দোঁহা

উত্থান পতন

 


কৌশিক সেন

বাংলা সাম্মানিক প্রথম বর্ষের মনিকুন্তলা বাসুর মন বড়ই খারাপ।  কি হইয়াছে, তাহা নিজেই বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছে না।  অনেক ভাবিয়াছে মনিকুন্তলা, আকাশ পাতাল ভাবিয়াও কোনো যথাযথ উত্তর খুঁজিয়া পাইতেছে না।  ইহাকে কি বলা উচিত? চিত্তবৈকল্য, নাকি চিত্ত বিকৃতি!  নাহ্, কোন যুতসই নামকরণ করিতে পারে নাই মনিকুন্তলা।

কিন্তু কি হইল মনিকুন্তলা বাসুর?  দিব্বি তো আট-নয় মাস পূর্বে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় দারুন সাফল্যে উত্তীর্ণ হইয়া কালেজ জীবনে প্রবেশ করিল!  কিন্তু অকস্মাৎ কি হইল এই একরত্তি ঊনবিংশ বর্ষীয়া তরুণীর!  মনিকুন্তলার পিতা শ্রীযুক্ত চন্দ্রশেখর বাসু সংস্কৃতি দপ্তরের একজন উচ্চপদস্থ আধিকারিক তথা শহরের একজন স্বনামধন্য নাট্যকর্মী।  মাতা শ্রীমতী রাজ্যেশ্বরী বাসু বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপিকা, প্রচুর লেখালিখি করেন।  এমত পরিবারের কন্যার কি মতিভ্রম হইল??

আহার নিদ্রা প্রায় ত্যাগ করিয়াছে মনিকুন্তলা।  চক্ষুকোল কৃষ্ণবর্ণ, কোটরাগত।  কেশ আলুথালু।  ভালো করিয়া খোঁজ খবর লইলে দেখা যাইবে সম্ভবত সে তার প্রাত্যহিক ক্রিয়া কর্মাদিও ত্যাগ করিবার পরিকল্পনা করিয়াছে।  বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হইবার পর যখন সকল তরুণী পশ্চিমি পোষাকে নিজেদের সাজাইবার ঘটা লাগাইল, কুন্তলা আসিল হ্যান্ড বাটিকের সুতির শাড়ী পরিহিত হইয়া।  স্কন্ধে শান্তিনিকেতনি ঝোলা।  কখনো এলো কবরী, কখনো বা আজানুলম্বিত বেণী।  চরণে কোলাপুরি পাদুকা।  দেখিলে মনে হইবে, রবীন্দ্র রচনাবলীর শেষের কবিতা হইতে সাক্ষাৎ লাবণ্য উঠিয়া আসিয়াছে বিশ্ব বিদ্যালয়ের রোদ্দুর সিক্ত অঙ্গনে।

প্রকৃত ঘটনার সুত্রপাত আসলে সাত আট মাস পূর্বেই।  ভর্তি হইবার পরপরই মনিকুন্তলার হাতে আসে পাঠক্রম অন্তর্গত ও বহির্ভূত নানারকম পুস্তক।  এই পুস্তক সকলই তাহার মস্তিস্ক প্রক্ষালনের মূল কারণ।  কুন্তলা শুনিয়াছে বিদ্যাসাগরের শকুন্তলা প্রেমে পড়িয়াছে, বডু চণ্ডীদাসের শ্রীরাধিকাও শ্রীকৃষ্ণের প্রেমরসে নিমজ্জমানা।  শরৎচন্দ্রের অনুপমা বা বঙ্কিমচন্দ্রের রাধারানীও প্রেমে পড়িয়াছে।  রবীন্দ্রনাথের চিত্রাঙ্গদাও প্রেমে পড়িল।  কুন্তলার বান্ধবী ও সহপাঠিনীরাও বলে “fall in love” অর্থাৎ প্রেমে পড়িয়াছে।  কিন্তু এই সকল সাহিত্য ইহাও বলে যে প্রেম মানবজীবন কে পবিত্র করে, অন্তরাত্মাকে উদ্বোধিত করে, উদার ও মহৎ করে।  এরূপে মানুষ প্রেমে পড়িবে না, উঠিবে।  অথচ সকলের কেন পতন হয়?  মানুষ যেরূপ গহ্বরে পড়ে, কদলী খোসায় পা পিছলাইয়া পড়ে, দামাল শিশুরা পালঙ্ক হইতে পড়িয়া যায়, সেইরুপ এই সকল নারীরা প্রেমে পড়িয়া থাকে।  কাহারও উত্থান নাই!

কুন্তলা ঠিক করিয়াছিল, সে সকলকে দেখাইয়া দেবে প্রেমে কি করিয়া উঠিতে হয়।  সেজন্য সে যথাসাধ্য চেষ্টা করিতে লাগিল, তথাপি যথাযথ কিছুই করিয়া উঠিতে পারিল না।  কুন্তলার সহপাঠিনী – প্রিয়াঙ্কা, রিঙ্কি, জিনিয়া সকলেই এই আট নয় মাস কালে একটি দুটি করিয়া পুরুষ বন্ধু ‘ম্যানেজ’ করিয়াছে।  তাহাদের সহিত রেস্তোরাঁতে সান্ধ্য আহার সারিয়া থাকে, নগর বাগিচার কেদারায় জানুতে মাথা রাখিয়া খিলখিল করিয়া হাসে।  কিন্তু হায় হায়, কুন্তলার ভাগ্যলিপিতে সেরূপ কিছুই হইল না।  কুন্তলা সুন্দরী।  কামরাঙা সবুজ ঢাকাইয়ের আঁচল উড়াইয়া যখন কালেজে প্রবেশ করে, তখন ছাত্র-অধ্যাপক নির্বিশেষে সকল পুরুষই ফিরিয়া চায়।  কিন্তু প্রেম নিবেদন!  না না, সেই সৌভাগ্য কুন্তলার এখনও হয় নাই।

নিন্দুকেরা বলে, ইহার নাকি অন্য কারণ রহিয়াছে।

‘নবীনবরণ’ অনুষ্ঠান চলাকালীন কালেজের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক শ্রী রকি আহুজা যখন আসিয়া সকলের সহিত আলাপ করিতেছিল, নবীনা তরুণীরা তাহাকে স্পর্শ করিবার জন্য ঝাঁপাইয়া পরিতেছিল।  রকি কুন্তলার সামনে আসিয়া হাত বাড়াইল।  কিন্তু কুন্তলা হাত বাড়াইল না, গম্ভীর হইয়া নমস্কার করিল।  রকি কহিল, “Hi, looking attractive in saree!”  কুন্তলা হুঙ্কার করিল, “Mind your language.  একজন মেয়ের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয়, জানেন না!”  বেচারি রকি, কি হইল, কেন হইল – বুঝিতে না পারিয়া মানে মানে কাটিয়া পড়িল।

 রকি আহুজা, দ্বাবিংশ বর্ষীয়, বাণিজ্য বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। আর্যপুত্র রকির গৌরবর্ণ, গভীর চোখ, জিম ফেরত সুগঠিত শরীর বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল ছাত্রীকেই আকর্ষণ করে।  রকির সান্নিধ্য পাইবার জন্য সকল তরুণীই স্বপ্ন দেখে।  এইররূপ রকির হাত স্পর্শ করিবার আহ্বান প্রত্যাখ্যান করিল নবাগতা মনিকুন্তলা!  ছিঃ ছিঃ। কি দেমাক মেয়েটার!  ঢিঢি পরিয়া গেল কালেজ ক্যাম্পাসে।

আর্যপুত্র রকি, জেদ তাহার শোণিতে মিশিয়া আছে।  এমন অধরা নারীই তার প্রার্থিত হইয়া উঠিল।  ছায়ার ন্যায় অনুসরণ করিতে লাগিল মনিকুন্তলাকে।

মনিকুন্তলা দেখিল মহাবিপদ।  এরূপ সুপুরুষের আহ্বান সত্যই লোভনীয়।  কিন্তু ওই প্রেমসাহিত্য নামক কণ্টক তাহার হৃদয়ে খচখচ করিতে লাগিল।  এই সম্পর্ক তাহার মনোজগতে উত্থান না পতন ঘটাইবে, সেই লইয়া বিষম দ্বিধায় পড়িল।

অবশ্য ইতিপূর্বেও যে কেহ তাহাকে বিশেষ দৃষ্টিতে দেখে নাই, তাহা বলিলে মিথ্যচার করা হইবে।  নবম শ্রেণীতে পড়াকালীন বান্ধবী পাপিয়ার জ্যৈষ্ঠ ভ্রাতার দৃষ্টি বড়ই মধুর লাগিয়াছিল।  কিন্তু ওই পর্যন্তই।  তাহার অধিক হাতছানি অন্য পক্ষ হইতেও আসে নাই।  একাদশ শ্রেণীর গৃহশিক্ষক একদা নোটের অন্দরে রঙিন খাম রাখিয়াছিল বটে, কিন্তু মনিকুন্তলা অচিরেই হারাইয়া ফেলে।

যাহাই হউক, রকি সংক্রান্ত দোলাচল মনিকুন্তলাকে আরও বিপর্যস্ত করিয়া ফেলিল।  চিন্তায় চিন্তায় কুন্তলা ক্ষীণকায়া হইতে লাগিল।

বাবা শুধাইলেন, “কি হয়েছে মনিমা, শরীর খারাপ নাকি? মাকে বোলো, ডাক্তার দেখিয়ে আনবে।“
মনি কহিল, “না বাবা, খালি কান্না পাচ্ছে।“
মা কহিল, “সেকি কথা, ডিপ্রেশন নাকি!”
বাবা কহিল, “রাজ, মামনির প্রপার কাউন্সেলিং দরকার।  ভালো সাইক্রিয়াটিস্ট খোঁজ করো।  অ্যাপয়েন্টমেন্ট নাও।“
মা মাথা নাড়িলেন।  মনি নিজকক্ষে গিয়া দরজা দেয়।

রাজেশ্বরীদেবী অনেক খোঁজ করিয়া শহরের এক নামকরা মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সময় লন।
নির্দিষ্ট দিনে সময় আসিলে মায়ের সঙ্গে মনিকুন্তলা রওনা হইল চিকিৎসকের উদ্দেশে। পাড়ার  মোড় হইতে মায়ের সাথে রিকশায় উঠিয়া বসিল কুন্তলা।  আজ উহার চক্ষু যেন আরও কোটরাগত।  একটি আকাশ নীল সালোয়ার কামিজ পড়িয়াছে, ওড়না অগোছালো ভাবে পায়ের ওপর লুটাইয়া রইল।

রিকশা চলিতেছে, গন্তব্যের দিকে আপন গতিতে।  হঠাৎ ক্যাঁচ!  ওড়নাটি রিকশার চাকায় ফাঁস লাগিয়াছে।  বুক হইতে ওড়না হ্যাঁচকা টানে খুলিয়া লয় রিকশার চাকা।  চলন্ত রিকশা হইতে হুমড়ি খাইয়া পড়ে কুন্তলা।  ছিটকাইয়া যায় সম্মুখবর্তী খোলা পয়ঃপ্রণালীর দিকে।
কিছুক্ষণ চোখে অন্ধকার দেখিল মনিকুন্তলা।  মাথাটা ঠুকিয়া গিয়াছিল পয়ঃপ্রণালীর কিনারায়।
“উঠে এস মনি”, অন্ধকার কাটাইয়া একটি হাত দেখিতে পাইল কুন্তলা।  মাথা ঘুরাইয়া দেখে রাস্তা আলো করিয়া রকি দাঁড়াইয়া আছে। দুই চক্ষুতে উদ্বেগ।  হাত বাড়াইয়া বলিতেছে, “হাত ধরো, প্লীজ!”

মনিকুন্তলা হাত বাড়াইয়া দেয়।  রকি আহুজার হাত ধরিয়া উঠিয়া আসে কুমারী মনিকুন্তলা বাসু।
 



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন