দোঁহা

স্পিক! স্পিক! স্পিক!


প্রদীপ গুপ্ত

শেষ বিকেলে ছাদে গেছিলাম। দক্ষিণ দিক থেকে একটা বেশ মন উদাস করা হাওয়া। করোনা হোক আর যাই হোক, তাই বলে তো আর নিশ্চয়ই বসন্ত তার পথ ছেড়ে দেবে না অন্য কোনো ঋতুকে, বাড়ির সামনেই একটা ঝাঁকড়া মাথা রেনট্রি। তার বাঁ পাশে একটা সেগুন, নির্দিষ্ট দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে আছে। সেগুন গাছের মাথায়, একটা বুলবুলি এসে বসেই খানিক লেজ নাড়াতে নাড়াতে চিরিক পিরিক করে ডেকেই ফের উড়ে চলে গেলো দক্ষিণ দিকে। 

আমি একটা বিষয় খুব লক্ষ্য করেছি, এই সময়ে বা গ্রীষ্মকালের সন্ধ্যায় শালিখ পাখিরা কখনো জোড়ায় বা কখনো ঝাঁক বেঁধে দক্ষিণ থেকে উত্তরের দিকে উড়ে যায়। শীতেও যায় কিনা জানি না, শীতে খুব একটা খোলা ছাদের নীচে এসে দাঁড়াই না কখনও। সূর্য তখন রেনট্রির বুকের ভেতর। কে জানে কখন কী খেয়াল হবে, ওমনি ঝুপ করে ডুব দেবে পশ্চিমাসাগরে।

আচ্ছা, সূর্য এভাবে ডুব দেয় কেন? ছেলেবেলা বাবাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। বাবা বলেছিলেন, 'সারাদিন দৌড়ঝাঁপ করে ঘেমে গিয়ে সন্ধ্যাবেলা স্নান করতে নামে তোর মায়ের মতো।' পরক্ষণেই মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, 'ডুব দেয় না, আমরা পৃথিবীটার যে পিঠে আছি তার উল্টোপিঠে চলে যায়। একটু বড় হলে বুঝবি।'

এখন তো কতো বড় হয়েছি বাবা, এখন আমার মনে হয়, যেদিকেই যাক, ফিরে আসার উদগ্র কামনা নিয়েই বুঝি সবাই যায়। ফিরে আসবে কিনা সেটা না জেনেই এটা কামনা করে বুঝি - আবার যদি ফিরি তাহলে যেন -
তাহলে যেন কী! সেটা কী সবাই বুঝে বলে? আমার মনে হয় বেশীরভাগ সময়েই একটা আবেগে বলে যায় - যদি ফিরি ফের তাহলে যেন -

হঠাৎ রেনট্রি-টার ঝাঁকড়া মাথায় লুকিয়ে থাকা একটা নাম না জানা পাখি ডেকে উঠলো - 'স্পিক স্পিক স্পিক'
আমার হঠাৎ সে অসুখের দিনের কথা মনে পড়ে গেলো। একজন কেরলিয়ান নার্স কী অসীম মমতায় গালের ওপর আলতো চাটি দিয়ে বলে যাচ্ছিলো - 'স্পিক স্পিক স্পিক...'

আমি তো বলতেই চাই রে পাখি। কতো কথা, কতো ব্যথা, সুখ দুঃখ, হাসি গান, মান অপমান জমে আছে এই পাঁজরে। কিন্তু বলতে পারছি কই? বলতে গেলেই চিন্তায় পড়ি, কেউ কিছু ভাববে না তো, দুঃখ পাবে না তো কেউ! 
দিনে দিনে হালকা হচ্ছে শরীর। বৃদ্ধ হচ্ছি। এখন যেন বেশ বুঝতে পারি - এমন অনেক কথাই পাঁজরে নিয়ে চলে যেতে হবে, যেগুলো হয়তো বলা উচিত ছিলো, কিন্তু কোনোদিনও বলা হয়ে উঠবে না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন