দোঁহা

গুয়ের্নিকা’র ছবি


অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
 
পাহাড়ের উপরে দাঁড়িয়েছিলাম। চার বছরের অপেক্ষা শেষে দাঁড়িয়েছিলাম। এই সময়ের ভিতরে যে কোনো মানুষ সম্পূর্ণরূপে বদলিয়ে যেতে পারে। সময় মানুষকে বদলে দেয়। সময় মানুষকে বদলিয়ে যেতে সাহায্য করে। এই পাহাড়টা আমার অচেনা। গৌহাটি শহর থেকে খানিক বেরুলেই রাস্তার একপাশে যে এমন একটি পাহাড় উঠে গেছে, সে না বলে দিলে জানতেই পারতুম না কোনোদিন। ভাগ্যিস সে বলেছিল। নইলে পৃথিবীর এই বিশেষ জায়গাটিকে কোনোভাবেই চেনা হতো না আমার। আমি তার কাছে কৃতজ্ঞ। চার বছরের এই অপেক্ষমানতা, আমাকে আবারও তার কাছাকাছি এনে দিয়েছে।

আমি একটা পাথরের উপরে বসেছিলাম। অনেক নীচেকার হাইওয়ে দিয়ে গাড়িগুলো যাতায়াত করছে। এখন বিকেল। সূর্যটা ঢলে পড়েছে, কিন্তু এখনও তার পাটে বসতে দেরী আছে খানিক। আমি মনে মনে চিন্তা করছিলাম। আমার সামনে আরও একটা পাথর। তার নীচে ঘাস গজিয়েছে। ঘাসের উপরে একটা ফুল। মাটিটুকুকে যেন ভেজা ভেজা লাগে। কিছুদিন আগে বৃষ্টি হয়ে গেছে। বাতাসে এখনও সোঁদা সোঁদা গন্ধটা ভেসে আছে। নাক টানলেই পাওয়া যায়। আমি তার কথা ভাবছিলাম।

এতবছরে সামান্যতম যোগাযোগ ছিল না। কেমন করে সম্পর্কটা ভেঙেছিল, সেই সব ইতিহাসও অতীতের আড়ালে চলে গিয়েছে। মনে করলেও, মনে পড়ে না সে সব। হাতের মোবাইলটাকে নিশ্চুপ অবস্থায় রেখেছি। বহুদিন হয়ে গেল নীরবতাকে উপলব্ধি করিনি। সম্পূর্ণ স্বাধীন এক নীরবতা। আজ সেই নীরবতাকে উপভোগ করব। আমার সামনেকার আকাশ, দিগন্তে গিয়ে মিশেছে। আমি আমার পকেটের মধ্যেকার জিনিসটাকে নিয়ে নাড়াচাড়া করি। অলস হয়ে পড়েছি। আমি আবারও দিগন্তের দিকে তাকাই।

নীচের পথ দিয়ে কারোর উঠে আসার শব্দ পেলাম। ভেজা পাতার উপর দিয়ে কেউ যেন উঠে আসছে। আমি ফিরে তাকালাম। চার বছরেরও পর, আবারও দেখলাম তাকে। চেহারাটা সেই একইরকম রয়েছে। একইরকমে ঋজু, তীক্ষ্ণ, একইসঙ্গে অদ্ভুৎ এক লালিত্যবোধে ঘেরা। কেবল চিত্রকরেরাই যে লালিত্যকে উপলব্ধি করতে পারে। ছবি আঁকত সে। এক জন্মদিনে আমাকে সে উপহার দিয়েছিল ভ্যান গগের ‘পোটাটো ইটার্স’। আমি তার কাছ থেকেই পিকাসোর ‘গুয়ের্নিকা’র ইতিহাস জেনেছিলাম। আমাকে প্রথম সে দেখিয়েছিল তারই নিজের হাতে আঁকা কয়েকটি স্কেচ। মানুষের দেহাবয়ব। নানাবিধ দৃষ্টিকোণ থেকে। যেমন সমস্ত দেহাবয়বকে দিয়েই পেশাদার চিত্রকরেদের হাতে-খড়ি’র অনুষ্ঠান হয় (বোধহয়)। এইসময়ে আমি আবারও কাব্যিক হয়ে পড়ছি। এইসময় কবিতার সময় নয়। সে উঠতে উঠতে আমার প্রায় সামনেটায় এসে পড়েছে। আমি আমার হাতটাকে বাড়িয়ে দিই। সে আমার হাত ধরল। স্পর্শসুখ।

-“ছবি আঁকছ তো?”, আমি জিজ্ঞেস করি।
-“আঁকা হয় না তেমন। সময় পাই না।” সে জবাব দেয়।

আমরা আবারও চুপ করে বসে থাকি। অল্প অল্প হাওয়া দিচ্ছে। নিস্তব্ধতার একটা সৌন্দর্য আছে। একটা শব্দ আছে। আমরা সেই সবকিছুকেই উপভোগ করছিলাম। দুজনে বেশ কাছাকাছি বসে আছি। কিন্তু স্পর্শ না করেই। দূরের ওই পাহাড়টার উপরে ক্রমশ সূর্যটাকে ঢলে পড়তে দেখছি। হাওয়াটা ক্রমশ ঠাণ্ডা হয়ে আসতে শুরু করেছে। এই তো সভ্যতা আমাদের। হঠাৎ করে যেন সমাজের বিশালত্বকে উপলব্ধি করি। সাতশো কোটি মানুষের বসবাস এই পৃথিবীতে। একে অপরকে কতটুকুই বা চিনেছি? মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলন ঘটতে ঘটতেই সময় পেরিয়ে যায়। আমরা পাশাপাশি বসবাস করি। চিনে উঠতে পারি না। স্পর্শ করতে পারি। অনুভব করি না। প্রত্যেক মানুষই প্রত্যেক অন্যজনকে কোনও না কোনও ভাবে প্রভাবিত করে। আশ্চর্য এক অনুরণন। সেই অনুরণনকেই ভালবাসা বলে বোধহয়।

এপ্রিল ১৯৩৭। নাৎসি জার্মানি আর ফ্যাসিস্ট ইতালির সৈন্যবাহিনী হামলা চালিয়েছিল স্পেনের বিস্কে প্রদেশের গুয়ের্নিকা অঞ্চলের উপর। জুন ১৯৩৭, পিকাসো আঁকলেন সেই গুয়ের্নিকার ছবি। পৃথিবী জুড়ে প্রচারিত হলো সে। যুদ্ধবিরোধী এক দলিল হিসেবে চিরতরে পৃথিবীর ইতিহাসে গুয়ের্নিকা’র ছবিটি ঠাঁই করে নিল। কিন্তু কই, হানাহানি তো থামল না। আমাদের যুদ্ধের প্রবৃত্তি যে নিভল না। প্রতিটা হিংসার মুহূর্তে আমার গুয়ের্নিকা’কে মনে পড়ে। শায়িত সেই সৈন্যটির হাতে ধরা ভাঙা তলোয়ারের অংশ। তারই ফাঁক দিয়ে উঁকি মারতে চেষ্টা করা, গাছের একটি ফুল। আমরা শিল্পের অভিব্যক্তিকে নিয়ে বেঁচে থাকি। সেই আমাদের ভালবাসার আরেক নাম। সে তার হাত দুখানিতে আমার একটি হাতকে কোনওভাবে বন্দী করেছে। আমিও তাকে ছাড়াতে চাইব না।

ভয়ানক একটা প্রতিশোধস্পৃহা জেগে ওঠে। ঠেলে ফেলে দিলেই তো হয়। নিজেকে, অথবা অন্য কেউ ...

সেও কি মনে মনে এমনটাই ভাবতে চেয়েছে? মৃত্যুর প্রতি মানুষের একটা অমোঘ টান কাজ করে। বিশেষত যারা অপেক্ষা করে আছে, তাদের ক্ষেত্রে তো বটেই। তারা মনে মনে শেষ হয়ে যেতে চায়। শেষ করে দিতেও চায়। কখনও তারা তাকিয়ে দেখে না, উজ্জ্বল সূর্যের ওইপাশেকার আকাশ।

পাহাড়ের উপরে দুইজনে পাশাপাশি বসে ছিল। একটি ছেলে ও একটি মেয়ে পাশাপাশি। গোধূলির আলোয় তারা কথা বলছিল। অথবা বলছিল না বোধহয়। খানিকদূর থেকে দেখলে মনে হবে, তাদের দুখানি শরীর যেন একে অপরের পাশ বেয়ে বেয়ে উঠে গিয়ে নতুন একটা কিছুর সৃষ্টি করেছে। তাদের উপরে আলো পড়েছে। তাদের ছায়া পড়েছে মাটির উপর। পৃথিবীতে যদি যুদ্ধের বিপরীতে কেবলই ভালবাসার কথা বলা যেত, তাহলে বোধহয় পৃথিবীটা - যেন বা ঠিক এদের দুজনকার মতোই, এদের দুজনকার সম্পর্কের মতোই সুন্দর হয়ে উঠত।

ঠেলে ফেলে দিলেই তো হয়। দুজনেরই কি একই সময়ে একই কথাকে মনে পড়ল? এমনটাও কি সম্ভব? নইলে দুজনেই কেন বা হঠাৎ একইসঙ্গে দাঁড়িয়ে উঠবে? আমিও তখন তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়েছি আমার প্রতিদ্বন্দ্বীর অভিমুখে। সেও দেখলাম অপলক তাকিয়েছে, আমার চোখে চোখ রেখেই। গৌহাটি শহরের উপর ঘন কালো হয়ে বিশাল একটা মেঘ জমে উঠেছে। ঝড় উঠবে বোধহয়। এই অপরূপ সৌন্দর্যের ভিতরে প্রচণ্ড যেন একটা হিংসার অভিব্যক্তি, যেন বা আমাদের দুজনকারই বুকের ভিতরে অজান্তে হাপরের মতোই ওঠানামা করতে শুরু করেছে। অনেক বছরকার যে অপেক্ষা, অনেক বছরকার যে অজ্ঞাত অস্তিত্বযাপন একে অপরের বিপরীতে, সেই সমস্তটুকুকেই যেন বা আগ্নেয়গিরির লাভাস্রোত হয়ে - আমরা দুজনেই দুজনকার শরীরের ভিতর দিয়ে, তাকে ক্রমশ উঠে আসতে অনুভব করেছি।

অস্ফূটে আমি বলি ‘জীবন’। অস্ফূটে সেও বলে ‘জীবন’। পাহাড় কাঁপিয়ে একটা গুলির শব্দ শোনা যায়।

গুলিবিদ্ধ দেহটা অনিশ্চিত অবস্থায় পড়েছিল। পাহাড় থেকে নীচে পড়তে পড়তেও তেমন একটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। পকেট থেকে হাতটা বেরিয়ে, ছড়িয়ে যেন বা ঠিক শিল্পীদের মতোই পড়েছিল মাটির উপর। সেই হাতের ভিতরে একটা শিশির উপস্থিতিকে লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। এখন সেই শিশিটা ছড়িয়ে পড়ে রয়েছে। সেই শিশির ভিতরে থাকা তরল পদার্থটিও ছিপি খুলে গিয়ে মাটির উপরে ছড়িয়ে পড়েছে। ঘাসগুলো যেন বা পুড়ে কুঁচকিয়ে গিয়েছে হঠাৎ। “এই পৃথিবীতে রণরক্তসফলতা সত্য।” অস্ফূটে পাহাড়ের উপর, কেউ বা যেন উচ্চারণ করে।

পাহাড়ের উপরে দাঁড়িয়েছিলাম। চার বছরের অপেক্ষা শেষে দাঁড়িয়েছিলাম। এই সময়ের ভিতরে যে কোনো মানুষ সম্পূর্ণরূপে বদলিয়ে যেতে পারে। সময় মানুষকে বদলে দেয়। সময় মানুষকে বদলিয়ে যেতে সাহায্য করে। এই পাহাড়টা আমার অচেনা। অনেকদূর থেকে গোধূলির আলোয় কয়েকজন মানুষ আমাদের দিকে তাকিয়ে দেখছিল। গোধূলির সময়টা ভারী সুন্দর। পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তেই এমনটা বোধ হয়। সূর্য ডুবে গেলেই ঝুপ করে যেন একটা শীত নেমে আসে হঠাৎ। সেই শীতলতার ভিতরে একটা আরামবোধ আছে। সমস্ত শরীর যেন নিজেকে সেই শীতলতায় চুবিয়ে নিতে থাকে। আমরা পাশাপাশি নেমে আসছিলাম। হাতে হাত রেখে নেমে আসছিলাম। এই পৃথিবীতে রণরক্তসফলতা সত্য। কিন্তু শেষ সত্য নয়। আমরা অস্ফূটে উচ্চারণ করি। আমাদের এতদিনকার যুদ্ধটাও এতদিনে পরিণতি পেল বোধহয়।

পথচলতি মানুষেরা সেদিন দেখেছিল, দুজন মানুষ দুজনের হাতে হাত রেখে পাহাড় থেকে নেমে আসছে।
পথচলতি মানুষেরা সেদিন দেখেছিল, দুজনেরই টি-শার্টের পিছনে গুয়ের্নিকা’র ছবি।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন