দোঁহা

জেতবন ও অনাথপিন্ডক

 


অভিষেক  চট্টোপাধ্যায়

শ্রাবস্তীর নামী শ্রেষ্ঠী সুদত্ত। নাম ছড়িয়ে রয়েছে সারা জম্মুদ্বীপে। গান্ধার থেকে শুরু করে মগধ, অবন্তী কোথায় নেই তাঁর বাণিজ্যের সূত্রে যাতায়াত। ঠিক যতটা তাঁর আয় তা বোধহয় আর কারোরই নেই  পুরো  শ্রাবস্তীতে। শুধু শ্রাবস্তী কেন পুরো কোশলেই তাঁর সম্পদের কাছাকাছি সম্ভবত আর কেউই নেই। কোশলরাজ প্রসেনজিৎ এর অনুরোধে মগধ থেকে অনেক ধনী শ্রেষ্ঠী কোশলে এলেও সুদত্তের অবস্থান টলানো বোধহয় অসম্ভবই রয়ে গিয়েছে। ধনঞ্জয় শ্রেষ্ঠী বা  মিগারের নাম সমসাময়িক গ্রন্থগুলিতে পাওয়া গেলেও সুদত্ত-র শ্রেষ্ঠত্ব অন্য জায়গায়। সে দুঃখীর সম্বল। অর্জিত অর্থের প্রায় অনেকটাই তাঁর নিত্য ব্যয় দারিদ্রপীড়িত জনগণের মুখে দু'মুঠো অন্নের জোগান দেওয়ার জন্য। তাই সে  অনাথপিণ্ডক। অনাথ, অসহায়ের মুখে খাদ্যের ব্যবস্থা করা এক গৃহী...তাই এমন নাম l  

 সেই অনাথপিণ্ডক তাঁর জ্ঞাতির ঘরে গিয়েছেন কোন বিশেষ প্রয়োজনে। স্থান মগধের রাজধানী রাজগৃহ। তথাগত তখন অবস্থান করছেন গিরিব্রজেই। আত্মীয়ের কাছে বুদ্ধের নাম শুনেই বিশেষ কৌতূহল হল অনাথপিণ্ডকের। একটু অবাকই হলেন শ্রেষ্ঠী। যে গৃহে এলে তাকে নিয়ে রীতিমত হুড়োহুড়ি পড়ে যেত, যাতে তাঁর কোন অবহেলা না হয়, সেখানে যেন তার দিকে তাকানোর ফুরসতই নেই গৃহকর্তার। খানিকটা মজা করেই বললেন তিনি, যেন দেখেশুনে মনে হচ্ছে বাড়িতে মগধরাজ বিম্বিসার আমন্ত্রিত। আর তখনই জানতে পারলেন আমন্ত্রিত ব্যক্তি মগধরাজ নন বরং এক শ্রমণ, যিনি আজকাল রাজগৃহের সীতবনে অবস্থানরত। নাম বুদ্ধ। বুদ্ধ...নামটার মধ্যেই বোধহয় সেই  মায়া ছিল। অবশ্য বুদ্ধত্ত্ব অর্জনের বিষয়ে অনাথপিণ্ডকের মনে খানিকটা সংশয়ও ছিল হয়তো। কিন্তু যাইহোক প্রবল একটা  আকর্ষণ ধীরেধীরে দুর্দমনীয় হয়ে উঠল। জানতে পারলেন তিনি আসবেন সেখানে নিমন্ত্রণ রক্ষায়। কিন্তু তাও যেন এক অলৌকিক টান অনুভব করতে লাগলেন  তখন থেকেই। রাত যেন আর কাটছেই না। কখন রাতের তমিস্রা কাটবে আর দেখা পাবেন সেই আলোকিত মহাপুরুষের সেই চিন্তায় দু'চোখের পাতা স্থির করতে পারলেন না শ্রেষ্ঠী। বারবার জানলার বাইরে দেখতে লাগলেন রাতের অবসানের অপেক্ষায়। কিন্তু না! রাত যেন আর শেষই হচ্ছেনা, ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটল বণিকের, বেড়িয়ে পড়লেন সেই মহামানবের সন্ধানে। কিন্তু সেই অন্ধকার রাতে কি করে পৌঁছবেন অচেনা নগরপথে। রাজগৃহ তো আর তাঁর শ্রাবস্তী নয়... হাঁটতে লাগলেন সুদত্ত। আশ্চর্য! হেঁটেই চলেছেন তিনি। যেন কোন মহাশক্তির আশ্চর্য টানে এগিয়ে চলেছেন লক্ষ্যের দিকে। অবিচল পদচারণায় যখন পৌঁছেছেন ততক্ষনে পূর্বাকাশে রঙের খেলা শুরু হয়ে গিয়েছে। সীতবনে পৌঁছে গেলেন অনাথপিণ্ডক স্বপ্নাদেশ পাওয়া মানুষের মত। কিন্তু কোথায় কী? কী করে খুঁজে পাবেন তিনি সেই  মহামানবের সন্ধান! আবার যখন সংশয়ের ঘেরাটোপে বন্দি বণিক  ফিরে যাওয়ার কথা চিন্তা করছেন এমন সময় শুনলেন সেই উদাত্ত কণ্ঠস্বর... “সুদত্ত এসো!" কিন্তু এই নামে এখানে কে  ডাকতে পারে? অবাক সুদত্ত দেখলেন এক অনিন্দ্যসুন্দর শ্রমণ দাঁড়িয়ে রয়েছেন সামনে! না এতক্ষন দেখেননি  তাকে, তাহলে... বুঝতে বাকি রইল না আর কিছু। ইনিই সেই  বুদ্ধ... তথাগত ! প্রণত হলেন সুদত্ত। বিস্ময়ের বিহ্বলতা কাটলে জানতে চাইলেন জীবনের বহু আকাঙ্খিত সেই সব না জানা প্রশ্ন, যার উল্লেখ রয়েছে বৌদ্ধগ্রন্থের পাতায় পাতায়। শুরু হল এক নতুন অধ্যায়ের। বিস্মিত সুদত্ত পেলেন ধর্মের এক নতুন ব্যাখ্যান যা তাকে নিয়ে গেল বিশ্বাসের এক চরম মার্গে কিন্তু তাঁকে তো ফিরে যেতে হবে আবার কোশল রাজধানী  শ্রাবস্তীতে। কী করে সে দেখা করবে তথাগতের সাথে? তাহলে উপায়? আবার আজকের পর থেকে তথাগতের সাথে দেখা না হলেও তো চলবে না। আমন্ত্রণ জানালেন ভগবানকে তার আতিথেয়তা গ্রহণের জন্য শ্রাবস্তীতে একবার অন্তত আসতে। রাজী হলেন বুদ্ধ...শুরু  হল শ্রাবস্তী পর্বের।

 
বুদ্ধকে আমন্ত্রণ তো জানিয়ে এলেন কিন্তু  তার থাকার ব্যবস্থা কী হবে সেই চিন্তায় অনাথপিণ্ডকের ঘুম উড়েই গেল। বুদ্ধের জন্য নিরিবিলি ও একান্তে সময় কাটানোর জন্য স্থান নির্বাচন করতে গিয়ে রীতিমতো সমস্যায় পড়লেন শ্রেষ্ঠী সুদত্ত। দেখেন অনেক জায়গাই, কিন্তু মনে ধরেনা। অবশেষে একটা জায়গা পছন্দ হলেও তা নিয়ে বাঁধলো মহাগোল। নির্বাচিত স্থানটি আবার রাজকুমার জেতের পছন্দের জায়গা, তার বাগান, যা জেতবন নামে পরিচিত।  


যাইহোক স্থান যখন তথাগতের থাকার জন্য মনোনীত করা হয়েই গেছে তখন আর পিছু হঠার প্রশ্নই নেই। সংবাদ পৌঁছল রাজকুমার জেতের কাছে। কিন্তু বেঁকে বসলেন তিনি। কোনোভাবেই রাজী নন। তখন সুদত্ত কিনে নিতে চাইলেন পুরো ভূমিটি। জেতও দেখলেন পাশ কাটানোর এই একমাত্র সুযোগ। এমন মূল্য স্থির করতে হবে যা হবে সুদত্তর আয়ত্তের বাইরে। বললেন পুরো প্রাঙ্গন স্বর্ণমুদ্রায় যদি ঢেকে দেওয়া যায় তবেই তিনি তা  হাতছাড়া করতে পারেন। সুদত্ত তো এককথায় রাজী। তিনিও এমনই সুযোগ চাইছিলেন। কেটে ফেলা হল সবরকমের গাছ রয়ে গেল শুধু কয়েকটা আম আর চন্দনগাছ। একের পর এক গরুর গাড়ি বোঝাই হয়ে আসতে থাকলো স্বর্ণমুদ্রা পুরাণ... একেরপর এক গাড়ি ভর্তি পুরাণ এসেই যাচ্ছে আর ঢেলে দেওয়া  হচ্ছে জেতবনের প্রাঙ্গনে। অবিশ্বাস্য মুগ্ধতায় হতবাক রাজকুমার জেত ও তাঁর ইয়ার-বন্ধুদের চোখ ততক্ষনে কপালে! আরে, করছে কী লোকটা! এতো বড় একটা প্রাঙ্গন যা কিনা তারা হেঁটে শেষ করতে পারেননা পুরোটা তা কিনা নিজের সারাজীবনের সঞ্চয় দিয়ে ঢেকে দিতে চাইছে। অবাক রাজকুমার হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। বিস্ময়ে তাঁর হাত গালে চলে  গেল ( সূত্র: ভারহুত রেলিফ)। নিশ্চয়ই  শ্রমণের মধ্যে বিশেষ কিছু আছে তবে কিনা সুদত্তর মত এক অভিজ্ঞ শ্রেষ্ঠী তাঁর সারা জীবনের উপার্জন এরকমভাবে বিলিয়ে দিচ্ছে একটা প্রাঙ্গন ক্রয় করার জন্য। কিছুটা হতাশাও গ্রাস করল তাকে। যে আত্মশ্লাঘায় জেতবন স্বর্ণমুদ্রায় ঢেকে দেওয়ার কথা বলেছিলেন তাতো উল্টো হয়ে গেল উপরন্তু এক অদ্ভুত বিষণ্ণতাও গ্রাস করছে তাকে। এদিকে অনাথপিণ্ডকের আনা গাড়ি গুলির সমস্ত স্বর্ণমুদ্রা উপুড় করে দিয়েও কিছুটা স্থান ফাঁকা রয়ে গেল। এবার আসরে  নামলেন জেত। কিছুটা জমি যা তখনো ঢাকতে বাকি ছিল তার মূল্য মুকুব করলেন আর তার উপর নির্মাণ করলেন এক সুদৃশ্য প্রবেশদ্বার। নির্মিত হল শ্রাবস্তীর গর্ব জেতবন। এবার বহু অর্থ ব্যয় করে শুরু হল তৎকালীন ভারতবর্ষের সবথেকে আকর্ষণীয় বৌদ্ধবিহার এবং ভিক্ষুসংঘ নির্মাণ। জেতবন মহাবিহার। সারা ভারতের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের প্রধান তীর্থভূমি। বুদ্ধের আদেশে জেতবন বিহার বর্ণিত হল “অনাথপিন্ডিকারামা" যেখানে বুদ্ধ কাটালেন উনিশটি বর্ষাবাস।

 জেতবন বিহার সম্পর্কে জানার আগে অনাথপিণ্ডক সম্পর্কে দু'এক কথা না জানলে তা ঠিক হবেনা। তাই সৃষ্টির আগে স্রষ্টা সেই নীতিতে যদি অনাথপিণ্ডকের দিকে লক্ষ্য করি তবে দু'একটা তথ্য আগেই দেওয়া হয়েছে, যেমন তার পূর্বনাম বা তার বিপুল পরিমান বাণিজ্যসম্ভারের কথা। তাঁর নিযুক্ত সার্থবাহদের দেশের প্রায় সর্বত্র বাণিজ্যের সূত্রে যাতায়াত জেতবন বিহারকে বিশেষভাবে সকলের সামনে তুলে ধরে। আরো বড় ব্যাপার হল বুদ্ধের দীর্ঘসময় ধরে জেতবনে বসবাস। অনাথপিণ্ডক যখন জেতবন বিহার নির্মাণ শুরু করেন তখন তিনি রীতিমতো সংসারী ছিলেন। কিন্তু তাঁর স্ত্রী কোনোভাবেই তার দানধ্যানের বিরোধিতা তো করেনইনি বরং তাঁর  প্রচ্ছন্ন একটা সায় ছিল। ইতিহাসে অনাথপিণ্ডক যে গুরুত্ব পান তার খুব  অল্প অংশই হয়তো তাঁর স্ত্রীর জন্য বরাদ্দ হয়েছে। এটা অবশ্য খুব আশ্চর্যের নয়, ইতিহাস এরকম বহুক্ষেত্রেই নীরবতা পালন করেছে। যাইহোক, বিভিন্ন পালি গ্রন্থাবলী থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী অনাথপিণ্ডকের স্ত্রী ছিলেন পুন্যলক্ষ্যন। ধম্ম পালনে স্বামীর যথার্থ সহধর্মিনী ছিলেন তিনি। শ্রাবস্তীর জেতবন বিহারের নিকটেই শ্রেষ্ঠী অনাথপিণ্ডকের সপ্তমঞ্জিল গৃহের দ্বার সর্বদা উন্মুক্ত ছিল দীন, অভূক্তদের জন্য। আর সেই কাজের দায়িত্ব নিষ্ঠাভরে পালন করতেন পুন্যলক্ষন। কখনো সেই দ্বার কারোর জন্য বন্ধ হয়নি। সাংসারিক জীবনে অনাথপিণ্ডক ছিলেন দুই কন্যা এবং এক পুত্রের পিতা। জ্যেষ্ঠ কন্যার সুবিবাহ সম্পন্ন হলেও কনিষ্ঠ কন্যার মৃত্যু খুব অল্প বয়সে ঘটে। আর তার ফলে সমস্ত স্নেহ ভালোবাসা উপুড় করে পড়ে একমাত্র পুত্রের উপর। ফল, পুত্রের বিপথে গমন। অনাথপিণ্ডক স্থির করলেন পুত্রের বিবাহ দেবেন। কন্যা হিসেবে নির্বাচন করলেন বিখ্যাত শ্রেষ্ঠীপুত্র ধনঞ্জয়ের কনিষ্ঠা কন্যা সুজাতাকে। সুজাতার অবশ্য একটা অন্য পরিচয়ও ছিল। সে ছিল বিশিষ্ট উপাসিকা বিশাখার ভগ্নী। কিন্তু বিবাহের পর থেকেই সুজাতা পতিগৃহে সম্ভবত সুখী ছিলেন না। তার ফল স্বামী, শ্বশুরের বিরুদ্ধাচারণ। পরে অবশ্য তথাগতের পরামর্শে সে সমস্যা দূর হয়, সুজাতা বাধ্য বধূতে রূপান্তরিত হন।


অনাথপিণ্ডক শুধুমাত্র জেতবন বিহার শুধু নির্মাণই করেননি, বিহারের সকলপ্রকার রক্ষণাবেক্ষনের দায়িত্বও নিজের কাঁধে তুলে নেন। বিহারবাসী সমস্ত ভিক্ষুদের যাবতীয় দায়িত্ব, খরচ দায়িত্ব সহকারে সামলাতে থাকেন। অতিরিক্ত খরচের ফল যা হওয়ার তাই হল। অমনোযোগিতার কারণে দ্রুতই লোকসান গ্রাস করে তার বাণিজ্যে আর ফলে একটা সময় অর্থকষ্টে পড়েন তিনি। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রতিদিন দু'বেলা তথাগতের দর্শনের সময় কিছু না কিছু হাতে  করে নিয়ে যেতে তিনি কখনো ভুলতেন না। এমনকি যখন বুদ্ধ পরিব্রাজনে ব্যস্ত থাকতেন তখনো তিনি নিয়মিত বিহারে যেতেন এবং অপর ভিক্ষুদের স্বাচ্ছন্দের দিকে নজর রাখতেন।


বুদ্ধের দীর্ঘ বসবাস কালে শ্রাবস্তীবাসীরা বুদ্ধের সাথে দেখা করতে, তার উপদেশ, ধম্মের ব্যাখ্যান শুনতে উপস্থিত হতেন। কিন্তু বুদ্ধের অনুপস্থিতিতে কোন এক প্রতীক না থাকার ফলে তাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পন করতে তারা নিতান্তই বিড়ম্বনায় পড়তেন। অনাথপিণ্ডক সে ব্যাপারে অগ্রসেবক আনন্দের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। আনন্দ বিষয়টি বুঝলেন, কিন্তু সেখানে অসুবিধাও রয়েছে বিস্তর। কারণ বুদ্ধের নিজের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পনে আপত্তি ছিল। অনেক চিন্তাভাবনার পর বোধিবৃক্ষের একটি চারা বিহার প্রাঙ্গনে রোপন করা হল..."আনন্দবোধিবৃক্ষ" নামে পরিচিত সেই বৃক্ষটি তথাগতের প্রতীকরূপে তার অনুপস্থিতিতে পূজিত হতে লাগল।




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন