দোঁহা

উত্তর কলকাতার গলিখুঁজি

 

  

অর্ণব বসু


বড়ো হওয়া মফঃস্বলে। কলকাতার কাছাকাছি। ফলে খুব ছোট থেকেই কলকাতায় যাতায়াত ছিল। তাই শহরকে আগলানোর একটা ইচ্ছে বরাবর। পেরছি কি? ছবির জন্য বেঁচে থাকা না বেঁচে থাকার জন্য ছবি তা ভাবতে ভাবতেই জীবনের নানা বাঁকে ভিজুয়াল আর্টের চর্চা একপ্রকার অবশ্যাম্ভাবী আশ্রয় হয়ে দাঁড়াল। উত্তর কলকাতা জুড়ে হাজারো গলির মধ্যে হেঁটে যেতে যেতে বারংবার মনে হয়েছে যেন সেইসব রাস্তা, গলি, ইঁট যেন এক-একটি দীর্ঘ উপন্যাস।

 
করোনা পর্বে শহরকে খুব অদ্ভুত ভাবে দেখেছি। সে দেখার মধ্যে খানিক ভয় ছিল, খানিক উৎকন্ঠা, খানিক হারিয়ে ফেলা। বহু কাছের মানুষের চলে যাওয়া, ক্রমশ ফাঁকা হয়ে যাওয়া রাস্তাঘাট, আমফানের প্রভাবে কলেজপাড়ায় ক্ষতি হয়ে যাওয়া বহু দোকান এসব মিলে গত দু বছর কম ওলট পালট হয়নি।





উত্তর কলকাতার কথা বলতে গিয়ে মনে পড়ে যায় প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা "উত্তর কলকাতার কবিতা"। এই শহরের উত্তর প্রান্তে কত কী ঘটে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত, ভেসে চলা নদী, মানুষ, পাখি যেন অনন্তের কাছে একপ্রকার নিশ্চিত সঁপে দেওয়া নিজেকে। অথচ এই শহরের জরা, ব্যাধি, মৃত্যুকে একের পর এক সামাল দিয়েছে গঙ্গা, তার ধারণক্ষমতা অসীম!  
 




মনে পড়ে রথীন মিত্রের স্কেচ, আমিও হয়ত শহরকে খানিক সেভাবেই দেখতে চেয়ছি। যেন উঠে আসা এক দীর্ঘ গাছের পুরোন শিকড় আজন্মকাল গেঁড়ে আছে শহরে, এই দুঃসময়ে সে গাছ যেন জীবনের একমাত্র আশ্রয়। তার কোটরে ছড়িয়ে রয়েছে শহরের কত গোপন কথা, আর সেসব পেরিয়ে আমরা হেঁটে যাই আরও উত্তরে আহিরিটোলার দিকে...



 
শহরে বেশ কিছু ঘাট আছে, যেখানে মানুষের আনাগোনা তুলনামূলক ভাবে কম। সেসব ঘাট দেখে মনে হয়ে যাদু দেখানোর মঞ্চ। দূরে দাঁড়ানো কিছু দর্শক। মঞ্চে এক অদৃশ্য যাদুকর, যার হাতে মায়াকাঠি, গোটা শহরকে সারিয়ে তুলবে একটু একটু করে।
 



শহর ঘুরতে ঘুরতে দরজার প্রতি এক অমোঘ টান অনুভব করি। কতদিনের পুরোনো চাঁদমালা ঝুলে রয়েছে নীল দরজার মাথায়, খানিক স্বপ্নের মত মনে হয়। যেন কাছে গেলেই ভেঙে যাবে ঘুম...



 
যেটুকু শহর, সেটুকু বিশ্বাস। যেটুকু বিশ্বাস, সেটুকু মায়া। আর এই মায়ার চাদর বুনে চলা এক বেড়াল শুয়ে থাকে জানলার গায়ে, আমোদিত রোদ বেড়ালের গায়ে এসে পড়ে। সে রোদে শহর ঝিকমিক করে, চোখ ঝলসে যায় আলোয়, যেন ছুঁয়ে ফেললেই প্রেম হয়ে যাবে শহরের সাথে।




 
টেলার্সের দোকান। জামাকাপড়ে জোড়া লাগানো হয়, দেখি করোনায় সর্বস্ব খুইয়ে আসা এক বৃদ্ধ যার জীবনে কোনো সুতো নেই, জোড়া লাগানোর মত। সে দোকান- মালিকের সহায়ক, দরজার পাশে বসে হাওয়া খেলে যায় তার পায়ের পর...




কুমোরটুলি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে পড়ে, গত দুবছর পুজো হয়নি, তার বায়না হয়নি। কত কত মাটি গলে পড়ল, রঙ নষ্ট হল, ভেঙে গেলো সংসার। সংসারের ভেতর হু হু হাওয়া বয়ে যায়, শূণ্য চেয়ার পড়ে থাকে কুমোরটুলির বুকের ভেতর!




রোদ এসে পড়ে পায়ের কাছে, জীবন যেরকম! ঘরের ভেতর বন্ধ হয়ে আসে ঘর, সে দরজা আর খোলে না! মুখ দেখাদিখি নেই, এক আশ্চর্য আধা আলো-অন্ধকারে এক নতুন দৃশ্য দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়ে শহর...




শহর সেরে ওঠে, যেভাবে আলো-গাছ। স্বপ্নের ভেতর থেকে কে যেন হাতড়ে নেয় নতুন জীবন! আর সে জীবনে রঙ আসে, আসে বেঁচে থাকার নতুন ইচ্ছে। উত্তর ঘিরে এই হেঁটে চলা, এই খুঁজে চলে এক অসীম ইচ্ছে, যা কখনো পূরণ হবে না!



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন