অর্ঘ্য দে
পড়ন্ত বেলার হৈমন্তিক আলোটুকু নিঃসাড়ে শুষে নিচ্ছে পথ ও প্রান্তর। আলপথ বরাবর হেঁটে আসে শ্যামবর্ণা মেয়েটি। যেন কালাকালের গভীর থেকে জন্ম নেয়া কালের নিয়ন্তা দেবী। এমন আবিল বেলায় শ্যামাঙ্গী হয়ে ওঠে চরাচর। প্রাচীন বৃক্ষে দ্রুত সন্ধ্যা নামছে। কয়েকটা জোনাকি ঘুরে ঘুরে উড়ে চলে। বৃক্ষ সংলগ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে মেয়েটি। হাওয়ায় উড়ছে তাঁর উন্মুক্ত উদ্দাম কেশরাশি। অনিয়ন্ত্রিত সেই কেশবিন্যাসের জটাজালে যেন এক সুতোয় বাঁধা আছে সময়, প্রলয়-স্থিতি। তার নিকশ কালো পায়ের কাছে জোনাকিদের উদ্দেশ্যহীন উল্লম্ফন। কী জানি কোন দৈবসুখে ! হয়তো এ চোখের ভুল, হয়তো বা গৃহীজীবনে একপ্রস্থ দৈব দৃশ্যকল্প।
ভাবতে ভাবতে উন্মনা হয়ে পড়ি। অন্ধকারে ধাক্কা খাই। চেয়ে দেখি কোথাও জোনাকিদের আলোর জরি নেই। মেয়েটিও মায়ার মতো অদৃশ্য হয়েছে। তমসাচ্ছন্ন উঠোনের মতো আয়ত প্রান্তরে থেকে থেকে নূপুর বেজে ওঠে।
সুদূরপ্রসারী মেঠো হেমন্তিকায় মুহূর্তে আবছা হয়ে আসে গৃহস্থের দ্বীপ। ধোঁয়াশাচ্ছন্ন চোখ, নিস্তব্ধ সন্ধ্যায় মনদেউলে শাক্তকবি গেয়ে ওঠেন,
"শ্যামা নামের লাগল আগুন
আমার দেহ-ধূপকাঠিতে।
যত জ্বালি সুবাস তত
ছড়িয়ে পড়ে চারিভিতে"
আমি তাঁর দেখা পাই না। শুধু অতিজাগতিক সুবাসটুকু ভেসে থাকে হিমেল হাওয়ায়। স্বপ্নের মতো কণ্ঠস্বর আমায় তাড়িয়ে বেড়ায়। কোথাও কোনও আরতি নেই, ঘণ্টাধ্বনি নেই। শুধু শান্ত স্রোতের মতো প্রবাহিত দরাজ কালীকীর্তন। অন্ত:পুর থেকে সে গান নিরেট অন্ধকারে উৎসারিত। আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি। সে গান আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ে। ক্রমে গিলে খায় দেশজ সীমারেখা, কালের চৌহদ্দি। সুর ও বাণীর মহাজাগতিক উত্তাপ অনুভূত হয় নিশ্বাসে। আমার ভিতরের অন্তরীণ অহং সেই তাপে পুড়তে থাকে। দাহ্যতার দাবিতে সারিবদ্ধ ক্লান্তি, আলস্য, আসক্তি, বিষয়-বাসনা, একে একে আত্মসমর্পণ করে।
ছাই ওড়ে অনন্তে, মুক্তির পিপাসায় সারা গায়ে মেখে নিই। ধোঁয়ার মতো হাল্কা লাগে নিজেকে।