণ দিই? বুঝতে সাহায্য করবে। ধরুন আপনি বন্ধুদের সাথে ঘুরতে গিয়েছেন। কোথায় যাবেন ? ডুয়ার্সেই চলে যান। জঙ্গুলে প্রেম। সেখানে গিয়ে অন্য একটি আপনাদেরই মত গ্রূপের কোনো মেয়ে বা ছেলের সঙ্গে আপনার বন্ধুত্ব হল। আপনারা দুজন গল্প করছেন, সকালে একসাথে চা খাচ্ছেন, রাতে মদের আসর থেকে টুক করে বেরিয়ে চাঁদের আলোয় কটেজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে গল্প করছেন। সাফারির পরে বাকিদের থেকে একটু আলাদা হয়ে যাচ্ছেন। দু দলের বাকিরা যথাযথ ভাবে টিটকারি মারছেন আপনাদেরকে। কিন্তু আপনারা দুজনেই জানেন যে, আপনারা কেওই প্রেমে তো পড়েনইনি, এমনকি পড়ার সম্ভবনাও যে বড়ো একটা আছে তেমন গ্যারেন্টি দেওয়া মুশকিল কেন?  

আমরা সাধারণ ভাবে যাকে 'পূর্বরাগ' পর্যায় বলে থাকি সেটা আসলে একটা পরিণত প্রেমের সম্পর্কের ভ্রুনাবস্থা | উপযুক্ত জল, হাওয়া পুষ্টি ও পরিবেশ পেলে তবেই সে ভূমিষ্ঠ হবে, মনুষ্য পদবাচ্য হবে | গর্ভপাত হওয়া প্রেমজ ভ্রুন হল এই 'situationship'। সে জন্ম নিয়েছে, কিন্তু বেড়ে ওঠার প্রথম পর্যায়েই শেষ হয়েছে তাঁর জীবনঅর্থাৎ 'পূর্বরাগ' এক্ষেত্রে কোনো পর্যায় না, সেটিই এ জিনিসের আস্ত জীবনকথা।
                   আর যদি এহেন পূর্বরাগ প্রেমে উত্তীর্ণ হয়েও যায়, তবু আপনারা দুজনেই জানেন সে প্রেমের কোনোই ভবিষ্যত নেই। আপনার ইতিমধ্যে জানা হয়ে গেছে উনি দিল্লির। কলকাতায় বা  বাংলায় আবার আসার কোনো চান্সই নেই। আর আপনিও চাইলেই হুট করে সেমিস্টার বা চাকরি ছেড়ে দিল্লি গিয়ে ডেট করতে পারবেন না। দুজনেই জানেন যে ফেরার ট্রেন ধরার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়ে যাবে একে অপরকে মুছে ফেলার প্রক্রিয়া। হয় দুজন দুজনকেই সরিয়ে ফেলতে চাইবে আর নাহলে একজন তো করবেই নিশ্চিত। আর নাহলে বড়জোর কয়েক মাস চলবে ভিডিও কল আর হোয়াটস্যাপ। তারপর দিব্য নিজের নিয়মে 'যৌবনের ফুল গিয়েছে ঝরিয়া' হয়ে যাবে। যেমন আজকাল আকছার হয়।
         এই পুরো জিনিসটা জানা এবং বোঝা সত্ত্বেও আপনাদের দুজনারই একে অপরের সঙ্গটা বড় ভালোলাগছে। এই পাঁচটা দিন যতটা পারা যায় একে অপরকে নিয়ে পুষিয়ে নিতে চাইছেন। কিছুতেই আরেকজকে কাছ ছাড়তে চাইছেন না। এই পাঁচটা দিনের বর্তমানের খাতিরে আপনি ভাবতে রাজি নন পাঁচ দিনের পরের ভবিষ্যতকে নিয়ে। আর সেটা হয়তো এইজন্যই যে আপনারা দুজনেই জানেন যে, পাঁচ দিনের পরে আর কোনো ভবিষ্যত নেই। তবু এই পাঁচ দিন এই একটা মানুষের চেয়ে বেশি প্রিয়, বেশি দরকারী এবং বেশি আপন আর কেও নেই এই গোটা পৃথিবীতে আপনার কাছে।
        বা ধরুন, আপনার স্কুল জীবনের কোনো বন্ধু বা বান্ধবী, যার সঙ্গে আপনার খুব হালকা করে আলাপ ছিল - তার সঙ্গে অনেক বছর পর হঠাৎ করে দেখা হল, কথা হল। এখন আপনাদের মধ্যে একটা ভালোলাগা তৈরি হয়েছে, কথা বলতে ইচ্ছে করছে, আরো সময় কাটাতে ইচ্ছে করছে। এই ভালোলাগার মুহূর্তটা শেষ হয়ে যাক সেটা একদমই চাইছেন না। কিন্তু আপনি জানেন এই বিষয়টা এগোবে না। হয়তো আপনার জীবনে কেও আছে।  হয়তো তার কোথাও বিয়ের তোড়জোড় চলছে। কিন্তু তবু এই মুহুর্তে তার সাথে যা কিছু করতে ভাললেগেছে, তার একটাও বাদ দিতে, শেষ করতে বা থামাতে ইচ্ছে করছে না।

মানুষের সম্পর্ক নিয়ে ভাবার বা লেখার ক্ষেত্রে বোধ করি সবথেকে বড় মজা একপ্রকার তরলতার উপস্থিতি। শুরুতেই বলেছি এইসব আমদানি হওয়া শব্দ গুলো পিঠে করে প্রেমজ সম্পর্কের হাজারো দৃষ্টিকোণ আর প্রকারভেদ বয়ে নিয়ে আসে। অনেক সময়ই এই ভিন্ন সমীকরণগুলো একে ওপরের বড্ডো কাছে চলে আসে, তাদের তখন সংজ্ঞায়িত করাও মুশকিল হয়ে যায়, আর তাদের পৃথক করাও। ফলতঃ যে ধূসর জমি বারবার তৈরী হয়ে যায়, সেখানেই প্রেমজ শিল্পের ফসল ফলে সবচেয়ে বেশি। অসংজ্ঞায়িত সমীকরণই গান, গল্প, কবিতার ঊষর জমি। তাই এত লেখা হয়েও প্রেমজ সম্পর্ক নিয়ে নতুন কিছু লেখার বা নতুন ভাবে পুরোনো জিনিস লেখার অবসর রয়েই যায়।
                
আমাদের এই আলোচনায় এই কথাগুলো কিভাবে প্রাসঙ্গিক? বছর দশেক আগে-আমরা তখন কলেজে- অনুপম রায়ের একটা গান বেরিয়েছিল। নাম 'অদ্ভুত মুগ্ধতা'। তখন অনুপম সুন্দর গান লিখতেন, এখনকার মত অতি দূর্বোধ্য হয়ে যাননি। 'অদ্ভুত মুগ্ধতা'ও এরকমই একটা শব্দবন্ধ। তবে তার ভাবনাটা আবার আলাদা। সেটা হচ্ছে এক মুহূর্তের মুগ্ধতা। সেটাও ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু এত তীব্র নয়। সেটায় মানুষটার প্রতি মুগ্ধতার জায়গা বেশি, তাকে ভালোবাসতে চাওয়ার জায়গা কম। তার থেকে নান্দনিক আনন্দ পাওয়ার ইচ্ছে অনেক বেশি প্রবল, রক্তমাংসের মানুষ হিসেবে দু হাতে ধরার চাওয়া কম। "Situationship" 'অদ্ভুত মুগ্ধতার' থেকে বেশি গাঢ়, বেশি তীব্র; অথচ সম্পর্কের থেকে অনেক পলকা।
                  মোটামুটি এই হল "situationship" এর চেহারা। একেবারেই চালহীন, চুলোহীন অযত্নে লালিত, ক্ষনজীবী দু দিনের মেহেমান। হঠাৎ করেই তার ক্ষনজন্মের সময়টা আপনার সাথেই কাটাতে এল। আপনি কারোর সাথে লিপ্ত থাকা অবস্থায়ও হতে পারে, একা থাকার সময়ও হতে পারে। আপনি তৃপ্ত, সুখী, পরিপূর্ণ-তখনও হতে পারে, আবার আপনি অসুখী, আকাঙ্খী-তখনও হতে পারে।  
                     
প্রকৃতি, স্বভাব, ধরণ এসব নিয়ে তো আলোচনা হল। কিন্তু তার চেয়েও বেশি জরুরি এই বিশেষ প্রেমজ সমীকরণের উৎসটার সন্ধান করা। কেন বলছি? বলছি কারণ আমার বেশ দৃঢ়ভাবে মনে হয় যে, এই উৎসের সঙ্গে আমাদের একুশ শতকের মানুষের মনস্তত্বের অনেক ডালপালা জড়িয়ে রয়েছে। আকস্মিকের একটা নিজস্ব উত্তেজনা আছে। মনের যে আদ্রর্তা আপনি যে সময়ে আশাই করছেন না, ঠিক তখনই যদি সেটা পেয়ে যান; তাহলে সেটা হিতকরী হোক বা ক্ষতিকারক, অর্থপূর্ণ হোক বা মামুলি, স্রেফ ওই আকস্মিকতার ঝাঁজে আপনাকে তৃপ্তি দেবে। কারণ যা কিছু হিসেবের বাইরে, তা আপনাকে হিসাবখাতার বেড়াজাল ছিড়ে বেরোবার রাস্তা করে দেয়। সিসিফাস আপনি যখন রোজকার পাথর তোলায় অভ্যস্ত, তখন একটা ছোট্ট নুড়ি আপনার পায়ে এসে লাগলেও সেটা আপনাকে চক্রাকার জীবন থেকে বাইরে বের করে আনে।
                       
পরিণত পোক্ত সম্পর্ক চাকুরিজীবীতার অপর নাম। তার নিত্যদিনের চাকা ঘোরানোর মাঝে অভ্যাসের চাপে কখন ভালোবাসার প্রাণবায়ু বেরিয়ে গিয়েছে আমরা বুঝতে পারিনা। সে স্থায়িত্বর বুকে আপনার নিরাপত্তা, যে নৈমিত্তিক আপনাকে বহির্জগতের অস্থিরতা থেকে বাঁচায়, কম্পাসের যে কেন্দ্রে পা ডুবিয়ে আপনার জীবন ছন্দে চলে, সেই সবকিছুকে তখন বিষবৎ জ্ঞান হয়। তখন ইচ্ছে করে নিরাপত্তার উপনিবেশ ভেঙে বেরোতে, অরক্ষিত হতে ইচ্ছে করে শুধু একটু অপ্ৰত্যাশিত কিছু ঘটবে এই আশায়। যে বিপন্নতার ভয়ে এত সৈন্য সাজানো, সেই বিপন্নতাকে তীর্থের কাকের মতো চাইতে ইচ্ছে করে। বিপদহীনতা এক মারাত্মক বিপদ- তাতে সম্পর্ক-যন্ত্রের পিভটে অনুৎসাহের মরচে জমতে দেরি হয় না |  
                     
অনেকেই মনে করেন এই নিরাপত্তা নামের বিপন্নতা কোনো এক বিশেষ সময়ে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। আমার তা মনে হয়না। নিরাপত্তা আর বিপন্নতার প্রতি আমাদের দ্বিমুখী সহবাসী লোভ প্রতিনিয়ত নিজের ঘরে ফসল তোলে, তুলেই যায়। নিরাপত্তার আড়ালে বিপন্নতা ঢাকা পড়ে থাকে মাত্র, তারপর বহুদিনের সেই জমা লোভ বৃত্তের জীবন ভেঙে বেরোতে চায়। অনিশ্চিত, ভঙ্গুর, ক্ষনিকের কিছু পেতে স্বাদ হয় বড়ো। আর ঠিক এইগুলোই তো নিয়ে আসে 'situationship ' .

এছাড়াও দায়িত্বহীন আনন্দের জায়গাটা তো আছেই। পিপিএফ থেকে এপ্রেইসল, পিপিটি থেকে ডিটিপির মধ্যে পরে হাজারো দায়িত্বের মাঝে কাটে আমাদের জীবন। যে সম্পর্ক মজবুত তার অনেক দায়িত্বের দাবি থাকেএমন কোনোকিছু যেখানে ভবিষ্যতের দায় নেই, সেটা নিখুঁত প্রশান্তির বিষয় তো বটেই।    
              
এবারে আসি প্রাতিষ্ঠানিক প্রেমের সাথে situationship এর সমীকরণে। আজও দক্ষিণ এশিয়ান সংস্কৃতিতে তো বটেই, পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতেও অনেক ক্ষেত্রেই বিবাহকে প্রেমের চূড়ান্ত পরিণতি বলে ভাবা হয়ে থাকেকোনো সম্পর্কের ভবিষ্যৎহীনতা জেনেও তার দিকে এগিয়ে যাওয়া শুধু বিবাহের মতো একগামী সামাজিক প্রতিষ্ঠানকেই চ্যালেঞ্জ করে তাই নয়; প্রেমজ সম্পর্কের সঙ্গে কালদোষে জুড়ে যাওয়া 'স্থায়িত্ব', 'চিরকালীন' ইত্যাদি শব্দগুলোকেও প্রশ্ন করে। কী প্রাচ্য কী পাশ্চাত্য- পৃথিবীব্যাপী সাহিত্য, সিনেমা, গান, নাটক খুঁজে দেখুন- দীর্ঘস্থায়ী প্রেমকে একটা মর্যাদার আসনে হামেশাই বসানো হয়ে থাকেউল্টোটা হয়না বলছিনা, কিন্তু এটাও যে হয় তার ঢালাও উদাহরণ। বুঝতে অসুবিধা হয়না প্রেমের সঙ্গে এই 'স্থায়ী', 'চিরকেলে' শব্দগুলো জুড়ে যাওয়া আসলে বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানের অবৈবাহিক ( এমনকি প্রাক-বৈবাহিক ) আত্মপ্রকাশ। দীর্ঘস্থায়ী প্রেম কোথাও একটা গিয়ে সততার সমার্থক হয়ে যায়। বিবাহের মতো অবৈবাহিক সম্পর্কেরও সাফল্যের মাপকাঠি হয়ে যায় তার দৈর্ঘ্য। এই ভাবনাকেই কোথাও একটা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে যায় এই 'পরিস্থিতির প্রেম'। বলে যায়, যে প্রেম ক্ষণজীবীও হতে পারে, তার শরীরে শতাব্দীর পথ হাঁটার জ্বালানি নাও থাকতে পারে, তার ভিত্তিও দুর্বল হতে পারে-কিন্তু তা বলে ভিন্ন প্রকার প্রেমের মধ্যে বা সম্পর্কের মধ্যে উঁচু-নিচুর জাতপাত করা যায়না।
                     কথা হচ্ছিল সমাজস্বীকৃত প্রতিষ্ঠানিক প্রেমের অবৈবাহিক প্রকাশ নিয়ে। দেখবেন কলেজে, অফিসে, বন্ধুমহলে, পারিবারিক স্তরে দীর্ঘস্থায়ী প্রেমের প্রভূত মর্যাদা আছে। আপনি যদি এইরকম কোনো সম্পর্কে থাকেন, আপনারা সকলের আলোচ্য বিষয় হয়ে যাবেন, একটা নীরব সম্মান খুঁজে পাবেন সকলের আচরণে। এই সবটাই আপনার একগামী স্থায়ী সম্পর্কের সার্টিফিকেট যা সমাজ আপনাকে দিচ্ছে। কারণ সমাজের চোখে আপনারা দুজন রেজিস্ট্রিবিহীন দম্পতি। ক্ষণস্থায়ী হাঠৎ প্রেমের প্রতি ঠিক এর উল্টো প্রতিক্রিয়া দেখবেন। অর্থাৎ পরিস্থিতির প্রেম শুধু প্রাতিষ্ঠানিক প্রেমকে নয়, অবৈবাহিক স্তরে সে যে আদর্শগত ন্যারেটিভের জন্ম দেয়, তাকেও চ্যালেঞ্জ করে।   
                   
এখান থেকে একটা প্রশ্ন এসেই যায় যে- পরিস্থিতির প্রেম যদি বিবাহ বাদেও বিবাহের আদর্শকে প্রশ্ন করে, তাহলে সেকি প্রাতিষ্ঠানিক প্রেমের পাশাপাশি একগামিতাকেও প্রশ্ন করছে। মানুষ কী অন্তর্নিহিত স্বভাবগত ভাবেই বহুগামী? একটা সময়ের বিশিষ্টতা জুড়ে দিয়ে, "এটা কী উত্তর আধুনিক সমাজব্যবস্থার নিজস্বতা ?" বলা যেতে পারে। দ্বিতীয় প্রশ্নটায় আমি পরে আসছি। situationship কে মানুষের অন্তর্নিহিত বহুগামী প্রবৃত্তির অজস্র প্রমানের মধ্যে একটা বলে দেখা যেতেই পারে। এমন একটা কিছু যেটা ভবিষ্যৎ চিন্তা থেকে নয়, সামাজিক স্বীকৃতির লোভে নয় , স্রেফ ইচ্ছাগত ও প্রবৃত্তিগত জায়গা থেকে জন্ম নিচ্ছে।
                
চিন্তার এই দৃষ্টিকোণে লেন্স রাখলে একটা চিরন্তন বিতর্কের ছবি স্পষ্ট হয় - প্রবৃত্তি বনাম সংস্কৃতির বিতর্ক। ফ্রয়েডিয়ান মনস্তত্ত্বে যে 'সুপারইগো'-র উল্লেখ পাওয়া যায়, তাকে ফ্রয়েড চিহ্নিত করছেন ব্যক্তির অবচেতনে ( unconscious ) উপস্থিত পৈতৃক নিষেধের এজেন্ট হিসেবে। পরবর্তীতে নারীবাদী মনস্তাত্বিকরা 'সুপারইগো' কে পৈতৃক না পিতৃতান্ত্রিক এজেন্ট হিসেবে উল্লেখ করেছেন। পৈতৃক বা পিতৃতান্ত্রিক যেটাই হোক না কেন, এই সুপার-ইগো মানুষের অবচেতন প্রবৃত্তিকে (unconscious desire ) কে ইচ্ছেখুশি মতো নিজেকে প্রকাশ করার পথে বাধা দেয়। যেহেতু পিতৃতন্ত্র একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান তাই সুপারইগোকে সমাজের এজেন্টও বলা যেতে পারে। মোটকথা সামাজিক জীব মানুষ এই সুপারইগোর নিষেধের সামনে মাথা ঝুকিয়ে নিজের অবচেতন প্রবৃত্তিকে চাপা দিয়ে সমাজের 'কোড অব কন্ডাক্ট' মেনে চলে। বিবাহ যেহেতু একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান, তাই পৃথিবীতে যে যে সমাজে বহুবিবাহ নিষিদ্ধ সেইসকল সমাজের সার্বিক অবচেতনে বহুগামিতার প্রতি নিষেধাজ্ঞা থাকবেই। অতএব, বহুগামিতা ও একগামী বিবাহকে যথাক্রমে প্রবৃত্তি ও সংস্কৃতি হিসেবে চিহ্নিত করে লড়িয়ে দেওয়া যায় কিনা, সেটা ভাবনার বিষয়।
                    আমি এই বিতর্কে কোনো বিশেষ মতামত দিতে চাইনা, শুধু এইটুকু বলতে চাই প্রেমজ সম্পর্কের আরো অনেকিছুর মতো এই পরিস্থিতির প্রেমও এই বিতর্কের উদ্রেক ঘটিয়ে দেয়। তবে হ্যাঁ, পরিস্থিতির প্রেম বহুগামিতার পক্ষে সওয়াল করলেও, বহুবিবাহের পক্ষে একেবারেই করেনা। এই প্রতিষ্ঠানের উল্টোমুখেই তো তার অধিষ্ঠান।        

সাম্প্রতিক উদাহরনের কথা বলতে গেলে বরুণ ধাওয়ান-কৃত শ্যাননের "ভেড়িয়া"র কথা বলতেই হয়। একটা কেতাদুরস্ত কর্পোরেট employee অরুণাচলের দুর্গম প্রদেশে গিয়ে সেখানকার এক অজানা অচেনা মেয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। আদর্শ 'Situationship' ! ফিল্মে অরিজিতের কন্ঠে "আপনা বানা লে" গানটায় একটা লাইন আছে - "তু মেরা কোই না হো কে ভি কুচ লাগে"! বস্তুত, এইটাই 'situationship' এর নিখুঁত এক লাইনের সামারী। সাম্প্রতিক উদাহরন বাংলা সিনেমাতেও আছে বইকি। ২০১৭ তে মুক্তিপ্রাপ্ত কৌশিক গাঙ্গুলির "বিসর্জন" মনে পড়ছে? সম্পূর্ণ অচেনা দুটো আলাদা দেশের দুটো মানুষের স্রেফ চার-পাঁচদিনের মধ্যে বেনামি, 'সমাজবিরোধী', 'রাষ্ট্র বিরোধী' আবেগে জড়িয়ে পড়া ? আচ্ছা, রাজ চক্রবর্তীর "বোঝে না সে বোঝে না" মনে পড়ে? আবির আর পায়েলের চরিত্র দুটোর গল্পটা? দুজন সম্পূর্ণ অচেনা মানুষ বেখেয়ালে, অজান্তে আবেগে জড়িয়ে পড়ে স্রেফ একটা দিন একসাথে কাটিয়ে!
        এবারে যে দ্বিতীয় প্রশ্নটার উত্তর দেওয়া হয়নি সেটাই ফিরি। যদি ভেবে থাকেন এসব হাল আমলের জিনিস, মারাত্মক ভুল করবেন। এসব "কুল" নামকরন আজকাল যতই হোক, জিনিসটি আসলে বহু পুরোনো। ইতিহাস সাক্ষী আছে, জীবন আর শিল্পীকে ফাঁকি দেওয়া অত সোজা নয় ! তায় আবার সে শিল্পী যদি হন বিভূতিভূষণ বা প্রেমেন মিত্র। বলুন তো, ভানুমতির কথা মনে পড়ে আপনাদের? 'আরণ্যক'- এর আদিবাসী দলিত রাজকন্যা ভানুমতি? উপন্যাসের কথক যাকে ভালোবেসে বিয়ে করে লবতুলিয়ায় ঘর বাঁধতে চেয়েছিলেন ? বা মনে পড়ে তেলেনাপোতার সেই মেয়েটিকে? যার টানে আবারও সেই ভগ্নপ্রায় স্বপ্নরাজ্যে ফিরতে চেয়েছিলেন কথক? এসবই হাল আমলের 'Situationship' ছাড়া আর কী ?
             সাহিত্য সিনেমা জুড়ে এই দৃষ্টান্ত ভুরি ভুরি। "অতিথি" গল্পে তারাপদর সঙ্গে মেয়েটির সম্পর্ক। "হঠাৎ দেখা" কবিতাটাই তো তাই ! ভাবলে আরো অনেক দৃষ্টান্ত মনে পড়বে আমি নিশ্চিত।
      এখন এহেন ক্ষণজীবী, মৃত্যমুখী ভালোবাসার আগাছা কি শক্ত গুঁড়ির গাছ হয়ে উঠতে পারে? পারে শক্ত শিকড় মানুষ দুটোর বুকের মধ্যে গেড়ে দিতে? নিজের শরীরকে পোক্ত বানাতে ? নিশ্চই পারে। তবে তার জন্য কপাল দরকার, সুযোগ দরকার, ভাগ্য দরকার। ভাঙা চালের ভালোবাসার নিরাপত্তা দরকার। সে সুযোগ বড়ো একটা তার জোটে কী?
       
কিউপিডের তুণের ভাঙা তীর হল এই রকম ভালোবাসা! ভাঙা বলেই তুণের এককোনে অযত্নে পড়ে থাকে। যে অটুট তীর বুকে বিঁধলে পোক্ত সম্পর্ক তৈরি হয়, সে জোর তার কোথায়? শুধু তীরের ডগায় লাগানো রাসায়নিকের প্রভাবটা একইরকম তীব্র হয়। সেই রাসায়নিক সারের নেশায় জংলা ফুলের মত মন মাতাল করা গন্ধে কদিন খুব করে বেঁচে নেয়। তারপর সময়ের মালি এসে যথাসময়ে যোগাযোগের কুড়ুলে সমূলে উপড়ে ফেলে তাকে। তার ছেঁড়া শরীরের দিকে বিদ্রুপ করে হাসে পোক্ত কাণ্ডের অভিমানে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা স্থায়ী সম্পর্ক।

আগাছা। ভালোবাসার আগাছা।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন