দোঁহা

অন্নপূর্ণা দেবী: এক অনন্য ব্যক্তিত্বের প্রতিধ্বনি




অনুমিতা সেনগুপ্ত 

কেউ তাঁর কথা শুনেছেন। কেউ হয়তো বা সাক্ষাৎ পেয়েছেন মাত্র। কিন্তু তাঁর শিল্পসত্তার সান্নিধ্য খুব কম লোকই পেয়েছিলেন। স্বয়ং আলি আকবর খানের কাছে যিনি ছিলেন অসামান্যা, পণ্ডিত রবিশঙ্কর যাঁকে প্রতিভাময়ী আখ্যা দিয়েছিলেন, সেই রহস্যে মোড়া নারী হলেন “অন্নপূর্ণা দেবী”। যিনি সংগীতের ছায়াপথ থেকে সম্পূর্ণরূপে নিজেকে সরিয়ে রেখে আবদ্ধ করে নিয়েছিলেন শহরের একটি ছোট্ট আবাসন ‘আকাশ গঙ্গায়’, যেখানে তাঁর সঙ্গী ছিল পিতার দেওয়া তানপুরা, সুরবাহার।

বোম্বাই (বর্তমানে মুম্বাই) শহরের এক অভিজাত এলাকার সুউচ্চ আবাসনের ছয় তলার বাসিন্দা, এই মহিলা সম্পর্কে আবাসনের প্রতিবেশীরাও বিশেষ কিছু জানতেন না। যেটুকু জানতেন তা লিফট্ কর্মীর বদান্যতায়। সেভাবে কেউ তাঁকে দেখেন নি বা আলাপ করাও সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি। কেবল দরজার পাশে কলিংবেল সংলগ্ন স্থানে চৌকো বোর্ডে লেখা “6A, অন্নপূর্ণা দেবী” আর কিছু নির্দেশাবলী -

১) দরজা কেবলমাত্র সোমবার এবং শুক্রবার খোলা হয়।
২) তিন বার বেল বাজাতে হবে।
৩) যদি কেউ দরজা না খোলে তবে দয়া করে নিজের নাম, ঠিকানা লিখে রেখে যাবেন।

সাক্ষাৎ বা যোগাযোগ না হওয়ার জন্য দুঃখিত।

অন্নপূর্ণা দেবী ছিলেন অর্ন্তমুখী, অসীম গুণসম্পন্না, প্রতিভাময়ী সংগীত শিল্পী। জানা যায়, জীবদ্দশায় তিনি কোনো চিত্রগ্রাহক, সাংবাদিকের মুখোমুখী হননি। সর্ব-সাকুল্যে ১১-১২টি অনুষ্ঠান করেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল পিতার সাঙ্গীতিক ঐতিহ্যকে শ্রোতাদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া। তাই পিতার ছবি সামনে রেখে তিনি অনুষ্ঠান করতেন।

তাঁর এহেন প্রতিভাকে সম্মান জানাতে মধ্যপ্রদেশ সরকার তাঁকে মাসিক এক লক্ষ টাকা অনুদানসহ একটি পার্ক দিতে চেয়েছিলেন। তৎকালীন ইন্দিরা গান্ধী স্বয়ং তাঁকে ইহুদি মেনুহিন ও জর্জ হ্যারিসনের সম্মানার্থে তাঁদেরই সাথে মিলিত বাদ্যযন্ত্র বাদনের অনুরোধ করেন। প্রতিক্ষেত্রেই তিনি তা অবলীলায় প্রত্যাখ্যান করেছেন।

সুরসম্রাজ্ঞী অন্নপূর্ণা দেবী মাইহারে এক অভিজাত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবকাল থেকে তিনি দেখে এসেছিলেন পিতা সংগীতাচার্য বাবা আলাউদ্দিন খান সাহেব তাঁর সুযোগ্য পুত্র আলি আকবর খানকে সরোদ বাদনের তালিম দিয়ে চলেছেন। একদিন তিনি লক্ষ্য করেন, ভাই আলি আকবর কিছুতেই একটি রাগের নোটস ঠিকমতো আয়ত্ত করতে পারছিলেন না। সেইসময় অন্নপূর্ণা দেবী এগিয়ে এসে তা ঠিক করে দেন। সমগ্র ঘটনাটি পিতা দেখে ফেলেন এবং কন্যার অভূতপূর্ব পারদর্শিতায় মুগ্ধ হন। তিনি তাঁকেও সংগীত শিক্ষায় শিক্ষিত করতে ব্রতী হন। পরবর্তীতে খান সাহেব তাঁর এই লাজুক, অর্ন্তরমুখী কন্যাকে ‘সুরবাহার’ উপহার দেন। 

উল্লেখ্যনীয় সে সময় মেয়েদের সংগীত চর্চা ছিল রুদ্ধ। তালিমের পূর্বে তিনি যতটুকু আত্মস্থ করেছিলেন সবটাই পর্দার আড়াল থেকে। একদিন খান সাহেবের অন্যতম প্রিয় শিষ্য রবিশঙ্কর তাঁর দাদা উদয়শঙ্করকে গুরুজীর কাছে নিয়ে এলেন নৃত্যের সাথে সাথে সেতার বাদনে তালিম দেওয়ার জন্য। এক কথায় সৃষ্টি হল এক অভূতপূর্ব সাঙ্গীতিক পরিবেশ।

অন্নপূর্ণা দেবী, রবিশঙ্কর, আলি আকবর- এই ত্রয়ীর দূর্বার সঙ্গীত সাধনায় অন্নপূর্ণা দেবীর প্রতিভার বার বার প্রতিফলন ঘটতে দেখা যায়।

রবিশঙ্কর তাঁর আত্মজীবনীতে এক জায়গায় বলেছেন নিবিড় অনুশীলন নিরলস সাধনার তাগিদে অন্নপূর্ণা দেবী মাইহারে চলে যান এবং সেখানে ১৯৩৮-৪১ সাল পর্যন্ত চলে তাঁর বিরামহীন সঙ্গীতচর্চা। ১৯৪১ সনে তাঁর সাথে অন্নপূর্ণা দেবীর বিবাহ হয়। বিবাহ প্রসঙ্গে রবিশঙ্কর স্বীকার করেন অন্নপূর্ণা দেবীকে বিবাহ করার বাসনা তাঁর ছিল না। কিন্তু ভগ্নীপতি ও ভাই-এর অনুরোধে তা বাস্তবায়িত হয়। অনীহার কারণ হিসেবে তিনি বলছেন সে সময় গুরুর ভালোবাসা, আর্শীবাদ, শিক্ষা আহরণই ছিল তাঁর মুখ্য উদ্দেশ্য।

এইভাবেই দিন কাটছিল। রাগ-রূপায়ণে উচ্চাঙ্গ সংগীতের সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম দিকগুলি ক্রমশ আত্মস্থ হতে চলেছে, ঠিক এমন সময়ই জন্ম হল পুত্র শুভেন্দ্রর। এতে অন্নপূর্ণার সাধনায় ব্যাঘাত তো ঘটলই, ভেঙ্গে পড়লো তাঁর স্বাস্থ্য। রবিশঙ্কর স্বীকার করেছেন যে স্বামী হিসাবে তিনি সে সময় সার্থক বা দায়িত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন নি।

এমনিতেই অন্নপূর্ণা দেবী ছিলেন একাকী, অভিমানী এবং অর্ন্তমুখী মহিলা। পরবর্তীতে ঘটনা পরম্পরায় রবিশঙ্করের সাথে কমলা দেবীর সম্পর্ক তিনি মেনে নিতে পারেন নি। ভেঙে যায় তাঁদের দীর্ঘদিনের দাম্পত্য জীবন। ঠিক সেই সময় মৃত্যু ঘটে তাঁর পিতার। অতিদ্রুত, আকস্মিক এবং অনাকাঙ্খিত ঘটনাগুলি তাঁর জীবনে এতটাই প্রভাব ফেলে যে তিনি অবসাদগ্রস্থ হয়ে পড়েন। বর্হিজগৎ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন।

এহেন অসহায়তার মধ্যেও যাকে ঘিরে তিনি স্বপ্ন দেখতেন অর্থাৎ পুত্র শুভেন্দ্র, যিনি পিতার হাত ধরে আমেরিকায় চলে গেলে তিনি ভীষণ মুষড়ে পড়েন। না চাইতেও পুত্রের সাথে ব্যবধান ক্রমশ বাড়তে থাকে। এরপর ঘটে শুভেন্দ্রর অকাল মৃত্যু। এতখানি পুত্রশোক, আঘাত তিনি সহ্য করতে পারেন নি। ফলতঃ চরম অবসাদের শিকার হন। সারা জীবন ধরেই এই অবসাদ তাঁকে গ্রাস করেছিল, ফলে প্রকৃত উৎসাহী শিক্ষানুরাগীরা তাঁর সান্নিধ্য থেকে হয়েছিলেন বঞ্চিত।

প্রসঙ্গক্রমে এসে পড়ে বংশীবাদক নিত্যানন্দ হলদিপুরের কথা। যিনি কিছুতেই তাঁর সাক্ষাৎ পাচ্ছিলেন না। তালিম নেওয়া তো দূর অস্ত। অবশেষে বন্ধু সরোদ শিল্পী রাজীব তারানাথের সাহায্যে তাঁর সুপ্ত-বাসনা চরিতার্থ হয়। উল্লেখ্য অন্নপূর্ণা দেবীর বাড়ীতে রাজীব তারানাথের যাতায়াত ছিল অবাধ। পরিচয়পর্ব চলাকালীন অন্নপূর্ণা দেবী তাকে রাগ ইমন পরিবেশন করতে বলেন। এক্ষেত্রে যে সামান্য ত্রুটি-বিচ্যুতি ঘটেছিল তিনি তা সংশোধন করে দেন। সমগ্র ঘটনাটি হলদিপুরকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়, তাঁর মন ভরে ওঠে শ্রদ্ধায়।

অন্নপূর্ণা দেবী ছিলেন খানিক আত্মভোলা মনের মানুষ। এ প্রসঙ্গে, একটি মজার দৃষ্টান্ত হলদিপুরের কাছ থেকে জানা যায়। এক নেপালী বালক অন্নপূর্ণা দেবীর কাছে ইচ্ছা প্রকাশ করে যে, সে ওঁনার কাছে বেহালা বাদন শিখতে চান। কথোপকথনের মাধ্যমে তিনি জানতে পারেন যে বালকটি অতীতে অন্য বাদ্যযন্ত্র বাজাতো। এই বিষয় জানা মাত্রই তিনি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন। কিন্তু তার ইচ্ছাকে মর্যাদা দিয়ে সেই বালকের জন্য তিনি বেহালা শিক্ষনের একজন শিক্ষক নিযুক্ত করেন এবং তাঁর প্রাপ্য সান্মানিকও তিনিই দিতেন।

বলাবাহুল্য অনেক ভালো কাজের মধ্যেও হতাশা তাঁকে গ্রাস করে রেখেছিল। বিখ্যাত বংশীবাদক হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া এক জায়াগায় বলেছেন হতাশা, অবসাদ তাঁর জীবনে এতটাই প্রগাঢ় হয়ে উঠেছিল যে বেঁচে থাকার স্পৃহাটাই চলে গিয়েছিল।

অভিমানী অন্নপূর্ণা দেবীর কথা বলতে গেলে যে ঘটনাটি বিশেষভাবে এসে পড়ে তা হল সরোদবাদক প্রদীপ কুমারকে কেন্দ্র করে একটি ঘটনা। ১৯৭৪ সাল থেকে প্রদীপ কুমার তাঁর কাছে তালিম নিচ্ছিলেন। স্মৃতি চারনায় তিনি বলেছেন তাঁর বিবাহের সময় ভুলবশতঃ গুরু মাকে নিমন্ত্রন করতে ভুলে যান। এই ঘটনায় তিনি এতখানি ব্যাথিত হন যে তাকে তালিম দেওয়া বন্ধ ক’রে দেন। কারণ তিনি মনে করতেন এহেন ঘটনা এক ধরণের অবজ্ঞা, অ-শ্রদ্ধার বহিঃপ্রকাশ মাত্র। প্রায় ৭-৮ বছর তালিম বন্ধ থাকার পর অন্নপূর্ণা নিজেই অভিমান ভেঙ্গে তাকে ফিরিয়ে নিয়েছিলেন।

তবে আচরণের কথা যদি আসে তবে আমেরিকাবাসী রুশি কুমার পান্ড্য যিনি ছিলেন আলি আকবরের ছাত্র, তিনি ভারতে বেড়াতে এলে অন্নপূর্ণা দেবীর সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং অল্প সময়ের মধ্যে কিছু রাগ-রাগিনী আয়ত্ত করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। স্বাভাবিকভাবেই তিনি হতাশ হয়ে বলেন, শাস্ত্রীয় সংগীত চা জাতীয় পানীয় নয় যে খেয়ে নিলেই হল।

দৃষ্টান্তস্বরূপ এই রুশি কুমার পান্ড্যকে তিনি পাঁচ বছরে কেবল দুটি রাগ শিখিয়েছিলেন। একটি ভৈরবী অপরটি ইমন।

অন্নপূর্ণা দেবী ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতকে নিয়ে গিয়েছিলেন এক বিশাল উচ্চতায়। তাঁর রুদ্রবীণার ঝংকার আজও প্রতিধ্বনিত হয়ে চলেছে শাস্ত্রীয় সংগীত জগতে। এহেন যশশ্বিনী নারী ২০১৮ সালের ১৩-ই অক্টোবর মর্ত্যের মায়া কাটিয়ে পাড়ি দেন সুরালোকের জগতে। আজও তাঁকে ঘিরে যে সাঙ্গীতিক রহস্যময়তা পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে, তাকে ছেদ করতে পারে এমন সাধ্য কার?

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন