সাগরিকা শূর
এ লেখার ভাবনা যখন মাথায় আসে তখন বহু যুগ পরে একটি পড়ন্ত বিকেলে ছাদে বেড়াচ্ছিলুম, অর্থাৎ বহু যুগ পর পড়ন্ত বিকেলে প্রুফের গাদা, বিলের হিসেব, সাহিত্যের নিরস তত্ত্ব অথবা অন্যান্য অকাজের দৌড়োদৌড়ির এক চিলতে অবসরে ছাদে ওঠবার সুযোগ হয়েছিল। সেই অকাল ছাদভ্রমণই নাড়িয়ে দিয়ে গেল 'আমাদের ছাদ', অর্থাৎ বাঙালির ছাদযাপনকে কিঞ্চিৎ নেড়ে-ঘেঁটে দেখবার ইচ্ছে।
জানলার সাথে সাথে ছাদের সঙ্গেও বাঙালির বড় আপনার সম্পর্ক। পশ্চিমের দেশের মতো সে ছাদকে ব্রাত্য করে রাখেনি, বরং তার দৈনন্দিন যাপনেরই অংশীভূত করে নিয়েছে। ছাদ বলতে আপনাদের কী মনে পড়ে জানি না, আমার অবশ্যম্ভাবী মনে পড়ে যায় বঙ্কিম বা শরদিন্দুর ঐতিহাসিক উপন্যাসের প্রতিচ্ছবি:
"গোবিন্দলাল দেখিলেন ফটক নাই–রেলিং পড়িয়া আছে। প্রবেশ করিয়া দেখিলেন–ফুলগাছ নাই–কেবল উলুবন, আর কচুগাছ, ঘেঁটু ফুলের গাছ, কালকাসন্দা গাছে বাগান পরিপূর্ণ। লতামণ্ডপসকল ভাঙ্গিয়া পড়িয়া গিয়াছে—প্রস্তরমূর্তি সকল দুই তিন খণ্ডে বিভক্ত হইয়া ভূমে গড়াগড়ি যাইতেছে–তাহার উপর লতা সকল ব্যাপিয়াছে, কোনটা বা ভগ্নাবস্থায় দণ্ডায়মান আছে। প্রমোদভবনের ছাদ ভাঙ্গিয়া গিয়াছে; ঝিলমিল শার্সি কে ভাঙ্গিয়া লইয়া গিয়াছে–মর্মরপ্রস্তর সকল কে হর্ম্যতল হইতে খুলিয়া তুলিয়া লইয়া গিয়াছে–সে বাগানে আর ফুল ফুটে না–ফল ফলে না–বুঝি সুবাতাসও আর বয় না।"
- কৃষ্ণকান্তের উইল, দ্বিতীয় খণ্ড
অথবা,
"চৈত্যচূড়ার চারিপাশে চতুষ্কোণ ছাদ, উপাসনাগৃহের স্তম্ভগুলি এই ছাদকে ধরিয়া রহিয়াছে। সঙ্কীর্ণ সোপানশ্রেণী বাহিয়া ছাদে উঠিতে হয়; কিন্তু উপরে উঠিয়া আর সঙ্কীর্ণতা নাই, স্তম্ভের স্থূলচূড়া ঘিরিয়া প্রশস্ত ছাদ অঙ্গনের মত চতুর্দিকে ছড়াইয়া পড়িয়াছে। এই ছাদের এক কোণে একটি দারুনির্মিত প্রকোষ্ঠ; অবশিষ্ট স্থান অসংখ্য মৃৎকুণ্ডে পূর্ণ। প্রত্যেকটি কুণ্ডে একটি করিয়া শিশুবৃক্ষ বা লতা; চম্পা মল্লিকা জাতীয় কুরুবক শেফালী; পারস্য দেশের দ্রাক্ষালতা, মহাচীনের চারুকেশর, তিব্বতের সূচীপর্ণ। মহাচার্য দীপঙ্কর এই দারু-প্রকোষ্ঠে বাস করেন এবং অবসরকালে শিশুবৃক্ষগুলিকে সন্তানস্নেহে লালন করেন।
আজ সায়াহ্নে তিনি ছাদের উপর একাকী পদচারণ করিতে করিতে চিন্তা করিতেছিলেন। শাস্ত্রচিন্তা নয়, ধর্মচিন্তা নয়, নিতান্তই ঐহিক ভাবনা তাঁহাকে উন্মনা করিয়া তুলিয়াছিল। থাকিয়া থাকিয়া তিনি ঊর্ধ্ব আকাশের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিতেছিলেন।"
- তুমি সন্ধ্যার মেঘ
তবে বাঙালির ছাদ নিঃসন্দেহে এমন প্রকাণ্ড প্রাসাদপম নয়, সে যদি বা এককালে জমিদারিযুগে থেকেও থাকে, সে সবও চুকেবুকে গেছে বহুদিন। বরং মন্বন্তর-দেশভাগ-মহামারী-প্লাবন পেরিয়ে তার ছাদও যেন 'বিবাহ প্রস্তাব'-এর বাড়িটির মতো শান্ত, স্নিগ্ধ, ছিমছাম। তবে এককালে যে বাঙালির ছাদের বেশ রমরমা ছিল তা ধরা আছে সাহিত্য-সিনেমার একাধিক পরিচ্ছেদে। এইখানে খুব প্রাসঙ্গিকভাবেই মনে পড়ে যায় অপর্ণা সেন পরিচালিত 'গয়নার বাক্স' ছবিটির কথা - ছবি শুরুর অব্যবহিত পরেই মিত্তির বাড়ির পেল্লায় ছাদে আমাদের নিয়ে যান পরিচালক, দেখা যায় পরিবারের মেয়ে-বউয়ের প্রায় সকলেই ছাদে নানাবিধ কাজে ব্যস্ত, কেউ বৈকালিক আড্ডায় মশগুল, কেউ মেয়ের চুল বেঁধে দিচ্ছে, কেউ বা আবার জামা বুনছে, ছেলেরা ঘুড়ি ওড়াচ্ছে আর এইখানেই প্রথমবারের জন্য আলাপ হয়ে যায় সোমলতা (কঙ্কনা সেনশর্মা অভিনীত) ও তার বড় তরফের জা রেবার, এই ছাদের আলসেতে দাঁড়িয়েই বাড়ির দুই কর্তার একই জুড়ি গাড়িতে একে অন্যের বিরুদ্ধে মামলা লড়তে যাওয়ার দৃশ্য দেখে হেসে কুটোপুটি হয় দুই জা-এ সবই বাঙালির অতি পরিচিত ছবি। ছাদ ও ছাদের নানা দৃশ্য বিভিন্নভাবে ফিরে ফিরে এসেছে এ ছবিতে, সে প্রসঙ্গে পরে আসা যাবে। আপাতত খুঁজে দেখা যাক বাঙালির এমনই আরও কিছু পেল্লায় ছাদ।
'গয়নার বাক্স'-এর মতোই এমন বাহারি ছাদের ব্যবহার রয়েছে সত্যজিৎ রায়ের একাধিক ছবিতেও। প্রথমেই মনে পড়ে যায় 'জয় বাবা ফেলুনাথ' ছবিতে কাশীর বাড়িটির ছাদ ও 'ক্যাপ্টেন স্পার্ক' ওরফে রুকুর গল্প। ঘোষাল বাড়িতে ঢোকবার মুখেই ফেলুদা অ্যান্ড কোম্পানির চোখ যায় ছাদের পাঁচিলে, কারণ সেখান থেকেই তাদের উদ্দেশ্যে কেউ বন্দুক তাক করে তাদের চমকে দেয়, খোঁজ নিয়ে জানা যায় সে আর কেউ নয়, এ বাড়ির ছোট ছেলে রুকু, যে নিজেকে ক্যাপ্টেন স্পার্ক ভাবতে ভালোবাসে। ছাদের পাঁচিল ধরে হাঁটার দৌলতে বকা খেয়ে চলে গেলেও এর কিছু পরপরই ক্যাপ্টেন স্পার্কের সঙ্গে 'ক্যাপ্টেন ফেলু'র আলাপ বেশ জমে ওঠে, সেও ক্যাপ্টেন স্পার্কের ছাদের ঘরেই। এমনকি রহস্য সমাধানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্লুও উঠে আসে এই দৃশ্যেই:
ফেলুদা: "ক্যাপ্টেন স্পার্কের মতো একজন লোক থাকতে বাড়ি থেকে গণেশটা চুরি হয়ে গেল, এটা কেমন হল?এটা কি ভালো হল?"
রুকু: "ওটা একজন রাজার কাছে আছে"
- "কোথাকার রাজা?"
- "অ্যাফ্রিকার"
- "তুমি কী করে জানলে?"
- "ক্যাপ্টেন স্পার্ক জানে"
- "তা সেটা রাজার কাছ থেকে উদ্ধার করা যায় না?"
- "ক্যাপ্টেন স্পার্ক করবে!"
- "করবে?"
- "নাহলে সেটা আটলান্টিস চলে যাবে"
একইভাবে মনে পড়ে যায় 'জলসাঘর' ছবিটির কথা, যদিও সে ছবির আঙ্গিক একেবারেই আলাদা। ছবি বিশ্বাস অভিনীত প্রৌঢ় বিশ্বম্ভর রায়ের ছাদে বসে গড়গড়া টানবার দৃশ্য দিয়েই ছবির শুরুয়াত, জমিদারি প্রায় বিকোতে বসলেও মেজাজটা যাঁর এখনও রয়েছে ষোলো আনা। 'জলসাঘর'-এর এই দৃশ্য আবার মনে করিয়ে দেয় সাম্প্রতিক ছবি 'বল্লভপুরের রূপকথা'র কথা। বাদল সরকার রচিত বিখ্যাত হাস্যরসাত্মক নাটক অবলম্বনে অনির্বাণ ভট্টাচার্য পরিচালিত এ ছবিরও গোড়ার দিকেই ছাদ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। দৃশ্যটি খানিক তুলে দেওয়া যাক–
ছবির শুরুতেই দেখা যায় দেনার দায়ে জর্জরিত ছোটবাবু অর্থাৎ ভূপতি তাদের জমিদার বাড়ির পেল্লায় ছাদে গামছা পরে ঘুমুচ্ছে। তার জমিদারির অবস্থা যেমন, বাড়ির ছাদের অবস্থাও তথৈবচ৷ এই দৃশ্যে পরিচালক একটি দুর্দান্ত ড্রোন শট নিয়ে সমগ্র বাড়ি ও ছাদকে এক অনবদ্য পরিসরে ধরতে পেরেছেন। এরপরই চাকর মনোহর এসে ভূপতির ঘুম ভাঙায়। জানা যায় ভূপতিরই পূর্বপুরুষ প্রেতযোনিপ্রাপ্ত রঘুপতির দৌরাত্ম্যে সে আগের রাতে শেষমেশ ছাদে এসে আশ্রয় নিয়েছে।
তবে ছাদের সঙ্গে বাঙালির রোমান্সের একটি চিরন্তন সম্পর্ক। প্রেমিক বা প্রেমিকা বাড়িতে এলে তাকে খানিক আলাদা করে পাওয়ার জন্য একান্নবর্তী পরিবার বা আজকের নিউক্লিয়াস পরিবারেও ছাদ চিরকালই আলাদা মর্যাদা পেয়ে এসেছে। খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে, পারিবারিক চালচিত্রের মধ্যে থেকেও ছাদই সেই নির্জনতা, সেই একান্ত অবসরের দরজাটা খুলে দিতে পারে সামান্য হলেও।
ছাদ-লাগোয়া একটি সামান্য ঘর, তাতে এক সদ্যবিবাহিত দম্পতি সংসার পেতেছে। কিন্তু শত অভাবেও তাদের অন্তরঙ্গতায় ঘাটতি নেই৷ আগ্রহী বাঙালি দর্শকমাত্রই জানেন, এ দৃশ্য 'অপুর সংসার'-এর, যে সংসারের এক অদ্ভুত মায়াকাজল বোধহয় জন্মের পরপরই বাঙালিকে কে পরিয়ে দিয়েছে। 'অন্য বসন্ত' এও দেখা যায় এমনই এক দুপুর-বিকেলে ছাদযাপনের কথা, মনে পড়ে যায় তন্বিষ্ঠা-অভিমন্যুর একসাথে সূর্যাস্ত দেখবার নিবিড় দৃশ্যটি। বাঙালির অবিসংবাদী রোমান্সের নায়ক উত্তম কুমারের অন্তত দু'টি ছবি মনে পড়ছে এই প্রসঙ্গে - 'পৃথিবী আমারে চায়' ও 'চাওয়া-পাওয়া'। 'চাওয়া-পাওয়া' ছবিতে সুচিত্রা সেন ও উত্তম কুমারের লিপে অসাধারণ রোমান্টিক গানদু'টিই, যথাক্রমে সন্ধ্যা মুখার্জীর কণ্ঠে "এই যে কাছে ডাকা, এই যে বসে থাকা" এবং হেমন্ত মুখার্জীর কণ্ঠে "যদি ভাবো এ তো খেলা নয়, ভুল সে তো শুরুতেই", কিংবা 'পৃথিবী আমারে চায়' ছবিতে মালা সিনহার লিপে গীতা দত্তের কণ্ঠে জ্যোৎস্নালোকিত ছাদের পটভূমিতে দাঁড়িয়ে "নিশিরাত বাঁকা চাঁদ আকাশে, চুপিচুপি বাঁশি বাজে বাতাসে", দর্শকের মনের কোন গোপন তন্ত্রীতে নাড়া দিয়ে যায়! অন্যদিকে আধুনিক বাঙালির প্রেম ও বিপ্লবের চিরন্তন উপন্যাস কালবেলা-এর শুরুতেও ধরা আছে এমনই এক অসামান্য ছাদকথা:
"কলকাতার মেয়েরা বিকেলের এই সময়টা ছাদে ছাদে কাটিয়ে দেয়৷ হয়তো ওদের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই কিংবা এই বিরাট শহরে ঘুরে বেড়ানোর অনুমতি মেলে না। অন্তত এ পাড়ার মেয়েদের দেখলে ওর তাই মনে হয়। কিন্তু ওই মেঘ-থমথমে সন্ধেবেলায় যখন সব ছাদ খালি হয়ে গেছে তখন ওই মেয়েটি ঘাড় বেঁকিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে অমন করে কী দেখছে? খুব বিষণ্ণ সময় এলেই মানুষ অমন ভঙ্গীতে দাঁড়াতে পারে..."
একই প্রসঙ্গে মনে পড়ে 'শ্রীমান পৃথ্বীরাজ' ছবিটি, অসাধারণ দক্ষতায় একাধিক দৃশ্যে ছাদের ব্যবহার করেছেন পরিচালক তরুণ মজুমদার। তিনটি কিশোর-কিশোরীর উচ্ছ্বল আনন্দ উপভোগের পাশাপাশি "সখী ভাবনা কাহারে বলে" গানটির এমন অপ্রতিম চলচ্চিত্রায়ন উপহার দিয়েছে এই ছবিই। অন্যদিকে শত অভাবের মধ্যেও, ভাড়া বাড়িতে থাকবার গঞ্জনা সহ্য করেও প্রিয়জনের সান্নিধ্য যে একটি পলেস্তরা খসা, জরাজীর্ণ বাড়ির ছাদকেও দুর্মূল্য করে তোলে, ঋত্বিক ঘটকের 'নাগরিক'-এর একটি দৃশ্য বুঝি সেই কথাই বলে।
অন্যদিকে ছাদ সংক্রান্ত আলোচনায় একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছাদ পেটানোর গান। ঢালাই ছাদের পূর্বযুগে যখন লাল পাথর, চুন, সুরকি সহযোগে ছাদ তৈরি করা হতো তখন একদল শ্রমিক সারিবদ্ধভাবে বসে মুগুর দিয়ে ছাদ পেটাতেন ও তাদের অপরিসীম পরিশ্রম লাঘব করবার জন্য গান গাইতেন। এই গানই ছাদ পেটানোর গান নামে পরিচিত, এ গান সারিগান বা বৃন্দগানেরই অংশবিশেষ। অন্যান্য লোকসঙ্গীতের ও শ্রমসঙ্গীতের মতোই এই গান সহজ, সরল ভাষায় রচিত, এর কোনো নির্দিষ্ট স্বরলিপি নেই, জীবনের সুখ-দুঃখ, আশা-নিরাশার কথা এ গানে উঠে আসে প্রায়শই। সম্প্রতি 'তবুও প্রয়াস' প্রকাশনী রবিউল ইসলাম ও সেলিম মণ্ডলের সম্পাদনায় ছাদ পেটানোর গান নামক বইটিতে ৯১ টি ছাদ পেটানোর গান সংকলন করবার দুরূহ কাজটি করেছেন। এর আগেও অগাস্টে আর্নল্ড বেক তাঁর 'সংস অফ লেবার' রেকর্ডটিতে ও মৌসুমী ভৌমিক তাঁর 'দ্য ট্রাভেলিং আর্কাইভ' এ এই সংগ্রহের কাজ করেছেন। নজরুল ইসলাম একসময় ছাদ পেটানোর গান রচনা করেছিলেন। সেই গানের অংশবিশেষ এখানে ধরা রইল -
"সমবেত : সারাদিন পিটি কার দালানের ছাদ গো
পাত ভ’রে ভাত পাই না, ধ’রে আসে হাত গো॥
১ম : তোর ঘরে আজ কি রান্না হয়েছে?
২য় : ছেলে দুটো ভাত পায়নি, পথ চেয়ে রয়েছে।
৩য় : আমিও ভাত রাঁধিনি, দেখ্ না চুল বাঁধিনি
শাশুড়ি মান্ধাতার বুড়ি মন্দ কথা কয়েছে।
৪র্থ : আমার ননদ বড় দজ্জাল বজ্জাত গো।
সমবেত : সারাদিন পিটি কার দালানের ছাদ গো।"
শুধু ছাদ নয়, ছাদের ঘরও যে খুবই গুরুতর তারও একাধিক নির্দশন ছড়িয়ে আছে বাংলা গদ্য-পদ্য-চলচ্চিত্রে। এ প্রসঙ্গেই অবশ্যম্ভাবীভাবে প্রথমেই মনে পড়ে ঊনসত্তরের গণ অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে নির্মিত আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের অতুলনীয় উপন্যাস চিলেকোঠার সেপাই, মনে পড়ে ইলিয়াসের অসামান্য সৃষ্টি ওসমান ও হাড্ডি খিজিরের চরিত্র, তাদের ভাবনা-চিন্তা, বিপ্লবের স্বপ্ন ও নিবিড় বন্ধুত্ব। অন্যদিকে পূর্বে উল্লিখিত 'ক্যাপ্টেন স্পার্ক'-এর ঘরটিও চিলেকোঠার ঘর, বা ছাদের ঘর। 'গয়নার বাক্স' ছবিটিতে এই ঘরটি যেন নিজেই একটি চরিত্র হয়ে উঠেছে, সে শুধুই রাসমণি দাসীর বসবাসের কারণেই নয়, ছাদের ঘর যে সমাজ-সংসার থেকে বিচ্যুত করে রাখবার একটি পন্থাও হতে পারে, এ ছবি মনে করিয়ে দেয় তাও। এমনকি সমস্ত শখ-আহ্লাদ-কামনা-বাসনা বঞ্চিত একটি বাল্যবিধবা তার অতৃপ্ত যৌন বাসনা চরিতার্থ করতে চেয়ে কীভাবে তার প্রেমিকের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায় তারও সাক্ষী থাকে এই সুবৃহৎ, একাকী ছাদ।
একইসঙ্গে মনে পড়ে যায় জয় গোস্বামীর বিখ্যাত কবিতা 'মেঘ বলতে আপত্তি কি?', সেখানেও সেই ছাদ আর ছাদের ঘর জুড়ে লুকোচুরি খেলা–
"দু’ এক ক্লাস এর বয়স বেশি, গ্রীষ্ম ছুটি হলে
ঘুরেও গেছে কয়েক বছর, এই জানে সক্কলে
আজকে দগ্ধ গ্রীষ্ম আমার তোমায় বলতে পারি
মেঘ দেখতাম, ছাদের ঘরে, ফুলপিসিমার বাড়ি।"
তবে ছাদের স্মৃতি বাঙালির কাছে যে কেবলই সুখের, তা একেবারেই নয়। বরং ছাদের সঙ্গে যে মৃত্যু বা ধ্বংসেরও একটি নিবিড় যোগাযোগ আছে একটু চোখ মেললেই তা পরিষ্কার হয়ে যায়। 'শ্রীমান পৃথ্বীরাজ' ছবিতেও রসিক ওরফে পৃথ্বীরাজ ব্রিটিশদের দিকে বোমা ছোঁড়ে তারই শ্বশুরালয়ের ছাদ থেকে। হালকা হাস্যরসের মেজাজে পরিবেশিত হলেও তা আসলে বাঙালির বিপ্লবচেতনাকেই ইঙ্গিত করে৷ অন্যদিকে এই ছাদের অনুষঙ্গই আরও সিরিয়াস আবহে উঠে আসে 'পারমিতার একদিন' ছবিতে, যখন অপর্ণা সেন অভিনীত সনকার মৃত্যুর পর ছোট মেয়ে খুকু (সোহিনী সেনগুপ্ত অভিনীত)কে দেখা যায় ছাদে বসে পা ছড়িয়ে পাখিদের মুড়ি বিলোতে। তবে ছাদ ও মৃত্যু প্রসঙ্গে বাংলা সাহিত্যে মাস্টারস্ট্রোকটি রেখে গেছেন সম্ভবত শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। বাঙালি পাঠকমাত্রই এবং ব্যোমকেশ উৎসাহী (নব্যচলচ্চিত্রার্পিতব্যোমকেশ-উৎসাহীদের কথা জানা নেই) মাত্রই নিশ্চয়ই 'মগ্ন মৈনাক'-এর সেই শিরদাঁড়া বেয়ে ঠাণ্ডা স্রোত নামানো বিবরণটি সযত্নে মনে রেখেছেন। এই সুবাদে সেটিই আর একবার ফিরে দেখা যাক:
"বাড়ির পশ্চিমদিকে, যেদিকে ভাড়া বাঁধা হয় নাই, সেইদিকে বাড়ির ঠিক ভিতের কাছে মৃত যুবতীর দেহ পাওয়া গিয়াছে। এ কে রে পুলিস ডাক্তারকে সঙ্গে আনিয়াছিলেন, ডাক্তার পরীক্ষা করিয়া বলিলেন, উচ্চস্থান হইতে পতনের ফলে ঘাড়ের কশেরু ভাঙিয়া মৃত্যু হইয়াছে, মৃত্যুর কাল অনুমান এক ঘন্টা আগে, অর্থাৎ সাড়ে ছ'টার সময়। এ কে রে তখন তিনতলার খোলা ছাদে গিয়া দেখিলেন, ছাদের মাঝখানে একটি ছোট মাদুরের আসন পাতা রহিয়াছে, তাহার পাশে একজোড়া মেয়েলি চপ্পল। খবর লইয়া তিনি জানিতে পারিলেন যে, মেয়েটি প্রত্যহ সূর্যাস্তের সময় ছাদে আসিয়া বসিত। সন্দেহ রহিল না যে আজও মেয়েটি ছাদে গিয়াছিল এবং ছাদ হইতে পড়িয়া মরিয়াছে।"
তবে ছাদ যে শুধুই সন্ধ্যাযাপনের অবসরের ঠিকানা, নিভৃত মুহূর্তযাপনের বিশ্বস্ত আশ্রয়স্থল, নিজেকে মেলে দেবার বা খুঁজে পাবার আস্তানা, কিংবা জীবন-মৃত্যুর সাক্ষী কোনো রক্তাক্ত পরিসরই নয়, বাঙালির ছাদ যে আসলেই একটি মঞ্চ, তা বোধহয় সাম্প্রতিক সময়ে অনির্বচনীয়ভাবে দেখিয়েছেন পরিচালক অঞ্জন দত্ত, তাঁর 'দত্ত ভার্সেস দত্ত' ছবিতে। ছবির শুরু থেকেই ছাদের অনুষঙ্গ ঘুরে ফিরেই আসে নানান মোড়কে, কথকের নিজের কথায়:
"আমাদের দত্ত বাড়ির ছাদটা ছিল আসলে একটা স্টেজ, একটা মঞ্চ। সেখানে কত কী ঘটতে দেখেছি আমি! আমার স্কুলের সেই ছোট্ট, বখাটে, গাঁজাখোর বন্ধুটি সেদিন আমাদের ছাদে হঠাৎ বড় হয়ে গিয়েছিল।"
বাঙালির ছাদ বাস্তবেই এক রঙ্গমঞ্চ, অন্তত অনেক বছর অব্দি তাই ছিল। ছাদে বড়ি দেওয়া, মশলা রোদে দেওয়া, মরশুমে আচার শুকোতে দেওয়া, জ্যৈষ্ঠের অলস দুপুরে মাদুর বিছিয়ে প্রিয়বই বা প্রিয়জনের সঙ্গে ছাদবিলাস, বিকেল হতে না হতেই ঘুড়ির মেলা আর ভোকাট্টা, লোডশেডিংয়ের রাতে মশারি খাটিয়ে ছাদের মেঝেতে রাত্রিবাস, উৎসবে-পার্বণে ছাদবাসর, বাঙালির দৈনন্দিনতায় ছাদ চিরকালই ওতপ্রোত জড়িয়ে থেকেছে। আসলে ছাদ কখনোই শুধুমাত্র ইট-কাঠ-পাথরে মোড়া একটি এনটিটি মাত্র হয়ে থাকেনি, আরও অনেককিছুর মতোই বাঙালি তাকে কখন যেন জড়িয়ে নিয়েছে তার নিয়ত সত্তায়, তার প্রতিদিনের যাপনে, তার একান্ত অধিবাসে। তাই মনখারাপ হলে সে একা একা ছাদে উঠে গিয়েছে, প্রিয় মানুষের সামান্য অন্তরঙ্গতার খোঁজে তাকে সঙ্গ দিয়েছে প্রিয় ছাদ, আবার সেইই মন ভেঙে গেল চুপচাপ তারাদের দিকে তাকিয়ে আশ্রয় খুঁজেছে সেই ছাদেই, সদ্য যৌবনে পা দিয়ে বাবা-মায়ের চোখের আড়ালে প্রথম সুখটান দিয়েছে বন্ধুর বাড়ির কোনো ছাদে, পাশের লেডিস হোস্টেলে থাকতে আসা মেয়েটি বিনুনি দুলিয়ে ছাদে বেড়াতে এলে থমকে গেছে তার হাতে ধরা গোল্ডফ্লেক। কিন্তু আজ, একের পর এক পুরনো বাড়ি ভেঙে বহুতল, পায়রার খোপ আর দেশলাই বাক্স গড়ে ওঠার সুবাদে ছাদ তার সমস্ত জৌলুস নিয়ে হারিয়ে যেতেই বসেছে।
ব্যক্তিগত স্মৃতি থেকে বলতে পারি, নব্বই দশকের ছেলেবেলাতেও ছাদ এক অভূতপূর্ব ভূমিকা পালন করে এসেছে। বেশ বড় ছাদ থাকবার সুবাদে গরমের ছুটি আর শীতের ছুটির অনেকাংশই কেটে গেছে ছাদে ভাই-বোনদের ক্রিকেট ম্যাচ কিংবা ব্যাডমিন্টন ইনিংসে; প্রতি বিজয়া দশমীতে সন্ধে না হতেই ভিড় জমেছে আত্মীয়-অনাত্মীয়-পাড়া-প্রতিবেশীর, কারণ আমাদের বাড়ির ছাদ থেকেই সামনের পুকুরের বিসর্জন দেখা যায় সবচেয়ে ভালো। সালটা ২০০১ কিংবা ২০০২, এখনও বেশ মনে পড়ে, ডিসেম্বর কি জানুয়ারির শীতে ঢালাও বিছানা পড়েছে ছাদে, কারণ, সে বছর এক অত্যাশ্চর্য উল্কাপাত দৃশ্যমান হবে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের কাছে, এবং কার্যত হয়েছিলও তাই। বহু রাত অব্দি জেগে, সোয়েটার, টুপি, কম্বল মুড়ি দিয়ে সেই ছাদেই চলে রাত্রিযাপন, অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা কখন ভাস্বর হবে সেই মহাজাগতিক বিস্ময় এবং একসময় পর তা ঘটেও, ঝরে পড়ে একের পর এক উল্কা, পরদিন স্কুল বোর্ডে বিশেষ সংবাদে স্থান করে নেয় 'মিটিওর শাওয়ার'। আজ আর সেই রামও নেই, সে অযোধ্যাও নেই। বাঙালির ছাদ এখন প্রায় অতীত, পাঁচতলা (পড়ুন, পঁয়ষট্টিতলা) মল, পুরোটাই 'আকাশঝাড়ু', দোতলা-একতলা বাড়ির ছাদযাপন এখন সাহিত্য-সিনেমার স্মৃতিতেই। বাঙালির ছাদে বসে বসে এখন আর কেউ কাঁদে না, বরং ছাদেরাই হয়তো আজকাল একলা কাঁদে ফেলে আসা দিনগুলোর কথা মনে করতে করতে, তার মফস্বলী মন এখন আর "পাতি দুঃখ" জমিয়ে কবিতা বানায় না, এখন তার "হাতিশালে হাতি" না থাকলেও হ্যালোজেনে "আলো" আছে বিস্তর, সেই স্বল্প-ভীতু বাঙালি এখন দেদার 'স্মার্ট', তার হাসি এখন আর "ন্যালাখাপা", "বিষাদবিলাসী" নয়, বরং সে আজ জানে কীভাবে বিষাদের মার্কেটিং করতে হয়, তাই আরও অনেক কিছুর মতো আধুনিক বাঙালির ছাদও গেছে৷ মফস্বলে নয় নয় করে এখনও যেক'টি বাড়ি ও ছাদ টিকে আছে তাদেরও মাথায় বসেছে সুদৃশ্য শেড, আর শহরের ছাদগুলি হয়ে উঠেছে রুফ-টপ রেস্তোরাঁর নতুন ঠিকানা। আজকাল তাই মনে হয় আর এক-দু' দশক পর বাঙালির ছাদবিলাস কি থেকে যাবে শুধুই স্মৃতিকথা বা নস্ট্যালজিয়া হয়েই?