সুকন্যা সাহা
কালী, মহাকালী বা কালীকা হলেন পরমা আদি শক্তির আধার। তান্ত্রিক শাস্ত্র মতে তিনি দশম মহাবিদ্যার প্রথম মহাবিদ্যা। সময় ও মৃত্যুর দেবী কালিকার উৎপত্তি দেবী দুর্গার থেকেই। শাক্ত মতে তিনিই সৃষ্টি, তিনিই লয়, সময়, শক্তি, পরিবর্তন ও ধ্বংসের মূর্ত প্রতীকস্বরূপ। বুৎপত্তিগত ভাবে কালী শব্দের অর্থ হল কালের পূর্ণতা, বা তার স্ত্রী লিঙ্গ, যার পুংলিঙ্গ 'কাল' যা ভগবান শিবের নাম।
তিনি কৃষ্ণ বা ঘোর বর্ণ। অবশ্য পুরাণ মতে, তাঁর প্রথম আবির্ভাব ভগবান শিব হতে। তিনি শক্তির চূড়ান্ত প্রকাশ এবং সমস্ত জীবের জননী। নির্দোষকে রক্ষা করার জন্য তিনি মন্দকে ধ্বংস করেন। পরবর্তীকালে সময়ের সাথে সাথে ভক্তি আন্দোলন ও তান্ত্রিক সম্প্রদায়ের মত অনুযায়ী তিনি মহাবিশ্বের মা, আদিশক্তি বা পার্বতী হিসাবেও পূজিতা হন। যদিও কালী শব্দটি অথর্ববেদের প্রথম দিকেই আবির্ভূত হয়, তবে সঠিক নাম হিসেবে এটির প্রথম ব্যবহার কথক গৃহসূত্রে।
ষষ্ঠ শতাব্দীর শ্রী শ্রী চন্ডীতে বিরচিত দেবীমাহাত্ম্য যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁর সবচেয়ে পরিচিত চেহারা। দেবীমাহাত্ম্যের প্রথম অধ্যায়ের দেবতা হলেন মহাকালী, যিনি ঘুমন্ত বিষ্ণুর শরীর থেকে দেবী যোগনিদ্রা রূপে আবির্ভূত হন যাতে ব্রহ্মা ও বিশ্বকে মধু ও কৈটভ নামক দুটি অসুর থেকে রক্ষা করার জন্য তাকে জাগিয়ে তোলা হয়। বিষ্ণু জেগে উঠলে তিনি দুই অসুরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন। ভগবান বিষ্ণুর সাথে দীর্ঘ যুদ্ধের পর যখন দুই অসুর অপরাজিত থাকেন, তখন মহাকালী দুই অসুরকে মোহিত করার জন্য মহামায়ার রূপ ধারণ করলেন। মধু ও কৈটভ মহাকালী দ্বারা মন্ত্রমুগ্ধ হলে বিষ্ণু তাদের হত্যা করেন।[৯:৭০]
পরবর্তী অধ্যায়ে, কালী দ্বারা ধ্বংস হওয়া দুই অসুরের কাহিনী পাওয়া যাবে। চন্ড ও মুন্ডা দেবীদুর্গাকে আক্রমণ করে। দুর্গা এমন ক্রোধের সাথে প্রতিক্রিয়া জানান, যার ফলে তাঁর মুখ কালো হয়ে যায়, যার ফলে কালী তাঁর কপাল থেকে বেরিয়ে আসেন। কালীর চেহারা গাঢ় নীল, নিমজ্জিত চোখ এবং পরনে বাঘের চামড়ার শাড়ি এবং গলায় অসুরের মাথার মালা। তিনি অবিলম্বে দুই অসুরকে পরাজিত করেন। পরবর্তীতে একই যুদ্ধে, অসুর রক্তবীজ অপরাজিত থাকে কারণ তাঁর রক্তের প্রতিটি ফোঁটা মাটিতে পৌঁছানো থেকে নিজেকে পুনরুৎপাদন করার ক্ষমতা ছিল। অগণিত রক্তবীজ একের পর এক হাজির হয় যুদ্ধক্ষেত্রে। দেবী কালী অবশেষে মাটিতে পৌঁছানোর আগেই তাঁর রক্ত চুষে এবং অসংখ্য রক্তবীজের শরীরের রক্ত পান করে (যাতে এক ফোঁটা রক্তও মাটিতে স্পর্শ না হয়) তাঁকে পরাজিত করে। কিন্সলে লিখেছেন যে দেবী কালী 'দেবী দুর্গার মূর্ত ক্রোধ' প্রতিনিধিত্ব করেন।
তন্ত্র পুরাণে দেবী কালীর একাধিক রূপভেদের উল্লেখ পাওয়া যায়। কালী মোট নয় প্রকার। যথা, দক্ষিণাকালী, কৃষ্ণকালী, সিদ্ধকালী, গুহ্যকালী, শ্রীকালী, ভদ্রকালী, চামুণ্ডাকালী, শ্মশানকালী ও মহাকালী। এ প্রসঙ্গে ড. মহানামব্রত ব্রহ্মচারীর লেখা "জগজ্জননী কালীমাতার তত্ত্ব" নামক একটি ছোট্ট বইতে তিনি শাক্ত-বৈষ্ণব মিলনের একটি অসাধারণ রেফারেন্স দিয়েছেন বৈষ্ণব শিরোমণি ষড় গোস্বামীর অন্যতম শ্রীজীব গোস্বামীর লেখা থেকে।
'যঃ কৃষ্ণঃ সৈব দুর্গা স্যাৎ
যা দুর্গা কৃষ্ণ এব সঃ।'
অর্থাৎ যে কৃষ্ণ, সেই দুর্গা এবং যিনি দুর্গা তিনিই কৃষ্ণ।
এখন প্রশ্ন হল এত রং থাকতে তিনি কেন কালো বা কৃষ্ণবর্ণা? কালো কি? কালো কি কোনো রং? না! কালো হল সমস্ত রঙের অভাব। কোনো বস্তুর ওপর আলো পড়লে খানিকটা শক্তি শোষিত হয়, খানিকটা পেরিয়ে যায় ভেদ করে আর যা অবশিষ্ট প্রতিফলিত হয় সেই আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের ওপর নির্ভর করে আমরা কোন রং দেখবো। যে বস্তু দৃশ্যমান তরঙ্গের সবটাই শুষে নেয় তার ওপর আলো পড়লে দৃশ্যমান কোনো আলোই প্রতিফলিত হয় না; তাকেই আমরা কালো দেখি। বাস্তবে যদিও এমন কোনো বস্তুর অস্তিত্ব জানা যায় নি যা দৃশ্যমান সমস্ত আলো আত্মস্থ করতে পারে, পদার্থবিদ্যায় এমন বস্তুর উল্লেখ পাওয়া যায় যাকে বলে 'ব্ল্যাকবডি' অর্থাৎ কৃষ্ণবস্তু। পরবর্তীকালে ভক্তি আন্দোলনের নানা পর্যায়ে রামপ্রসাদ থেকে বামাখ্যাপা নানা কালী সাধকেরা মহাকালীকে নিজের কন্যারূপে দেখেছেন । গান বেঁধেছেন
"শ্যামা মা কি আমার কালো? কালো রূপে ব্রহ্মময়ী হৃদিপদ্ম করে মোর আলো রে ..."
বা
"কালো মেয়ের পায়ের তলায় / দেখে যা রে আলোর নাচন"
পরিবর্তনের সরণি পেরিয়ে আমরা কালীর অনেক রূপ রং দেখি, কৃষ্ণ কালী, শ্যমা কালী বা ঠাকুর শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণের ভবতারিণী মায়ের মূর্তি, দক্ষিণেশ্বরে যিনি পূজিতা হন। কালীঘাট থেকে কংকালিতলা, তারপীঠ থেকে কামাখ্যা এগুলি সবই সতীপীঠ। সতী বা পার্বতীর নানা দেহাংশ পড়েছিল এই সব স্থানে।
স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর 'মৃত্যুরূপা মাতা' বা Kali the Mother কবিতায় কালী মাতার রূপের অভূতপূর্ব বর্ণনা দিয়েছেন:
The stars are blotted out,
The clouds are covering clouds,
It is darkness vibrant, sonant.
I the roaring, whirling wind
Are the souls of a million lunatics
Just loose from the prison-house,
Wrenching trees by the roots,
Sweeping all from the path...
The sea has joined the fray,
And swirls up mountain-waves,
To reach the pitchy sky.
The flash of lurid light
Reveals on every side
A thousand, thousand shades of Death begrimed and black —
সুতরাং তিনি পরমা প্রকৃতি জগদম্বিকা, ভবানী ত্রিলোক পালিকা। তিনিই মহাবিদ্যা আদ্যাশক্তি মহামায়া।