দোঁহা

শান্তিনিকেতনে নববর্ষে রবীন্দ্র জন্মোৎসব



পল্লবী চ্যাটার্জী


'বন্ধু হও,শত্রু হও, যেখানে যে কেহ রও,

ক্ষমা করো  আজিকার মতো

পুরাতন বরষার সাথে
পুরাতন অপরাধ যত।'

সারা বছরের সমস্ত না পাওয়ার গ্লানিকে দূর করে আপামর বাঙালির জীবনে বৈশাখের  প্রথম দিনের এই ভোরের হাওয়া নতুন সকাল নিয়ে আসে, প্রচলিত কথায় বৈশাখের প্রথম দিন ‘ পয়লা বৈশাখ’। বাংলা বছরের প্রথম দিন। গ্রীষ্মের প্রবল দাবদাহের মধ্যেই মহা সমারোহে পালিত হয় বাঙালির নববর্ষ। শান্তিনিকেতনে অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের সৃষ্ট বিশ্বভারতীতেও ঘটা করে পালন করা হয় এ উৎসব। এই আলোচনায় এবারে আসবো সেই উৎসবেরই রূপের বর্নানায় এবং রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় এই নববর্ষের দিনই কবির জন্মদিন পালনের রীতির কিভাবে সূচনা হল তাও শব্দ-বন্ধনীতে দেখবো।

শান্তিনিকেতন সূচনার সময় নববর্ষ তেমন জাঁকজমক করে পালিত হত না। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ধারা মেনেই সকালে উপাসনা, মন্ত্র পাঠ হত। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ‘ নববর্ষ ’ প্রবন্ধটির কিছু কিছু অংশের উল্লেখ করা যেতে পারে। নববর্ষ যে তার কাছে শুধুই নতুন বছরের আগমন নয়, এই বার্তাটি তিনি আশ্রমের সকল ছাত্রছাত্রী , শিক্ষক শিক্ষিকার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কবির প্রতিটি দিনের সূচনা হত জীবনদেবতাকে স্মরণ করে। নববর্ষের দিনটিও তার ব্যতিক্রম নয় এ দিন আশ্রমিকদের নিয়ে বিশেষ উপাসনা করতেন কবি। ধ্যনবাদ জ্ঞাপন করেন সেই জীবনদেবতাকে এই বিশেষ দিনটির জন্য। নববর্ষ প্রবন্ধের সূচনা অংশে এই ‘অন্তকালের প্রভুকে’ বারেবারে প্রনাম নিবেদন করেছেন কবি।

‘এই - যে বৈশাখের প্রথম প্রত্যুষটি আজ আকাশপ্রাঙ্গনে এসে দাঁড়ালো, কোথাও দরজাটি খোলবারও কোন শব্দ পাওয়া গেল না, আকাশ ভরা অন্ধকার একেবারে নিঃশব্দে অপসারিত হয়ে গেল, কুঁড়ি যেমন করে ফোটে আলোক তেমনি করে বিকশিত হয়ে উঠল - তার জন্য কোথাও কিছুমাত্র বেদনা বাজল না। নববৎসরের ঊষালোক কি এমন স্বভাবত এমন নিঃশব্দে আমাদের অন্তরে প্রকাশিত হয়?

নিত্যলোকের সিংহদ্বার বিশ্বপ্রকৃতির দিকে চিরকাল খোলাই রয়েছে ; সেখান থেকে নিত্যনূতনের অমৃতধারা অবাধে সর্বত্র প্রবাহিত হচ্ছে। এইজন্য কোটি কোটি বৎসরেও প্রকৃতি জরাজীর্ণ হয়ে যায় নি ; আকাশের এই বিপুল নীলিমার মধ্যে কোথাও লেশমাত্র চিহ্ন পড়তে পায় নি। এইজন্যই বসন্ত যেদিন সমস্ত বনস্থলীর মাথার উপরে দক্ষিণে বাতাসে নবীনতার আশিসমন্ত্র পড়ে দেয় সেদিন দেখতে দেখতে তখনই অনায়াসে শুকনো পাতা খসে গিয়ে কোথা থেকে নবীন কিশলয় পুলকিত হয়ে ওঠে, ফুলে ফুলে পল্লবে বনশ্রীর শ্যামাঞ্চল একেবারে ভরে যায় - এই- যে পুরাতনের আবরণের ভিতর থেকে নূতনের মুক্তিলাভ এ কত অনায়াসেই সম্পন্ন হয়। কোথাও কোনো সংগ্রাম করতে হয় না।’

পুরাতনের আবরণ ঘুচে  নব আগমনের বিষয়টি এর থেকে আর স্পষ্ট করে উপস্থাপন করা যায় বলে মনে হয় না। এই নতুন সকালে শান্তিনিকেতন আশ্রমে যে স্নিদ্ধ, নির্মল বাতাস , যে পাখির কলতানে মুখরিত তাতে যেন মেতে গিয়ে আমরা নববর্ষের এই প্রথম প্রভাতের কথা ভুলে না যাই।

‘আমাদের নববর্ষ এমন সহজ নয়, এমন কোমল নয়, শান্তিতে পরিপূর্ণ এমন শীতল মধুর নয়। মনে যেন না করি এই আলোকের নির্মলতা আমারই নির্মলতা, এই আকাশের শান্তি আমাওই শান্তি; মনে যেন না করি স্তব পাঠ ক’রে নামগান ক’রে, কিছুক্ষণের জন্যে একটা ভাবের আনন্দ লাভ ক’রে আমরা যথার্থরূপে নববর্ষকে আমাদের জীবনের মধ্যে আবাহন করতে  পেরেছি।’

এই নববর্ষ প্রতিবছর আমাদের জীবনে নিয়ে আনে নব উদ্বোধন। জীবনদেবতার করুণাআশীষে আমরা একটা করে দিন উপহার পাই সেই দিন , বছরের এই প্রথম দিনে আমরা যেন সেই দেবতার কাছে প্রতিজ্ঞা করি কর্মের মধ্য দিয়ে জীবনকে আমরা বয়ে চলবো, বাক্যের বাহুল্যতা নয়, আমাদের মধ্যে তার সৃষ্টিরলীলা যেন প্রতিদিন ধ্বনিত হয়।

 শান্তিনিকেতন আশ্রমে শালবিথী আম্রকুঞ্জের ওপার থেকে যখন নতুন বছরের প্রথম সূর্য দেখা দেয়, তখন আশ্রমের প্রভাত ভরে ওঠে বৈতালিকের গানে

‘ভেঙেছ দুয়ার এসেছ জ্যোর্তিময়, তোমারি হউক জয়’।

এরপর মন্দিরে উপাসনা, গুরুদেবের লেখা গান , পাঠের মধ্য দিয়ে নববর্ষ পালিত হয়। ‘ আনন্দরূপমৃতম’ যিনি তাকে স্মরণ করে শুরু হয় এই পয়লা দিন।

রবীন্দ্রনাথ এই নববর্ষ উপলক্ষ্যে লিখতেন নতুন নতুন গান। বর্ষশেষ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ বলেছেন,

‘ধাও গান , প্রান ভরা ঝড়ের মতন ঊর্ধ্ববেগে

অনন্ত আকাশে।

উড়ে যাক ,দূরে যাক বির্বণ বিশীর্ণ জীর্ণ পাতা

বিপুল নিশ্বাসে।

হে নূতন, এসো তুমি সম্পূর্ণ গগন পূর্ণ করি

পুঞ্জ পুঞ্জ রূপে -

ছন্দে ছন্দে পদে পদে অঞ্চলের আবর্ত- আঘাতে

উড়ে হোক ক্ষয়

ধূলিসম তৃণসম পুরাতন বৎসরের যত

নিস্ফল সঞ্চয়।’

ফেলে আসা  বছরের সমস্ত হতাশা, নৈরাশ্য ধুলিকনার মতো উড়িয়ে দিয়ে আমরা সবটুকু আশ্বাস দিয়ে অপেক্ষা করি এই নতুন বছরের এ কবিতায় সেই কথাই ধ্বনিত হয়েছে। রচনা করেছেন গান,

‘ দাও আমাদের অভয়মন্ত্র, অশোকমন্ত্র তব।

দাও আমাদের অমৃতমন্ত্র, দাও গো জীবন নব।’

এরকম প্রায় প্রতি বছরই নববর্ষ উপল্যক্ষে গান কবিতা, প্রবন্ধ রচনা করতেন কবি।

রবীন্দ্রনাথ সাহজাদপুরে জমিদারির কাজের ভার গ্রহন করে দেখলেন নববর্ষের এক অন্য রূপ, নববর্ষের আগের দিন থেকে সেখানে উৎসবের শুরু হয়ে যেত।

‘সেদিন যাকে বলে জমিদারি সেরেস্তার ‘পূন্যাহ’, খাজনা আদায়ের প্রথম দিন। কাজটা নিন্তানই বিষয় -কাজ। কিন্তু জমিদারি মহলে সেটা হয়ে উঠেছে পার্বণ। সবাই খুশি। যে খাজনা দেয় সেও, আর যে খাজনা বাক্সেতে ভর্তি করে সেও। এর মধ্যে হিসেব মিলিয়ে দেখবার গন্ধ ছিল না।’

১৯৩৯ সালে শ্যামলী বাটি তে নববর্ষের দিন কবি বলেন, -‘ নববর্ষ ধরতে গেলে রোজই তো লোকের নববর্ষ। কেননা এই হচ্ছে মানুষের পর্বের একটা সীমারেখা। রোজই তো লোকের পর্ব নতুন করে শুরু।’

রবীন্দ্র-জন্মদিবসের সময় অর্থাৎ বৈশাখের শেষদিকে গ্রীষ্মের দাবদাহে আকুল হয়ে উঠত বোলপুরের এই তপ্ত-প্রান্তর। চৈত্রের মাঝামাঝি সময় থেকেই মাঠ প্রান্তর ধূ-ধূ করত যেন একাকিত্বের অনল-জ্বালা। তার উপর নিদারুন জলকষ্ট। কবির জন্মদিনে তাই প্রতিবছর গ্রীষ্মাবকাশ থাকত আশ্রমে। আশ্রমিক এবং ছাত্রছাত্রীদের অনুরোধে এবং রবীন্দ্রনাথের সম্মতিতে ১৯৩৬ সাল থেকেই নববর্ষের দিনই কবি জন্মদিন পালনের রীতি প্রচলিত হয়।

কবির ৭৬ তম জল্মদিন পালিত হয় এই নববর্ষের দিনই। নববর্ষ উপলক্ষ্যে পত্রপুটের বারো সংখ্যক কবিতায় জীবনের সীমানায় দাড়াঁনো সেই মানুষকেই খুঁজে পেলেন কবি -

‘গান যে মানুষ গায় দিয়েছে সে ধরা, আমার অন্তরে,

যে মানুষ দেয় প্রাণ দেখা মেলে নি তার।

দেখেছি শুধু আপনার নিভৃত রূপ

ছায়ায় পরিকীর্ণ

যেন পাহাড়তলিতে একখানা অনুত্তরঙ্গ সরোবর।’

 
জীবন সায়াহ্ণে উপনীত কবির আত্ম-বিশ্লেষণের তাকে যন্ত্রনা দেয়। তিনি আশাবাদী হয়তো এই নতুন সূর্যদয়ের ওপারে সেই প্রাণদাত্রী অপেক্ষমান যিনি কবিকে আহ্বান জানান ‘এসো মৃত্যুবিজয়ী’।

১৯৩৭ সালে নববর্ষের দিন মন্দিরে উপাসনার পর কবির জন্মোৎসব পালিত হয়। এর কয়েকদিন আগেই  ২৫ শে চৈত্র ১৩৪৩ সনে লিখলেন ‘ স্মরণ’ কবিতাটি।

‘ যখন রব না আমি মর্ত কায়ায় তখন স্মরিতে যদি হয় মন

তবে তুমি এসো হেথা নিভৃত ছায়ায় যেথা এই চৈত্রের শাল বন’

গুরুদেব বরাবর নিভৃতলোকের পূজারী ছিলেন।  জনকোলাহলের ক্লান্তিকর পরিবেশের তুলনায়, আশ্রমের শাল বনের ছায়া তাকে অনেক বেশী শান্তি দিত। এই বছর নববর্ষের দিনই চীনা ভবনের দ্বার উন্মোচন হয়।

১৯৩৮ নববর্ষের অনুষ্ঠানে আচার্যের ভূমিকা গ্রহন করেন। মন্ত্রচ্চারণের মধ্য দিয়ে উপাসনার পর শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতনের আদিবাসীরা কবিকে তাদের তৈরী শিল্পকর্ম উপহার হিসেবে প্রদান করেন। অধ্যাপক তান- য়ুন- সান ও অন্যান্য চৈনিক পন্ডিতগণ কবিকে উপহার দেন। এরই মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে গেছে ভারাক্রান্ত মনে এই নববর্ষের দিনই কবি অমিয় চক্রবর্তী কে একটি পত্রে লেখেন, ‘ … এই বিশ্বব্যাপী আশঙ্কার মধ্যে আমরা আছি ক্লীব নিষ্ক্রিয়ভাবে দৈবের দিকে তাকিয়ে -এমন অপমান আর কিছু হতে পারে না- মনুষ্যত্বের এই দারুণ ধিক্কারের মধ্যে আমি পড়লুম আজ ৭৮ বছরের জন্ম বৎসরে’।

এরপর  ১৯৪১ সালে কবির শেষ জন্মদিন পালিত হয় নববর্ষের দিন। উদায়নের বারান্দায় বসে কবি স্বয়ং সম্পূর্ণ অনুষ্ঠানটি দেখেন। আচার্য ছিলেন ক্ষিতিমোহন সেন। তিনি কবি রচিত ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধটি পাঠ করেন। এই জন্মোৎসবে সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনুরোধে গুরুদেব রচনা করলেন ‘মানবের জয়গান’ শান্তিদেব ঘোষের স্মৃতিচারণা থেকে জানা গেল সেই কথা।

‘প্রথমে আপত্তি করলেন, কিন্তু আমার আগ্রহ দেখে …বললেন ‘ সৌম্য আমাকে বলেছে মানবের জয়গান গেয়ে একটা কবিতা লিখতে।’

এই কবিতাটিই দেখা দিল ‘ওই মহামানব আসে’ গান রূপে।

শান্তিনিকেতন আশ্রমে আজও সেই ধারা মেনে নববর্ষ পালিত হয়, তবে বর্তমানে শিক্ষাব্যবস্থায় semester system চালু হওয়ায় কবির জন্মদিবসের দিনই জন্মদিন পালিত হয়। নববর্ষের এই প্রভাতে পরমবহ্মের কাছে নিখিল বিশ্বাবাসীর জন্য কবির প্রার্থনা -

‘আজি এ সুপ্রভাতে,

বিশ্বজনের প্রাঙ্গণতলে লহো আপনার স্থান--

তোমার জীবনে সার্থক হোক,
নিখিলের আহ্বান।'

 

গ্রন্থঋণঃ

 ১. পচিঁশে বৈশাখ, অনুত্তম ভট্টাচার্য।

২. রবীন্দ্র জীবনী, প্রভাতকুমার, মুখোপাধ্যায়।

৩. রবিজীবনী, প্রশান্তকুমার পাল।

৪. জীবনের ধ্রুবতারা, শান্তিদেব ঘোষ।

৫. শান্তিনিকেতন প্রবন্ধগ্রন্থ - নববর্ষ- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

৬. চিঠিপত্র , রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

৭. বিশ্বভারতীর উৎসব , সুশীল কুমার মন্ডল।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন