অলি সেন
লীলা মজুমদার একবার লিখেছিলেন, চোরের গল্প নাকি ছোটগল্পের অন্যতম প্রধান উপজীব্য (প্রেম আর ভূতের গল্প বাদ দিলে)। কাজেই আজ যখন কোন মতেই ভেবে পাচ্ছিলাম না কি লিখব, কি নিয়ে লিখব ইত্যাদি, তখন এইসব দুষ্কৃতকারীরাই মনের মধ্যে এসে একরকম বাঁচিয়ে দিয়ে গেল। ধাঁ করে মনে পরে গেলো সাহিত্যিক মনোজ বসুর 'নিশি কুটুম্ব'র কথা। সেই যেখানে সাহেব নামে এক চোর ছিল, অসম্ভব প্রতিভাশালী ছিলো সে, কোন দলবল ছাড়া একাই এসে সিদ্ কেটে, কিংবা জানলাটানলার শিক ভেঙ্গে ঢুকে বেবাক সামগ্রী পাচার করে দিত। বাড়ির লোকে এমনি ঘুমোত যে কিচ্ছু টের পেতনা। অবশ্য সকালে উঠে টের পেতেও তাদের দেরী হতনা এ কার কাজ। তবে আড়ালে তাকে বাহবাও দিত। এমন পরিষ্কার হাতের কাজ নাকি পাঁচটা গ্রামে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
তার ওপর এই সাহেব ছিল খুবই চরিত্রবান চোর। মহিলাদের পারতপক্ষে এড়িয়ে চলত। এমনকি সুযোগ পেলেও তাদের সঙ্গে অন্যায় ভাবে ঘনিষ্ঠতার চেষ্টা পর্যন্ত করতনা। এটা বোধহয় সেকালের চোরেদের অবশ্য পালনীয় কর্তব্যের মধ্যেই পড়ত।
কালে কালে সব নিয়মের মতোই এই সব নৈতিক শিক্ষা দীক্ষার দিকও শিথিল হয়ে গেছে। এখন আর সেই চোর ও নেই, সেই সিদ্ কাঠিও নেই। তবে গল্প গুলো রয়ে গেছে। সেকাল একাল মিলিয়ে তার সংখ্যা করা যাবে না। তাদের নিয়ে বিভিন্ন জনের অভিজ্ঞতা যেমন আছে, শোনা কথা আছে, তেমনি বিখ্যাত গল্প - উপন্যাস - নাটক ও কিছু কম নেই।
চোরের গল্প বলতে প্রথমেই যার কথা মনে পরে সে হল শর্বিলক। অতি প্রাচীন চোর। প্রাচীনতম যাকে বলে। যদিও কতটা পুরনো তাই নিয়ে মতদ্বৈততা আছে, তবে মোটামুটি ভাবে খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয়/চতুর্থ শতাব্দীতে নাট্যকার শুদ্রক তাঁর 'মৃচ্ছকটিক' নাটকের দ্বিতীয় নায়ক হিসেবে ব্রাহ্মণপুত্র শর্বিলক কে হাজির করেছিলেন। সে ছিল অতি প্রতিভাধর, অতি পাকা চোর এবং সেকালে সবাই জানতো ধুরন্ধর চোর মাত্রেই একজন উচ্চমানের শিল্পী। কমের থেকেও কম সময়ে সে এক একটি সিদ্ কাটত এক একরকম নক্সায়। অপূর্ব সেই নক্সা, সর্বাঙ্গ শিল্প সুষমায় ভরা। কিন্তু অত সব কাজ করতে গিয়েও সে কখনোই ধরা পড়ত না। আর কে না জানে, 'চুরি বিদ্যা মহা বিদ্যা যদি না পর ধরা।'-
বাস্তবিক সেকালে ভারতবর্ষে যে চৌষট্টি কলা শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল (গনিকাদের আরও বেশি, প্রায় বাহাত্তর টি বিষয় শিখতে হত) তার মধ্যে চুরিবিদ্যা ছিল অন্যতম।
বলাবাহুল্য তাদের একজন আরাধ্য দেবতাও ছিলেন। ডাকাতদের যেমন আরাধ্যা ছিলেন কালী, চোরদের ছিলেন কার্তিকেয়। বৈদিক যুগে যদিও তিনি যুদ্ধের দেবতাই ছিলেন পরে কিভাবে যেন চোরেরা তাঁকে আপন করে নেয়। তিনিই নাকি প্রথম যোগাচার্য নামের এক গুরুকে এই শাস্ত্র শিক্ষা দিয়েছিলেন।
সে যাইহোক মোট কথা চুরি করাটাকে তখন একরকম বাহাদুরির কাজ বলেই মনে করা হত। সেকালে 'চৌর' কথাটার মানে ছিল চতুর অর্থাৎ বুদ্ধিমান। পরে তুর্কি, পাঠান, মুঘল, ইংরেজরা এ দেশে আসার পরে অবশ্য এই ধারণার বদল হয়। কলকাতায় ইংরেজ আমলে বিশেষ করে চুরি জালিয়াতি ইত্যাদি অত্যন্ত জঘন্য অপরাধ বলে বিবেচিত হত। তাই গোড়ার দিকে অপরাধীদের ফাঁসী পর্যন্ত দেওয়া হত। পরে যদিও এতটা বাড়াবাড়ি আর ছিলনা। তবে যাই হোক না কেন চুরি, পকেটমারা, ভাঁওতা দেওয়া, সিদ্ কাটা এগুলো থেকেই গেছিল। যদিও শাসকদের বেশ কড়া নজর ছিল, তারা 'ঠাকুর' বা সার্জেন কনস্টেবল ইত্যাদি পুলিশ কর্মচারির সাহায্যে চোরদের বেশ দমিয়েও রাখতেন।
উনবিংশ শতাব্দীর সপ্তম দশকে কলকাতায় পুলিশ কমিশনার ছিলেন সিভিলিয়ান উইলিয়াম জেমস হার্শেল (Hershel)। কলকাতায় থেকে ইনি একটা মস্ত আবিষ্কার করেছিলেন। "১৮৮০ সালে ইংল্যান্ডের 'নেচার' পত্রিকায় তিনি একটি চিঠি লেখেন। আঙ্গুলের ছাপ থেকে যে অপরাধী ধরার একটা উপায় হতে পারে এই চিঠিতেই সেটা প্রথম জানা যায়।" …মনে পড়ছে সিধু জ্যাঠার ফেলুদাকে করা সেই বিখ্যাত প্রশ্নের উত্তর? আধুনিক ডিটেকটিভ বিদ্যার এই হল গোড়াপত্তন।
সেইসময় ঠগী দমনের জন্য দারোগা বরকতউল্লা বা কলকাতা পুলিশের ঝানু গোয়েন্দা ও গোয়েন্দা দপ্তর
সিরিজের লেখক - সম্পাদক প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় বেশ নাম করেছিলেন। কিন্তু এই ভাবে কি আর প্রকৃত ঝানু চোর দের আটকে রাখা যায়! কাজেই ছোট চোর, বড় চোর, ছোট চুরি, বড় চুরি সবরকমই ছিল। শুধু সময়ের সঙ্গে বা অবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নিতে গিয়ে চুরির ধরন গুলো হয়তো পাল্টে যাচ্ছিল।
কলকাতার রাস্তায় গ্যাস বাতির আগে জ্বলত রেড়ির তেলের বাতি।কর্পোরেশনের কর্মীরা রোজ বাতির কাঁচ পরিষ্কার করে তাতে তেল ভরে আলো জ্বালিয়ে যেতেন। দেখা গেল সেই তেল বেবাক চুরি হয়ে যাচ্ছে। চোর কিন্তু ধরা পড়ত না।
চোর ছাড়া কেউ চোর ধরতে পারে না। এমন একটা ধারণা কিন্তু আমাদের দেশে ছিল। তাই প্রাচীনকাল থেকে ঘাগী চোর কে বশ করে পুলিশের কাজ করানো হতো।
একবার সুকুমার সেন লিখেছিলেন, আমাদের দেশের "ছেলেভুলানো গল্পে যে বড় চোরের দেখা পাই তিনিই তখনকার দিনের বড় পুলিশ এবং এখনকার দিনের শার্লক হোমসের বড় ভাই মাইক্রফট হোমসের ভারতীয় পূর্বপুরুষ।"...
অর্থাৎ একাধারে super - criminal এবং super - sleuth… এই কল্পনার বীজটা কিন্তু আমাদের দেশের নিজস্ব। সেই যে পুরনো প্রবাদ আছে
'জো সো চৌর সোউ দুষাধী' - অর্থাৎ যে সে চোর সেই শাস্তিদাতা। ফরাসী গোয়েন্দা লেখক মরিস ল ব্লাঁ তাঁর গল্পের নায়ক আরস্যান্ লুপ্যাঁ কে ঠিক এইরকমই এক চরিত্র দিয়েছিলেন।
চোরদের নিয়ে যখন এতো কেচ্ছা কাহিনী ই হলো তাহলে হাবিব তানভীরের 'চরণ দাস চোর' ই বা বাদ যায় কেন!
নাটকটি আদতে রাজস্থানের একটি লোক কাহিনী।
প্রথমে এর নাম হয়েছিল 'চোর চোর', পঞ্চাশ মিনিটের একটি নাটক, যার নায়ক একজন চোর, নাম চরণ দাস, যে একজন সাধুর কাছে তিনটি প্রতিজ্ঞা করেছিল। তার মধ্যে একটি ছিলো কোনো রানী যদি কখনো তাকে বিয়ে করতে চান, চরণ দাস তাতে রাজী হবেনা এবং সেই প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে তাকে শেষে প্রাণ পর্যন্ত দিতে হয়েছিল।
নাটকটির ঘটনা প্রবাহের মধ্যে দিয়ে সমাজের বিভিন্ন কৌতুকময় দিক ফুটে উঠেছিল, যা কিন্তু খুব তীব্র ছিলনা- কিন্তু কোথাও গিয়ে দর্শককে ভাবিয়েছিল, বিব্রত করেছিল। প্রায় চার দশক ধরে নাটকটি সমান জনপ্রিয়।
যে উদ্দেশ্য নিয়ে নাটকটার কথা বললাম তা হলো চোর হয়েও এখানে চরণ দাসের অদ্ভুত একটা সততা ছিল। এতে কিন্তু অবাক হওয়ার কিছু নেই। চোর হওয়া মানেই মিথ্যেবাদী হওয়া নয়, অসৎ হওয়া নয় -
ভারতবর্ষের প্রাচীন চৌর্য শাস্ত্রে বলা হয়েছে-
এমন কোন কলা পৃথিবীতে নাই যা চৌর্যের উপর প্রতিষ্ঠিত নয় - জগতে সর্বত্র তস্করের অপূর্ব লীলা বৈচিত্র। পৃথিবীর অন্ধকারকে চুরি করে ভগবন অংশুমালী আকাশে দীপ্যমান। স্বয়ং বিষ্ণু বিশ্বের পাপ হরণ করে পুণ্যবান। শিক্ষক ছাত্রের অজ্ঞানতা অপহরণ করেন। চোরেরা ধনীর অসংযত লিপ্সাকে সংযত করে রাখেন।এর চাইতে পুণ্যের কাজ আর কি হতে পারে!!
মার্কসবাদীরা এই যুক্তি শুনে কি বলতেন কে জানে!
গ্রন্থ ঋণ:
১. মৃচ্ছকটিক ও তৎকালীন সমাজ: রধিকারঞ্জন চক্রবর্তী
২. কলিকাতার কাহিনী: সুকুমার সেন
৩. প্রাচীন ভারতে চৌর্যশাস্ত্র: দিলীপ কুমার কাঞ্জিলাল