সত্যজিৎ মুখোপাধ্যায়
শীত চলে গিয়ে চোখ রাঙানো গরম এর আগে বসন্তর সময়টুকু যেন ক্ষনিকের অবসর। ঠিক গরম ও না আবার ভোর বেলায় একটু ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব।
নিজের অজান্তেই পায়ের কাছে ফেলে রাখা তুলোটে পাতলা কম্বল টা টেনে নিল অনির্বাণ। বালিশ এর পাশে রাখা স্মার্ট ফোন জানিয়ে দিল সকাল ছ'টা। কম্বল সরিয়ে উঠে বসলো অনির্বাণ। কাঁচের জানলায় জড়িয়ে রাখা পর্দার ফাঁক গোলে নরম রোদ একই সরল রেখায় অনেকগুলো বৃত্ত তৈরি করেছে ঘর জুড়ে নিজের মত করে।
চট পট রেডি হয়ে সাইকেল নিয়ে বাড়ির গলি ছুঁয়ে মেইন রোডে উঠলো সে। সকালে ওঠার অভ্যেস তার বহুদিনের। এ বছর হায়ার সেকেন্ডারি চাপ সামলেও ফিটনেস টা ঠিক রেখেছে সে। বাবা ই অবশ্য বলে বলে তাকে এই অভ্যাস করিয়েছে। এখন মেইন রাস্তার মাঝামাঝি সে চলে এসেছে।
তাদের শহর ছাড়িয়ে এই অংশ টা একটু ফাঁকা। দু পাশে বড় বড় ফাঁকা জমি। ওপরে হাই টেনশনের তার। নতুন বেশ কয়েকটা ধাবা ও হয়েছে। অনি সাইকেল থামালো আরও কিছুটা এসে। রাস্তার ডান দিকেই বড় চা এর দোকান। সঙ্গে মিনারেল ওয়াটার, ডিম টোস্টও রাখে দোকান মালিক জয়নাল আলী। দোকান এর পাশেই পেট মোটা অশ্বথ গাছে সাইকেল টা হেলান দিয়ে রাখলো অনি। দোকানে ঢুকে ডান দিকের বেঞ্চে বসতেই মিষ্টি হেসে জয়নাল দা সিলড প্যাক জলের বোতল দিল অনি কে।
"একটু আদা দিয়ে লিকার চা করে দি?" অনি ঘাড় নাড়লো। বড় কাঁচের কাপে লাল চা নিয়ে বছর ১৪-১৫ র ছেলেটি অনির সামনে এসে দাড়ালো। অনির্বাণ তো একে দেখেনি কোনোদিন এই তল্লাটে।
প্রশ্ন শুনে জয়নাল একদম অনির সামনে এসে দাড়ালো। বললো - "কী বলবো ভাই! তুমি তো কদিন পরে এলে আমার দোকানে। গত শুক্রবার সন্ধ্যে বেলা দেখি আমার দোকানের সামনে এসে মুখ গুজে বসে রয়েছে। ডেকে জিগ্গেস করতেই প্রথমে ভয় পেয়ে তারপর কেঁদে ফেললো। এই তুইই সব বল না দাদা কে।" গলার কণ্ঠা টিয়া পাখির ঠোঁট এর মত উঁচু হয়ে বেরিয়ে আসা ছেলেটিকে ইশারা করলো জয়নাল।
অনি ছেলেটিকে বসতে বললো। ইতস্ততঃ করে সামনের ইট দিয়ে বেঞ্চির মত বানানো অংশে বসলো ছেলেটি। নাম জিজ্ঞাসা করতে বললো - "রঞ্জন। মন্দিরের বাবা ঠাকুর আমাকে রনি বলে ডাকতো।" ছেলেটি এবার অনির দিকে চোখ তুলে কথা বলছে। ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া জামার খোলা বোতাম গুলোর ভেতর থেকে বুকের হাড় আর গলার কণ্ঠাটা যেন আরও উঁচু লাগছে এখন!
ফারাক্কার থেকে কিছুটা দূরে উপনদী পাগলার পাশে একটা ছোট জঙ্গলের ভেতর মন্দিরে ওকে ছোট বেলায় কেউ ফেলে দিয়ে যায়। মন্দিরের পুরোহিত বাবাঠাকুরই ওর নাম রাখে রঞ্জন। ওই ছোট্ট বেলায় ওর গলায় নাকি একটা পঞ্চ রুদ্রাখের মালা ও ছিলো। স্থানীয় স্কুলে ও ভর্তি করে দিয়েছিলো বাবা ঠাকুর। কিন্তু বছর পাঁচেক আগে এমন জ্বর আসলো, হাসপাতাল এ নিয়ে গিয়েও ফেরানো গেলো না বাবাঠাকুর কে। এর পর মন্দির গেলো স্থানীয় ব্যবসায়ী মাখনলাল এর হাতে। স্কুলের বই জামা প্যান্ট সব নিয়ে তালতলায় এক পাইস হোটেল উঠলো।
রঞ্জন বলে যায় - "ভেবেছিলাম পড়াশুনোটা চালিয়ে যাবো। কিন্তু সকাল থেকেই হোটেল এর বাসন , রান্না সব কাজেই হাত দিতে হত। বছর খানেক আগে হোটেল খেতে আসতো দুই বাবু। তারাই বলে দিল্লির ওখানে কোথায় বড় কাজে নিয়ে যাবে। সেখানে গিয়ে ঠিকাদার এর নির্দেশ এ সারাদিন বিল্ডিং বানানোর কাজ করতে হত। এক রাতে জ্বর এলো। দুদিন খেতে দিল না ওরা। পালিয়ে আসলাম। কদিন ঠিক খেতেই পাই নি। এরপর চা কাকুর সঙ্গে দেখা হলো। এখন ওনার বাড়িতেই থাকছি। দোকান বন্ধ হওয়ার পর পড়াশুনো করছি আবার।"
জয়নাল কেটলি স্টোভে চাপিয়ে এগিয়ে এসেছে। অনির্বাণ কে বলে, "অনিদা আমি কাউন্সিলর কে বলেছি ওর সরকারি কাগজপত্রর ব্যবস্থা করে যদি এখানকার কোনো একটা স্কুলভর্তি করে দেওয়া যায়। তুমি ও একটু দ্যাখনা। ও নয় আমার বাড়িতেই থাকবে।" অনির্বাণ জয়নাল এর মুখের দিকে চোখ নামিয়ে রঞ্জনের দিকে তাকালো। অনির্বান যেন পরিষ্কার দেখতে পেলো পাগলা নদীর দু ফোটা জল রঞ্জন এর চোখ এর কোণায় চিক চিক করছে। সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দিয়ে অনির্বান এগোচ্ছে। ক্যাচ-ক্যাচ শব্দে অনি একটু দাঁড়ালো। বসন্তের ঝরা পাতা সাইকেল এর চাকা আর চেন এর মাঝে ঢুকে পড়ে শব্দ করছে। পাতা সরিয়ে আবার তাকালো অনি, দূরে প্রায় আবছা হয়ে আসা চা এর দোকানে জয়নাল আর রঞ্জন তার যাত্রা পথের দিকেই তাকিয়ে আছে।
