দোঁহা

রবীন্দ্রনাথের "কথা ও কাহিনী": " নিষ্ফলের হতাশের" আঁতের কথা


শাল্মলী রায় 


ইতিহাস ও সাহিত্যের তুলনামূলক আলোচনা প্রসঙ্গে আরিস্ততল বলেছিলেন, ইতিহাসের তুলনায় কাব্য অনেক বেশি দার্শনিক। কারণ ইতিহাস কেবল ধারাবিবরণী দেয়, কিন্তু সাহিত্য সেই ধারাবিবরণী থেকে খুঁজে আনে একটি নিটোল সম্পূর্ণ চিত্র বা কাহিনী। তাই ইতিহাস যেখানে কেবল ঘটে যাওয়া ঘটনার সম্পর্কে তথ্য উপস্থাপনের ধারাবিবরণী করেই নিজের দায় সারে, সাহিত্য সেখানে কি ঘটতে পারত সেই প্রশ্ন এবং সেই সম্পর্কিত যাবতীয় কল্পনারও যুক্তিমূলক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করার অবকাশ রাখে। তাই সাহিত্য প্রকৃতঅর্থে ইতিহাসের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এক অন্যতর বোধের জন্ম দেয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "কথা ও কাহিনী " কাব্যগ্রন্থটি যেন সেই অন্যতর ইতিহাসের এক অভিনব মায়া। এমনিতেই এই কাব্যগ্রন্থ রবীন্দ্রনাথের কাব্যজগতে বিশেষ ব্যতিক্রমী। কেন তা বলতে গেলে উল্লেখ করতে হয় তাঁর নিজেরই কথার, 

"ছবির অভিমুখিতা বাইরের দিকে, নিরাবিল দৃষ্টিতে স্পষ্ট রেখায়। সেইজন্যে মনের মধ্যে এই ছবির প্রবর্তন এমন বিষয়বস্তুকে স্বভাবত। বেছে নেয় যার ভিত্তি বাস্তবে। এই সন্ধানে এক সময়ে গিয়ে পড়েছিলুম ইতিহাসের রাজ্যে। সেই সময়ে এই বহির্দৃষ্টির প্রেরণা কাব্যে ও নাট্যে ভিড় করে এসেছিল ইতিহাসের সঞ্চয় নিয়ে। এমনি করে এই সময়ে আমার কাব্যে একটা মহল তৈরি হয়ে উঠেছে যার দৃশ্য জেগেছে ছবিতে, যার রস নেমেছে কাহিনীতে, যাতে রূপের আভাস দিয়েছে নাটকীয়তায়।"

 রবীন্দ্রনাথের এই বক্তব্যের মধ্যে যেন সেই আরিস্ততলীয় ভাবনারই ছায়া পাওয়া যায়। তাঁর আগে ইতিহাস আর কাব্যের এমন অভিনব মেলবন্ধন আর কখনোই করা সম্ভব হয়নি। কারণ ইতিহাস কিংবা পুরাণ বা প্রাচীন মহাকাব্য বিষয়ে বাংলা ভাষায় রবীন্দ্রপূর্ববর্তী যুগে যে যে সাহিত্য রচিত হয়েছে, তার মধ্যে ভাষা এবং ভাবের এক আতিশয্য পরিলক্ষিত হয়েছে বারবার। কাব্যের ক্ষেত্রে সেটা বহুমাত্রায় অধিক। অর্থাৎ মূল বিষয় বা সাহিত্যের ক্ষেত্রে যা গুরুত্বপূর্ণ, সেই প্লট, অলংকারের অতি চাকচিক্য দ্বারা ঢাকা পড়েছে। তাই ঘটনাগুলি না হতে পেরেছে আধুনিক যুগের বিশ্বাসযোগ্য, না চরিত্ররা হয়েছে সম্পূর্ণ মানবিক। তাই ইতিহাস শুনলেই পাঠকের মনে উদয় হয়েছে অতি জাঁকজমকপূর্ণ একটি চিত্রের, যা আসলে ইতিহাস এবং সাহিত্য কোনটিকেই যথাযথ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করতে সম্পূর্ণ সফল হয়নি, এবং তা একশ্রেণীর পাঠকের মনে এমন প্রশ্নের উদয়ও ঘটিয়েছে যে "ইতিহাস পড়ব কেন? বা  ইতিহাসের অত জটিল তথ্য আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কি ক্ষতিবৃদ্ধি করবে? সে তো যা হবার তা আগেই হয়ে গেছে।" 

মহাকাব্যের অমন জটিল ভাষা শুধু কাব্য পড়তে কেন আয়ত্ব করবেন পাঠক, এই বিষয়েও সঠিক উত্তর রবীন্দ্রপূর্ব ঐতিহাসিক  সাহিত্য দিতে অক্ষম। ঠিক এইখানেই রবীন্দ্রনাথ পাঠকদের উপহার দেন তাঁর "কথা ও কাহিনী"। 
প্রমথনাথ বিশী তাঁর "রবীন্দ্রকাব্যে বস্তুবিচার" গ্রন্থে লিখেছেন, 

"কথা ও কাহিনী কাব্যখানির জনপ্রিয়তা সার্বভৌমিক। এই জনপ্রিয়তার অনেক কারণ। রচনার সৌষ্ঠব ও কাহিনীর আকর্ষণ তার মধ্যে প্রধান।" 

এর সঙ্গে সঙ্গে তিনি এও উল্লেখ করেছেন যে বহুবছর ধরেই বহু নবীন বাঙালী পাঠকের জীবনে কাব্যের তথা ভারত ইতিহাসের প্রথমিক ধারণা সৃষ্টি করেছে এই কাব্যগ্রন্থই। তবুও বিশেষজ্ঞদের কাছে এমন গ্রন্থ কিছুটা অবহেলিত এবং তার কারণ প্রমথনাথ বিশীর মতে এর সহজবোধ্যতা। যা সহজ তাই অগভীর, এমন প্রচলিত ধারণা কোথাও যেন এই কাব্যগ্রন্থের সঠিক মূল্যায়নের পরিপন্থী হয়েছে। অথচ এই কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতায় পাওয়া যায় এক অসাধারণ সহজ কিন্তু গভীর মূল্যবোধ। ইতিহাস বা পুরাণ বা প্রাচীন সাহিত্যে যে মূল্যবোধ অস্ফুট হয়েই থেকে গিয়েছিল, রবীন্দ্রনাথ তাকেই যেন নতুন আলোয় উদ্ভাসিত করলেন  তাঁর কাব্যের মূল উপজীব্য করে। তাই ইতিহাস এখানে রসসিক্ত। ঐতিহাসিকতার চেয়ে বড় মানবিকতা, এই কথাই বারবার মনে করিয়ে দিয়ে যায় এই কাব্যগ্রন্থ। এখানে না আছে  অতিরিক্ত আলংকারিক ভাষা, না আছে ভাবের অযথা ভিড়। আছে কেবল স্নিগ্ধ একটি চিত্র, বা একটি নিটোল কাহিনী, যা পাঠকের মনে এক চিরকালীন রেশ রেখে যায়। 

এই কাব্যগ্রন্থের সম্বন্ধে আরো একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল এটি পাঠকের কল্পনাকে গুরুত্ব দিয়েছে। কি হয়েছিল এই ভাবনার চেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে কি হতে পারত বা প্রশ্ন রেখেছে এমনটাও হতে পারত না কি? তাই মূল গ্রন্থ যেখানে বাসবদত্তার এক নিষ্ঠুর নৃশংস পরিণতির কথা বলে, রবীন্দ্রনাথের মনের নান্দনিক সত্ত্বা তাকে মুক্তি দেয় মহানুভবতার এক অসাধারণ স্নিগ্ধ পরিণতিতে। "অভিসার"এর শেষে এমন বিস্ময়কর মিলন কাব্যসাহিত্যে বিরল। ঠিক যেমন আত্মসম্মান যে জীবনের চেয়ে অনেক মূল্যবান, মান এবং হুঁশই যে মানুষের পরিচয় তা এমন সহজ ব্যাখ্যাও রবীন্দ্রপূর্ব সাহিত্যে বিরল। অর্থাৎ সাহিত্য এখানে সার্থক। মানবিকতাই জীবনের মূল ধর্ম। ধন সম্পদ বা খ্যাতি নয়, মহত্ব , ঔদার্য, নিবেদন, সহমর্মিতাই শ্রেষ্ঠ মানবধর্ম। ঈশ্বর বিরাজ করেন মানবজীবনের মাঝেই। তাই সাধুশ্রেষ্ঠ নরোত্তম অনায়াসে নৃপতিকে বলতে পারেন, বিশ লক্ষ স্বর্ণমুদ্রায় রচিত দেবালয় কেবল রাজদম্ভে পূর্ণ, দেবতা সেখানে নির্বাসিত। দেবতা থাকেন "দীনসাথে দীনের আশ্রয়ে"। তাই রাজার কাছে শাস্তিস্বরূপ চেয়ে নেন নির্বাসন।

"ভক্তবৎসলেরে তুমি যেথায় পাঠালে নির্বাসনে
সেইখানে, মহারাজ, নির্বাসিত কর ভক্তজনে।"

এখানেই জয়ী হয় সাহিত্য, এখানেই পাঠক খুঁজে পায় মানবচরিত্রদের, খুঁজে পায় চিরকালীন মূল্যবোধকে, যা দেশ-কালের সীমার ঊর্ধ্বে, যা চিরকালীন, যা চিরপ্রাসঙ্গিক। শুধু তাই নয়, যারা চিরকাল অবহেলিত, কাব্যে উপেক্ষিত, তেমন চরিত্ররা কবিকল্পনার রসে হয়ে উঠেছে পাঠকের চির আপন। সেই  শিখসৈনিক যাকে ইতিহাস মনে রাখেনি, সেই দরিদ্র নারী যার দেওয়া ছিন্নবসন ম্লান করে হাজার রত্নের জৌলুস, সেই ভিক্ষুনি যার ভিক্ষাপাত্র হয়ে উঠেছিল অসহায়ের একমাত্র সম্বল, সেই কর্ণ বা কুন্তী যাদের পরিচয় কেবল রাজনীতির জটিল আবর্তের সঙ্গেই যুক্ত, তারা সকলেই রবীন্দ্রলেখনীতে অমরত্ব লাভ করেছে, লাভ করেছে মানবিক পরিচয়। তাই কুন্তীর রাজমাতা পরিচয় নয়,  মাতৃত্বের সঙ্কট বড় হয়ে উঠেছে; কর্ণ তাই বীর যোদ্ধা নন, মাতৃস্নেহ বঞ্চিত এক পুত্র, যার জীবনের সায়াহ্নে যুদ্ধজয়ের আকাঙ্খা লুপ্ত হয়েছে এক গভীর জীবনবোধে।

"হেরিতেছি শান্তিময়
শূন্য পরিণাম। যে পক্ষের পরাজয়
সে পক্ষ ত্যজিতে মোরে কোরো না আহ্বান।
জয়ী হোক, রাজা হোক পাণ্ডবসন্তান--
আমি রব নিষ্ফলের, হতাশের দলে।
জন্মরাত্রে ফেলে গেছ মোরে ধরাতলে
নামহীন, গৃহহীন-- আজিও তেমনি
আমারে নির্মমচিত্তে তেয়াগো জননী
দীপ্তিহীন কীর্তিহীন পরাভব-'পরে।
শুধু এই আশীর্বাদ দিয়ে যাও মোরে
জয়লোভে যশোলোভে রাজ্যলোভে, অয়ি,
বীরের সদ্‌গতি হতে ভ্রষ্ট নাহি হই।"

এমন করে বিষণ্ণতাকেও স্নিগ্ধ নান্দনিকতায়  উপস্থাপিত করতে রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর কেই বা কবে পেরেছেন? "কথা ও কাহিনী" তাই রবীন্দ্রকাব্যের সেই বিরল রত্ন, যা ইতিহাসের মধ্যে আরোপ করেছে personification। বিশ্বাস করিয়েছে এমনটাও তো হতে পারত!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন