দোঁহা

নকশি কাঁথা

শমিতা অধ্বর্য্যু 

উত্তর কলকাতার এক ঘিঞ্জি অঞ্চল। যেখানে  ভরদুপুরে রিক্সাওয়ালা এখনো টুংটাং করে অদ্ভুত আবহ সংগীত রচনা করে। গতকাল প্রায় তিন বছর পর অনিমেষ দেশে ফিরেছে। 

এই অঞ্চল এখন কানাগলির আস্তাকুঁড় হয়ে উঠেছে। সেকেলে কলকাতার বাবুয়ানি নিভে যাওয়া আভিজাত্য দাম্ভিকতার চিহ্ন নিয়ে বিশাল বিশাল ইমারতের পাশে দাঁড়িয়ে আছে জীর্ণ কলিজার পুরনো স্থাপত্যের কিছু বাড়ি। তার তলায় বাস বিভিন্ন রকমের পেশার অনিকেত মানুষজনের। এরা- এরাই বোধহয় সমাজতত্ত্ব বহির্ভূত। আজ এই পাড়ার এমন একটা পড়ন্ত ভরা বনেদিয়ানার শেষ চিহ্নটুকু অবলম্বন করে "জলসাঘর" এর নায়কের মত দাঁড়িয়ে থাকা বাড়ির গাড়ি বারান্দার সামনে বহু মানুষের জটলা। গলির ভেতর দিয়ে  টানা রিক্সা টুং টাং শব্দ তুলে গদাই লস্করি চালে চলে গেল। 

ভিড় ঠেলে অনিমেষ সামনের দিকে এগিয়ে যায়। ও বাবা!! এ যে দারুণ একটা নকশি কাঁথা। কাঁথায় যিনি ফোঁর তুলেছেন তিনি আর নেই। এই গাড়ি বারান্দা ছিল তার ঠিকানা। তিনি কে ছিলেন, কি খেতেন, কি করতেন, ব্যাঙ্ক ব্যালান্স ছিল কিনা- এসব পরিচয় পত্র তার জন্য নিরর্থক। এককথায় হতদরিদ্র এক অসহায় বৃদ্ধা। অনিমেষ মনে করার চেষ্টা করে গত তিন বছর আগেও এখান দিয়ে যাতায়াতের সময় সে ওই বৃদ্ধাকে দেখেছে কিছু সেলাই করতে। ভেবেছে, পরনের কাপড় হয়তো সেলাই করছে। কিন্তু মাঝে মাঝেই চোখে পড়েছে তার সেলাই করার দৃশ্য। 

গাড়ি বারান্দায় বসবাসকারী কোন বিশেষ ব্যক্তির জন্য, স্বভাবতই কোন উৎসাহ কোনো দিন ও জাগেনি অনিমেষের। সামনে একটা বড় নকশি কাঁথা পাতা রয়েছে, তাতে ফুটে উঠেছে নানা রঙের সুতোর বুননে বুনোট ভালোবাসা। দেশের প্রতি ভালোবাসা, তবে ইনি স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন কি না জানা যায় না। 

অনিমেষ চেয়ে থাকে অনিমেষে। কাঁথায় ফুটে উঠেছে নীল আকাশ, সোনালী ধানের ক্ষেত। এ তো একজন নামী শিল্পী। শহীদের ফাঁসিতে মৃত্যুবরণ, তারপর দু ভাগ হওয়া দুটি ধান ক্ষেতের মাঝে একটি কাঁটাতারের বেড়া। লাল রঙের সুতোর ফোঁরে ফুটে উঠেছে রক্তের এলোমেলো হয়ে যাওয়া দাগ আর তারই মাঝে উঠছে তেরঙা পতাকা। সবশেষে  সুন্দর অক্ষরে লেখা "জয় হিন্দ"।

আশ্চর্য! উনি কি লেখাপড়া জানা একজন জাত শিল্পী ছিলেন? নকশি কাঁথার গল্প গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে আজ। আস্তে আস্তে এই মহান শিল্পকর্ম জাতীয় সম্পত্তির মর্যাদা পাবে বলে ঘোষণা করা হয়েছে। এবার  অনিমেষ পাকাপাকি সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাকি জীবনটা নিজের দেশেই থেকে যাবার। আর যাই হোক, অনিমেষ তো অনিকেত বা সম্বলহীন নন। অন্যমনস্ক ভাবে গাড়ি বারান্দার পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে সেই ক্ষ্যাপার সঙ্গে দেখা। এই গাড়ি বারান্দাই এর  নিবাস। এই গাড়ি বারান্দার আশেপাশে কি যেন খুঁজছে সে। এই প্রথমবার কৌতূহলী হয়ে ওঠে অনিমেষের মন। 

"ওহে, কি খুঁজছো এমন করে এদিক ওদিক।" চটজলদি ক্ষ্যাপার উত্তর, "সোনার কাঠি, রুপোর কাঠি।" অনিমেষ বলে, "আশ্চর্য ! এসব দিয়ে কি হবে?" ক্ষ্যাপা হেসে বলে, "সোনার কাঠির ছোঁয়ায় শীতল হয়ে যাওয়া ভালোবাসাকে জাগাবো আর রুপোর কাঠির ছোঁয়ায় মরা জোছনায় আলতো করে রুপোলি স্বপ্ন এঁকে দেবো।" 

এবার অনিমেষের বাকরুদ্ধ হওয়ার পালা। বৃদ্ধা আর নেই। চোখেরা সামনে ভেসে উঠছে নকশি কাঁথার অনন্য কারুকলা। মানুষের গোটা জীবনটাই  যেন  নকশি কাঁথার ফোঁর। ভালোবাসা, আশা, ভরসা, বিশ্বাসের রংয়ের জমাট বুনোটে  বাঁধা পড়ে আছে শৈল্পিক প্রেমময় এই জীবনে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন