অর্পিতা রায় চৌধুরী
তারিখটা আমার ঠিক মনে নেই, কারণ আমি মনে রাখতে চাইনি হয়ত। আমায় রাখাল খুড়োর দোকান থেকে কিনে নিয়ে এসেছিলে। আমার মোটেও ইচ্ছে করেনি তোমাদের সাথে আসতে। বন্ধুদের ছেড়ে আর রাখাল খুড়ো কে ছেড়ে আসতে! তোমরা আমায় নিয়ে অনেক দরদাম করেছিলে। আমার আসল কদর তোমরা সেদিনও করোনি আর আজও করোনা। তোমরা কি জানো? রাখাল খুড়োর মেয়ে অসুস্থ? তার জন্যে রোজ তাকে কত টাকা খরচা করতে হয় মেয়েটা কে শুধু বাঁচিয়ে রাখার জন্যে? তোমরা জানবে কেন? তোমরা এমন করে দরদাম করলে যে শেষ পর্যন্ত বুড়ো বাধ্য হয়ে খুব কম লাভ রেখে তোমাদের কাছে বিক্রি করে দিলো আমায়। তোমরা খুশি মনে বলেছিলে “দেখলি? বুড়ো,তাও লাভ করবে!” না তোমরা ওনার কষ্ট বুঝলে আর না তোমরা আমার কদর দিলে।
বাড়ি ফিরে একটা রঙিন দেয়ালে আমায় ঝুলিয়ে দিলে। তোমাদের মধ্যে কে যেন বলে উঠলো “একে বলে টেস্ট!” বলে সে নিজের ঘরে চলে গেলো। তোমরা বাকিরাও চলে গেলে। ঝুলে রইলাম আমি একা! সেদিন সারা রাত আমি একা একা পরে রইলাম। কেউ একবারও আমার কাছে এলে না। বন্ধুদের জন্যে ভীষণ মন খারাপ করেছিলো। মনে পড়ছিল রাখাল খুড়োর কথা। ওনার মেয়েটাকে দেখেছিলাম। একবার দোকানে এসেছিল। হাড় জিরজিরে চেহারা। চোখের তলায় খালি। রুগ্ন সেটা খুব বোঝা যায় তাকে একবার দেখলেই। বড্ড মায়া হয়েছিল তার জন্যে। ভেবেছিলাম আমি যেদিন বিক্রি হবো, সেদিন কিছু সাহায্য করতে পারব ওর। কিন্তু সেই তোমরা এমন দরদাম করলে যে, যা লাভ হলো তার থেকে লোকসান হলো বেশি।
পরের দিন ধুতি পড়া একটা মোটা লোক এলো, হাতে একটা ঝাড়ন নিয়ে। এসেই আমার দিকে তাকিয়ে দুম করে একটা প্রণাম করে নিজের মনে কি জানি বললো। বলে আমায় খুব যত্ন করে পরিষ্কার করতে শুরু করলো। তোমাদের মধ্যে কে জানি বলে উঠেছিল “বিমল! তাড়াতাড়ি কর! আরো অনেক কাজ পড়ে আছে যে!"
এভাবে এগোতে থাকে দিন। প্রতিদিন মোটা বিমল প্রণাম করে আর আপন মনে কি সব বলে। তারপর আমায় পরিষ্কার করে চলে যায়। তোমরা তো আমায় ভুলেই গেছো। মাঝে মধ্যে কোন অতিথি এলে, তারা তোমাদের আমার কথা মনে করিয়ে দিয়ে যায়। তারা চলে যেতেই আবার তোমরা আমায় ভুলে যাও। তোমাদের কাছে আমার কদর সেদিনও ছিল না আর আজ আমার দামটাও তোমাদের কাছে বড়ো কোনো ব্যাপার না। কারন আমি পুরোনো হয়ে গিয়েছি। আমার দাম উঠে গিয়েছে বলে হয়ত আর আমায় তোমাদের ভালো লাগেনা। কি জানি খুরোর রুগ্ন মেয়েটি কেমন আছে? আমার বন্ধুরা কাদের ঘরে বিকোলো? তাদের অবস্থা কেমন? আমারই মতো, না আমার চেয়েও মন্দ? সারাদিন একা একা পড়ে থাকি আর এসব নানান কথা ভাবি। মনে মনে বলি একটা ভূমিকম্প হোক আর আমি দেয়াল থেকে পড়ে গিয়ে ভেঙে যাই। এভাবে আর মন টেকে না। পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। ভেঙে যেতে ইচ্ছে করে!
এমনি একটা মনখারাপ করা সন্ধ্যে তে হঠাৎ কে জানি এলো তোমাদের বাড়িতে। হাতে একটা রঙিন বাক্স। তোমাদের মধ্যে এক জন কে জড়িয়ে ধরে বললো “কনগ্রাচুলেশন দিদিভাই!” যাকে বললো সেই মানুষটা খুব আহ্লাদী হয়ে ওঠে। অতিথি তার হাতে ধরিয়ে দেয় রঙিন বাক্সটা। বাক্স থেকে বেরিয়ে আসে একটা খুব সুন্দর পেইন্টিং। খুব উল্লসিত হয়ে খুব প্রশংসা করে সে উপহারটার। তারপর সে আমার দিকে এগিয়ে আসে। আমায় নামিয়ে দেয় দেয়াল থেকে। আমি পড়ে থাকি মেঝেতে আর দেয়ালে ঝোলে নতুন উপহার। আমি অবাঞ্ছিত। আমার সময় ফুরিয়েছে।
বিমল আমায় উঠিয়ে নিয়েছিলো পরের দিন সকালে। আমি এখন বিমলের ঘরের ছোট্ট দেয়ালে ঝুলে আছি। বিমল মাঝে মধ্যে আমার দিকে তাকায় আর সেই প্রতিদিনের মতোই প্রণাম করে। কি জানি কি সব বলে যায় নিজের মনে। আজকাল সে রোজ সকালে স্নান সেরে একটা নতুন জিনিস করছে দেখেছি। তাকে বলতে শুনি “গণেশ ঠাকুর, আমাকে একটা সুন্দরী বউ দাও! আমি রোজ তোমায় লাড্ডু খাওয়াবো!” কে গণেশ? কে ঠাকুর? এসব ও কি বলে ওই বোঝে। আমি ওর কথার অর্থ বুঝতে পারিনা। ফ্যাল ফ্যাল করে কেবলি ওর দিকে চেয়ে থাকি। ও এক গাল হেসে আবার কাজে চলে যায়। রোজ আমায় দেখছি নিয়ম করে পরিষ্কার করছে। সেটা অবশ্য ও আগেও করত। স্বযত্নে আমায় ধূপধুনো দিচ্ছে। মাঝে মাঝে আমাকে একটা লাড্ডু দেখিয়ে কি সব বিড়বিড় করে বলে আর নিজেই সেটা খেয়ে ফেলে। আমি কিছুই মাথা মুন্ডু বুঝতে পারছি না। বিমলটা কি পাগল হয়ে গেলো? রাখাল খুড়ো কে বললে হতো। খুড়ো একজন ডাক্তার বাবু কে চেনে। ওকে ওনার কাছে একবারটি নিয়ে গেলে হতো।
তবু বলব, তোমাদের দেয়াল থেকে ওর ছোট্ট দেয়াল ঢের ভালো। নাই বা বুঝলাম ওর কথার মানে। ও তবুও তো কথা বলতে আসে আমার সাথে। আমার দাম নিয়ে ওর কোনো মাথা ব্যাথা নেই। আমারও একটা কেমন রোমাঞ্চকর লাগে পুরো ব্যাপারটা। সত্যিই আগের চেয়ে অনেক ভালো আছি। তোমরাও আশাকরি ভালো আছো। নতুন উপহারটি কে আমার অসংখ্য ধন্যবাদ। কিন্তু খারাপ লাগে ওর জন্যে। ওই দেয়ালে একাকী ঝুলে থাকার কষ্টটা ও এখন পাচ্ছে। ও মনে মনে আমারই মতো নিশ্চয়ই ভূমিকম্পের প্রার্থনা করছে। ভেঙে পরতে চাইছে। আমি জানি। আমি ভুক্তভোগী। যাইহোক, আমি এখন একটু আরাম করব। তোমরা ভালো থেকো। চলি।