১.
-কোথায় আছ ঋষি?
-এত রাতে কোথায় থাকব টুকুন? ঘরে খাচ্ছি।
-একটা ইনফরমরমেশন নেওয়ার ছিল।
-বল।
-নবীন পল্লিটা তোমাদের বাড়ি থেকে কত দূর?
-কত দূর মানে! সামনেই তো, নতুন বাজার পুকুরটার পাশে। কেন কিছু পেয়েছ নাকি?
-পেয়েছ মানে, অনেক কিছু। কাল একটু সকালের দিকে সময় দিতে পারবে?
-কখন?
-তুমি যখন বলবে।
-আটটা থেকে সাড়ে আটটার মধ্যে। তারপর অফিস বেরোতে হবে।
-ওকে, সাড়ে সাতটায় যাচ্ছি, রেডি থেকো।
-কিছু বলবে না ?
-কাল বলব, সব বলব।
২.
গলির ভিতর স্কুটি চালাতেও টুকুনের অসুবিধা হচ্ছিল, পিছনে বসে থাকা ঋষির ভয় লাগলেও করবার কিছু নেই। টুকুন স্কুটি ছাড়ে না, এমনিই করে এই সব কাজে। নিজে স্কুটি চালায় আর ঋষি পিছনে ভয়ে ভয়ে বসে থাকে। এর আগে অবশ্য ঋষি টুকুনের সাথে বেশ কয়েকটা জায়গায় গেছে। এক জায়গায় তো ঋষির হাতে ক্যামেরাটা পর্যন্ত দিয়ে বলে ছিল, এটা তুমি কর, বাকিটা আমি করছি। তারপরেই নিজে বুম নিয়ে সটান চলে গেছিল। কোন একটা মেডিসিন দোকানের কিছু একটা সমস্যা ছিল। দোকানদার এই মারে তো সেই মারে। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা টুকুনের হাত পা ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেছিল। টুকুনকে বুঝতে না দিলেও পরে একদিন টুকুনই বলেছিল, 'তোমার ভয় পাওয়া দেখে আমিও ভয় পেয়ে গেছিলাম, এই বুঝি প্যান্টে কিছু করে দিলে!’
ঋষি আমতা আমতা করে উত্তর দেয়, 'না, মানে ওরকম কোনদিন দেখিনি তো তাই ভয় লাগছিল।’
টুকুন বেশ সাহসের সাথে বলে ওঠে, 'আমাদের লাইনে ওরকম একটু আধটু হয়। এটা তো আর তোমার মত নয়, টাইম মেনে ডিউটি করব, আর মাস গেলে কামাবো।’
মা বউকে কিছুই জানায় নি। এমনিতেই মুখে কিছু না বললেও টুকুনের সাথে বেরোনোটাকে মা ঠিক পছন্দ করে না। কলেজে টুকুন ঋষির থেকে সিনিয়র থাকলেও টুকুনের সাথেই পরীক্ষা দিয়েছিল।সেখান থেকেই আলাপ। তবে নিজেরা তুমি দিয়েই কথা বলে। প্রথমে মা অন্য কিছু ভাবলেও বিয়ের পরে তন্দ্রা অবশ্য কোন দিনও কোন প্রশ্ন করেনি। টুকুন দিব্যি তন্দ্রার সামনেই ইয়ার্কি করে। কয়েকদিনের মধ্যে টুকুনেরও বিয়ে হয়ে যায়। মা একদিন বলে ওঠে, 'বাবু বিয়ে হয়ে গেছে, এবার এই হুটহাট যার তার সঙ্গে বেরিয়ে যাওয়া গুলো বন্ধ কর। পাঁচজনে নানা রকম কথা বলতে পারে। তাছাড়া ঘরের বউ...'
-মা, একসাথে ঘোরাঘুরি মানেই কোন সম্পর্ক নয়। টুকুনও ম্যারেড।
সেদিন তন্দ্রাও ঋষির হয়ে ব্যাট ধরে বলেছিল, 'মা, এসব ব্যাপারে ভাবতে নেই। টুকুন খুব ভালো মেয়ে। ওর থেকে বেশি হোয়াটসআপ তো আমাকে করে। আশেপাশের খবর তো সব ওর থেকেই জানতে পারি।’ তন্দ্রার আর কি টুকুন তো কোনদিন ওকে নিয়ে স্কুটি চাপিয়ে খবর খুঁজতে আসেনা। সব কিছু এমনি ভাবে চেপেও রাখেনা।
সেদিন যেতে যেতে ঋষি অনেকবার জিজ্ঞেস করেছে, 'বল ব্যাপারটা কি বল। একটু টাচ দাও।’
টুকুন চুপ। শুধু একবার বলে, 'পায়রা নামের কাউকে চেনো? নতুন বাজারে মাছ বিক্রি করে।’
ঋষি সুন্দর ভাবে জবাব দেয়, 'না।’
-পায়রাকে চেন না, সেকি, তোমাদের বাজার আর তুমি নিজেই জানো না?
-মুখ চিনতে পারি, কিন্তু ও যে পায়রা কি ভাবে জানব?
অবশ্য পাড়াতে পায়রাকে সবাই জানে।টুকুন একটা দোকানে জিজ্ঞেস করতেই দোকানদার ঘাড় উঠিয়ে দুজনকে একবার দেখে চোখ নাচিয়ে বলে ওঠে, 'এয়েছেন কোথা থেকে?’
-ঐ স্কুল থেকে, আমি দিদিমণি। টুকুন সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেয়।
কেস জণ্ডিস, ঋষি সব শোনে। হাসি পেলেও চুপ থাকতে হয়।দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ছেলে পায়রার ঘরে যাওয়ার রাস্তা দেখিয়ে দিতেই টুকুন স্কুটির ব্রেক ছাড়ে। ছোট ছোট ঘর, অনেকটা বস্তির মত, মাঝ খানে রাস্তা। সেই রাস্তা ধরে এগিয়ে একটা ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে। উল্টোদিকে আবার একটা ডোবা রয়েছে। দরজাতে টোকা মারবার কিছুক্ষণ পরে দরজা খুলে যে ভদ্রমহিলা বাইরে বেরোলেন তাঁকে মধ্যমযস্ক মনে হল। টুকুন বলে উঠল, 'এটা কি পায়রাদার বাড়ি?’ শুনেই টুকুনকে আপাদমস্তক দেখে বলে ওঠে, 'হ্যাঁ। কিন্তু আপনি কে?’
-আমি স্কুল থেকে এসেছি।
মহিলার চোখে মুখে অবিশ্বাস। ‘স্কুল থেকে! এত সকালে?’
-আপনার মেয়ে কি ঘরে আছে? ভদ্রমহিলা এবার আমতা আমতা করে উঠলেন। ‘হ্যাঁ, মানে না।’
-কথা বলব। সরুন ভিতরে যাব।
মহিলা প্রথমে কি করবেন ভেবে পেলেন না, তারপরেই দরজার পিছনে গিয়ে ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করবার চেষ্টা করবার আগেই টুকুন খুব তাড়াতাড়িই দুটো দরজার মাঝে দাঁড়িয়ে গেল। মহিলা ‘কি করছেন...?’ বলতে বলতে টুকুন দরজা ঠেলে ঘরের ভিতর গিয়ে দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে দিল।
একা একা স্কুটির ওপর চেপে ঋষি অপেক্ষা করতে লাগল। সামনের ডোবাটা সবুজ পানাতে ভর্তি। উল্টোদিকে আবার কয়েকটা পরিবারও থাকে, মিনিট দশ বারো পরে টুকুন বেরিয়ে এসে বলে, 'চল ঋষি। এখানকার কাজ শেষ।’
এবার আর ঋষি পিছনে না বসে চালাতে আরম্ভ করে। টুকুনও কিছু না বলে পিছনে বসেই বলে উঠল, 'বাজার চল।’ ঋষি পাড়ার রাস্তা ছেড়ে বড় রাস্তার মোড়ে উঠতেই স্কুটি দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করে, 'এবার বল কোথায় যাবে?
-তোমাদের মাছ বাজারে। যার বাড়ি গেছিলাম ঐ বাজারে মাছ বিক্রি করে।
-সেই পায়রা!
-হ্যাঁ, পায়রা।
-কিন্তু এখন মাছের বাজার বসবে কি?
-কটা বাজে এখন?
-আটটা পনেরো।
-না’গো, আরো মিনিট পনেরো অপেক্ষা করতে হবে।
-ঠিক আছে একটা চায়ের দোকানে বসি। ঋষি সঙ্গে সঙ্গে স্কুটি চালিয়ে একটু দূরে একটা চায়ের দোকানে বসে দু’কাপ চা আর বিস্কুট বলে। ঋষি চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিয়েই বলে উঠল, 'কি ব্যাপার একটু বলবে?’ একটা শ্বাস টেনে টুকুন উত্তর দিতে যাবে এমন সময় টুকুনের হাসবেন্ট ফোন করে। ফোনটা নিয়ে একটু দূরে গিয়ে কথা বলে কিছুক্ষণ পরেই দোকানে ফিরে আসতেই ঋষি জিজ্ঞেস করে, 'কি হল বল?’
-বলব, কিন্তু এখন নয়। আগে পায়রার সাথে দেখা করে আসি।
-আমাকে বলবে না?
টুকুন ঋষির কাঁধে হাত দিয়ে উত্তর দেয়, 'অপেক্ষা কর সব জানতে পারবে।’
মাছ বাজারের একটু আগেই টুকুন ঋষিকে স্কুটি থামাতে বলে। ঋষি আরেকটু বেশি ভিতরে যাবার কথা বলতেই টুকুন বলে ওঠে, 'এটা তোমার বাড়ির কাছে।সমস্যা আছে।’ তারপরেই তাড়াতাড়ি নিজেই মাছ বাজারের দিকে চলে যায়।
সেদিনেই সন্ধ্যার দিকে ঋষি আবার মাছবাজারে মাছ কিনতে গিয়ে চেনা জানা একজনের মাধ্যমে পায়রাকে চেনে, কিন্তু আর বিশেষ কিছু জানতে পারে না। বাজারের একটু শেষে ছোট দোকান। ভালো নাম ভোলানাথ দাশ। ঋষি মাছ কেনার পরে পায়রার দোকানেও যায়। খয়রা, বেলে লোটে, মাছ নিয়ে বসেছে। ঋষি আবার তার থেকে আড়াইশো খয়রা কেনে। পায়রার কাছে মাছ কেনার সময়েই আবার টুকুনের কথা মনে আসে। বাজার থেকে বেরিয়েই ফোন করে। উল্টে দিক থেকে উত্তর আসে, 'বল।’
-তুমি তো কিছু বললে না!
-আর একটু অপেক্ষা কর। খবর করছি। পোর্টালে দিয়ে দেব্
-তুমি বলবে না?
-পরশু তোমার বাড়ি যাব। তন্দ্রাকে নিয়ে একটু বেরোতে হবে।
-আবার পায়রা?
-না, এবার একটু নতুন বিউটি পার্লারের একটা কেস আছে। একটু বলে রেখ, বাদ দাও আমিই বলে দেব। আজকে একবার ফোন করতে হবে।
বাড়ি ফিরে সেদিন তন্দ্রাকে টুকুনের কথা গুলো জানাতেই জিজ্ঞেস করে, 'সেদিন তোমরা কোথায় বেরিয়েছিলে?’
-ঐ বাজারের দিকে একটা পল্লীতে গেছিলাম। পায়রা নামের একজনের বাড়ি।
-পায়রা!
- হ্যাঁ। বাজারে মাছ বিক্রি করে।লোকটার নাম পায়রা। তবে কেন গেছিলাম জানিনা। মনে হয়েছে বেশ সিরিয়াস।
-তুমি ও’সবে থেকোনা, ও কিন্তু বেশ ড্যাশি-বুশি। মনে আছে? সেই মেয়ে পাচারের কেসটা কেমন কভার করেছিল?
-এটাও ঐ ধরণের কিছু ব্যাপার। বলছে না কিছু দেখি ফোন করতে হবে। তবে মালটা সব সময় কি যে অতো ব্যস্ত থাকে ফোন করলেই বলে, 'একটু পরে করছি।পরে মানেই রাত বারোটা।’
ঋষির টুকুনকে বেশ ভালো লাগে। দারুণ এনারজেটিক, ভালো বন্ধুও। মোটামুটি ওকে ফলো করলেই সব খবরের আপডেট থাকে।
পরের দিন ভোরে ঋষিকে ঘুম থেকে তুলে তন্দ্রা বলে, ‘তুমি কাল কোথায় গেছিলে জানো?’
ঘুমের মধ্যেই ঋষি উত্তর দেয়, 'না, কেন বলো তো?’
-আমাদের এখান থেকেই একটি মেয়েকে কারা যেন তুলে নিয়ে গিয়ে অসভ্যতা করে ফেলে দিয়ে গোছিল। এই নবীন পল্লির নাম দেয়নি, তবে একটা পল্লির কথা বলেছে।
ঋষির ঘুম মাথায় ওঠে। জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি কিভাবে জানলে?’
-এই যে পোর্টালে দিয়েছে।
-এত সকালে?
ও’তো এই সময়েই দেয়। ঋষির কাছে একে একে সব ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়। তন্দ্রাকে কিছু বলে না। টুকুনকে ফোনে চেষ্টা করে পায় না। বিরক্ত লাগে, সাথে নিয়ে গেলেও কিচ্ছু বলে না। মনে মনে ঠিক করে নেয় আর কোন দিন এরকম ভাবে ডাকলে যাবে না।
দিন তিন পরেই এক দুপুরে ঋষি অফিসে থাকাকালীন তন্দ্রা ফোন করে বলে, 'টুকুনের কোন খবর জানো?’
-না’তো কেন?
-মাথা ফাটিয়েছে।
-তুমি জানলে কিভাবে?
-ফেসবুকে মাথায় ব্যান্ডেজ দেওয়া ছবি দিয়েছে।
ফোন রেখেই ঋষি টুকুনকে ফোন করে কি হল জিজ্ঞেস করতেই উত্তর দেয়, 'মাথা ফেটেছে।’
-কিভাবে?
-ও অনেক ব্যাপার, এক কথায় বলা যাবে না।
-কোথায় আছো? হসপিটাল!
-না বাড়িতে রেস্টে আছি। প্রণয়ও আমার জন্যে ছুটিতে আছে। তুমি সময় করে চলে আসতেই পারো।
আফিস করে বিকালের দিকে টুকুনের বাড়ি গিয়ে হাল্কা টিফিন আর চা এর কাপে চুমুক দিয়ে কি হল জিজ্ঞেস করতেই টুকুন বলে, 'পায়রাতে ঠুকরে দিয়েছে।’
-মানে!
-মানে হল, তোমাদের নতুন পল্লির ঐ যে মাছ বিক্রি করে, পায়রা, সমস্যা তো ওকে নিয়েই।
-ও আবার কি করল?
-ও কিছু করেনি। কিন্তু সমস্যা হয় ওর মেয়েকে নিয়ে, বয়স ঐ তেরো চৌদ্দ হবে। মেয়েটির কিছু ছেলে বন্ধু কোথাও নিয়ে চলে গিয়ে সর্বনাশ করে বাজারের মুখে একটা কালী মন্দিরের কাছে ফেলে দিয়ে যায়।
ঋষি চমকে ওঠে। ‘সে’কিগো! এতো বড় ঘটনা আর আমরা কিছু জানি না? তুমি তো এত কিছু লেখো নি।’
-শুধু তুমি কেন কেউই জানেনা। এতটা লেখাও যায় না।
-তুমি কি ভাবে জানলে?
-এটা খুব অদ্ভুত প্রশ্ন করলে। এটা আমার প্রফেশন আর আমি জানবো না? খুব চেষ্টা করেছিলাম যদি কিছু একটা করতে পারি, পুলিশে কেস করবার কথাও বলেছিলাম। কিন্তু এমন অবস্থা, মেয়েটির বাড়ি ভীষণ নন কো-অপারেটিভ। পুলিশের তরফ থেকেও চেষ্টা হয়, কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয় নি। মেয়েটিকে হাসপাতালেও পর্যন্ত নিয়ে যেতে দেয় নি।
-বাব্বা! এত সব আমি তো কিছুই জানিনা।
-জানবে কি ভাবে, ঐ পায়রা প্রথমে পুলিশের কাছে নাকি খুব লাফালাফি করে শেষ কালে চেপে যায়। আমিও অনেক চেষ্টা করি, তুমিও কিছুটা জানো, সেদিন সন্ধে বেলাতেও আবার যায়। তারপর খবরটা করবার পরে ওদের পাড়া থেকে আমার অফিসে কয়েক জন এসে হুজ্জত করতে আরম্ভ করে। ঠেলাঠেলির সময় পালাতে গিয়েই এই অবস্থা।
শেষের কথাগুলো বলেই টুকুন নিজের মাথার ব্যান্ডেজের দিকে আঙুল দেখায়। কিছুক্ষণের জন্য সবাই চুপ করে যায়। আচমকা একটা অন্ধকার চার দেওযাল ভেদ করে সবার সামনে হামলে পড়ে।কিছু সময় সবাই চুপ থাকবার পর ঋষি বলে ওঠে, ‘আমি তো ভাবতেই পারছি না, আর ঐ পায়রাটাই বা কি রকম লোক?’
-না’গো আসল ব্যাপারটা এক্কেবারে আলাদা। অন্য জায়গায় চলে গেছে, সেটা তুমি আমি বুঝবো না।
-প্রণয়ের বলা শেষ হতেই ঋষি টুকুনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, 'এবার কি করবে তুমি?’
-আমি! দেখি, তবে মেয়েটা নাবালিকা।