সাগরিকা শূর
১.
"উঃ!" পিন ফোটানোর মতো ব্যথাটা জানান দিয়ে গেল আবার। জানান দিয়ে গেল যে অন্য অনেক কিছুর মতো স্নায়ুতন্ত্রটা এখনও বিকল হয়ে যায়নি। জানান দিয়ে গেল যে আশ্চর্যজনকভাবে অনুভূতিরা এখনও সজাগ!
গত বারো দিন এই সাদা চাদর মোড়া লোহার সিঙ্গল বেড, ওষুধ, ফুলের তোড়া আর হাসপাতালের নিজস্ব গন্ধ মেশানো একটা অদ্ভুত ঘোরলাগা গন্ধ, প্রত্যেক সন্ধ্যেয় নিয়ম করে চেনা পরিচিত মুখগুলোর বিরক্তিকর একঘেয়ে প্রশ্ন কিংবা উপদেশ, আলুনি ডালের ঝোল আর অন্নপ্রাশনের ভাত উগড়ে দেওয়া মাছ কিংবা সবজি, নার্স আর আয়াদের বাধ্যতামূলক 'যত্ন', ডাক্তারের অনিয়মিত পরিদর্শণ, আর..আর এই হঠাৎ হঠাৎ পিন ফোটানোর মতো ব্যথাটা - এরাই আমার পৃথিবী। ঠিক ২ সপ্তাহ আগে হয় অ্যাক্সিডেন্টটা। উইকেন্ড ট্যুরে মালদা থেকে ফেরার পথে সোজা পোস্টে ধাক্কা। না, না, 'দোসর' এর কেস নয়, আমি নিজে ড্রাইভ করেই ফিরছিলাম, একা, যেমন ফিরি মাঝে মাঝেই। এবারও সব ঠিকঠাকই ছিল, তবু ব্রেকটা হঠাৎ কীকরে যে ফেল করল জানিনা। শুধু এটুকুই মনে আছে আমি প্রাণপাণ চেষ্টা করেছিলাম স্টিয়ারিং ঘোরাতে, তবু শেষরক্ষা হয়নি। যখন জ্ঞান ফিরল তখন মালদা জেলা হাসপাতালে, অবশ্য তারপরদিনই ঠিকানা বদলেছে দক্ষিণ কলকাতার এই স্বনামধন্য বেসরকারী হাসপাতালে। আমার যদিও ইচ্ছে ছিলনা তেমন, কত লোকেরই তো সরকারী হাসপাতালেই চিকিৎসা হচ্ছে দিন রাত্রি, আমিই বা আলাদা কি? তফাৎটা মাসের শেষে কয়েকটা শূন্যের কম-বেশী বৈ তো আর কিছু নয়, কিন্তু মধু রিস্ক নিতে চায়নি। আপাততঃ বাঁ হাতের ফ্রাকচার, কোমরে অপারেশনের জায়গাটায় তীব্র যন্ত্রণা আর মাঝে মাঝেই টুকি দিয়ে যাওয়ার মতো ডান পায়ের গোড়ালির কাছে পিন ফোটানো ব্যথাটা, এই নিয়ে বেশ আছি।
২.
মধুবন্তীর সাথে আমার বিয়েটা হয় তিন বছর আগে। তখন আমরা একই কোম্পানীতে চাকরী করি, ও এইচ আর এ আর আমি আইটিতে, সেই সূত্রেই আলাপ। টুকটাক ঘোরাঘুরি, কথাবার্তা আর তারপরই বিয়ে। এটাকে ঠিক লভ ম্যারেজ বলা যায় কিনা জানিনা, কারণ মন দেওয়া নেওয়া বলতে যা বোঝায় সেটা ঠিক হয়নি আমাদের মধ্যে। আসলে তখন আমি তিরিশের কোঠায়, বাড়ি থেকে প্রত্যেকদিন বিয়ের জন্য তাগাদা, আর ঠিক তার বছর দেড়েক আগেই অনুর সাথে পাঁচ বছরের সম্পর্কটা ভেঙে যায় আমার। তাই মধুবন্তীর সাথে আলাপ হওয়ার পর শুধু ভালোলাগাটাই কাজ করেছিল, ভালোবাসার খোঁজ নেওয়ার সুযোগ বা ইচ্ছে কোনোটাই হয়নি। আর এই কর্পোরেটে চাকরী করার একটা অদ্ভুত সুবিধা আছে, সময়ের সাথে সাথে অনুভূতিগুলো ভোঁতা হয়ে যায় একটু একটু করে, 'হৃদয়ের কথা'র চেয়ে 'ব্যলান্স শীট'এর ভাষাটা সহজবোধ্য লাগে।
দূরত্বটা স্পষ্ট হয়েছিল যখন হানিমুনে নীলের সি বিচে বসে আমি একমনে আর্নল্ডের 'ডোভার বিচ' টা রিসাইট করার পর বুঝলাম, আমার অধুনা সঙ্গিনী, আমার 'বেটার হাফ' অদূরে ভাঙতে থাকা ঢেউ আর হাতে ধরা গোল্ড ফ্লেকে আগ্রহী হলেও আর্নল্ডে তাঁর কোনা আগ্রহ নেই এবং হয়তো কিছু কিছু বিষয় ছাড়া আমার প্রতিও না। ছেলেবেলা থেকে আবৃত্তি না শিখলেও প্রশংসার খুব একটা অভাব হয়নি। এমনকি কলেজ ফেস্টেও প্রতিবারই পারফরম্যান্স ছিল বাঁধা। তাই সদ্যবিবাহিতা স্ত্রীর কাছ থেকে এহেন নীরবতার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না ঠিক। তবু বিব্রত হলেও কিছুক্ষণ চুপ থেকে কৌতূহলের বশে আমিই জিজ্ঞেস করলাম, "কিছু বললে না?"
- "ওয়েল, আই ডোন্ট নো হোওয়াট টু সে..য়্যু ডু হাভ আ নাইস ভয়েস..বাট, কবিতা টবিতা আমি তেমন বুঝি না", সিগারেটের ছাই ফেলতে ফেলতে অপরপক্ষের অকপট উত্তর। এর পর বলার কিছু থাকে না, কারোর কবিতা নাই ভালো লাগতে পারে, সেটা দোষের নয়। কিন্তু 'ভালো না লাগা' আর উদাসীনতা এক জিনিস নয়। খারাপ লাগার যুক্তি থাকলে তার প্রতিযুক্তি দেওয়া যায়, কিন্তু উদাসীনতার কোনো কারণ হয় না। তবে উদাসীনতার জন্যও কাউকে দোষ দেওয়া যায় কি? আমিও তো কতকিছু নিয়েই উদাসীন, আমিও তো জানিনা ঠিক এই মুহূর্তে হীরে কিংবা প্লাটিনামের মার্কেট ভ্যালু কত, কিংবা ঐশ্বর্য রাইয়ের মেয়ের বয়স ঠিক কত হল, তবু ঠিক এই গোড়ালির ব্যথাটার মতো বুকের ভেতর চিনচিনে একটা পিন ফোটানো ব্যথা নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিয়েছিলাম।
এই পিন ফোটানো ব্যথাটা আমার বহুকালের সঙ্গী। ছোটবেলায় ইঞ্জেকশনে প্রচন্ড ভয় পেতাম, প্রত্যেকবার টক্সাইড নিতে যেতাম এই শর্তে যে ইঞ্জেকশন দিয়ে ফেরার পথে অন্তত একটা ডেয়ারী মিল্ক পাওয়া যাবে বা পরের দিন অন্তত আধঘণ্টা বেশীক্ষণ মাঠে থাকার অনুমতি। যদিও একটু বড় হয়ে এই ভয়টা কেটে গেছিল আস্তে আস্তে, কারণ ফুটবলের দৌলতে ইঞ্জেকশনটা তখন প্রায় অভ্যাস হয়ে গেছিল। তবে এখানেই শেষ নয়, একটা বড়সড় গণ্ডগোল বাধল ইলেভেনে বায়োলজি ক্লাসে। একদিন প্র্যাকটিকাল ক্লাসে গিয়ে শুনলাম আমাদের ব্যাঙের ডিসেকশন শিখতে হবে। সেদিন প্রথম প্র্যাকটিকাল ক্লাস বলে স্যার নিজেই ডিসেকশন করে দেখাচ্ছিলেন। প্রথমে এনাস্থেটিক ব্যাঙটার হাত পা টেনে পিন দিয়ে ওয়াক্স ট্রে তে আটকে তারপর মাঝবরাবর ছুরি দিয়ে কেটে ব্যবচ্ছেদ। কিন্তু আমার হঠাৎ কী হল কে জানে, ওই পিন ফোটানো দেখেই কেমন একটা অস্বস্তি শুরু হল, তার কিছুক্ষণ পরই হাত পা বরফের মতো ঠান্ডা, সে যাত্রা স্যর আর বন্ধুদের দাক্ষিণ্যে কোনোমতে বাঁচলাম। ফলস্বরূপ, তারপর দিনই ফোর্থ সাবজেক্ট বায়োলজি বদলে স্ট্যাটিস্টিকস। আমাদের বায়োলজি স্যর সত্যপ্রিয়বাবু ছিলেন কট্টর বাঙাল। আমার ওই অবস্থা দেখে নিজের হাতের মধ্যে আমার ঠান্ডা হয়ে যাওয়া হাতের তালু দুটো ঘষতে ঘষতে বলেছিলেন, "এইটুকান ব্যথা সহ্য করতি পারতাস না, বড় বড় ব্যথা সহ্য করবা কী কইরা"?
স্যরের কথার মানে যতদিনে বুঝেছিলাম, ততোদিনে সহ্যশক্তি অনেকগুণ বেড়ে গেছে। যাই হোক, ব্যাঙের ব্যবচ্ছেদের হাত থেকে উদ্ধার পেলেও বয়সের সাথে ব্যথার সম্পর্কটা যে ব্যস্তানুপাতিক নয় বরং সমানুপাতিক সে বোধ তখনও আমার হয়নি। তাই বায়োলজি ছেড়ে স্ট্যাটিস্টিকস নিলেও শেষরক্ষা হল না। প্রথমদিন স্ট্যাটিস্টিকস টিউশন গিয়েই একটা শ্যামলা মুখে চোখ আটকে গেল আমার। আমার প্রথম প্রেম..প্রেম, ভালোলাগা না মুগ্ধতা আজ আর ভালো বুঝিনা যদিও। তারপর থেকে পড়ার ফাঁকে ফাঁকে আড়চোখে একঝলক দেখে নেওয়া, টিউশন থেকে ফেরার পথে "আমার বাড়িও তো এদিকেই" বলে ঘুরপথে বাড়ি ফেরা, সিগারেটে সুখটান দিতে দিতে বন্ধুদের টীকা-টিপ্পনিগুলো হাসিমুখে হজম করা, কিংবা, পরীক্ষার আগে ভেন ডায়াগ্রাম বোঝানোর অছিলায় এক দু'বার তার বাড়িও ঘুরে আসা। টিপিক্যাল টিনএজ প্রেমে যা হয় আর কি। তবে সুখ কিংবা সুখটান কোনোটাই জীবনে দীর্ঘস্থায়ী হয় না, আমারও হয়নি। বন্ধুদের অত্যুতসাহ আর নিজের সমস্ত সাহস একজোট করে যে বিকেলে তাকে বলব ভেবেছিলাম, "আমার তোকে বড্ড ভালোলাগে", সেই বিকেলেই সিগারেট খেতে রাসের ঘাটে গিয়ে চোখ পড়ল দূরে, ঘাটের একদম শেষ সিঁড়িতে দুটো মূর্তি..পাশাপাশি বসা..সেই লম্বা বেনী, সেই শ্যামলা মুখ, সেই 'হরিণ চোখ'..দূর থেকে দেখলেও চিনতে ভুল হয়নি...
তারপর আর কিছু বলা হয়নি অবশ্য, বলার কথাও নয়। শুধু খুব গভীরে কোথাও সেই চিনচিনে পিন ফোটানো ব্যথাটা অনেকদিন পর্যন্ত সঙ্গী হয়ে ছিল...
আচ্ছা, আজ এত পুরনো কথা কেন মনে পড়ছে? আমি কি বুড়ো হয়ে যাচ্ছি? শুনেছি বয়স হলে মানুষ বড্ড অতীতমুখী হয়ে পড়ে। সারাদিন পুরনো কথা আর স্মৃতির নির্যাসে জারিত করে নিজেদের..আমারও কি তেমন হল? অবশ্য নয় নয় করে ৩৩ তো হয়েই গেল, আসছে জানুয়ারীতে ৩৪..সংখ্যার দিক থেকে দেখতে গেলে হয়তো বৃদ্ধ হতে এখনও অনেকই বাকি। কিন্তু মনের বয়স, তাকে আটকাই কেমনে? কিন্তু এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। আমি যে ভেবেছিলাম কোনোদিন বুড়ো হব না..কক্ষনো না.."সব শেষের তারা মিলালো আকাশ খুঁজে তাকে পাবে না/ ধরে বেঁধে নিতেও পার, তবু সে মন ঘরে যাবে না/ বালক আজও বকুল কুড়ায়..." আমার তো সেই বকুল কুড়ানো বালক হওয়ার কথা ছিল...তবে? জানিনা...জীবন সব হিসেবে কীভাবে তালগোল পাকিয়ে দেয় যেন বার বার। যা হওয়ার কথা দূরতম কল্পনাতেও ছিল না, তাই হয়ে যাই; যা না হতে পারলে জীবনটাই শূন্য বলে মনে হয়েছিল একদিন, তার ধারে কাছে না গিয়েও কেমন নির্দ্বিধায় কাটিয়ে দিই বছরের পর বছর...অদ্ভুত!
৩.
অবশেষে মুক্তির চিঠি। আজ সকালে জানলাম সবকিছু ঠিক থাকলে আমায় আগামীকালই ছেড়ে দেওয়া হবে। যদিও কাল রাত থেকে সামান্য জ্বর আর মাথাব্যথা সঙ্গী হয়েছে, তবে আশা করা যায় কালকের মধ্যে অনেকটাই সুস্থ হয়ে যাব। কোমরের ব্যথাটাও অনেকটাই কমে এসেছে, গোড়ালির নীচের ব্যথাটাও ততো জ্বালাচ্ছে না আর। তবু কেন যেন আমার তেমন আনন্দ হচ্ছে না, মানে এই ১২ দিন একটানা বিছানাবন্দী থাকার পর ছুটির খবরে যতটা আনন্দ হওয়ার কথা সেরকম কিছুই হচ্ছে না একদমই। বরং কেমন যেন মায়া পড়ে গেছে। এই বন্দীদশা, এই সারাদিন একটা ঘোর লাগা গন্ধ, এই অফুরন্ত অবসর...কেমন যেন অভ্যস্ত হয়ে গেছি পুরো সিস্টেমটার সাথে। প্রথম প্রথম খুব বিরক্ত লাগত, ভীষণ ডিপ্রেসন হতো...কতবার মনে হয়েছে পালিয়ে যাই...এভাবে একই ঘরে, প্রায় একই ভাবে দিনের পর দিন শুয়ে থাকা...এই অসম্ভব নিস্তরঙ্গ জীবন...শুধু মাঝে মাঝে সাদা পোষাকের কিছু মানুষ, যারা আমার শরীর ছাড়া আর কোনো খবরেই আগ্রহী নয়, আর প্রত্যেক বিকেলে নির্দিষ্ট কিছু চেনা মুখ, কিছু নির্দিষ্ট বাক্যবিনিময়, কিছু নির্দিষ্ট সময়ের নির্দেশিকা, বাকী সমস্ত সময়টা একটা অদ্ভুত নিঃসঙ্গতা...অদ্ভুত একটা আবেশ ঘিরে থাকে সারাদিন। হাসপাতালে থাকলে বোঝা যায় প্রত্যেকটা মানুষ কী ভীষণরকম একা...কী ভীষণ অসহায়। বাবার এক কাকা ছিলেন যিনি প্যারালিসিস হয়ে ১০ বছর শয্যাশায়ী থেকে মারা যান। কোনোদিন উঠে ঘর থেকে বারান্দায় পর্যন্ত যেতে পারেননি, তারওপর ছিলেন অবিবাহিত...এক এটেন্ডেন্ট ছিল, সেই সব করত। আমি তাকে জীবনে দেখেছি হাতে গুণে কয়েকবার মাত্র। কোনোদিনই তেমন কোনা টান ছিল না, থাকার কথাও নয়। কিন্তু এইকদিন এই হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শুয়ে বড্ড কষ্ট হয়েছে ওনার জন্য...১০ বছর ওভাবে কী করে ছিল মানুষটা?? তবে এসবই গোড়ার দিকের কথা। শেষের কয়েকদিন এই একাকীত্বটা বেশ উপভোগই করছিলাম বলা চলে। এ কদিনে নিজের ভেতরের মানুষটা বা বলা ভালো মানুষগুলোকে যেভাবে চিনেছি তেমন আর কখনো নয়। প্রতিদিন নিজের এক একটা স্তর, এক একটা সত্ত্বা সিন্দুক খুলে, ধুলো ঝেড়ে, নেড়েচেড়ে দেখা, তারপর আবার সযত্নে গুছিয়ে রাখা। মন জিনিসটা যে এত অবিমিশ্রভাবে জটিল, এত অসীম সেটা এই অ্যাক্সিডেন্টটা না হলে বোধহয় বুঝতাম না সত্যিই। কত সূক্ষ্ম ঘটনা, নিতান্ত তুচ্ছ কত স্মৃতিও যে কী পরম যত্নে তোলা থাকে, অথচ হয়তো সেসব মনে থাকার কোনো কথাই ছিল না...এ এক অদ্ভুত আত্মবীক্ষণ...
এই যেমন, আজ সকাল থেকে অনুর কথা বড্ড মনে পড়ছে। না, অনুকে আলাদা করে মিস করা, বা আলাদা করে মনে পড়ার কিছু নেই, কারণ ও আমার প্রতিদিনের অস্তিত্বে বাস করে। তবু টুকরো কিছু কথা, কিছু প্রায় ভুলে যাওয়া স্মৃতি আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে যাচ্ছে হঠাৎ। যেমন বাইরের কৃষ্ণচূড়া গাছটার দিকে যতবার চোখ পড়ছে, একটা বিকেল মনে পড়ে যাচ্ছে...এরকমই একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ ছিল আমাদের কলেজ ক্যাম্পাসে, লালে লাল হয়ে থাকতো বসন্তের শেষ থেকে পুরো গরমকালটা। একটা পড়ন্ত বসন্ত বিকেলে গাছটার নীচে বসে সবাই আড্ডা দিচ্ছি, হঠাৎ অনু ওর খোলা চুলে পাশে পড়ে থাকা কয়েকটা কৃষ্ণচূড়া গুঁজে নিল। সবার মধ্যে আমারই চোখ পড়ল প্রথম। ওই শেষ-বিকেলের আলো, অনুর ছোট্ট মুখটুকু ঘিরে উড়তে থাকা চুল, আর কানের পাশ থেকে উঁকি দিতে থাকা কৃষ্ণচূড়া..অদ্ভুত লাগছিল..কিছু বলতে পারিনি। শুধু চুপ করে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বুঝেছিলাম, "প্রহরশেষের রাঙা আলোয় সেদিন চৈত্র মাস/ তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ"..
তখনও অনুর সাথে আমার সম্পর্কটা ঠিক প্রেম হয়ে ওঠেনি। যদিও অনু, মানে অনমিত্রা বসুর সাথে আমার পরিচয় দীর্ঘকালের। সেই ফ্রক আর হাফপ্যান্ট পড়ে, আধো আধো গলায় কথা বলার বয়সেই। হ্যাঁ, অনু আমার প্রাইমারী স্কুলের বন্ধু, শুধু বন্ধু নয়, অভিন্ন হৃদয় বন্ধু। যে বয়সে প্রেম, ভালোবাসা, বন্ধুত্ব এসব আলাদা করে বোঝার দায় বা তাগিদ কোনোটাই থাকে না, আমাদের ভালোবাসার হাতেখড়ি সে বয়সেই। তখন একদিনও একজন অন্যজনকে না দেখলে বড্ড মন খারাপ হত, তখন এমন কোনো জিনিসই ছিল না যার মালিকানা দু'জনের নয়। সেটা অনুর বাবার এনে দেওয়া বিদেশী খেলনা পিস্তল কিংবা আমার সাধের ডাকটিকিটের কালেকশন। নার্সারী থেকে ফোর অব্দি সময়টা যে কীভাবে কেটেছিল নিজেরাও জানিনা। বন্ধুত্বে টান পড়ল যখন আমরা ক্লাস ফাইভে পড়াকালীন অনুর বাবা ট্রান্সফার হয়ে গেলেন জামশেদপুরে। এখনও মনে আছে, অনুরা কলকাতা ছাড়ার আগেরদিন ওদের বাড়ী গেছিলাম, আর দুজন দুজনকে জড়িয়ে কী ভীষণ কেঁদেছিলাম আমরা। শেষ অব্দি ঠিক হল, দুজনেই প্রতিমাসে চিঠি লিখবই, অন্তত একটা। বলাই বাহুল্য, জীবনের অনেক কথার মতোই এ কথাটাও রাখা হয়নি। প্রথম এক দু এক মাস দু' তরফেই প্রবল উৎসাহ, তারপর কখন যেন সব ক্ষীণ হয়ে এল। আর তখন চিঠির জামানা এমনিতেই প্রায় অস্তগত, বছরে এক কিংবা দু'বার ফোনে কথা হত, কখনো বা তাও না। ক্লাস সেভেন-এইট থেকে যোগাযোগটা শূন্যের কোঠায় এসে ঠেকল। কিন্তু মনের গভীরে দুজনেই কোথাও রয়ে গেছিলাম দু'জনের মধ্যে। সেটা বোঝা গেল কলেজের প্রথম দিনে, যখন আমি আমার নতুন বন্ধুদের সাথে ক্লাসরুম খুঁজতে ব্যস্ত, হঠাৎ পিছন থেকে মেয়েলী গলায় নিজের নাম শুনে দেখি, সাদা-শার্ট ব্লু জিন্সে এক আধুনিকা, মুখে একগাল হাসি, আমার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ছে...কে ও? ভাবতে ভাবতে একটু ইতঃস্তত করে সামনে যেতেই নিজের ভেতর থেকেই কে যেন বলে উঠল, "অনমিত্রা না?" বলতে বলতেই উল্টোদিকের নরম হাতদুটো আমার দু'কাঁধে..তারপর আর আমাদের পায় কে!
ডিপার্টমেন্ট আলাদা হলেও বন্ধুত্বে ভাঁটা পড়েনি। ক্লাস কেটে সিনেমা দেখা, পড়ন্ত বিকেলে ময়দানের পাশের সরু রাস্তাটায় হাতে হাত ধরে হেঁটে যাওয়া বহুদূর, কিংবা ঢাকুরিয়ার লেকের সূর্যাস্ত...বইপাড়ার গন্ধ মাখতে মাখতে এ গলি ও গলি ঘুরে ধোঁয়া ওঠা চা কিংবা প্যাচপ্যাচে গরমে পাঁচমাথার মোড়ের ম্যাঙ্গো লস্যি...এসপ্ল্যানেডের ট্রামে একলা দুপুর, বাগবাজার ঘাটের চুঁইয়ে পড়া সন্ধে। 'ভালোবাসি' কথাটা বলতে হয়নি একবারও, বোঝাতে হয়নি অনুভূতির গভীরতা। চারটে বছর কীভাবে কেটেছিল নিজেরাও বুঝিনি, ঘুম ভাঙল যখন আমার ব্যাঙ্গালোরের এর জব অফারটা এল। হঠাৎ বুঝলাম এবার নোঙর ছাড়ার পালা। এই চেনা গন্ডী, চেনা আবর্ত আর প্রায় নিঃশ্বাসের মতো অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া মানুষগুলোর থেকে অনেক অনেকটা সরে যেতে হবে...অনুর থেকে দূরে চলে যেতে হবে। অথচ ও কিন্তু খুশীই হয়েছিল। আসলে ও সবসময় চাইত আমি অনেক বড় হই, অনেক বড় কিছু করি। অবশ্য যাওয়ার আগের দিন সেই ক্লাস ফাইভে জামশেদপুর যাওয়ার মতো অবস্থাই হয়েছিল। সমস্যাটা শুরু হল আমি ব্যাঙ্গালোর যাওয়ার পর। ততোদিনে অনুও কলকাতায় একটা চাকরি পেয়ে গেছে। প্রায় রোজই কথা হতো ফোনে। কিন্তু চূড়ান্ত ওয়ার্ক-প্রেসার, সারাদিনের ক্লান্তি আর হাজার হাজার মাইলের দূরত্ব, কোথাও একটা তাল কেটে যাচ্ছিল। বুঝতে পারছিলাম লং ডিস্ট্যান্স রিলেশনশিপটা নিতে পারছিলাম দুজনের কেউই। অথচ হাত পা বাঁধা, আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলাম কোনো চাকরী নিয়ে কলকাতা ফিরে যেতে। কিন্তু কলকাতায় তখনো আই টি মার্কেট তেমন গ্রো করেনি। ওদিকে অনুরও তখন ব্যাঙ্গালোর আসা সম্ভব ছিল না। আর আমি চাইও নি যে ও সবকিছু ছেড়ে, নিজের কাজ, কেরিয়ারের সাথে কম্প্রোমাইজ করে আমার সাথে থাকুক।
প্রথমে শুরু হল খুঁটিনাটি জিনিস নিয়ে অযথা ভুল বোঝাবুঝি..তারপর তিক্ততা..আর সবশেষে পারস্পরিক দোষারোপ, যেটা আমাদের মধ্যে কখনো ছিল না। বুঝতে পারছিলাম সম্পর্কটা তার স্বাভাবিক উষ্ণতা হারাচ্ছে। অথচ আমরা দুজনেই কিন্তু শেষ অব্দি চেষ্টা করেছিলাম সম্পর্কটা বাঁচানোর। যদিও আজ মনে হয় আমাদের পারস্পরিক বিশ্বাসের ভিতটাই বোধহয় নড়ে গেছিল কোথাও। পরের বছর পুজোয় আমি কলকাতা এলাম, দেখাও করলাম দুজনে। আমার বিশ্বাস ছিল দেখা হলেই সব মেঘ কেটে যাবে। কিন্তু ট্রুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন, বুঝলাম ভৌগোলিক দূরত্বটা সম্পর্কের মধ্যেও ঢুকে পড়েছে অজান্তেই। ওদিকে অনুর বাড়িতেও বিয়ের তাগাদা চলছে, অথচ আমার তখনও বিয়ে করার মতো স্বাচ্ছন্দ্য নেই। অবশ্য তথাকথিত প্রেমের মতো তথাকথিত ব্রেক আপটাও আমাদের হয়নি। কিছু না বলেই দূরত্বের মাত্রাটা বেড়ে যেতে লাগল শুধু।
তারপরের বছরই বিয়ে হয়ে গেল অনুর। আমি তখনও কলকাতার বাইরেই, নেমন্তন্নের চিঠিও পেয়েছিলাম..যাইনি। শুধু মনে আছে, ওর বিয়ের দিন নিঃসঙ্গ ফ্ল্যাটে বসে ল্যাপটপে পাগলের মতো কাজ করেছিলাম সারারাত। আর তারপর থেকেই কাজটা কীরকম যেন পেয়ে বসল আমায়। একটা অসম্ভব জেদ, অদ্ভুত এক মাদকতা। নিরন্তর ডুবে রইলাম কাজে। চাকরীতে উন্নতি হল উত্তরোত্তর, তিন বছরে তিনটে কোম্পানী বদলালাম। শুধু ভেতরের শূন্যতাটা আরো গভীর, আরো তীব্র হয়ে চলল। এরমধ্যে মধুবন্তীর সাথে বিয়েটাও হয়ে গেল একসময়। আর বিয়ের সাথে সাথে পিন ফোটানো ব্যথাটার সঙ্গেও গাঁটছড়া বাঁধা হয়ে গেল আজীবন। অথচ, আঘাতের সাথে আমার সখ্যতা তো সেই শিউলিভেজা নরম ভোরে...যে ভোরে আমি পথ খুঁজব বলে পথ হারিয়েছিলাম। তারপর তো 'ধলচিতের খেয়াঘাট' কি 'মধুখালি বিল' পেরিয়ে সে পথ চলে গেছে কতদূর...আর সেই পথে হাজার বছর ধরে হাঁটতে হাঁটতে আমি বুঝেছি আঘাতের আরোগ্য হয় না, শুধু ঘর-বদল হয়...
৪.
১৮ নং বার 'মাধুকরী' এর পাতায় চোখ বোলাতে বোলাতে এই সব আকাশ-পাতাল চিন্তার ঘোরে বুঝতেই পারিনি কখন চোখের পাতা ভারী হয়ে এসেছিল। দুপুরে ঘুমানোর বদ অভ্যাস আমার কোনোকালেই নেই। এখানে আসার পর থেকে শরীর আর ওষুধের দৌলতে প্রায় আচ্ছন্নের মতো পড়ে থাকতাম, ইদানীং অবশ্য সে দশা কেটেছে। তবু কোনো কোনো দুপুরে একটা আবেশ আসে, যেমন আজ। সেই আবেশের মধ্যেই বুঝতে পারলাম কেউ ঘরে ঢুকেছে, খেয়াল হল ভিজিটিং আওয়ার্স শুরু হয়ে গেছে, এখন অনেকেই আসতে পারে। কোনোরকমে চোখ মেলে দেখলাম নীল শাড়িতে দরজার কাছে কেউ দাঁড়িয়ে..কে ও? এমন নীলাম্বরী হয়ে এসেছে? এমন কারোর তো আসার কথা ছিল না!! মাথাটা একটু তুলে ভালো করে দেখার চেষ্টা করলাম...কে? অনু?? অনু এসেছে সত্যি??? তারপরই মনে হল, নাঃ! অনু কীকরে আসবে? ওর তো আমার অ্যাক্সিডেন্টের খবরই পাওয়ার কথা নয়। তাছাড়া ও তো এখন স্টেটসে...পরবাসী...অ্যাক্সিডেন্টের আগের রাতে ছবি দেখেছি ফেসবুকে...তবে??!
আমাকে মাথা তুলতে দেখে দরজায় দাঁড়ানো মানুষটা এগিয়ে এল পায়ে পায়ে। চোখের দৃষ্টিটাও স্পষ্ট হল একটু একটু করে। আর একটু কাছে আসতে বিদ্যুৎ চকমের মতো মুখ থেকে বেরিয়ে এল একটা নাম, "ঊর্মি"!!!
সামনের চেয়ারটায় বসতে বসতে ঠোঁটের কোণে চিলতে হাসি খেলিয়ে ঊর্মি বলল, "চিনতে পেরেছ তাহলে?"
আমি তখনও নিরুত্তর। উল্টোদিক থেকে আবারও প্রশ্নবাণ, "খুব অবাক হচ্ছ না?"
সত্যিই অবাক হয়েছি। ঠিক কতটা ব্যাখ্যা করা অসম্ভব। সেই ঊর্মি..যার সাথে একদিন এমন কোনো কথা ছিল না যা বলতে পারিনা। ঊর্মি আমার বন্ধুর বোন আর আমার থেকে বছর ছয়েকের ছোট হলেও ওর সাথে আমার একটাই সম্পর্ক ছিল, সেটা অনাবিল বন্ধুত্ব। ঊর্মি মানে হঠাৎ অনবদ্য কোনো চিঠি কিংবা একলা কবিতা-দুপুর, ঊর্মি মানে অনর্গল কথা আর অব্যক্ত কোনো নিভৃতি, যার একটা অদ্ভুত ভাষা আছে...ঊর্মি মানে শীতের বিকেলে পাশাপাশি হেঁটে যাওয়া যতদূর খুশি, ঊর্মি মানে ধূমপান মাত্রা ছাড়ালেই চূড়ান্ত বকুনি অথবা কিছুদিন কথা না হলেই আষাড়ে আকাশ..ঊর্মি মানে, "হঠাৎ হাওয়ায় ভেসে আসা ধন"...সেই ঊর্মি এসেছে!
ওর প্রশ্নে একটু চমকে ধাতস্থ হয়ে বললাম, "একটু তো অবাক হচ্ছিই....আসলে তুই আসবি এক্সপেক্ট করিনি ঠিক..."
- "আমি তো কোনোদিনই তোমার এক্সপেকটেশনে ছিলাম না সুমন্ত্র দা..বারবারই তো উড়ে এসে জুড়ে বসেছি", হাল্কা হেসে বলল ঊর্মি।
খোঁচার ইঙ্গিতটা বুঝেও কথা ঘুরিয়ে বললাম, "আমি এখানে ভর্তি তুই কীকরে জানলি?"
- "কাল বিকেলে দাদা ফোন করেছিল...ও তো এখন আহমেদাবাদে, জানো হয়তো...ওই বলল তোমার অ্যাক্সিডেন্টের কথাটা...ও ও জানতো না...কালই তোমাদের কলেজের কোনো বন্ধু ওকে জানিয়েছে...দাদাই বলল একবার তোমার সাথে দেখা করে আসতে...আসলে ও খুব শকড হয়েছে খবরটা শুনে, এখানে থাকলে নিজেই আসত..."
- "ও, তাহলে অর্ঘ্য বলেছে বলে তুই এসেছিস, না হলে আসতি না?" অভিমানী গলায় বললাম আমি।
- "যা, ভাবতে চাও। আমি বারণ করার কে?...যাক, ভাগ্যিস আজ এসেছি...কালই তো তোমায় ডিসচার্জ করে দেবে শুনলাম...আজ না এলে তো দেখাই হতো না...এনিওয়ে, এখন কেমন ফিল করছ? ব্যথা আছে এখনো?"
- "ছিল...কিন্তু কিছু কিছু মানুষকে দেখলে ব্যথা আপনিই কমে যায়"।
আমার কথাটা শেষ হওয়ার সাথে সাথে একটা হাল্কা গোলাপী আভা যেন খেলে গেল ঊর্মির মুখে..ও কি লজ্জা পেল? এতক্ষণ পর ভালো করে দেখলাম ওকে। ঘন নীল বাটিকে সাদা ফুল ফুল ছাপ শাড়ি, নীল কোয়ার্টার হাতা ব্লাউস, ঘাড়ের কাছে আলগোছে একটা খোঁপা, কানে দুটো ছোট ছোট, সম্ভবত মুক্তোর দুল। সারাদিনের ক্লান্তি লেপ্টে আছে ওর সমস্তটায়। তবু কী অপূর্ব লাগছে! এত সুন্দর যেন ওকে কখনো লাগেনি। বুদ্ধদেব গুহ এক উপন্যাসে একটা সুন্দর কথা বলেছিলেন, "কাউকে দেখলে যে কারোর এত ভালো লাগে এর আগে জানতাম না।" আজ ঊর্মিকে দেখেও আমার ঠিক তেমনটাই মনে হচ্ছিল। বলব না বলব না করেও বলেই ফেললাম, "আজ তোকে সত্যিই 'ঊর্মি'র মতো লাগছে.."
ও কী বুঝল কে জানে, একটু চুপ করে থেকে হাল্কা হেসে বলল, "তুমি এখনও খুব ভালো কথা বল সুমন্ত্রদা...যে কোনো মেয়ে প্রেমে পড়ে যাবে..."
আবার একটা খোঁচা, অতএব আবার আমার কথা ঘোরানোর পালা, জিজ্ঞেস করলাম, " তুই ভিজিটিং কার্ড পেলি কোথায়? নীচে দেখা হয়েছিল কারোর সাথে?"
- "নাঃ, কার্ড ছাড়াই এসছি।"
- "মানে?? কার্ড ছাড়া ঢুকতে দিল?"
- "হ্যাঁ দিল, ধরে নাও আমার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা।"
আমি তখনও অন্ধকারে হাতরাচ্ছি দেখে একটু পরে নিজেই বলল, "আসলে এখানের একজন নার্স আমার স্কুলের বন্ধু...ওর থ্রু তেই এলাম...অবশ্য, না হলে হয়তো আসাই হতো না...নীচে তো মধুদি বা অন্য কাউকেই দেখলাম না! আর এখানে যা কড়াকড়ি, এমনি ঢুকতেও দিত না.."
- "হ্যাঁ, মধু আজ আসতে পারবে না বোধহয়..ফোন করেছিল দুপুরে..জরুরী মিটিং পড়ে গেছে"...দীর্ঘশ্বাসটা চেপে কোনোরকমে বললাম।
"ও...যাই হোক, তুমি এখন অনেকটাই সুস্থ দেখে ভালো লাগছে...দাদা খুব টেনশন করছিল..."
জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম, "আর তুই?"...কিন্তু শেষ মুহূর্তে সামলে নিলাম। এসব কথা বলার দিন বোধহয় অনেক আগেই অতীত। আমারই বুঝতে দেরী হয়ে গেল। আর ও যখন নিজে থেকে ওর কথা বলতেই চায় না, তখন আমিই বা কেন বার বার...থাক।
একথা সেকথার পর জিজ্ঞেস করলাম, "তারপর বিয়ে কবে করছিস?"
হঠাৎ হো হো করে হেসে উঠল ঊর্মি।
- "অত হাসির কী হল?" অপ্রস্তুত বলে উঠলাম আমি।
- "আরে তুমি পুরো পাড়ার জ্যেঠুদের মতো জিজ্ঞেস করলে", কোনোরকমে হাসি থামিয়ে ঊর্মি বলল।
- "না হয় তাই হল, এবার শুনি কবে সুখবর পাচ্ছি?"
- "ধরে নাও পেয়ে গেছ।"
- "মানে"?? চমকে উঠলাম আমি।
- "মানে তোমার সুখবর পাওয়ার যা তাড়া দেখছি তাতে তো কালই বিয়ের পিঁড়িতে বসলে ভালো হয় মনে হচ্ছে।"
- "কাল না হলেও খুব দেরীরও কারণ দেখছি না..যদিও এটা তোর পার্সোন্যাল ডিসিশন।"
- "আচ্ছা, বিয়ে না করলেই বা ক্ষতি কী?"
- "কোনো ক্ষতি নেই, কিন্তু করলেও খুব একটা ক্ষতি নেই বোধহয়।"
- "হুমমম..."
- "কী হুমমম? এত কী ভাবছিস? এবার দিল্লী কা লাড্ডু খেয়েই ফেল..আমরাও সেই উপলক্ষে একটু কবজি ডুবিয়ে খাই!"
- "একসাথে থাকার জন্য সেরকম মানুষের দেখা পাওয়া চাই সুমন্ত্রদা" হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলল ঊর্মি।
- "এতদিনেও সেরকম মানুষের দেখা পাসনি বলছিস?"
- "দেখা পেলেই কি একসাথে থাকা হয়? নাকি একসাথে থাকতে চাইলেই থাকা যায়?"
কী যেন ছিল ওর কথাটায়...চিনচিনে ব্যথাটা শুরু হয়ে গেল আবার। একটু সহজ হওয়ার জন্য বললাম, "না...তা যায় না...তবে কিনা শাস্ত্রে আছে সংসার পরম ধর্ম"
- "আমি তো সংসার করতে চাইনি সুমন্ত্র দা..কিছু পাগলামি ভাগ করে নিতে চেয়েছিলাম শুধু..."
"এনিওয়ে, লিভ ইট....এটা নাও..তুমি ভালোবাস, তাই এনেছিলাম" একটা বইয়ের প্যাকেট ব্যাগ থেকে বার করতে করতে বলল ঊর্মি।
খুশি ঝিলিক দিয়ে গেল আমার দু' চোখে, "বাঃ, অন্তত কেউ তো বই দিল। ভাগ্যিস তুই ফুল আনিসনি। এখানে এসে থেকে ফুলের গন্ধে ঘোর লেগে গেল, যেই আসছে সেই একটা করে ব্যুকে আনছে, যেন এভারেস্ট থেকে এলাম!! নিজের বিয়েতেও মনে হয় এত ফুল পাইনি!"
- "ইচ্ছে করেই ফুল আনিনি....'ফুলকে দিয়ে মানুষ বড় বেশী মিথ্যে বলায়'"
"যাই হোক, তোমায় একটা খবর দেওয়ার ছিল", একটু চুপ করে থেকে বলল ঊর্মি।
- "কী??" হঠাৎ কোনো অজানা আশঙ্কায় চমকে উঠলাম। কী বলবে ঊর্মি? কী খবর?? কোনোক্রমে ভেতরের উত্তেজনাটা আড়াল করে ওর উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম।
- "আমি নর্থ বেঙ্গল যাচ্ছি"।
- "ও....বেড়াতে?"
- "না, মানে, নর্থ বেঙ্গল শিফট করছি...আসলে নর্থ বেঙ্গল ইউনিভার্সিটিতে একটা অফার পেয়েছি...হঠাৎই পেলাম...যদিও গেস্ট লেকচারার...কিন্তু অপারচুনিটি বেশী, তাই অ্যাকসেপ্ট করে নিলাম..."
এতটা চমক আশা করিনি সত্যি...কোনোরকমে বললাম, "অফ অল প্লেসেস নর্থ বেঙ্গল কেন?? কলকাতায় কি বেটার অপারচুনিটি পেতি না? তাছাড়া পার্মানেন্টও তো নয় বলছিস, তাহলে?"
- "না, তা নয়...তবে স্যালারী নেহাত মন্দ নয়...তাছাড়া ওখানকার একটা পাবলিশিং হাউসেও কথা হয়ে আছে, ফ্রিলান্সিং এর ব্যাপারে...দুটো মিলিয়ে খুব প্রবলেম হবেনা হোপফুলি..."
- "হুমমম...তবু হুট করে কিছু ঠিক করার আগে আর একটু ভেবে দেখতে পারতি বোধহয়...তোর এখানকার চাকরীটা তো ভালোই ছিল...মানছি ওখানে এক্সপোজার বেশী, স্টিল শুধু গেস্ট লেকচারশিপের ভরসায়..."
- "আমি অনেক ভেবেই ডিসিশন নিয়েছি সুমন্ত্র দা...অনেকদিন তো হল এখানে...এইভাবে...এবার না হয় একটু অন্যভাবে দেখি। আর রিস্কের কথাই যদি বল, সে তো সবেতেই আছে। তুমি নিজেই তো একসময় বলতে, রিস্ক না নিলে কেউ বড় হতে পারে না...তাছাড়া তুমি তো জান নর্থ বেঙ্গল আমার কতটা পছন্দের...বরাবর একটা অদ্ভুত টান ফিল করি। আর ওখানে গিয়ে আমার রিসার্চেরও সুবিধা হবে...আর এর মধ্যে সিএসসি পেয়ে গেলে তো চিন্তাই নেই..."
- "হুমম...তো কাকু কাকীমা কী বলছেন? আর অর্ঘ্য?"
- "দাদা তো এনকারেজই করল। বাবা মা তেমন রাজী হচ্ছিল না...তারপর রণে ভঙ্গ দিয়েছে আর কী!"
- "বাঃ...তো যাচ্ছিস কবে?" চাপা দীর্ঘশ্বাসটা আর একটু আড়াল করে বললাম।
- " নেক্সট উইক...তোমার সাথে আলাদা করে দেখা করে খবরটা দেব ভেবেছিলাম, ভাবিনি এভাবে দেখা হবে।"
- "হুমম...এনিওয়ে, কনগ্রাচুলেশন্স এন অল দ্য বেস্ট"
- "থ্যাঙ্কস...যাক, এবার উঠতে হবে। তুমি সাবধানে থেকো। রেস্ট নিয়ো ঠিকমতো।"
- "তুই কলকাতা ফিরবি তো, নাকি ওখানেই...?"
প্রশ্নটা শুনে আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাল ঊর্মি, যেন কিছু বলতে চায়, যেন অনেকদিনের অনেক অব্যক্ত কথা জমে আছে ওর দু' চোখে। একটু চুপ করে থেকে বলল, "দেখা যাক...না, ফিরলেই বা ক্ষতি কী? আমার জন্য তো কোত্থাও কেউ অপেক্ষা করে নেই..."
"যাক, আজ উঠি। তুমি খুব তাড়াতাড়ি সেরে ওঠো। আর এরপর থেকে গাড়িটা চালানোর সময় শুধু গাড়ি চালানোর কথাই ভেবো, অন্যকিছু না," হঠাৎ পুরনো ঊর্মির গলাটা শুনতে পেলাম মনে হল, যে আমার ওপর রাগ করলে ঠিক এভাবেই বকত।
- "হাঃ হাঃ, এটা ভালো বলেছিস..এনিওয়ে, যাবার আগে একবার দেখা করে যাস পারলে..."
- "চেষ্টা করব। আজ চলি। ভালো থেকো।"
পাশে রাখা ব্যাগটা নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল ঊর্মি, আমি একদৃষ্টে ওর চলে যাওয়াটুকুর দিকে তাকিয়ে রইলাম।
৫.
ঊর্মি মনটা বড্ড খারাপ করে দিয়ে গেল। একটা অদ্ভুত অস্বস্তি হচ্ছে কোথাও, অদ্ভুত একটা শূন্যতা আচ্ছন্ন করে ফেলছে আমায়। বিকেলটুকু ফুরিয়ে আসছে দ্রুত, আর একটু পরেই নেশাচ্ছন্ন রোগীর মতো সন্ধ্যা আবৃত করবে একটু একটু করে, আবৃত করে ফেলবে গোচর কিংবা অগোচর যত দৃশ্যপট, আবৃত করে ফেলবে এই ঘর, এই অসুস্থতা, এই একাকী সংসার, আবৃত করে ফেলবে আমার যা কিছু...
বাইরে চোখ পড়তেই দেখলাম, কৃষ্ণচূড়া গাছটার ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে পাতাহীন, শূন্য একটা গাছ...একা। অনেকটা দীর্ঘ অসুখে জীর্ণ, হাড় জিরজিরে, নিঃসঙ্গ রোগীর মতো। মন জিনিসটা কী অদ্ভুত, আর ততোটাই অদ্ভুত বোধহয় আমাদের দৃষ্টির বিন্যাস বা 'পারসপেক্টিভ'। কোনো একটা নির্দিষ্ট সময়ে আমাদের ফ্রেমে ঠিক ততোটাই ধরা পড়ে যতটা আমরা দেখতে চাই। ঠিক যেমন এতদিন এই মরা গাছটা এভাবে চোখেই পড়েনি, আজ সকালেও কৃষ্ণচূড়াটাই উজ্জ্বল হয়ে ছিল। আবার এখন এই পাতাহীন, শূন্য গাছটাই যেন পুরো ফ্রেমটা জুড়ে আছে। আসলে প্রত্যেকটা মুহূর্তে আমরা বোধহয় নিজেদের মতো করে এক একটা 'অবজেক্টিভ কো-রিলেটিভ' খুঁজে নিই আর সেটুকুই আমাদের দৃষ্টিতে ভাস্বর হয়ে থাকে...
জানলা থেকে চোখ সরিয়ে আধশোয়া শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দিতেই পাশের টেবিলটার দিকে চোখ পড়ল। ঊর্মির রেখে যাওয়া বইয়ের প্যাকেটটা...তেমনি পড়ে আছে। হালকা লাগল একটু...কতোদিন পর বই দিল কেউ! আস্তে আস্তে প্যাকেটটা তুলে নিলাম। খোলস খুলতেই উঁকি দিল আনকোরা দুটো বই - একটা বাংলা, আরেকটা বিদেশী..শ্রীজাত'র 'বান্ধবীগাছ' আর গার্সিয়া মার্কেজের 'লাভ ইন দ্য টাইম অফ কলেরা'। মার্কেজের বইটা নেড়েচেড়ে দেখতেই ভেতরের পাতায় চোখে পড়ল গোটাগোটা অক্ষরে কয়েকটা লাইন..
"We die to each other daily. What we know of other people is only our memory of the moments during which we knew them. And they have changed since then. To pretend that they and we are the same is a useful and convenient social convention which must sometimes be broken. We must also remember that at every meeting we are meeting a stranger."
অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস এনে দিল লেখাটা..সত্যি, 'স্ট্রেঞ্জারই' বটে।
যথারীতি মেয়েটা নিজের নাম লেখেনি এবারও। একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, "তুই কখনো বই দিলে নিজের নাম লিখিস না কেন রে?"
- "কেন, লিখতেই হবে?"
- "লিখলে ভাল লাগে..প্রাপকের সাথে যে দিচ্ছে তারও স্মৃতি থাকে তাহলে.."
- "কেন নাম না লিখলে মনে রাখবে না আমি দিয়েছিলাম?...তাহলে না হয় নাই মনে রাখলে...সবকিছু মনে রাখার দরকারই বা কী?"
এরপর তর্কের ঝড় অনেকখানি এগিয়ে ছিল। তবু সে তার জেদে আজও অনড়। আসলে ঊর্মি বরাবর একটু অভিমানী। বইগুলো দখে আবার ওর চলে যাওয়াটা মনে পড়ে গেল। আজও যেন একবুক অভিমান নিয়ে ফিরে গেল ও...অথচ আমি কীই বা করতে পারতাম? ঊর্মি আমায় বড় ভালোবাসে, জানি। আমিও যে বাসি না তা নয়। কিন্তু তাতে একসাথে সংসার করা যায় না, ওকে আমি ভালোবেসেছি, কিন্তু চাইনি কখনো। আসলে আমার কাছে ও অনেকটা রাত-জাগা তারার মতো, যাকে নিজের সবটুকু বলা যায়, পাশাপাশি বসে রাত জেগে গল্প করা যায়, কিন্তু তাকে ছোঁয়া যায় না। আর আমার বরাবর মনে হয় প্রত্যেকটা সম্পর্ক একটা নিজস্ব স্পেস দাবী করে, সেই স্পেসটা তাকে না দিতে পারলে সম্পর্কটার অপমৃত্যু হয়। এটা আরো বেশী বুঝেছিলাম অনু চলে যাওয়ার পর। আমরা বোধহয় বড্ড বেশী কাছে চলে গেছিলাম পরস্পরের, দু'জন দু'জনের অস্তিত্বটা আলাদা করে দেখার মতো ফাঁকটুকুও আর অবশিষ্ট ছিল না। ঊর্মির ক্ষেত্রে আমি সেই ভুলের পুনরাবৃত্তি চাইনি। ঊর্মির সাথে যে একান্ত বন্ধুত্বটা আমি শেয়ার করতাম, বিয়ের মতো অভ্যাসগত সম্পর্কে এনে সেই বন্ধুত্বটা নষ্ট করতে চাইনি আমি..কিন্তু ঊর্মি সেটা কোনোদিনই বুঝল না বোধহয়....
একটা অদ্ভুত শূন্যতা হাতছানি দিচ্ছে যেন। একা...আরো বেশীমাত্রায় একা হয়ে যাচ্ছি ক্রমশ। মধু থেকেও নেই, অনু তো সেই কবেই চলে গেছে, ঊর্মিও চলে যাচ্ছে এবার..."আমিই শুধু রইনু বাকি"। আমার সাথে সত্যিই থাকা যায় না বোধহয়....
চিন্তাটা ছিঁড়ে গেল হঠাৎ। টেবিলের ওপর ফোনটা বাজছে, উঁকি মেরে দেখলাম, মধু কল করছে। থাক, বেজে যাক...কথা বলার ইচ্ছে নেই এখন...কারোর সাথেই আর কোনো কথা নেই আমার...
বাজতে বাজতে একসময় কেটে গেল ফোনটা। এখানে তো ফোন অ্যালাও ই করত না প্রথমে। একটু সুস্থ হওয়ার পর, মধু বার বার রিকোয়েস্ট করায় রাখতে দিয়েছে। কেন যে তখন রাজী হলাম? যোগাযোগ জিনিসটা মাঝে মাঝে বড্ড বিরক্তিকর ঠেকে আজকাল...আবার বাজছে ফোনটা..উফফ...নাঃ, এবার ধরতেই হবে....
- "হ্যাঁ, বল।"
- "কী হল ফোন ধরছ না কেন? কখন থেকে কল করছি!"
- "খেয়াল করিনি, বল। তোমার মিটিং কেমন হল?"
- "কোয়াইট গুড। পরে বলব ডিটেইলস।...আচ্ছা শোনো, কাল তো তোমার ডিসচার্জ?"
- "সেরকমই তো জানি.."
- "হুম। গতকাল তো ডক্টরের সাথে আমার তাই কথা হয়েছিল, আই উইল কল টু দ্য হসপিটাল টুনাইট।"
- "হুমম...তুমি কি এটা বলতেই ফোন করলে?"
- "ওয়েল, নট একচ্যুয়ালি....ওয়েল....আই অ্যাম এক্সট্রিমলি সরি সুমন্ত্র...আই উইল নট বি এইবেল টু গো ট্যুমরো..."
এই কথার কী উত্তর হয় জানা নেই, তাই চুপ করেই থাকলাম।
মধুই আবার বলে উঠল, "হ্যালো, আর য়্যু দেয়ার?? শুনতে পাচ্ছ?"
- "বল।"
- "কথা বলছ না কেন? ডিড য়্যু হিয়ার মি?"
- "শুনলাম।"
- "লুক, আই ওয়ান্টেড টু গো ট্যুমরো...বাট...বাট...আজকের মিটিংটাই সব ঘেঁটে দিল...আজ মিঃ আলুওয়ালিয়া জানিয়েছেন কালকের ফ্লাইটেই আসছেন...হি একচ্যুয়ালি লাইকড আওয়ার বিসনেস প্রপোসাল...ক্যান য়্যু ইম্যাজিন? মিঃ আলুওয়ালিয়া!! দ্য থার্ড মোস্ট সাকসেসফুল বিসনেস ম্যান ইন ইন্ডিয়া রাইট নাও!!! স্টিল, আই ট্রায়েড মাই বেস্ট টু ম্যানেজ আ লিভ ট্যুমরো...বাট মাই বস ডেসপারেটলি ওয়ান্টস মি টু বি দেয়ার..."
- "হুমম..."
- "বাট, আমি দাদার সাথে কথা বলে নিয়েছি...দাদার কাল অফ আছে...ও আর বৌদি চলে যাবে হসপিটালে...আর মা তো এমনিই যেত...ডোন্ট ওয়ারি..."
- "দাদাদের কেন আবার বিরক্ত করতে গেলে শুধু শুধু? সুনীলদা কে গাড়িটা দিয়ে পাঠিয়ে দিলেই তো হত...আর আমি তো এখন অনেকটাই সুস্থ।"
- "নো ওয়ে...দাদা নিজেই বলেছিল যাবে তোমার ডিসচার্জের দিন...আমি তো যেতামই...অফিসের ঝামেলায় ফেঁসে না গেলে...বাট ওরা সবাই থাকবে, তোমার কোনো প্রবলেম হবে না, দেখো।"
- "নিজের ব্যাপারে আমার প্রবলেম কমই হয় সেটা তো তুমি জানই মধু...যাই হোক, কালকের জন্য অল দ্য বেস্ট।"
- "থ্যাঙ্কু...তুমিও কাল সাবধানে এস...আই উইল কাম ব্যাক আরলি ট্যুমরো...ওকে?"
- "হুমম"
- "ওকে, বাই নাও...ঠিকঠাক খেয়ে নিও...টেক কেয়ার।"
- "য়্যু টু। বাই।"
মধু কলটা কাটতেই সুইচড অফ করে দিলাম মোবাইলটা। আমার জন্য কারোর কোত্থাও একফোঁটাও সময় নেই...সবাই যে যার মতো নিজেকে গুছিয়ে নিতে ব্যস্ত...শুধু আমারই কোথাও যাওয়ার নেই...কোথাও ফেরার নেই...কোথাও পৌঁছনোর নেই...
আঃ!! মাথার যন্ত্রণাটা বাড়ছে, কোমরটাও বিদ্রোহ করছে আবার...উফফফ!! একটা অসহ্য, তোলপাড় করা যন্ত্রণা যেন হাত বুলিয়ে যাচ্ছে পা থেকে মাথা অব্দি, বিবশ করে তুলছে দেহের প্রতিটা লোমকূপ। কোনোরকমে হাত বাড়িয়ে মাথার পাশের বেলটা বাজালাম।
সিস্টার এল, কোনোমতে গোঙাতে গোঙাতে "পেইন" কথাটুকু বলতে পারলাম মাত্র। এভাবে কতক্ষণ কাটল জানিনা। কিছুক্ষণ পর ডক্টর এসে ইমিডিয়েট ইঞ্জেকশন দিতে বলে গেলেন। আবার ইঞ্জেকশন, আবার সেই পিন...
বা হাঁতের শিরায় অসহ্য ব্যথাটা সহ্য করতে করতে চোখ বন্ধ করতেই দেখলাম, অজস্র পিন একে একে ছুটে আসছে আমার দিকে...কোথাও একটা তলিয়ে যাচ্ছি আমি...কোথায়? অতলান্ত কোনো মহাসমুদ্র নাকি অতল কোনো মহাকূপ?...জানি না...শুধু বুঝতে পারলাম আমাকে ঘিরে পিন, অগুন্তি পিন...আমার দক্ষিণে, বামে, ওপরে, নীচে, ঈশানে, নৈঋতে...আমার দশ দিক ছেয়ে আছে তারা...পালাবার পথ নেই। অবশ্য আর পালাতে চাইও না আমি...আসুক, আরও তীব্র বেগে ছুটে আসুক ওরা...আহত করুক আমার সমস্ত শিরা, উপশিরা, ধমনী...বিদ্ধ করুক আমার নিয়তঃ অনুভূতি...মিশে যাক আমার প্রতি রক্তকণিকায়...
এস, আর নিবিড় হয়ে এস...
এই তো ক্রুশবিদ্ধ হবার সময়...
