তানিয়া চক্রবর্তী
জীবনের সবচেয়ে স্বাভাবিক এবং আশ্চর্যতম সত্যি মৃত্যু। যখন জীবন জীবনকে বুঝতে শুরু করে তখন মৃত্যুর কথা জেনেও জীবন তার আধিপত্যের বেগে মৃত্যুকে তুচ্ছ করে দেয় কিম্বা বলা যায় এড়িয়ে যায়। কিন্তু মৃত্যু এত চতুর যে সে এই খেলায় অতর্কিতে আসে আর নিশ্চিত জিতে যায়। তবে যদি এরকম হয় মৃত্যুর প্রভাবে জীবন তুচ্ছ হয় আর সেই মৃত্যুকে জীবন নিজেই নির্ধারণ করে তখন আত্মহত্যার আক্ষরিক। তবে যাঁদের জীবন শুনে, দেখে আমরা ভাবিত হই সেই শিল্পী, সাহিত্যিক, দার্শনিকরাই যদি সহজাত মৃত্যুকে মিথ করে মৃত্যুকে নিজের হাতে নিয়ে আসেন! ভাবতে অবাক লাগে! কেন, কী এর কারণ? আত্মার হত্যা বা আত্মহত্যা নাকি মুক্তির বার্তা
“তারা আমাকে পাওয়ার চেষ্টা করেছিল...আমি তাদেরকে প্রথমে পেলাম”
- হ্যাঁ মৃত্যু সম্পর্কে এরমটা ভেবে জীবনের শেষে একটি নোটে এমনটাই লিখেছিলেন ভ্যাচেল লিন্ডসে। এই আমেরিকান কবিকে আধুনিক গীতিকবিতার জনক বলত গোটা আমেরিকা।
“Every man's life ends the same way. It is only the details of how he lived and how he died that distinguish one man from another.”
-Ernest Hemingway
নোবেলবিজয়ী সেই উপন্যাস দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি–এর লেখক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে। বন্দুকের নল নিজের মুখে ঢুকিয়ে নিজের হাতে ট্রিগারে চাপ দিলেন-শেষ হয়ে গেলেন কিংবদন্তী লেখক,মতান্তরে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যিনি নিজেই ছিলেন এক যোদ্ধা। শেষ জীবনের চূড়ান্ত অস্থিরতার কারণেও হয়ত তিনি এদিকে এগোলেন কিম্বা যার কারণ আমরা শুধুই ধারণা করব বুঝতে পারব না। শোনা যায় তাঁর চার স্ত্রী–এর কেউই তার সঙ্গে সুখি ছিলেন না। মেয়েদের প্রতি এমনিও নাকি তার বিজাতীয় বিরাগ ছিল। তাঁর জীবনীকার জানিয়েছেন পরিবারগত একটি বিষয় ছিল, কারণ তাদের পরিবারের সকলেই প্রায়েই পথের মানুষ; তাঁর বাবা, বোন এবং ভাই এরা সকলেই আত্মহত্যার অনুগামী। হেমিংওয়ে তাঁর মাকেও ঘৃণা করতেন। বোধ করি তাঁর এই বোধ কোনো সম্পর্কেই তাকে থিতু হতে দেয়নি ফলে জীবন বিভীষিকার মতো অস্থির তাঁর কাছে।
“I am rooted, but I flow.”
-Virginia Woolf
এরকম লাইন যাঁর তার মৃত্যুও কাব্যিক। টু দ্য লাইটহাউসের লেখিকা জীবনের শেষ চিঠিতে লিখছেন আমি অনুভব করছি যে আমি আবার পাগল হয়ে যাচ্ছি - এই লেখিকা যিনি বলছেন নারী তুমি যখন ফিকশন লিখবে তখন তার একটি কক্ষ আর অর্থ প্রয়োজন হবে অবশ্যই। এই কবি ওভারকোটের পকেটে নুড়ি ভরতে ভরতে নদীর কাছে নিজেকে এগিয়ে দিলেন, সমপর্ণ করলেন মৃত্যুর কাছে ৫৯ বছরের বয়সে। যিনি লেখাকে বলেছিলেন সেক্স। সেই দুর্দমনীয় লেখিকা জলে জড়িয়ে গেলেন মৃত্যুকে হাতে নিয়ে।
ইউকিও মিশিমা জাপানের প্রখ্যাত লেখক, অভিনেতা, নাট্যকার আরো কত কী একজীবনেই তিনি। কিন্ত চূড়ান্ত জটিল জীবন ছিল তার, তাঁর পিতাই তাঁর লেখা সহ্য করতে পারতেন না। লেখা দেখলেই তা নষ্ট করে দিতেন। পরবর্তীতে তিনি রাজনৈতিক দ্বন্দ্বর মধ্যে ঢুকে পড়েন কিন্তু তার মৃত্যু ছিল সাহসিকতার। সমঝোতায় না যাওয়া কিম্বা নিজের সূত্রে অনড় থাকার জন্যই তিনি নিজের পেটে ধারালো অস্ত্র ঢুকিয়ে হত্যা করেন নিজেকে।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে আর ফিরলেন না কবি, তিনি ক্যারিন বোয়ি। জীবনবোধে জর্জরিত কবি সম্পর্কে অসুখী ছিলেন। প্রচুর ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি।
আরেক অপূর্ব ভাষ্যের কবি সিলভিয়া প্লাথ - নিজের জন্য ভয়াবহ মৃত্যু বেছে নিয়েছিলেন, গ্যাস ওভেনে নিজের মাথা ঢুকিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দেন। ফ্রিডা ও নিকোলাস নামে দুই সন্তানের মা - একজন মা, এক স্ত্রী, এক প্রেমিকা, এক বোদ্ধা কবি কোন আঙ্গিকের মানুষ সেদিন আত্মহত্যা করেছিলেন আমরা বুঝব না। তবু জানি নিজেকে জেতাতে গিয়ে এনারা হয়ত জীবন হারিয়ে ফেলেছেন। আসলে গেম থেকে কুইট করা একটা হার কিম্বা এটাও হতে পারে গেমটাকেই তারা হারিয়ে দিয়েছেন! আসলে যাঁর জীবন সেই জীবন প্রাপ্ত না হলে বাকি সবটাই তো আপেক্ষিক কিম্বা ধারণা।
মাত্র ছেচল্লিশ বছর বয়সে প্রেমে ব্যর্থ এক কবি আত্মহত্যা করলেন, তিনি কথাসাহিত্যিক ফোস্টার ওয়ালেস, প্রেমে পড়েছিলেন কবি মেরি কারের। তাঁর নাম নিজের গায়ে ট্যাটু করে এঁকেছিলেন। ইংরেজি সাহিত্যের সর্বকালের সেরা ১০০ বই এর মধ্যে তাঁর বই –এর স্থান হয়। গ্যারেজের মধ্যে দড়িতে গলায় ফাঁস দিয়ে তিনি আত্মহত্যা করেন।
নোবেলবিজয়ী মহিলা কবি অ্যানি সেক্সটন সমস্ত খ্যাতি পেয়েও অস্থির ও বিপর্যস্ত থাকতেন। বহুবার চেষ্টার পরে শেষ অবধি নিজের গাড়িতে কার্বন-মনো-অক্সাইড ছেড়ে আত্মহত্যা করেন।
মায়াকোভস্কি রুশ সাহিত্য ও বিপ্লবে যিনি রাজার মতো পথিকৃৎ, সেই উজ্জ্বল কবি সম্পর্কের টানাপোড়েনে ছিটকে গিয়ে নিজেকে গুলিবিদ্ধ করে আত্মহত্যা করেন।
বাবা আত্মহত্যা করেছিলেন, তার পর মা আবার বিবাহ করেছিলেন। জন ব্যরিম্যান এরকম ভাঙন থেকে এসেছিলেন। বিশ্বজোড়া খ্যাতি পেয়েও কবি বুঝেছিলেন এখানে তেমন কিছু নেই তার মতো করে। ১৯৭২ সালে ওয়াশিংটনের এভিনিউ ব্রিজ থেকে প্রায় ৯০ ফুট নীচে মিসিসিপি নদীতে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন কবি।
ফ্রান্সের নাট্যকার নিকোলাস ক্যামফোর্ট নিজেকে গুলিবিদ্ধ করে ব্যর্থ হন মৃত্যুর কাছে তারপর ছুরিকাঘাতে নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করেন। আসলে জেলে যাওয়া থেকে মুক্তি পেতেই তিনি এই পথ বেছে নেন। নিজের জীবনের কাছে নিজে সমর্পন করা বোধ করি মানতে পারতেন কিন্তু সমাজের কাছে নিজেকে প্রতিষ্ঠা না করাতে পারলেই এনারা হতাশাপ্রবণ হয়ে উঠেছেন হয়তবা।
জন্মেছিলেন সাউথ আফ্রিকায়, তার সিলেক্টেড পোয়েমস মানুষের ভালবাসার। মাত্র ৩১ বছর বয়সে সমুদ্রের জলে নিজেকে বিলীন করে আত্মহত্যা করেন ইনগ্রিড জংকার।
উর্দু লেখক শ্যামস আঘা যদিও খুব পরিচিত লেখক নন তবুও তিনি যে অসম্ভব প্রতিভাসম্পন্ন লেখক ছিলেন তা লেখকমহল জানে। বিচ্ছেদকামী বাবা মা এর থেকে তিনিও আলাদাই থাকতেন। ১৯৪৫ সাল নাগাদ তিনি হারিয়ে যান। দীর্ঘদিন তার লুপ্ত থাকার কারণে ধরে নেওয়া হয় তিনি মৃত, পরে তাকে পাওয়া গেলেও তিনি সেইসময় ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন।
উর্দু ও পাঞ্জাবি ভাষার বিশিষ্ট কবি সরভত হুসেন প্রেমে ব্যর্থ ও একাকীত্বের কাঠামোকে ভেদ করে ট্রেনলাইনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। শোনা যায়, ট্রেন, ট্রেনলাইন-এই গতি ও তাঁর পথ সম্পর্কে তার একটা আসক্তি ছিল। প্রথম আত্মহত্যার মুহূর্তে তাঁর পা হারিয়ে যায়। তিনি এখানেই বসে থাকেন না , পরে আবার ট্রেন লাইনে ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যু সুনিশ্চিত করেন।
কার্ট কোবেন বলেছিলেন, “ If you die you're completely happy and your soul somewhere lives on. I'm not afraid of dying. Total peace after death, becoming someone else is the best hope I've got.”
“Truth sits upon the lips of dying men."
-Matthew Arnold
সক্রেটিস বলেছিলেন মৃত্যু আসলে জীবনের বৈপরীত্য আর সেটা খুব জৈবিক আর দৃশ্যমান। ফলে এটা নিয়ে আমরা ভাবিত, ক্লিষ্ট। এর বাইরে একটা অদৃশ্য অভূতপূর্ব খেলা আছে, যেটা প্রজ্ঞার খেলা।
এত বিশিষ্ট মানুষেরা কেন মৃত্যুর কাছে এত এগিয়ে গেছেন, শুধুই কী অস্বাভাবিকতা নাকি এর ভেতরে জীবন থেকে মৃত্যুর পথে যাওয়ার অন্য কোনো ইঙ্গিত তারা পেয়েছিলেন। আসলে জৈব আধানের মধ্যে নিবিষ্ট আমরা যতটুকু দেখা যায় তা নিয়েই তো ভাবি - ছকের দাবার মেঝেতে সাদা আর কালো... এই চলন্ত প্রাণের ছক তো সেই জীবন ও মৃত্যুর মধ্যে সীমাবদ্ধ।
মৃত্যু তো আসবেই, চাইলেও না চাইলেও। চাওয়া আর না চাওয়া দুজনের মিউচুয়্যাল সমর্থক মৃত্যু। সময় নির্ধারিত নয় ফলে এই জীবন খেলায় ভরপুর সাসপেন্স সে রাখতে জানে। জন্ম যেমন ক্ষণ জানে, জানান দেয় আসার কথা ফলে সতর্ক থাকা যায়। মৃত্যু কিন্তু খুব চালাক সে এসবে নেই। আচ্ছা যাঁরা আত্মহত্যা করে তারা কী জীবনের কাছে হেরে যায়? কিন্তু সে যদি জেতা-হারার খেলার কথা নাই ভাবে কেবল যদি পরিশ্রান্ত হয় জীবনের কাছে, যে প্রাণ সে এনেছে তাকে সে নিজেই আর বহন করতে না পারে। আমরা কাজের ক্ষেত্রেও তো স্বেচ্ছা অবসর নিয়ে থাকি। মৃত্যুর অধিকারে আমরা অধিকারী নই তাই লুকিয়ে জীবনকে বিপর্যস্ত করে মানুষকে পৃথিবী ছাড়তে হয়। ফলস্বরুপই বোধ হয় ইউথেনেশিয়া বা মার্সি কিলিং এর আগমন হতে শুরু করে। যাই হোক এই প্রসঙ্গে আমরা আবার পরে কখনো আসব। এখানে প্রধানত সেইসব মানুষদের নিয়ে আলোচনা করব যাদের জীবন দেখার পদ্ধতি একটু আলাদা অর্থাৎ জীবনকে যারা সৃষ্টির মাধুর্যে ভরিয়ে রেখেছেন তারাও মৃত্যুকে সময়ের আগে আসতে বাধ্য করেছেন! কেন করেছেন? তাঁরা একটা নিজস্ব পৃথিবীতে আলোকিত এই আধিপত্যে কোনো প্রতিবন্ধকতাই তারা মেনে নিতে পারেননি। তাই বোধ হয় এই পথ বেছে নিয়েছেন তারা। আমেরিকার বিশিষ্ট কার্টুনিষ্ট জ্যাকসন যিনি জন্মেছিলেন ১৯৪১ সালের ১৫ই মে। ৬৫ বছর বয়সে যখন তিনি জানতে পারেন তার প্রস্টেটে ক্যান্সার ধরা পড়েছে তখন তিনি আত্মহত্যা করেন। এরপর আসা যাক রালফ বার্টনের কথায়, আমেরিকায় এই কার্টুনিস্ট সেলিব্রিটিদের চিত্র এঁকে বিখ্যাত হয়েছিলেন কিন্তু মাত্র ৩৯ বছর বয়সে তিনি তার পেন্টহাউসে আত্মহত্যা করেন নিজেই নিজেকে গুলিবিদ্ধ করে। তিনি তার সুইসাইড নোটে লিখেছিলেন “যাকে ভালবেসেছি তাকে হারিয়েছি আরো লিখেছেন আমি সামান্য কষ্ট পেয়েছি, প্রচুর বন্ধু ও সাফল্য পেয়েছি, প্রচুর দেশে ঘুরেছি কিন্তু এক স্ত্রী থেকে আরেক স্ত্রীর কাছে এক ঘর থেকে আরেক ঘরে যেতে আর ২৪ ঘণ্টা নতুন সৃষ্টির অন্বেষণে আমি হতাশাগ্রস্থ।"
হারমান ব্রুড (১৯৪৬-২০০১) যাকে দিয়েই “রক এন রোল স্টার” কথাটার পর্যায় আসে। ১৯৭০ /১৯৮০ তে চূড়ান্ত বাণিজ্যিক সফলতা পেয়েছিল তার সঙ্গীত। যদিও ড্রাগ আর মদের নেশায় তিনি নিমজ্জিত ছিলেন পরে সেটা সংযমে রাখতে না পেরে ৫৪ বছর বয়সে হিলটন হোটেল থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন এবং তার সুইসাইড নোটে লিখে যান “পার্টি অন, আমি তোমাদের দেখতে পাবই।”
শাকিব জালালি এই পাকিস্তানি লেখক আলিগড়ের বাসিন্দা। উর্দু এই কবি মাত্র ৩২ বছর বয়সে নিজেকে সরিয়ে নেন পৃথিবীর যাবতীয় আলো থেকে। যখন ১৯৪৭ সাল তখন ওনার বয়স মাত্র পনেরো তখন থেকে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন।
জন প্যাট্রিক এই বিশিষ্ট নাট্যকার তার অনবদ্য সব নাটকের স্ক্রিপ্ট লিখতে লিখতে কখন ফিল্মের স্ক্রিপ্ট রাইটার হয়ে গেলেন। যাই হোক জীবনের সব সাফল্যমন্ডিত পর্বের পরও প্যাট্রিককে তার ঘরে প্লাস্টিকে মাথা আবদ্ধ অবস্থায় পাওয়া যায়, ৯০ বছর বয়সে জীবনের এই মৃত্যুকে তিনি চেয়েছিলেন।
অগাস্টিনা অ্যান্ড্রেড জেনারেশন ১৯৮০ তে সবচেয়ে প্রশংসা পেয়েছিলেন। বিবাহিত জীবনের চূড়ান্ত দ্বিধা, স্বামীর পলিগ্যামি স্বভাব তাকে জীবনবিমুখ করে দেয়। তিনি তার সন্তান রেখেই আত্মহত্যা করেন।
ইউথেনেশিয়া এরপরে মানুষের জীবনের বোধ করি অপরিহার্য বিষয় না হলেও বিষয় হয়ে উঠতে থাকে। এনারা কেউ শহীদ হননি কিন্তু মৃত্যু এদের কাছে অসময়ে এসেছে। এনারাই একে আহ্বান করেছেন। শুধুই কী মানসিক বিকার, যন্ত্রণা! না তা নয় আসলে জীবন একটা রূপকের হেলদোল তার মাত্রা বিভিন্ন ধাত্রে ভিন্ন। সেখানে জীবনকে জীবন বলা কিম্বা মৃত্যুকে মৃত্যু বলা খুব সহজতর নয়।ইচ্ছামৃত্যু বা মার্সি কিলিং নিয়ে এর পরে কথা বলব।
জীবনের যে মৃত্যুকে আমরা বরণ করি সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু স্বাভাবিকতাকে চাবুক দিয়ে টেনে নিজের ভেতরে বসিয়ে দিলে সে জীবন নিয়ন্ত্রণ করতে শিখে যায়। সেটা সবসময় খুব ইতিবাচক তা কিন্তু নয় কিন্তু এটা নেতিবাচক হলেও একটা ক্ষমতা। বোধ করি তাই অসমসাহসী লেখকদের বীরের মতো অনেকে মৃত্যুকে টেনেছে।
"জাপান দ্য বিউটিফুল মাইসেলফ” - এর নোবেলবিজয়ী লেখক (জাপানি) ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা, যিনি আত্মহত্যা ও আত্মহননের ভাবনা নিয়ে তীব্রভাবে চিন্তিত ছিলেন। বলতেন কেউ কী আছে যে একবারও আত্মহননের কথা ভাবেনি! তিনি নিজেই কার্বন মনোক্সাইড বিষে আত্মহত্যা করেন।
আইরিশ চিত্রশিল্পী রয়্যাল আকাদেমির ছাত্র থমাস ফস্টার। যাঁর অপূর্ব সৃষ্টি মিস ট্রি। তিনিও নিজে হাতেই নিজেকে ১৮২৬ সালে হত্যা করেন।
যদিও যে মৃত্যুর কথা এখন বলব তা নিয়ে বিতর্ক আছে যে এটা তিনি আদৌ করেছেন নাকি তাকে হত্যা করা হয়েছে।তিনি হলেন ভিনসেন্ট ভ্যান গগ, যাঁর ছবি সম্পর্কে নতুন করে বলা বাতুলতা মাত্র! বন্দুকের গুলিতেই তার মৃত্যু হয়।
আমেরিকার সবচেয়ে আধুনিক চিত্রশিল্পী আলফ্রেড হেনরী মুর যার ছবি বর্তমানে এক বিস্ময় তিনিও বেছে ছিলেন আত্মহত্যার পথ।
হার্ট ক্রেন আমেরিকার কবিদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর দ্য ব্রিজের কথা অজানা নয় পাঠকদের। তবে নিজের জীবন নিয়ে জর্জরিত ও অস্থির ছিলেন ক্রেন। তার শেষ সময়ের সম্পর্ক থেকে উৎপত্তি হয় দ্য ব্রোকেন টাওয়ার এর। বিভিন্ন অভিযোগ, যৌন সম্পর্কে দ্বিরূপতা নিয়ে বিদ্ধ হওয়ার ফলে জর্জরিত ক্রেন ঝাঁপ দিয়েছিলেন মেক্সিকোর সমুদ্রে, তাঁর দেহ আর পাওয়া যায় নি। তবে প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন তার শেষ বাক্য ছিল “গুডবাই, এভ্রিবডি।"
সুইডিশ লেখক হ্যারি মার্টিনসন। যিনি ১৯৪৯ সালে সুইডিশ পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত হন। তিনি যুগ্ম ভাবে অন্য লেখকের সঙ্গে নোবেল পেয়েছেন। কিন্তু এর প্রাপ্তিটা ভরপুর বিতর্কিত ছিল। অনুভূতিপ্রবণ হ্যারি বিতর্ক সহ্য করতে পারতেন না ফলে এক অদ্ভুত হত্যা মৃত্যু তিনি বরণ করেন নিজেই ছুরিকাঘাতে নিজের দেহ ছিহ্ন করে প্রাণ নেন।
মিরিট কোহেন যার জন্ম রাশিয়াই হলেও তিনি ছিলেন ইজরায়েল -এর শিল্পী। জীবনের অপূর্ব শিল্প মুহূর্ত বাদ দিলে কিছু মুহূর্তে এল এস ডি –এর প্রভাবে তিনি চিকিৎসাধীন ছিলেন। পরে তিনি আমেরিকার এক বড় বাড়ির ছাদ থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন।
জীবন এক নিছক খেলা নয়, এটা একটা শর্তসাপেক্ষ ধৈর্য্য –এর খেলা। "মরণ রে তুঁহু মম শ্যাম সমান" - এটা জীবনে লাঘু করা বোধ করি খুব সহজ নয় সে ইচ্ছে বা অনিচ্ছে যার প্রাধান্যই বেশী থাক না কেন!
আমাদের ঘরটাকে যেমন আমরা জ্বালিয়ে প্রতিভাপূর্ণ করি। দেহের ভেতরে প্রাণও তাই। তাই যেখানে প্রাণ নেই সেখান থেকেই আমাদের ভয়, কষ্ট শুরু হয়। একটা জ্যান্ত দেহেও যদি আমরা স্পন্দনের ছোঁয়া না পাই বলি মুখটা মরা মরা হয়ে গেছে প্রাণ নেই। কবিতা, সিনেমা, জীবন, প্রেম সবেতেই আমরা প্রলুব্ধ গতি চাই আর প্রাণ ভেসে ওঠে। প্রাণ পেলেই আমরা আলোকে ধরে রাখতি পারি। এই বুদ্ধিজীবী লেখকরাও মৃত্যু বেছেছেন কিন্তু যতক্ষণ ছিলেন ততদিন সৃষ্টি এগিয়ে এসেছে। আসুন প্রাণের দিকে মুখ করে বসার চেষ্টা করি যতটা পারি, একটা যন্ত্রণা বা যুদ্ধেরও প্রাণ থাকে; যার প্রাণ থাকে সে তো এমনিতেই জিতে গেল তার আর হার কী - তবু এটাই সিদ্ধান্ত বলব না কারণ কোন অভাববোধ থেকে এই ইচ্ছা জাগে যার জাগেনি সে বুঝবে না। সে অবশ্যি ভাগ্যবান কারণ সে জীবন আবার খেলার সুযোগ পেল। তবু আমরা আর একটু চেষ্টা করি জীবনের দিক থেকে মৃত্যুকে দেখার...
“Dogs do not have many advantages over people, but one of them is extremely important: euthanasia is not forbidden by law in their case; animals have the right to a merciful death.”
-Milan Kundera
জীবন আর জীবনের তাগিদ এই দুটোর সমতা এবং তার ব্যবহারযোগ্য উপকরণের ওপর নিয়ন্ত্রণ একটা জীবনের গতিকে নির্বাহ করে কিন্তু জীবন যদি জীবনের কাছেই ভার স্বরূপ হয়ে আসে । মানে যা সমস্যা তা সমস্যা নয় তা একটি বোঝা, যা জীবন তা জীবন নয় ফলে ব্যক্তি ছুটি চাইতে শুরু করে। অবশ্য সবক্ষেত্রে এই বোধের অধিকারীও এক নন এই বোধও এক নয়। তবে আত্মহত্যা বা মার্সি কিলিং এর আক্ষরিক প্রয়োগ এক নয়। কারণ আত্মহত্যা এক নিভৃতের গঠন আর মার্সি কিলিং বা ইচ্ছা মৃত্যু বা ইউথ্যানাশিয়া সম্মতিক্রমে নিষ্কৃতি নেওয়া যা কারো অগোচরে নয় তাই এর ফরমায়েশি নাম “ডেথ উইথ ডিগনিটি।"
খুব বেশীদূর যেতে হবে নয়া, হিন্দিতে একটি ছবি হয়, ছবিটির নাম –গুজারিশ। সঞ্জয় লীলা বনশালীর ছবি। অভিনয়ে ঋত্বিক রোশন পক্ষাঘাতে আক্রান্ত। কেবল মুখ ছাড়া বাকি সব অংশই তার অবশ। সে একসময় এক বিশিষ্ট জাদুকর ছিল, বন্ধুর প্রতিহিংসায় তার দুর্ঘটনা হয় এবং দীর্ঘদিন তিনি এইভাবে রয়েছেন এবং শেষ পর্যন্ত তিনি ইউথ্যানাশিয়ার দাবি রাখেন। যদিও তা পূর্ণ হয় না গল্পের দিক ঘুরে যায়। কিন্তু কোন অবস্থা কোন অভিব্যক্তি থেকে এই ইচ্ছে আসে তা স্পষ্ট ভাবে এখানে দেখানো হয়েছে। এই কার্যের অধিকারকে ফলপ্রসূ করতে বিদেশে এক প্রতিষ্ঠানমূলওকে এজেন্ডা আছে “ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অফ রাইট টু ডাই সোসাইটিজ।" যেখানে প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন মানুষ আত্মহত্যা করে সেখানে ইচ্ছামৃত্যু কার্যকারণ দিক দিয়ে কতটা অভিঘাতপূর্ণ তা নিয়ে তর্ক আছে, থাকবে।জাপান, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, নিউজিল্যান্ড এইসব দেশে বিভিন্ন শর্তসাপেক্ষে ইউথ্যানাশিয়াকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। সে এক শান্তির ওষুধ যা প্রয়োগে শান্তির মৃত্যু গ্রহণ করা যায়। সেই বিশিষ্ট ওষুধের নাম “সোডিয়াম পেন্টোবার্বিটাল।" এরই মধ্যে এই মৃত্যুকে সহযোগিতা করতে “ডিগনিটাস” ক্লিনিকের জনপ্রিয়তা বেড়েছে। সুইটজারল্যান্ডে ২০০৮ সাল থেকে ২০১২ সালের মধ্যে বিশ্বের প্রায় ৩১টি দেশ থেকে ৬১১ জন ইচ্ছামৃত্যু বরণ করতে আসে। তবে এটা সত্যি শুধুমাত্র ভাল না লাগা বা খামখেয়ালিপনায় মৃত্যুর দাবি কোথাই গ্রাহ্য নয়। সাধারণত দেখা গেছে নিউরোন ডিজিজ, পার্কিনসন ডিজিজ এসবে মৃত্যুর প্রতি ইচ্ছে কে বাড়িয়ে তোলে। সুইটজারল্যান্ডে সুইসাইড টুরিজ্যম খুব জনপ্রিয় হলেও এই নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। পরিবারের সকলে জানছে নিকটতমর মৃত্যু হচ্ছে, ফলে একটা শুদ্ধ একতা কাউন্টডাউনের প্রক্রিয়াকরণ একসঙ্গে মরণকামী ও তার আশপাশে চলতে থাকে।
হুগো ক্লাউস একজন বিখ্যাত বেলজিয়াম লেখক, কবি এবং ছবিনির্মাতা। তার মৃত্যু ইউথ্যানাশিয়ার মাধ্যমে হয় এবং সেটা ছিল সেই সময়ের এক বিশেষ বিতর্ক। তাঁর মতো উন্নত মস্তিষ্কের এক মানুষের যখন অ্যালজাইমার্স হয় তখন তিনি ইচ্ছামৃত্যুর আবেদন করেন, এবং ২০০৮ সালে ৭৯ বছর বয়সে ইউথ্যানাশিয়া দ্বারা তার মৃত্যু ঘটে। অ্যানি এম জি বিখ্যাত ডাচ লেখিকা, ছোটদের জন্য লেখায় তাকে রানি আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। তার ৮৪ বছর বয়সের পর তার ভেতর থেকে অনুভূতি আসে মৃত্যু যাপনের তিনি পিল নেওয়া শুরু করেন এবং ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে চলে যান। হার্বার্ট ফাক্স একজন বিশিষ্ট অস্ট্রিয়ান অভিনেতা, জীবদ্দশায় তার ফিল্মে অভিনয়ের সংখ্যা ১৪০টি। তিনি ভিলেনের চরিত্রে বেশী জনপ্রিয় ছিলেন, ৭৯ বছরে সুইডিশ আইন প্রনালীকে মেনে তিনি ইউথ্যানাশিয়ার মাধ্যমে মৃত্যুকে গ্রহণ করেন। এইসকল সেলিব্রিটির কথা কেন বললাম কারণ জীবনের বিশেষ মুহূর্তে সংস্পর্শ পেয়েও জীবনকে তাদের দামি মনে হয়নি। তার জীবনের আধিপত্য বা সৌন্দর্যকে কাটিয়ে বেরিয়ে গেছেন জীবনেরই কারণে।
গ্রীসে প্রথম ইউথ্যানাশিয়ার ভাবনার প্রভাব আসে। সক্রেটিস হেমলক পান করার ব্যাপারে প্লেটো, সেনেকা এদেরও সম্মতি ছিল। কিন্তু হিপোক্রেটিস এর বিরোধিতা করেছেন। আসলে ভল্যান্টারি ইউথেনেশিয়া একটা একটা সম্মতিক্রমের মৃত্যু। আর ইনভল্যান্টারিতে ব্যক্তির ইচ্ছে খুব গুরুত্বের নয়। ভারতে সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী “প্যাসিভ ইউথ্যানেশিয়া (পরিপূরক –এর সরবরাহ বন্ধ করা যখন জীবন জটিলতম পর্যায়ে, যথা কোমা)। দীর্ঘদিন কোমায় আছেন এরকম ব্যাক্তির ক্ষেত্রে বেশ কিছু প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে ইউথ্যানাশিয়াকে সম্মতি দেওয়া যেতে পারে। ইউথেনেশিয়া কথার অর্থ হল ভাল মৃত্যু। যুক্তরাষ্ট্রের পাঁচটি রাজ্য, বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ এ সাধারণত রোগভিত্তিক কারণে এই ভলন্ট্যারি ইউথ্যানাশিয়া স্থান পায়। আর তাছাড়া সুইটজারল্যান্ডের মৃত্যু সম্পর্কিত ভ্রমণ, আসলে যারা তাদের দেশের মধ্যে এই সুবিধা পাচ্ছে না তারা এখানে এসে এটি গ্রহণ করেছে।
এই নিয়ে তর্ক বিতর্ক থাকা স্বাভাবিক, আমরা জানি আমাদের আগমন স্বাভাবিক এবং নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু মৃত্যুতে আমাদের হাত আর অধিকার দুটোই সাধারণত নেই। নিজের জীবন নিজের নেওয়ার অধিকারও আমাদের নেই, বাস্তবিক এটা খুব বড় সত্যি যে যেহেতু জীবনের মুহূর্ত অনন্ত নয়! আর স্বাভাবিক কারণেই তার মৃত্যু ঘটে ফলে জীবনকে শেষ করা দেওয়া খুব ইতিবাচক নয়। তবে এটাও তো সত্যি যে জীবন জীবনের মানেই উপলব্ধি করতে পারছে না তার কাছে জীবন তো মৃত্যুর সামিল, ফলত রুগ্ন, জর্জরিত মানুষের ক্ষেত্রে এটা সম্যক চাহিদা হতেই পারে। এখন যদি নেতিবাচক অপরাধমূলক দিকের কথা ভাবি তাহলে বলতে হয় পৃথিবীটাই বিপরীতধর্মী সেখানে শুধু ভাল কখনো একা থাকতে পারে না। তবে একটা ভাল নিয়মের প্রয়াস শুরু হতেই পারেই যদি তা দিয়ে জীবনকে সম্মান করা যায়।
