দোঁহা

প্রদীপের তলায় অন্ধকার


 সুকান্ত সেনগুপ্ত

বর্তমানে আমরা স্বাস্থ্য এবং চিকিৎসা সম্বন্ধে অনেক সচেতন হয়েছি। কিন্তু প্রকৃত সচেতনতা এসেছে খুব কম মানুষের মধ্যেই, সে শিক্ষিত হোক বা অশিক্ষিত, ধনী হোক বা দরিদ্র। যদিও উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং ওষুধপত্র বাজারে এসেছে। স্বাস্থ্য এবং চিকিৎসা সম্পর্কিত হোক বা অন্য কিছু, অতিসচেতনতার সঙ্গে আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। এইসব কারণেই অতিসচেতন ব্যক্তিরা অধিক জটিলতা ও রোগে ভুগছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যই শরীরের স্বাস্থ্য রচনা করে। (পুষ্টিতে ইমুউনিটি বাড়ে / তারপর রোগে ভুগলে / সর্বাধিক ইমিউনিটি বাড়ে / বেপরোয়া থাকলে)। (আন্তরিক দুর্বলতা,/ও মনে জমা ভয়,/সময় বুঝে কোপ মারে,/রোগ তারে কয়।) আশা করি যারা প্রকৃত স্বাস্থ্য সচেতন ব্যক্তি তারা এর অর্থ নিশ্চয়ই বুঝতে পারবেন। কোন খাদ্যে কি পুষ্টিগুণ আছে সেটা জানা অতটা জরুরি নয় জরুরি হলো খাদ্যকে পরিপাক করে নেওয়ার মত শরীর গঠন করা। এবং তাতেই শরীরে সুস্থতা আসে।

       আমাদের দেশে প্রথাগত ঐতিহ্যময় চিকিৎসা ব্যবস্থার সাথে সাথে অন্যান্য চিকিৎসা ব্যবস্থাও প্রচুর সংমিশ্রণ ঘটেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত দু-একটি চিকিৎসা পদ্ধতি বাদে বাকি চিকিৎসা পদ্ধতি গুলিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বিশেষ কোন প্রচেষ্টা ও প্রচার প্রসার নেই,অর্থ বিনিয়োগও নেই। তাছাড়া যে চিকিৎসা ব্যবস্থা গুলিতে মন ও শরীরের আমূল পরিবর্তন, শুদ্ধিকরণ ও রূপান্তরণ হয় সেগুলির প্রতি মানুষের অনিচ্ছা, অলসতা আছে। এখন অর্থের বিনিময়ে দ্রুত ফল পাওয়ার আশায় কিছু হানিকারক ঔষধ প্রয়োগের ফলে ভেঙে পড়ছে জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ এবং গড়ে উঠছে রোগী হয়ে বেঁচে থাকার প্রবণতা। বিকল্প চিকিৎসার নামে অবহেলিত হয়ে পড়ে আছে অনেক চিকিৎসা পদ্ধতি। যেগুলো আসলে পরিপূরক চিকিৎসা। আবার কিছু চিকিৎসা ব্যবস্থা যারা স্বয়ংসম্পূর্ণ বলে দাবি করে। প্রতিটি চিকিৎসা ব্যবস্থা পরস্পর একজোট হয়ে চিকিৎসার কাজ করতে নারাজ এবং তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পরস্পর বিরোধী হওয়ার কারণে সঠিক চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয় সাধারণ মানুষ। এমনকি কিছুক্ষেত্রে একটি চিকিৎসা পদ্ধতির চিকিৎসক অন্য চিকিৎসা পদ্ধতিকে নিচু দেখানোর প্রচেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখেন না। এমন রোগীর কমতি নেই যারা দূরদূরান্ত থেকে চিকিৎসা করিয়ে এসে চিকিৎসকের পরামর্শমতো বারো মাস ওষুধ সেবন করে চলেছেন শুধুমাত্র রোগটিকে কন্ট্রোল করে রাখার জন্য,সুস্থ হওয়ার জন্য নয়। আবার বর্তমান যা পরিস্থিতি তাতে অনেক ক্ষেত্রেই অতিসচেতন না হওয়া ও দরিদ্রতার কারণেও অনেক রোগী বেঁচে যায়।

       প্রেসার, সুগার, কোলেস্ট্ররল, ফ্যাটি লিভার, হার্ট কিডনি লিভার ফেইলিওর, মাইগ্রেন, বাতের ব্যথা, হাঁটুর ব্যথা, কোলাইটিস, জন্ডিস, অ্যাংজাইটি, ডিপ্রেশন, প্রোস্টেট এর সমস্যা, হাঁপানি, হৃদরোগ, গুপ্ত রোগ, সোরাইসিস, এলার্জি, হার্ট ব্লকেজ, থাইরয়েড সমস্যা, টিউমার প্রভৃতি আরও অনেক রোগ আছে যেগুলোর জন্য কোনো একটি চিকিৎসা পদ্ধতি রোগীকে সারা জীবন ওষুধ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয়,শুধু রোগটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য। শুধু তাই নয় এই ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতির কথাগুলো চিকিৎসকদের দ্বারা এমনভাবে প্রচার করা হয় যেন তা সর্বজনস্বীকৃত এবং দেশে সেই রোগ সারিয়ে তোলার জন্য আর কোনো চিকিৎসা পদ্ধতিই নেই। দীর্ঘদিন একই রোগের একই ধরনের কেমিক্যাল ও হরমোন জাতীয় ঔষধ প্রয়োগে শরীরে নানান পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া,জটিলতা ও রোগ বাসা বাঁধে। ফলে রোগী ধীরে ধীরে চিকিৎসার জালে জড়িয়ে পড়ে।

        প্রকৃতপক্ষে প্রতি ক্ষেত্রেই রোগের সাথে প্রতিবার লড়াই করে আমাদের শরীর। তাই আমাদের শরীরই সবথেকে বড় চিকিৎসক। এই শরীর কোন যন্ত্র নয়। তার চিন্তা-ভাবনা, আবেগ, অনুভূতি, বিচার করার ক্ষমতা সবকিছু মিলিয়ে নিয়ন্ত্রণ করে শরীরের বিভিন্ন হরমোন, এনজাইম ও কেমিক্যালসকে।সেই শরীরকে শুধু সমর্থন দেওয়াটাই একজন স্বাস্থ্যসচেতন ব্যক্তির প্রধান কাজ। সে কারণেই একজন চিকিৎসক যদি সত্যিই স্বাস্থ্য সচেতন হন তাহলে প্রথমে তার নিজে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হওয়া বাঞ্ছনীয়। মনের ভয় ও শরীরের দুর্বলতাকে দূর করতে পারলেই সব চিকিৎসার সমাধান হয়ে যায়। দরকার শুধু দৈনন্দিন জীবনে কিছু নিয়ম, সংযম, সঠিক খাদ্যাভ্যাস, শরীরচর্চা ও ধ্যান পূর্বক কাজ করা। মনের চিন্তারূপী বীজটাকে যদি আমরা ঠিক করে নিতে পারি তাহলেই সেই ফলদায়ী বৃক্ষ মজবুত হবে।প্রকৃতপক্ষে আমাদের জীবনের ছোট ছোট ভুল ত্রুটি গুলিই বড়সড়ো রোগের কারণ। সেগুলিকে ঠিক করে নিতে পারলেই দৈনন্দিন জীবনকে একটি সুরে বেঁধে স্বাস্থ্যসম্মত ও নীরোগ থাকা সম্ভব।

       মানুষ যদি তার নিজের স্বাস্থ্যের ব্যাপারে নিজে বুঝে নিতে না পারে তাহলে চিকিৎসক কিছু করে দিতে পারবে না। চিকিৎসক রোগের চিকিৎসা করেন কিন্তু শরীরকে সুস্থ রাখার দায়িত্ব সম্পূর্ণ নিজের। আমদের অসুস্থতার কারণ হলো আমাদের স্বাস্থ্যের রিমোট কন্ট্রোলারটি আমরা অন্যের হাতে তুলে দিয়েছে। আমার বিশ্বাস ভবিষ্যতে আমাদের সুন্দর স্বাস্থ্য গড়ে তোলার জন্য ইন্টেগ্রেটেড মেডিসিন চিকিৎসা পদ্ধতিকে মেনে নিতেই হবে। ইন্টেগ্রেটেড চিকিৎসা পদ্ধতি হলো কোন রোগীকে সমর্থন দেওয়া ও সুস্থ করে তোলার জন্য যত ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি আছে তার মধ্যে নিরাপদ ও সর্বোত্তম চিকিৎসা পদ্ধতিটি সেই রোগীর জন্য প্রয়োগ করা। এই চিকিৎসা পদ্ধতিতে ঔষধ,সার্জারি এবং প্রথাগত প্রাচীন ঐতিহ্যময় চিকিৎসা পদ্ধতি, ভেষজ, ধ্যান, যোগ প্রকৃতিকে কাজে লাগানো হয়।তাছাড়াও এই চিকিৎসা পদ্ধতির অন্যতম উদ্দেশ্য হল দৈনন্দিন জীবনশৈলী সঠিক করে শরীর, মন ও অন্তর্মনের অভূতপূর্ব পরিবর্তন এনে শরীরকে এতটাই সমর্থন করে তোলা যাতে শরীর নিজেই বিভিন্ন সংক্রমণ ও ব্যাধির সাথে লড়াই করতে পারে। রোগীকে সুস্থতার প্রকৃত ছন্দে ফিরিয়ে আনাই এই চিকিৎসা পদ্ধতির প্রধান উদ্দেশ্য। এমন অনেক রোগ আছে যেগুলো আমাদের দুরারোগ্য রোগ বলে মনে হয়। সেগুলো এই চিকিৎসা পদ্ধতিতে খুব সহজেই স্বল্পখরচে সেরে ওঠা বা আয়ত্তে আনা সম্ভব।

      বিভিন্ন চিকিৎসা পদ্ধতির মধ্যে প্রাকৃতিক চিকিৎসা, আয়ুর্বেদ, অ্যালোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি, ইউনানি,পশ্চুরাল ট্রিটমেন্ট,অ্যারোমা থেরাপি, ভাইব্রেশন ট্রিটমেন্ট, ম্যাগনেটিক ট্রিটমেন্ট, আকুপ্রেশার, আকুপাংচার, সিদ্ধা, ফিজিওথেরাপি, ধ্যান, যোগ, ভিজুয়ালাইজেশন প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। অনেকক্ষেত্রে সঠিক পরামর্শ পাওয়া গেলে ঘরে বসেও রোগ সারে। প্রতিটি চিকিৎসা পদ্ধতি গুলির গুরুত্ব নিজ নিজ ক্ষেত্রে অপরিসীম। আমাদের দেশে বিভিন্ন ঐতিহ্যময় চিকিৎসার অপূর্ব ভান্ডার রয়েছে। যেগুলো প্রাচীন হলেও বিজ্ঞানসম্মত। প্রাশ্চাত্যের অনুকরণ করতে গিয়ে আমরা দেশীয় সংস্কৃতি ও চিকিৎসা ব্যবস্থাকে ভুলতে বসেছি। চিকিৎসার আলো আনতে গিয়ে আমরা এটাই ভুলে গেছি যে আমাদের প্রদীপের তলাতেই অন্ধকার হয়ে গেছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন