দেবব্রত রায়
সব কি ABCD..., 1234... এর দিকে চলে যাচ্ছে ! একসময় তীব্র ইংরেজ-বিরোধিতায় জন্মেছিল চরম দেশাত্মবোধ। চরম বাঙালিয়ানা। কিন্তু সেই বাঙালিয়ানার কী দুর্দশা! স্বয়ং রবি ঠাকুর বলেছিলেন, মাতৃভাষা, মাতৃদুগ্ধ স্বরূপ।১৯৫০এ শিক্ষামন্ত্রী হরেন্দ্রনাথ রায়চৌধুরীর কংগ্রেস, ১৯৮৪তে বাম-সরকারের চেষ্টাসত্ত্বেও, এক্কাগাড়ির এ আর, অ্যাপলের এ-তে আমরা সব গুল্লিয়ে ফেলেছি। দেবভাষা সংস্কৃত তো নিজের রাজ্যপাট কবেই হারিয়েছে।
আমি মন্ত্র-তন্ত্র জানিনে মা...,গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা। কূলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা। রাশি রাশি ভারা ভারা ধান কাটা হল সারা, ভরা নদী ক্ষুরধারা খরপরশা...। তুমার পাকা আমে মাছি বুসেছে... ! সব মিলেমিশে বাংলার ঠাটবাটও এবার বোধহয়, গেল গেল
এখন ইশকুলে ইংরেজি ছাড়া ব্যাগের একটা হ্যান্ডেলও নড়ে না। হাকিম এবং হুকুম তো না-মুমকিন। বন্ধুদের ঠেক, ক্লাব,ক্যানটিন ফ্যামিলি-পার্টি হই-হূল্লোড় আনন্দ উৎসব শোক অর্থাৎ, রাজদ্বার টু শ্মশান, সব জায়গাতেই, হয় ইংরেজি মেশানো বাংলা নাহলে, শুধুই ইংরেজির ফোয়ারা ছোটে। আর বাড়িতে, পাড়ার গলি-গল্লায়, সেই অ-এ অজগর, আ-এ আম, ক-এ কাকাতুয়া...
এসব লিখতে গিয়ে একটা চুটকি মনে পড়ে গেল। একটি বাচ্চা ইশকুলে হটাৎ-ই, উঠে দাঁড়িয়ে ক্লাস-টিচারকে জিজ্ঞেস করল ,"ম্যাডাম, এইখানে হিশি করব ? "ম্যাডাম রেগেমেগে চিৎকার করে উঠলেন, হোয়াট ?
ছেলেটি প্রায় কাঁদো-কাঁদো গলায় বললো,"হিশি করার ইংরিজিটা ভুলে গেছি! " আসলে ছেলেটা মে আই গো টু টয়লেট,কথাটা বলতে চেয়েছিল। কিন্তু সেটা তার মনে ছিল না
একসময় মাগধি প্রাকৃত বা, মাগধি-ভাষারও এই হাল হয়েছিল। সেগুলো বিবর্তিত হয়ে তৈরি হয়েছিল ভোজপুরি মৈথিলি( মৈথেনি) ওড়িয়া বাংলা এবং অসমিয়া-ভাষা।
এই পাঁচটা ভাষার আদিরূপকে দুটো ভাগে ভাগ করা হয়।১) পশ্চিম মাগধি ( ২) পূর্বাঞ্চলীয় মাগধি
বুঝতেই পারছেন, আমরা হলাম দু-নম্বর অর্থাৎ, পূর্বাঞ্চলীয় মাগধির উত্তরসূরী
বাংলাভাষা তৈরি হওয়ার পিছনে অবশ্য, গৌড়ীয় প্রাকৃত এবং গৌড়ীয় অপভ্রংশের প্রভাব ছিল সবচেয়ে বেশি। অর্থাৎ শুদ্ধ মাগধির সঙ্গে পাঞ্চ হচ্ছিল মাগধি প্রাকৃত এবং গৌড়ীয় প্রাকৃত। এখন যেমন একটা জগাখিচুরি-বাংলা আমরা বলি, লিখি,অনেকটাই বা, কিছুটা সেরকম । কেউ কেউ বলেন, কবিতা পাঠ্য-ইতিহাসের চেয়েও সত্য। আমার মতে, কবিতা ইতিহাস ভুগোল বিজ্ঞান-সবকিছু ভুক্তভোগীর মতোই তুলে ধরে এবং সমসাময়িক ভাষাকে গুরুত্ব দেওয়াটাও কবিতার অন্যতম দায়িত্ব। যেটা পোস্টমর্ডান সাহিত্য, বিশেষ করে, পোস্টমর্ডান কবিতার একটা উল্লেখযোগ্য চিহ্ন। এই গ্রহের কোনো ভাষাই নিজের চরিত্রে মৌলিকতা টিকিয়ে রাখতে পারেনি। বলা ভালো, পৃথিবীর সব ভাষাই যে-ভাবে নিজের মৌলিকতা হারিয়েছে, বাংলা- ভাষাও সেভাবেই সংস্কৃত আরবি ফারসি উর্দু হিন্দি ইংরেজি তামিল তেলেগু...ইত্যাদি-ইত্যাদি-বহু- শব্দকেই আত্মীয় করে নিয়েছে। যেমন, মক্কেল আক্কেল ইমারত ইশারা খালি রাজি হজম হিসাব জলসা ফোয়ারা, এরকম বহু শব্দ আরবি থেকে বাংলায় এসে ঢুকেছে।
তিরন্দাজ গোয়েন্দা অজুহাত চাবুক নালিশ চেহারা আপোশ কারবার সরগরম বরফ খরচ হরদম পরদা অন্দর হাজার গোয়েন্দা... শব্দগুলো এসেছে ফারসি থেকে।হিন্দি-ভাষা তো আমরা আকছারই ব্যবহার করি।যেমন, ঝান্ডা কাহিনি কচুরি ইস্তক বন্ ধ চাহিদা ইত্যাদি-ইত্যাদি। এই-যে, আমরা লুঙ্গি বলি।এটা তো বর্মি-শব্দ।প্যান্ডেল শব্দটা এসেছে তেলেগু-ভাষা থেকে। ইংরেজি-শব্দের কথা আর নাই-বা বললাম। আমরা যে বাংলা বলি বা,লিখি, তার ৩০-৩৫ শতাংশ শব্দই তো ইংরেজি।
আগে ভাষা বদলায় তারপর, বদলে যায় একটা আস্ত জাতি। হয়তো একদিন এভাবেই আমাদের পশ্চিমবঙ্গের নাম হয়ে যাবে, হিজিবিজিবিজবিজ