কণাদ চৌধুরী
রাংলি রাংলিওট দার্জিলিং জেলার অন্তর্গত এক ছোট্ট পাহাড়ি জনপদ, শৈল শহরের রানি দার্জিলিং থেকে যার দূরত্ব মোটে বত্রিশ কিলোমিটার। আবার ওই একই নামে সেখানে আছে এক বেশ নামজাদা একটা চা-বাগান। আর রুমার গডেন (১৯০৭-১৯৯৮) ছিলেন ইংরেজ লেখিকা, জন্ম সাসেক্স, ইংল্যান্ড। এই চা বাগান আর সেই ইংরেজ লেখিকার মধ্যেকার সম্পর্ক খুঁজে পেতে হলে ফিরে যেতে হবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার সমকালীন ভারতবর্ষে। রুমার গডেনের বাবা ছিলেন ব্রিটিশ ভারতবর্ষে, অধুনা বাংলাদেশের অন্তর্গত নারায়ণগঞ্জে ব্রহ্মপুত্র স্টিম নেভিগেশন কোম্পানিতে চাকুরিরত। জীবনের অনেকটা সময় ভারতে কাটিয়েছিলেন রুমার গডেন, প্রায় ষাটটিরও বেশি বইয়ের রচয়িতা এই লেখিকার অনেক লেখাই ব্রিটিশ ভারতবর্ষের পটভূমিকায় রচিত, যার অন্যতম হিমালয়ের কোলে এক চা-বাগানে কিছুদিন কাটানোর অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা একটি স্মৃতিকথন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে লেখিকার প্রথম স্বামী লরেন্স ফস্টার যখন বর্মায় গেলেন যুদ্ধ করতে, রুমার তখন তাঁর দুই শিশুকন্যাদের নিয়ে থাকেন কলকাতায়। তাঁর লেখা বেস্ট সেলার ‘ব্ল্যাক নর্শিশাস’ ততদিনে বেশ নাম করলেও, স্বামীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্কে তখন ফাটল ধরতে শুরু করেছে। ব্যক্তিগত জীবনের টানাপোড়েন থেকে পালিয়ে বাঁচতে দুই শিশুকন্যা, তাদের গভর্নেস আর কয়েকটা কুকুর নিয়ে রুমার চলে আসেন রাংলি চা বাগানে। সেখানে পাহাড়ি উপত্যকার মাঝে জিংলাম নামের এক পাহাড়িয়া ছোটি গাঁওয়ে চা বাগানেরই এক ছোটো বাংলো বাড়িতে রুমার কাটিয়েছিলেন প্রায় এক বছর, তাঁর মেয়েদের বয়স তখন পাঁচ এবং তিন। পাহাড় এবং প্রকৃতিকে সঙ্গে নিয়ে নির্জন একাকীত্বের মাঝে রাংলিতে বসবাসের সেই স্মৃতি নিয়ে ১৯৪৩ সালে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর আত্মজৈবনিক বই ‘রাংলি রাংলিওট – দাস ফার অ্যান্ড নো ফারদার’।
রুমার গডেন তাঁর বইতে ‘রাংলি রাংলিওট’, এই নামের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা রূপকথার গল্পটাও শুনিয়েছেন তাঁর পাঠক-পাঠিকাদের। কোনও এক সুদূর অতীত কালে, হয়তো বা নোয়ার প্লাবনের সময় তিস্তা নদীতেও এক ভয়াবহ বন্যা এসেছিল। নদীর জল বাড়তে বাড়তে প্লাবিত করছিল হিমালয়ের উপত্যকা, সেই জলের সীমা যখন পাইন গাছের মাথাকে প্রায় ছুঁয়ে ফেলতে চলেছে, তখন ভয়ে এবং আতঙ্কে বিপন্ন মানুষজন পাহাড়ের শীর্ষে এক মন্দিরে প্রার্থনারত একজন লামার শরণাপন্ন হয়ে তাঁকে জনগণের দুর্দশার কথা জানাল। লামা বললেন “নদীকে আদেশ দাও, সে যেন নীচে নেমে যায়"। বিস্মিত জনতা শুধাল, “সে কী, নদীকে কে হুকুম করবে? আর তাছাড়া, নদী আমাদের কথা শুনবেই বা কেন”? লামা বললেন “আচ্ছা! নদী তোমাদের কথা শুনবে না! তাহলে তো দেখছি আমাকেই কথাটা বলতে হয়”। এই কথা বলে তিনি প্রার্থনা ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এসে সমুখপানে দুই হাত প্রসারিত করে নদীকে বললেন “রাংলি রাংলিওট – ব্যস, অনেক হয়েছে, আর নয় – দাস ফার অ্যান্ড নো ফারদার”! বন্ধ হয়ে গেল নদীর জলস্ফীতি, জল নেমে গেল উপত্যকা থেকে এবং লামাও তাঁর প্রার্থনায় ফিরে গেলেন। আবার এই নামকরণের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা দ্বিতীয় যে গল্পটা প্রচলিত আছে, সেটারও কেন্দ্রবিন্দুতে আছেন এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসী। তিনি নাকি একবার ভালো চায়ের খোঁজে বেরিয়েছিলেন। এ বাগান, সে বাগান ঘুরে ঘুরে কোনও চা-ই যখন তাঁর মনোমতো হচ্ছে না, তখন এই বাগানের চা পান করে তৃপ্ত হয়ে তিনি বলে ওঠেন “রাংলি রাংলিওট” – অর্থাত্ ভালো চায়ের খোঁজে আর দূরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই - দাস ফার অ্যান্ড নো ফারদার। প্রথম গল্পটা শুনতে নিখাদ রূপকথার মতো লাগলেও, দ্বিতীয় গল্পটাকে এই চা-বাগানের বিজ্ঞাপন বলে মনে হওয়াটা আশ্চর্য নয়। তবে জায়গাটার নামকরণের গল্প যাই হোক না কেন, ডানকান কোম্পানির প্রাচীনতম চায়ের ব্র্যান্ডের নামটা ছিল এই বাগানের নামেই। প্রবীণরা অনেকেই হয়তো সেই রাংলি রাংলিওট লেখা চৌকো টিনের কৌটোটাকে মনে করতে পারবেন, যার গায়ে নীল আকাশ আর কাঞ্চনজঙ্ঘার পটভূমিতে আঁকা থাকত শিঙ্গা হাতে লাল পোশাকে সজ্জিত এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর ছবি।
নিউ-জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে দশ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে সেবককে ডানদিকে রেখে এগিয়ে গেলে রামবি বাজারের একটু পরেই মূল সড়ক ছেড়ে বাঁ-দিকে রাস্তা উঠে গেল পাহাড়ের ওপরে। রিয়ংগ বনাঞ্চলের মধ্যে দিয়ে কিছুটা এগিয়ে গেলেই শুরু হবে চা-বাগান, তিস্তা ভ্যালি, নামরিং আর গিলি চা-বাগানের এলাকা পেরিয়ে গিয়ে তবে আসবে রাংলি রাংলিওট। রাংলি থানা ছাড়িয়ে সামান্য এগিয়ে গিয়ে নামতে হবে গাড়ি থেকে, পাহাড়ের ঢাল বেয়ে চা-বাগানের কিনারা ধরে পায়ে হেঁটে কিছুটা নামলেই ফরেস্টি হোম-স্টে। বাড়ির দোতলায় থাকার ঘরগুলোর সাথে একটা বসার জায়গা, তার কাঁচের দেওয়াল পেরিয়ে বাইরে তাকালেই দেখা যায় ডানদিক থেকে বাঁ দিকে নেমে গিয়েছে রাংলি রাংলিওট চা-বাগানের সবুজ কার্পেট। যতদূর চোখ যায়, সমান উচ্চতায় কেয়ারি করা চা-গাছের ঝোপগুলোর উপরিভাগ তৈরি করেছে এক সবুজ তরঙ্গায়িত পৃষ্ঠতল, দূর দিগন্তে গিয়ে সেই সবুজ ঢেউ লুকিয়ে পড়ে সতত-সঞ্চরমান সাদা মেঘের আড়ালে, আবার কখনো দূর আকাশে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে থাকা নীল পাহাড়ের ঢাল বেয়ে পথিক মেঘের দল উঠে আসে নীচ থেকে ওপরে, চরাচরকে ঢেকে দিয়ে চোখের সামনে টাঙ্গিয়ে দেয় একখানা সাদা পর্দা, আর বাগানের মাঝে কুয়াশায় ছায়াবৃতা হয়ে অতন্দ্র প্রহরায় নীরবে দাঁড়িয়ে থাকে গোটা চারেক সুউচ্চ পাইন গাছ।
সকালের আলো ফুটতে না ফুটতেই এখানে চা বাগানে শুরু হয়ে যায় দিনের কর্মব্যস্ততা। পিঠে রাখা বেতের ঝুড়ি কাপড় দিয়ে কপালে বেঁধে কোমরে প্লাস্টিকের চাদর জড়িয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে পাতা তোলার কাজে লেগে পড়ে বাগান শ্রমিকের দল। কিছুটা দূরে রাস্তার ওপর মোটরবাইক দাঁড় করিয়ে তাদের ওপর কড়া নজর রাখে লেবার-সর্দার, টুকটাক সুখ-দুঃখের গল্প আর হাসি-ঠাট্টাও চলতে থাকে পাতা তোলার ফাঁকে ফাঁকে, কিন্তু দিনের শেষে নির্দিষ্ট ওজনের চা পাতা তুলতে পারলে তবেই মেলে দিনের মজুরি। রোদ আর বৃষ্টি থেকে মাথাটাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে শরীরের সঙ্গেই বেঁধে রাখতে হয় ছাতাটাকে, দুই হাত সচল রাখতে হয় দুটি পাতা একটি কুঁড়ি তোলার কাজে। ওদিকে আবার শহর থেকে আসা ‘হ্যালো গাইজ’ ইউটিউবার-বাবু ক্যামেরা হাতে মহিলা শ্রমিকদের সমানে অনুরোধ করে চলেছেন “থোড়া সা গানা গাইয়ে না, গানা গাতে গাতে কাম কিজিয়ে, উসকা এক ভিডিও উঠায়েঙ্গে, ইউ-টিউব মে দেঙ্গে” – কী আবদার! আমার সঙ্গিনীও অবশ্য আবদার করে একজনের কাছ থেকে ঝুড়ি চেয়ে নিয়ে মাথায় বেঁধে একটু শৌখিন মজদুরি করে দেখলেন দূর থেকে দেখতে যতটা সহজ মনে হয় কাজটা, আসলে সেটা মোটেই ততটা সহজ নয়। কীটনাশকের ব্যাপক ব্যবহারের ফলে চা-বাগানে পাখিদের আনাগোনা মনে হয় একটু কম, তবুও শেড ট্রির ডালে ডালে চোখে পড়ে দু-চারটে ব্লু হুইসলিং থ্রাসের ওড়াউড়ি। বাগানের পথ ধরে ছোটো ছোটো দল বেঁধে স্কুলের ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বাস রাস্তার দিকে উঠে আসে স্কুল ইউনিফর্ম পরিহিত বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েরা, স্কুল অবধি অনেকটাই পথ নিত্য পায়ে হেঁটে পার হতে হয় তাদের। সেই পথই আবার নেমে গিয়েছে নীচে বাগানের কারখানায়, যেখানে সবুজ চা পাতাকে ডলে, মুচড়ে, সেঁকে তৈরি হয় কালো রঙের ‘দার্জিলিং টি’। বাগানের পথে চলতে চলতেই চোখে পড়ে পরিত্যক্ত এক বাংলো, এককালে সেখানেই ছিল বাগানের ‘অস্পাতাল’, যেখানে থাকতেন বাগানের ‘ডাগদারবাবু’। রাংলির বাগানে চা গাছের সবুজ গালিচার ওপর রৌদ্রছায়ার খেলা দেখতে দেখতে সময় হারিয়ে যায়, মনে হয় এই বুঝি সাগিনার পোশাকে সামনে এগিয়ে আসবেন দিলীপ কুমার, সায়রা বানুকে সঙ্গে নিয়ে গান ধরবেন “ছোটি ছোটি সপনা হমার, ছোটি আশা ছোটি প্যার”। আরও একটু এগিয়ে পাইনের বনের আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকে সবুজ লন আর বাগান দিয়ে ঘেরা ম্যানেজার সাহেবের সুদৃশ্য বাসস্থান, বাগানের পরিভাষায় যার নাম ‘বড়া বাংলা’। যে বাংলোর অগ্নিপ্রজ্জ্বলিত ফায়ারপ্লেসের পাশে সন্ধ্যাবেলায় মদিরার পাত্র হাতে নিয়ে আরামকেদারায় গা এলিয়ে দিয়ে এখনও হয়তো দিনের ক্লান্তি অপনয়ন করেন কেউ না কেউ, যে বাংলোর গা থেকে এখনও বাতাসে ভেসে আসে সেই ঔপনিবেশিক সময়ের গন্ধ, যে সময়ে এই বাগানেরই কোথাও এক বাড়িতে বেশ কিছু দিন কাটিয়ে গিয়েছিলেন লেখিকা রুমার গডেন।