দোঁহা

সিনেমা, প্যারাডাইস এবং আমি


[ প্রথম পর্ব ]

ডঃ মেঘদূত রুদ্র

বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে কোভিডের চতুর্থ ঢেউ নাকি আসতে চলেছে। কেউ কেউ আবার বলছেন যে এতে আমাদের দেশে তেমন কোনো প্রভাব পরবে না। তবে যেই যেই ক্ষেত্র গুলিতে কোভিড অলরেডি মারাত্বক প্রভাব বিস্তার করে দিয়েছে তার মধ্যে অন্যতম প্রধান হল দেশের শিক্ষা ব্যাবস্থা আর তারপর দেশের বিভিন্ন সিনেমা হল (সিঙ্গেল স্ক্রিন)। 

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া কোভিডের সময় সবথেকে বেশীদিন ধরে সিনেমা হল গুলি বন্ধ ছিল। এর প্রধান কারণ হল যে সিনেমা দেখাটা জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কাজের মধ্যে পরে না। আর দ্বিতীয় কারণ হল অনলাইন প্ল্যাটফর্ম গুলো তো আছেই। দেখতে হলে ওখানেই দেখে নেওয়া যাবে। অকাট্য যুক্তি। প্রতিবাদ করার কোনো জায়গাই নেই। ফলে বন্ধ থাকতে থাকতে একসময় হলগুলি জীর্ণ হয়ে যাবে এবং একে একে সব বন্ধ হয়ে যাবে। হয়ে যাচ্ছে। হয়ে গেছে।

একথা ঠিক যে ক্রাইসিসের সময় এন্টারটেইনমেন্ট মানুষের প্রাথমিক চাহিদা নয়। প্রাথমিক চাহিদা হল খাদ্য, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, নিরাপদ জীবন। যেকোনো সময়েই সিনেমা না দেখেও মানুষ দিব্বি বেঁচে থাকতে পারে। আর প্যান্ডেমিকের সময় তো আরও পারে। আর সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখাটা তো কোনো ইস্যুর মধ্যেই পরে না। থাকলে থাকলো, গেলে গেলো। কার বাবার কি? কিন্তু মুশকিল হল যে হলে গিয়ে সিনেমা দেখতে না পারলে আমার অসুবিধা হয়। আমার ধারনা হল মালিকেরা ছাড়াও আমার মতো আরও বেশ কিছু আপদ গোছের লোকজন আছে যাদের অসুবিধা হয়। কারণ তাদের কাছে সিনেমা নিছক একটা মনোরঞ্জন নয়। সিনেমা হচ্ছে বেঁচে থাকার একটা গুরুত্বপূর্ণ রসদ। অক্সিজেনের মতোই। টিভিতে ক্রিকেট, ফুটবল ম্যাচ দেখাই যায়। কিন্তু স্টেডিয়ামে গিয়ে খেলা দেখার যে কি মজা সেটা যারা গিয়ে দেখেছে তারাই জানে। আবার সার্কাসে, চিড়িয়াখানায় বাঘ অনেকেই দেখেছেন কিন্তু জঙ্গলে শিকাররত বাঘ দেখার যে রোমাঞ্চ সেটা যারা দেখেছে তারাই জানে। সেরকমই সিনেমা হলে গিয়ে ছবি দেখার মধ্যে যে আনন্দটা আছে সেটা বাড়িতে বসে দেখার মধ্যে নেই। প্রেক্ষাগৃহ আমার কাছে প্যারাডাইসের মত। সেটার কারণ গুলো পরে বলছি। আপাতত বিভিন্ন সিনেমা হলের সাথে আমার সম্পর্কের গল্পগুলি বলি।  

আমি যেই সিনেমাটা প্রথম হলে গিয়ে দেখেছিলাম সেটা নাম ‘বালক শিবাজি’। মারাঠি বা হিন্দি ছবি বাংলায় ডাব করা। আমার দু-তিন বছর বয়েস ছিল। বাড়ির পাসের সিনেমা হল ‘পদ্মশ্রী’ তে গিয়ে ছবিটা দেখেছিলাম। আমার বাবা-মা হয়তো ভেবেছিলেন, যে এই জীবনের শুরুতেই এই ছবি দেখলে ছেলে এক সময় গিয়ে শিবাজির মতো বীর হবে। সে যাই ভাবুক, এতো কম বয়েসে আমায় যে তারা হলে নিয়ে গেছিলেন তাতেই আমি নিজেকে খুব লাকি বলে মনে করি। বহু লোকেরই এই সৌভাগ্য হয় না। সেই সিনেমা দেখার স্মৃতি আমার খুব অল্পই মনে আছে। স্বপ্নে দেখা স্মৃতির মতো ঝাপসা টুকরো কিছু দৃশ্য মনে আছে। শিবাজির অভিষেক হচ্ছিল, আমি হলের ডান প্রান্তে সামনের দিকে বাবার কোলে বসে ছিলাম ইত্যাদি। ‘পদ্মশ্রী’ হলটা পার কলোনি অঞ্চলে অবস্থিত। যাদবপুর থেকে গড়িয়া অবধি বিস্তীর্ণ কলোনি অঞ্চলের সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষের সুখ-দুঃখের সঙ্গী হল এই সিনেমা হলটি। আরেকটা বিষয়েও আমি খুব লাকি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে এই লেখাটা যারা পড়ছেন তাদের মধ্যে ৯০% মানুষেরই সেই সৌভাগ্য নেই। পদ্মশ্রী এখনও জীবিত আছে। এবং এখনও আমি সেখানে গিয়ে ছবি দেখি। ৯০% মানুষ তাদের প্রথম ছবি যেই হলে গিয়ে দেখেছিলেন সেইসব হলগুলির আজ আর কোনো অস্তিত্ব নেই। শপিং মল, বিজনেস কমপ্লেক্স ইত্যাদি হয়ে গেছে কিম্বা হওয়ার প্রস্তুতি চলছে। এইভাবেই আমাদের ছোটবেলার স্মৃতিকে আমরা চোখের সামনে মুছে যেতে দেখছি। কিন্তু কিছুই করছি না। আমিও করিনি। 


আমার দ্বিতীয় ছবি আমি যেই হলে দেখেছিলাম তার নাম ‘মহুয়া’। বাবা ও তার বন্ধুদের সাথে গিয়ে ‘জ্যাংগো’ নামের একটি ইংরাজি ছবি আমি ‘মহুয়া’ তে গিয়ে দেখেছিলাম। হাউজ ফুল ছিল। মনে হয় ছবিতে যৌন দৃশ্য ছিল। অথবা থাকবে এই আশায় হাউজ ফুল হয়েছিল। আমার মনে নেই। হয়তো আমার চোখ ঢেকে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু যেটা মনে আছে তা হল জ্যাংগো নামের চরিত্রটা ছিল একজন কিলার। একটা কফিন নিয়ে ঘুরত। মানুষকে মেরে ওই কফিনে ভরে নিয়ে যেতো। আর অন্য সময় নিজেই ওই কফিনে ঘুমিয়ে থাকতো। আমি ডান সাইডের একদম পেছনে বসেছিলাম। হেবী চিপস-টিপস খেয়েছিলাম। অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহ। এত এত মানুষ। একধরণের সেলিব্রেসন চলছে। অদ্ভুত মজা হয়েছিল। তখন আমি প্রাইমারি স্কুলে পড়ি কিন্তু বয়েস কত ছিল সেটা আর মনে নেই। বাবাকে জিজ্ঞেস করলে হয়তো বলে দিতে পারতো কিন্তু জিজ্ঞেস করা হয়নি। বাবা পরলোক গত হওয়ায় আর সেই সুযোগ নেই। এবং আমার বাবার সাথে সাথে ওই একই বছর ‘মহুয়া’ হলটাও পরলোক গত হয়েছে। বন্ধ অনেকদিন আগেই হয়ে গেছিলো। কোভিডের পর বিল্ডিংটা ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এখন পুরো ফাঁকা ময়দান। কোভিডের কারণে হয়তো কন্সট্রাকশন আটকে আছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই মার্কেট কমপ্লেক্স হয়ে যাবে। শেষের দিকে হলের নামের জায়গার ‘ম’ আর ‘য়া’ টা উঠে গিয়ে শুধু ‘হু’ টা ছিল। লোকজন মজা করে বলতো যে WHO-র নতুন অফিস গড়িয়াতে খুলেছে। মহুয়ায় আমি প্রচুর ছবি দেখেছি।


আমার বাড়ি ছিল দক্ষিণ কলকাতার রামগড় কলোনিতে। আর মহুয়া ছিল গড়িয়াতে। বাড়ির থেকে অটোতে ৫ মিনিটেই ডিসট্যান্স। আর হেঁটে ১৫ মিনিট। জীবনে আমি সবথেকে বেশি ছবি দেখেছি ‘পদ্মশ্রী’তে। দ্বিতীয় ‘নবীনা’। আর তৃতীয় ‘মহুয়া’। শাহরুখ খানের প্রথম ছবি যেটা আমি হলে গিয়ে দেখেছিলাম তার নাম হল ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে’। সেটা মহুয়াতে গিয়ে দেখেছিলাম। পিসতুতো দিদিরা পুজোর ছুটিতে বেড়াতে এসেছিল। বাবা সবাইকে দেখাতে নিয়ে গেছিলো। এই ছবিটা আমাদের দেশের অনেকগুলি জেনারেশনের দৃষ্টিভঙ্গিকেই পালটে দিয়েছিল। হিন্দি ছবির ভাষাকেও বদলে দিয়েছিল। হিন্দি ছবির ইতিহাসকে অনেকেই ‘Pre DDLJ’ আর ‘Post DDLJ’ এই দুই ভাগে ভাগ করে থাকেন। আমি অবশ্য তার আগে থেকেই শাহরুখ খানের ফ্যান হয়ে গেছিলাম। বাড়িতে ভিসিআর ভাড়া করে এনে ‘বাজিগর’ ছবিটা দেখার পর থেকেই আমি শাহরুখ খানের ফ্যান। আর আগে অমিতাভ বচ্চনের ফ্যান ছিলাম। ওই ভিসিআর ভাড়া করেই বাড়িতে বচ্চনের ছবি দেখা হতো। সেই সময় হলে গিয়েও অবশ্য বচ্চনের দুটো ছবি আমি দেখেছিলাম। প্রথম ছবি যেটা দেখেছিলাম তার নাম ‘দোস্তানা’। হলের নাম ‘বান্টি’। দ্বিতীয় ছবি ‘খুদা গাওয়া’। হলের নাম মনে নেই। আসলে আমার মামাবাড়ি হল ‘বো ব্যারাকে’।সেই বো ব্যারাক যেখানে বাঙালিরা ক্রিসমাসের সময় ঘুরতে যায়। আর কিছু লোক বছরের বিভিন্ন সময় হোম মেইড ওয়াইন কিনতে যায়। অদ্ভুত কসমোপলিটান জায়গা। হিন্দু, মুসলমান, ক্রিস্টান, বৌদ্ধ ইত্যাদি প্রায় সব জাতির বাস। ব্যারাকে দুটো মাত্র বাঙালি পরিবার থাকে। তার মধ্যে একটা আমার মামাবাড়ি। আমার দাদু কলকাতা পুলিশে ছিলেন। অনেস্ট অফিসার ছিলেন। বাড়ি, ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স কিছুই করতে পারেন নি। কিন্তু কোনো একটা ভাবে ওখানে একটা কোয়াটার ম্যানেজ করতে পেরেছিলেন। আজও আমার মামাতো ভাই সেখানে ভাড়ায় থাকে। সেই বো ব্যারাকের কাছে অর্থাৎ মধ্য কলকাতায় সেই সময় অনেক সিনেমা হল ছিল। তাই মামার সাথে কোন হলে গিয়ে ‘খুদাগাওয়া’ দেখেছিলাম সেটা মনে নেই। 

মধ্য কলকাতায় সেই সময় যেইসব হল ছিল তার মধ্যে ৮০% হলেরই আজ আর কোনো অস্তিত্ব নেই। আমার সেই মামাও অনেক বছর হল মারা গেছেন। ‘দোস্তানা’ রি-রিলিজ হয়েছিল। কারণ ছবিটা রিলিজ হয়েছিল ১৯৮০ সালে। তখন আমি জন্মাইনি। হলের ম্যানেজারের সাথে বাবার পরিচয় ছিল। তাই আমাদের টিকিট কাটতে হয় নি। উলটে ম্যানেজার আমাদের চা-কোল্ডড্রিং খাইয়েছিলেন। কিন্তু ‘খুদা গাওয়া’ রিলিজ হওয়ার সময়তেই দেখেছিলাম। ১৯৯২ সালে। হলে প্রচুর সিটি পরেছিল। আমি তখন সিটি দিতে জানতাম না। এখনও জানিনা। অনেক অভ্যাস করেছি কিন্তু আয়ত্ত করতে পারিনি। পরবর্তীকালে আমি সিটির একটা অলটারনেটিভ তৈরি করেছিলাম। সে বিষয়ে পরে বলছি। ছবিতে অমিতাভের মুখে হেবী হেবী সংলাপও ছিল। ‘খুদা গাওয়া’ আমি দুবার হলে গিয়ে দেখেছিলাম। দ্বিতীয়বার বাবার সাথে ‘বান্টি’ তে। ‘বান্টি’ ছিল আমার বাড়ির কাছেই। নাকতলা আর গড়িয়ার মাঝামাঝি একটা জায়গায়। স্টপেজটার নামও বান্টি। অমিতাভের দুটো ছবিতেই প্রচুর অ্যাকশন ছিল। আমার বাবা অ্যাকশন ফিল্ম খুব ভালোবাসতেন। আসলে আমার বাবার অনেক ব্যবসায়িক শত্রু ছিল। তারা বাবার অনেক ক্ষতি করেছিল। তাই মনে মনে বাবা তাদের মারতে চাইতেন। কিন্তু সেটা বাস্তবে পারতেন না। তাই পর্দার নায়ক যখন ভিলেনকে ক্যালাতো তখন তাই দেখে বাবা একধরণের তৃপ্তি পেতেন। মনে হতো নায়ক তাঁর হয়ে বদলাটা নিচ্ছে। তাই বাবার সাথে যেসব ছবি দেখেছি তার মধ্যে অ্যাকশন ফিল্মই বেশি। 

মিঠুনের ‘ফুল অউর অঙ্গার’ দেখেছিলাম বান্টিতেই। ছবিতে বেশ কিছু গভীর প্রেমের দৃশ্য ছিল। দৃশ্যগুলির সময় বাবাকে একটুও অস্বস্তি পেতে দেখিনি। ব্যাপারটা বেশ লিবারাল ছিল। আর যে যার মত করে এঞ্জয় করেছিলাম। বাবার সাথে চিরঞ্জিতের একটা ছবিও ‘পদ্মশ্রী’-তে গিয়ে দেখেছিলাম। না ‘বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না’ নয়। ওটা ওই সময় না দেখার আফসোস আমার আজীবন রয়ে যাবে। আমরা যেটা দেখেছিলাম সেটাও সাপ-টাপ নিয়েই। আসলে ‘বেদের মে…’ ব্লকবাস্টার হিট হওয়ার ফলে চিরঞ্জিত সেই সময় পরপর ওইরকম টাইপের কিছু ছবিতে অভিনয় করেছিলেন। আমরা ওরকমই একটা ছবি হয়তো দেখেছিলাম। ‘বেদেনীর প্রেম’ বা ‘রাখাল রাজা’ হতে পারে। এঞ্জয় করেছিলাম। বান্টিতে কুমার গৌরব অভিনীত একটা ছবিও সেই সময় দেখেছিলাম। সেটা কোন ছবি আর কেনই  সেটা দেখেছিলাম ঠিক জানি না। বান্টি যেহেতু আমাদের বিনা পয়সায় দেখার জায়গা ছিল তাই মাঝে মাঝেই বাবার সাথে ওখানে চলে যেতাম। আর বান্টিতে সেই সময় হয়ত এইটাই চলছিল। একেবারেই এঞ্জয় করিনি।  কিন্তু ফ্রি-তে ছবি দেখার সেই সুখ বেশিদিন আমাদের কপালে সয় নি। হলটা তার পরপরই উঠে যায়। 

বান্টি হলটাকেই আমি প্রথম উঠে যেতে দেখেছি। ৯০-এর দশকের ঘটনা। কেনো উঠে গেছিল জানি না। ওঠার পর শুনেছিলাম ওখানে আলুর গোডাউন হয়েছিল। বান্টি উঠে যাওয়ার জন্য তখন তেমন কোনো দুঃখ হয়নি। কারণ অপশন অনেক ছিল। আর ফ্রিতে দেখার বিষয়টা আমি তখন জানতাম না। আজ এটা ভেবে দুঃখ হয় যে তখন কেন দুঃখ হয়নি। কারণ এখন অপশন কমতে কমতে হাতে গোনা কয়েকটাতে এসে ঠেকেছে। বর্তমানে ‘গুগল'-এও বান্টির কোনো অস্তিত্ব নেই। ‘Bunty Cinema Hall’ দিয়ে সার্চ করলে ‘Bunty aur Bubli’ ছবির খবর দেখায় আর বান্টি এলাকায় নতুন কোন কোন ফ্ল্যাট বিক্রি আছে সেটা দেখায়। কিছু মানুষের স্মৃতিতে ছাড়া আজ আর বান্টির কোথাও কোনো অস্তিত্ব নেই। কিন্তু এখন দেখি যে কারুরই এই নিয়ে বিশেষ দুঃখ-টুঃখ হয়না। বরং অধিকাংশ মানুষ এটাতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। আবার গতরটা খাটিয়ে সিনেমা হলে যেতে হবে। খরচাও বেশি। কি দরকার। তার চেয়ে হল-টল সব উঠে যাক। ‘মোবাইল ভিউইং’ জিন্দাবাদ। আমার বাবার কোনো কালেই খুব একটা টাকা-পয়সা ছিল না। তবে সিনেমা দেখার নেশা ছিল প্রবল। তাই ছোটবেলায় আমি হলে গিয়ে অনেক ছবি দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। সিনেমা দেখার নেশা আমার মায়েরও ছিল। তবে মায়ের সাথে দেখা সিনেমা গুলির কথা আমার খুব একটা মনে নেই। কারণ সেগুলোর অধিকাংশই ছিল ছবি। সেই সময় বাংলা ছবির দুরবস্থা ৫-৭ বছরের বাচ্চারাও বসে দেখতে পারতো না। এখনও পারে না। তবে মনে আছে যে মা আর পিসিদের সাথে ‘পদ্মশ্রী’-তে গিয়ে ‘শ্বেত পাথরের থালা’ ছবিটা দেখেছিলাম। প্রভাত রায়ের ছবি। মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন অপর্ণা সেন। এটা ছিল ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তর প্রথম ছবি। এছাড়া মধ্যে কলকাতায় কোনো একটা হলে মা আর মামির সাথে তাপস পালের ‘বলিদান’ ছবিটা দেখার কথা মনে আছে। সম্ভবত ‘অরুণা’ অথবা ‘পুরবী’ হলে। এটার কথা মনে আছে কারণ উষা উত্থুপের গাওয়া এই ছবির ‘উরি উরি বাবা কি দারুণ’ গানটা সেই সময় বিরাট হিট হয়েছিল। আমার মায়ের ছবিটা ভালো লাগেনি। আমার মা হালকা আঁতেল গোছের ছিলেন। মায়ের সাথে সত্যজিৎ রায়ের ‘আগন্তুক’ ও দেখতে গেছিলাম। একটা লোক ঘরে বসে বসে খালি জ্ঞান দিচ্ছে। কি যে বোর হয়েছিলাম সে আর কি বলবো। তবে একটু বড়ো হওয়ার পর আমার মা টিভিতে আমায় উত্তম কুমারের ছবি দেখার অভ্যাস তৈরি করিয়েছিল। সেই সময় দূরদর্শনে উত্তম কুমারের ছবি প্রায়শই দিতো। আর ২৪শে জুলাই উত্তম কুমারের প্রয়াণ দিবস উপলক্ষে এক সপ্তাহ ধরে 'গুরু'র ছবি দেখানো হতো।

একটু বড় হওয়ার পর সত্যজিৎ রায়ের ছবি দেখানোর অভ্যাস মা-ই তৈরি করিয়েছিল। সেগুলো অবশ্য টিভি তে। তবে তার জন্য মায়ের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। আমি যে সিনেমা নিয়ে পড়াশোনা করেছি, সিনেমা নিয়ে পিএইচডি করেছি এবং পরবর্তীকালে চিত্র পরিচালনায় এসেছি তার পেছনে মায়ের প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় ছিল বলেই আমার ধারণা। সম্পূর্ণ সমর্থন ছিল না কারণ ফিল্ডটা খুবই অনিশ্চয়তায় ভরা এবং আমাদের এই ফিল্ডে কোনো যোগাযোগও ছিল না। দেখলেন তো আমি ‘ফিল্ড’ বললাম। কিন্তু অধিকাংশ লোকজন বলে ‘লাইন’। ‘ফিলিম লাইন’। তারপর ফিল্মে নামা। ডাউনফল হল আরকি। ‘লাইন’, ‘নামা’ এগুলো বলার মধ্যে সিনেমার প্রতি একধরনের অভক্তি, তুচ্ছতাচ্ছিল্যটা কাজ করতো বলে আমার মনে হয়। এখন অবশ্য ব্যাপারটা অনেকটাই কমে গেছে। এখন লোকজন অভ্যাসবশত ‘লাইন’ বলে। এবিষয়ে একটা গল্প মনে পড়ল। আমার এক সিনিয়র দাদা, সেও চিত্রপরিচালক, তার বিয়ের সময় তার এক আত্মীয়াকে নেমন্তন্ন করতে গেছিল। দাদার তখন স্ট্রাগ্লিং পিরিয়ড। টাকাপয়সা, নামডাক কিছুই তেমন নেই। তাও বিয়ে করার শখ। তো সেই আত্মীয়া দাদাকে বলেছিল ‘তোমার হবু স্ত্রী ও কি এই লাইনের মেয়ে?’। দাদা খুব প্রম্পটলি উত্তর দিয়েছিল ‘নানা লাইনের মেয়ে নয়, ভদ্রঘরের মেয়ে’। যাই হোক। সিনেমা ফিল্ড নিয়ে সেই অনিশ্চয়তা এখনও আছে। সেই কারণেই একের পর এক সিনেমা হল টপাটপ উঠে যাচ্ছে। আমার স্কুল জীবনে বন্ধুদের সাথে সবথেকে বেশি সিনেমা যেই দুটো হলে দেখেছি সেই দুটো হলও উঠে গেছে। যেই হলটায় প্রথম পানু (অ্যাডাল্ট ফিল্ম, ব্লু-ফিল্ম) দেখেছিলাম সেইটা অবশ্য এখনও আছে। স্কুলের গল্প পরের পর্বে বলছি।

 [ক্রমশ]

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন