দোঁহা

বিজ্ঞানশিক্ষার প্রসারে রবীন্দ্রনাথ


অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়

সাহিত্য সংসদের ‘সংসদ বাঙ্গালা অভিধান’-এর চতুর্থ সংস্করণের একবিংশতিতম মুদ্রণে ‘বিজ্ঞান’ শব্দের অর্থ হিসাবে বলা হচ্ছে যে, “ঈশ্বরানুভব, অপরোক্ষ জ্ঞান, বিশেষ জ্ঞান বা তত্ত্বজ্ঞান – নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও গবেষণার ফলে কোনও বিষয়ে ক্রম অনুসারে লব্ধ জ্ঞান বা সায়েন্স – উদাহরণস্বরূপ পদার্থবিজ্ঞান বা মনোবিজ্ঞান এমনকি শিল্পাদির শাস্ত্র বা সঙ্গীতবিজ্ঞান” – ব্যাপারটিকে বেশ ভালোরকমেই জটিল করে তোলা গেলো। এ বরং থাক। আমরা বরং সাদা অর্থে বিজ্ঞান বলতে যা বুঝি তাতেই ফিরে আসি। বিজ্ঞান অর্থে বিশেষ ভাবে জীবনবিজ্ঞান ও প্রকৃতিবিজ্ঞান – মূলত পদার্থ বিজ্ঞান বা রসায়ন। আরও একটু মূলগত ভাবে ভাবলে – বিভিন্ন প্রাকৃতিক ঘটনাবলীকে পর্যবেক্ষণ এবং যুক্তির দ্বারা সে সমস্ত ঘটনাবলীর ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ – এইগুলিই হলো বিজ্ঞানের প্রথম ও প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ। এইবিষয়ে রবীন্দ্রনাথের যে অবদান – সেইটিই আমার বলবার বিষয়।

রবীন্দ্রনাথ নিজে, এবং পরবর্তীতে বহু বিশিষ্ট রবীন্দ্র-গবেষক ও সমালোচক পণ্ডিতেরাও এই বিষয়ে আক্ষেপ করেছেন যে – গীতিকার এবং কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পাশ্চাত্যের কাছে বিশেষ ভাবেই একটি আধ্যাত্মিক গুরু-মার্কা চেয়ারে আসীন হয়ে রইলেন। উপনিষদের কবিকেই তাঁরা বরণ করে নিলেন। তাঁদের কাছে কবি চিরটাকালই হয়ে রইলেন, মিষ্টিক-গোষ্ঠীভুক্ত একজন চারণ-কবি অথবা সন্তসুলভ ব্যক্তিত্ব। অথচ, বাস্তবে যে রবীন্দ্রনাথ সম্পূর্ণ ভাবেই মাটির কাছাকাছি – যুক্তির কাছাকাছি থেকেছেন – একটি ভাষাকে তিলে তিলে রূপ দিয়েছেন, শিক্ষা এবং শিক্ষাপদ্ধতি বিষয়ে মনোজ্ঞ অবদান রেখে গিয়েছেন – সেগুলি সেসময়ে তাঁদের চোখে পড়তে পারেনি। হয়তো বা রবীন্দ্রনাথকে বাংলা ভাষাতেই পড়া দরকার, তাঁর সম্পূর্ণতাটুকুকে বুঝে নেবার প্রয়োজনেই।

বিজ্ঞানশিক্ষক রবীন্দ্রনাথ বা বিজ্ঞানশিক্ষার প্রসারে রবীন্দ্রনাথ – এই মূল বক্তব্যটিকে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা চলে। যথাক্রমে আদি পর্ব – অর্থাৎ যেখানে আমরা পাই প্রাবন্ধিক রবীন্দ্রনাথকে, বিশেষ ভাবে একটা সময়ে তিনি পরের পর বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ লিখেছেন – অনেকটা সাংবাদিকতার ঢঙেই – সময়কাল মোটামুটি ভাবে ১৮৭৮ থেকে ১৮৯৫। পরবর্তীতে, বিশ্বভারতীর রবীন্দ্রনাথ – যেখানে তিনি প্রায় বলা যেতে পারে একটি শিক্ষা-আন্দোলন গড়ে তুলতে চাইছেন, নিজে নেতৃত্ব দিচ্ছেন – এবং বিজ্ঞান থেকে শুরু করে পল্লী-পুনর্গঠন প্রভৃতি নানা বিষয়ে আধুনিক চিন্তা ও নতুনত্ব ধারণার প্রয়োগ ঘটাচ্ছেন। এবং সর্বোপরি জীবনসায়াহ্নে এসে রচনা করছেন ‘বিশ্বপরিচয়’। এই প্রতিটি ক্ষেত্রকে, আমি একে একে আজকের বক্তৃতাটির মাধ্যমে তুলে ধরতে চাইবো। কাজেই প্রথম আমরা দেখবো ১৮৭৮ – প্রবন্ধের নাম, ‘সামুদ্রিক জীব’ – লেখকের নাম শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সেসময়ের ‘ভারতী’ পত্রিকাতে প্রকাশিত। রসসৃষ্টির কারণে প্রবন্ধটির সূচনাংশেই বিহারীলাল চক্রবর্তীর একটি কবিতার উল্লেখ পাচ্ছি – কিন্তু আবার প্রবন্ধটির বাকি সমস্ত অংশেই লেখকের প্রখর জ্ঞানপিপাসার্ত অবস্থা, এবং সঙ্গে-সঙ্গেই বিজ্ঞানের আরও বিভিন্ন বিষয়কে জানবার ও পড়ে ফেলবার প্রতিও তাঁর অদম্য জেদ প্রকাশিত হচ্ছে। একাধিক বৈজ্ঞানিক গবেষণার উল্লেখ পাচ্ছি এই লেখায়, সঙ্গে সঙ্গেই কিভাবে জীবাশ্ম ও নানাবিধ প্রমাণ সাপেক্ষে সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের একটি রূপ ক্রমশ গড়ে উঠতে পারে সেই বিষয়েতেও একটি বিশদ আলোচনার হদিস পাওয়া যেতে পারছে। প্রবন্ধটির কিয়দংশকে তুলে ধরছি, “যদি কিয়দপরিমাণে জল খোলা জায়গায় কোনও পাত্রে রাখিয়া দেওয়া হয়, তবে শীঘ্রই দেখা যায়, তাহার উপর পীত ও হরিৎবর্ণের অতি সূক্ষ আবরণ পড়িয়াছে। অণুবীক্ষণ দিয়া দেখিতে গেলে দেখা যাইবে, সেগুলি আর কিছুই নহে – সহস্র সহস্র উদ্ভিদ পদার্থ ভাসিতেছে। তাহার পরেই সহস্র কীটাণু দেখা যাইবে, তাহারা দলবদ্ধ হইয়া সাঁতার দিতেছে ও সেই উদ্ভিজ্জ আহার করিয়া প্রাণ ধারণ করিতেছে। এই উদ্ভিদ পদার্থ যাহা আমরা অণুবীক্ষণের সাহায্য ব্যতীত দেখিতে পাই না – তাহাই হয়তো তাহাদের নিকটে একটি বৃহৎ রাজ্য। পরে আর একদল কীটাণু উত্থিত হইয়া প্রথমজাত কীটাণুদিগকে আক্রমণ করে, ও উদরসাৎ করিয়া ফেলে। প্রথমে উদ্ভিদ – পরে উদ্ভিদভোজী জীব, তৎপরে মাংসাশী প্রাণী উৎপন্ন হয়।” – লেখকের নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এমন বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ বা এমন একটি ভাষাকে শুনতে পেলেই – বিশেষ করে দুইজনের নাম মনে এসে পড়ে। তাঁদের মধ্যে একজন – তৎকালীন রিপন কলেজের অধ্যক্ষ, শ্রী রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী। অন্যজন শ্রী সুকুমার রায়। সংবাদধর্মী মেজাজে আহরিত বৈজ্ঞানিক তথ্যকে সুচারু ভাষাতে, সাধারণবোধ্য ভঙ্গিতে জনসাধারণের কাছে পেশ করতে – এই দুইজন মানুষ যে ঠিক কতটা পরিমাণে সিদ্ধহস্ত ছিলেন, তা অকল্পনীয় – কেবল তাঁদের রচনা পাঠের মাধ্যমেই তাঁদের প্রতিভা সম্পর্কে সম্যক ধারণা সম্ভব। রামেন্দ্রসুন্দর তবু, সেযুগের মানুষ হবার কারণে, এবং হয়তো বা পেশাগত ভাবে অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত থাকবার কারণে, বিচার্য বিষয়গুলিকে অল্প-বিস্তরে গম্ভীর বা ‘সিরিয়স-ভঙ্গি’তে উপস্থাপনার চেষ্টা করতেন। এর বিপরীতে ‘সন্দেশ’ পত্রিকার কর্ণধার সুকুমার – দিনের পর দিন যে আশ্চর্য সুললিত ভাষায় শিশু ও কিশোরদের প্রয়োজনে মনোহারী ভঙ্গিতে বিজ্ঞানের নানা খবর প্রকাশ করে এসেছেন – তার তুলনা মেলে না। রবীন্দ্রনাথ যেন এই দুইজনকার মধ্যবর্তী সময়ে, সেতু হয়ে বিরাজমান – অন্তত ‘বিজ্ঞানসম্মত’ ভাবে বলতে গেলে, (শুনুন টেকনিক্যালী বলতে গেলে) ভাষার দিক থেকে তো বটেই।

১৮৭৮এর পরে, ১৮৮২তে পাচ্ছি দ্বিতীয় প্রবন্ধ, এবারেও তা প্রকাশ পাচ্ছে বৈশাখের ভারতী-তে – এবারের শিরোনাম আরোই চমকপ্রদ, ‘দেবতায় মনুষ্যত্ব আরোপ’। প্রবন্ধটির সূত্রানুসন্ধান প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলছেন, হারবার্ট স্পেন্সারের ‘দ্য ইউজ অব অ্যানথ্রোপোমরফিজম’ নাম্নী একটি আলোচনার সাপেক্ষেই তাঁর এই রচনা। প্রবন্ধটিতে সাদা অর্থে বিজ্ঞান বলতে আমরা যা বুঝি তা হয়তো নেই, কিন্তু যা আছে তা হলো ধর্ম, যুক্তি ও দর্শনতত্ত্ব নিয়ে গভীর আলোচনা। কবির বয়স তখন ২১। এর পরেপরেই ক্রমশ একগুচ্ছ প্রবন্ধের প্রকাশ ঘটবে নিয়মিত ব্যবধানেই, কোনওটা ভারতী-তে, কোনওটা বালক-এ – কোনওটা বা সাধনা-য়। তাদের শিরোনামগুলির কয়েকটিকে উল্লেখ করি, ‘বৈজ্ঞানিক সংবাদ (বালক, ১৮৮৫)’, ‘উটপক্ষীর লাথি (সাধনা, ১৮৯১)’, ‘মানবশরীর (সাধনা, ১৮৯১)’, ‘রোগশত্রু ও দেহরক্ষক সৈন্য (সাধনা, ১৮৯১)’, ‘অভ্যাসজনিত পরিবর্তন (সাধনা, ১৮৯৩)’, ‘ঈথর, (সাধনা, ১৮৯৩)’, ‘ভূগর্ভস্থ জল এবং বায়ুপ্রবাহ (সাধনা, ১৮৯৪)’ ইত্যাদি।

এই প্রবন্ধগুলির আলোচনায় যাবো, তবে – প্রত্যেক বক্তৃতারই একটি গতি থাকা প্রয়োজন – এবং সেই গতির প্রভাববশত যদি বক্তব্যটি বাড়াবাড়ি রকমে একমুখী হয়ে দাঁড়ায় তবে তা শ্রোতাদের বিড়ম্বনার কারণ হয়। কাজেই – ১৮৭৮ থেকে ১৮৮২ এই সময়টার কথা মাথায় রেখে আমি একটি ছোট্ট ফুটনোট জুড়তে চাইবো, বাংলায় বলে পাদটীকা। তা হয়তো খানিকটা এই নীরস বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞানের চর্বিতচর্বণ থেকে শ্রোতাদেরকে খানিকটা ভারমুক্ত হতে সাহায্য করবে। বর্তমান বক্তৃতাটির সূচনাংশে আমরা পাশ্চাত্যপ্রতিভূদেরকে খানিকটা ঠেস দিয়ে বলেছিলাম যে, তাঁরা রবীন্দ্রনাথকে কেবল উপনিষদের কবি হিসেবেই মনে রেখে দিয়েছেন। আসুন না, আমরা একটু আত্মসমালোচনা করি। আমাদের অধিকাংশের কাছেই যে রবীন্দ্রনাথ কেবল প্রেম আর পূজাতেই সীমাবদ্ধ হয়ে রয়েছেন, সে কথাকে কি অস্বীকার করা যায়? আপনারাই বলুন। রবীন্দ্রনাথকে বিশেষভাবে আমরা মনে করি বছরে তিনটে দিন। হ্যাঁ, দুই নয় তিন। এক, ২৫শে বৈশাখ – দুই, ২২শে শ্রাবণ – এবং তিন, দোলপূর্ণিমার বসন্ত-উৎসব। ১৮৭৮এ রবীন্দ্রনাথ বিজ্ঞান বিষয়ে প্রবন্ধ লিখছেন কি লিখছেন না – আমরা সে বিষয়ে বিশেষ ভাবিত নই। অথচ, ১৮৭৭এ লেখা কবির একটি কবিতা অথবা ১৮৮৪তে লেখা কবির একটি গানকে আমরা বিশেষ ভাবেই মনে রাখতে চাই। প্রথমটি – সেই বিখ্যাত রচনা, “গহনকুসুমকুঞ্জ মাঝে – মৃদুলমধুর বংশী বাজে, বিসরিত্রাস লোকলাজে, সজনী আও আও লো ...”, আর দ্বিতীয়টি সেই গান, “আমার প্রাণের পরে চলে গেলো কে, বসন্তের বাতাসটুকুর মতো ...” এটিও তার সঙ্গে জুড়ে দিই, কিছু মানুষ – কিছু লেখক-গবেষক (অবশ্যই সকলে নন) – তাঁরা এই শেষোক্ত রচনাগুলির অনুপ্রেরণা হিসেবে বিশেষ একজনকে তুলে ধরতে চান। সেই মানুষটিকে নিয়ে – রবীন্দ্রনাথের উপরে তাঁর ইতিবাচক প্রভাব, নেতিবাচক প্রভাব – ইত্যাদি নানা কথা শোনাতে চান। অস্বীকার করিনা, সেই মানুষটির প্রভাব রবীন্দ্রজীবনে অপরিসীম। ১৮৮৪তে তাঁর মৃত্যু (অপমৃত্যু শব্দটা সজ্ঞানে ব্যবহার করলাম না), রবিজীবনে একটি গভীর শোক নিয়ে আসতে পেরেছিলো। আজীবন তাঁর স্মৃতিকে, রবীন্দ্রনাথ তাঁর রচনাতে লালন করেছেন। এবং এটি বলতেও আমার কোনও দ্বিধা নেই যে, রবীন্দ্রনাথকে তিনি সবদিক থেকেই অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিলেন। কেন একথা বলছি? কারণ, কেবল ওই গান বা কবিতাই নয় – যে সময়ে রবিঠাকুর সেই একের পর এক বিজ্ঞান-বিষয়ক, সাহিত্য-বিষয়ক, দর্শন-ও-নন্দনতত্ত্ব বিষয়ক নানা ভাবের নানা বিষয়ের প্রবন্ধ দিয়ে ‘ভারতী’কে সমৃদ্ধ করে চলেছিলেন – আমৃত্যু, ১৮৮৪ সাল অবধি, সেই ‘ভারতী’ পত্রিকার সম্পাদিকার নাম ছিলো – কাদম্বরী দেবী, যাঁর পূর্ণাঙ্গ ও সঠিক মূল্যায়নের আজ বড়ো বেশী করে দরকার হয়ে পড়েছে। আমরা বিজ্ঞানশিক্ষাতেই ফিরে যাই বরং।

পূর্বোক্ত কয়েকটি প্রবন্ধের বিষয়ে যদি আলোকপাত করতে হয়, ‘ঈথর’ নামাঙ্কিত রচনাটিতে দেখা যাচ্ছে, যে লেখক সেটিতে শূণ্যমাধ্যম বা বায়ুমাধ্যমের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত তরঙ্গের বিষয়ে আলোচনা করতে চাইছেন। ওয়্যারলেস যোগাযোগ বা বেতারতরঙ্গ আবিষ্কারের পূর্বলগ্নে যে ঈথর মাধ্যম নিয়ে বিজ্ঞানীদের জল্পনা চলছিলো – সেই ১৮৯৩ সালেই বাংলার সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথ সেই বিষয়টিকে নিয়ে আলোচনা চালিয়েছেন একটি সাধারণ সাহিত্য পত্রিকায়। তিনি লিখেছেন, “ঈথর স্পর্শের অতীত এবং পদার্থের গতিকে কিছুমাত্র বাধা দেয় না ... এইজন্য বোধ হয় অনেক শিক্ষিত ব্যক্তি ঈথরের অস্তিত্বকে কাল্পনিক অনুমান মনে করেন। কিন্তু ঈথর আমাদের ইন্দ্রিয়ের অগম্য নয়, আলোকবোধ ও উত্তাপবোধই তাহার প্রমাণ।” আবার আমাদের এই মানবশরীর যে অজস্র কোষের সমাহারে সৃষ্ট এবং সেই প্রতিটি কোষের যে একেকটি নির্দিষ্ট উপযোগিতা, গঠনতন্ত্র এবং উপাদানসমষ্টি রয়েছে – সে বিষয়েতেই একটি বিস্তৃত পাঠ পরিবেশিত হয়েছে ‘মানবশরীর’-এর আলোচনায়। ‘ভূগর্ভস্থ জল এবং বায়ুপ্রবাহ’ শীর্ষক রচনাটিতেও যে কেবল ভৌগোলিক সংবাদ পরিবেশিত হয়েছে তা নয়, ভূগর্ভস্থ জলের ব্যবহার, জনস্বাস্থ্য বিষয়ক নানা তথ্যাদিসমূহ এবং আপৎকালীন সময়ে তার ব্যবহার সম্পর্কে যে সমস্ত সতর্কতা নেওয়া প্রয়োজন এমন বহুলবিস্তৃত বিষয়েও উক্ত প্রবন্ধটিতে বিস্তারিত একটি আলোচনা পাওয়া গিয়েছে।
 

এই সমস্ত প্রবন্ধগুলির পাঠান্তে যে আরেকটি জিনিস বিশেষ ভাবেই আমাদের মননে পরিলক্ষিত হয় – তা হলো আবার এই রচনাগুলির সহজবোধ্যতা এবং অনায়াস একটি উপস্থাপনা-পদ্ধতি। বিজ্ঞানের মানুষ না হলেও, আম-পাঠকের জ্ঞাতার্থে একটি অসামান্য শিক্ষক বা হয়তো গল্প-লেখকের ভঙ্গিতেই লেখক যখন একটির পর একটি বিষয়কে তুলে আনেন – কোথাও যেন তা গুরুগম্ভীর বোধ তো হয়ই না, বরঞ্চ কোথাও যেন তাঁর দেওয়া তথ্যগুলিও ভার না জাগিয়েই মনের মধ্যেটায় সহজ করে একটি ঠাঁই খুঁজে নেবার সুযোগ পেয়ে যেতে পারে। শিক্ষক তথা লোকশিক্ষকরূপেও গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের একটি আত্মপ্রকাশ ঘটতে পায়।

শিক্ষা এবং শিক্ষণপদ্ধতি বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের একটি দূরদর্শী ভাবনা সেই সময় থেকেই জন্ম নিতে শুরু করেছিলো। তারই ফসল হিসেবে ১৯০১ সালে শান্তিনিকেতনের ভুবনডাঙ্গায় দেবেন ঠাকুরের জমিদারিতে তিনি ব্রক্ষ্মচর্যআশ্রমের প্রতিষ্ঠা করেন। প্রাচীন উপনিষদে বর্ণিত ধারাতেই, একটি স্কুল বা বিদ্যালয়কে গড়ে তুলবার ইচ্ছে ছিলো তাঁর। কর্তার কথায় গিন্নিও আর বাধ সাধতে পারেননি। মৃণালিনী দেবীর গয়না বন্ধক দিয়ে, রবীন্দ্রনাথ স্কুলের খরচ চালাতেন – আর সাধারণ স্কুল থেকে ছাড়িয়ে এনে – গুরুদেবের স্কুলের প্রথম ছাত্র ছিলেন কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ। এই কুঁড়িই বিকশিত হয়ে পরিণত হবে বিশ্বভারতীতে, ১৯২১এর ২৩শে ডিসেম্বর। মাঝের যে বিপুল ঘটনাক্রম – তা নিয়ে পরে কখনও আলোচনার সুযোগ আসবে, কেবল এটুকুই বলে রাখার – যে ব্রক্ষ্মচর্যআশ্রম থেকে বিশ্বভারতী গড়ে উঠবার মধ্যবর্তী সময়টুকুতেই - দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কনিষ্ঠ পুত্র রবীন্দ্রনাথ, ক্রমশ গুরুদেব রবীন্দ্রনাথে পর্যবসিত হয়ে পড়েন। শিক্ষাপ্রসার ও সমাজমুক্তি আন্দোলনেও তাঁর জীবন একটি নতুন ধারায় মোড় নিতে সক্ষম হয়। একে একে তাঁর আশ্রমে আসেন ক্ষিতিমোহন সেন, তেজেশচন্দ্র সেন এবং জগদানন্দ রায়। বিদেশ থেকে আসেন উদ্ভিদবিদ পিয়ার্সন, দর্শনশাস্ত্রের অধ্যাপক সিলভাঁ লেভী, কৃষিবিদ লিওনার্ড এলমহার্স্ট এবং সমাজকর্মী সি এফ এ্যান্ড্রুজের মতো ব্যক্তিবর্গ। বিশ্বভারতীতে রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞানচিন্তাকে নিয়েই এবারে কিছু বলা প্রয়োজন বলে মনে করছি। সেই আলোচনা শুরু হোক বরং তেজেশচন্দ্রকে দিয়েই।

আচার্য তেজেশচন্দ্র সেন ষোলো-সতেরো বছর বয়সেই প্রথম শান্তিনিকেতনে আসেন এবং ব্রক্ষ্মচর্য আশ্রমে যোগ দেন। সৈয়দ মুজতবা আলী লিখেছেন, “প্রশ্ন উঠতে পারে, ষোলো বৎসরের বালক জানেই বা কি – কটা পাস দিয়েছে, পড়াবেই বা কি!” কিন্তু কিছু পরেই তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন, “গুরুগৃহে বিদ্যাসঞ্চয় করার সময়ে কনিষ্ঠকে বিদ্যাদান করার প্রথা এদেশে আবহমান কাল থেকে চলে আসছে। গ্রামের পাঠশালাতে এখনও সর্দার-পড়ুয়া নীচের শ্রেণীতে পড়ায় ...” – এই তেজেশচন্দ্র এর পরবর্তীতে সুদীর্ঘ পাঁচটি দশক জুড়ে বিশ্বভারতীতে অধ্যাপনা করেছেন। সি এফ এ্যান্ড্রুজের লেখা থেকে জানা যায় যে রবিঠাকুরই প্রথম ভারতবর্ষে একেবারে বিদ্যালয়স্তর থেকে হাতেকলমে শিক্ষা দেবার প্রয়োজনে ল্যাবরেটরীর উপযোগিতা বিষয়ে সচেতন হয়েছিলেন। স্কুলস্তরে ল্যাবরেটরীর মাধ্যমে বিজ্ঞানশিক্ষা প্রদান এদেশে রবীন্দ্রনাথের হাত ধরেই শুরু হতে পেরেছিলো। অর্থাভাবে বৃহদাকারে গবেষণাগার তৈরী সম্ভব না হলেও – সামান্য পুঁজিকে নিয়েই যে দুইজন মানুষ শান্তিনিকেতনে বিশেষ ভাবে একটি বিজ্ঞানচর্চার পরিবেশ গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিলেন – তাঁরা হলেন যথাক্রমে তেজেশচন্দ্র সেন এবং জগদানন্দ রায়। মূলত তেজেশবাবুর ক্ষেত্র ছিলো উদ্ভিদবিদ্যা এবং বিহঙ্গজ্ঞান। শান্তিনিকেতনে আজ যে বিভিন্ন দেশের নানাবিধ গাছগাছালি এবং পুষ্পশোভা দেখা যায়, তার পিছনে তেজেশচন্দ্রেরই অবদান। এই বিভিন্ন গাছগাছালি শান্তিনিকেতনের রুখাশুখা মাটিতে ফলিয়ে তুলতে গিয়ে যে উদ্ভিদবিদ্যা এবং মাটি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানের প্রয়োজন – তা কেউই অস্বীকার করবেন না। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তেজেশচন্দ্রের এই ভাবনায় প্রভাবিত হয়েছিলেন – এর উল্লেখ পাবো আমরা আবার ‘বিশ্বপরিচয়ের’ প্রাক-সময়টিতে। এবারে জগদানন্দকে নিয়ে কিছু বলা প্রয়োজন।

আলোচনার বিষয়বস্তু ছিলো, ‘বিজ্ঞানশিক্ষা প্রসারে রবীন্দ্রনাথ’ – ‘বিজ্ঞানশিক্ষক রবীন্দ্রনাথ’ নয়। তিনি নিজে প্রবন্ধ লিখেছেন – তার সঙ্গে সঙ্গেই এমন মানুষজনকে খুঁজে এনে উৎসাহ দিয়ে গড়েপিটে নিয়েছেন – যাতে করে কিনা সেই মানুষেরাও নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়ে জগতসভায় তাঁদের অধীত জ্ঞানকে বিতরণ করতে পারেন। জগদানন্দ রায় অঙ্ক এবং বিজ্ঞান পড়াতেন। এই সময়েই বিশ্বভারতীর লক্ষ্য হয়ে ওঠে স্বল্পমূল্যে লোকশিক্ষা প্রচারের নিমিত্তে কিছু বই বা পুস্তিকা প্রকাশ করা। বিজ্ঞান-বিষয়ক রচনাগুলির দায়িত্ব নেন জগদানন্দ। শান্তিনিকেতনে কবিগুরুর স্নেহচ্ছায়ায় থেকে একেকজন মানুষ যেভাবে নিজেদের পান্ডিত্যকে আশ্চর্য সৌকর্যের সঙ্গে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন – তার উদাহরণ হিসেবে সেই সময়ের দুজন মানুষের লেখা দুটি বিশেষ বইয়ের কথা উল্লেখ করবো। সেই দুটি থেকেই প্রকাশিত হবে শিক্ষক এবং আশ্রম পরিচালক হিসেবে রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি কতখানি ব্যপ্ত ও বিস্তৃত ছিলো। প্রথম বইটি দর্শনশাস্ত্র ঘেঁষা – রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব ভূমিকা সম্বলিত। অধ্যাপক ক্ষিতিমোহন সেনের লেখা, “মেডিভ্যাল মিষ্টিজম অব ইন্ডিয়া” – মধ্যযুগীয় ভারতবর্ষের ভক্তিবাদী সমস্ত সাধুসন্তদের বাণী ও ভাবধারার একটি খাঁটি সংকলন – বইটিকে পড়ে দেখবার সৌভাগ্য হয়েছে। দ্বিতীয় বইটি জগদানন্দের লেখা, “বিজ্ঞানাচার্য জগদীশচন্দ্রের আবিষ্কার”। বক্তৃতার গোড়াতেই রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী এবং সুকুমার রায়ের কথা উল্লেখ করেছিলাম – জগদানন্দের এই বইটিও এবং তাঁর অন্যান্য রচনাও, সেই পূর্বোক্ত দুইজন মানুষের সৃষ্টিসমূহকেই মনে পড়ায়। অধ্যাপক জগদানন্দ রায় – শান্তিনিকেতন স্কুলের অঙ্ক ও বিজ্ঞানের মাস্টারমশাই।

কেবল পাঠশালে ছাত্র ঠেঙালেই বিজ্ঞানশিক্ষার প্রসার হয় না। সমাজ এবং সমাজের সাধারণ মানুষের মনে বিশেষ ভাবে চেতনার উন্মেষ ঘটানোটাও প্রয়োজন। পল্লী পুনর্গঠনে রবীন্দ্রনাথের যে দূরদৃষ্টি – রথীন্দ্রনাথকে আর সব কিছু ছাড়িয়ে কৃষিবিদ্যা পড়িয়ে এনে বিজ্ঞানসম্মত পরিকল্পনায় শান্তিনিকেতন-শ্রীনিকেতনে কৃষিকাজকে শুরু করবার যে সুদূরপ্রসারী ভাবনা – নীলরতন সরকারের মতো বরেণ্য মানুষকে অভিভাবকরূপে ভেবে নিয়ে গ্রামেগঞ্জে ছোটো ছোটো স্তরে চিকিৎসাকর্মী এবং চিকিৎসাকেন্দ্র গড়ে তুলবার যে প্রচেষ্টা, এমনকি ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্প ও সমবায়নীতিকে প্রচার করতে তাঁর যে উদ্যোগ – এসবই যেন রবীন্দ্রনাথের একটি লার্জার দ্যান লাইফ ইমেজকে চিত্রিত করতে পেরেছে। সাহিত্যিক রামকুমার মুখোপাধ্যায়ের একটি বক্তৃতা শুনেছিলাম। তিনি বলেছিলেন যে, “রবিঠাকুর ব্যতীত বোধকরি আর একজনও এমন নোবেল-লরিয়েট মিলবে না যিনি কিনা নোবেলপ্রাপ্তির পরেও প্রাইমার (শুনুন সহজ পাঠ) লিখতে উদ্যোগী হয়েছেন।” শিক্ষাপ্রসার এবং শিক্ষকতার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের যে অবদান কেবল সেইটুকুকে নিয়েই বোধকরি ঘন্টার পরে ঘণ্টা বক্তব্য রাখা চলে। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি হয়তো অনেকেরই থাকে – তবু, যখন কবি ও গীতিকার রবীন্দ্রনাথের এই সত্ত্বাগুলিকেও প্রকাশ পেতে দেখি – তখন হয়তো, কবি ও গীতিকারের তকমাকে ছাপিয়েও মহাপুরুষ তকমাটিই আরও বেশী করে উন্মোচিত হয়ে পড়ে।

১৯৩৮ সালের মার্চ মাসে, মডার্ণ রিভিউ পত্রিকায় সি এফ এ্যান্ড্রুজের লেখা একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়, যার শিরোনাম ছিলো ‘রুরাল রিকনস্ট্রাকশন এক্সপেরিমেন্টস এ্যাট শ্রীনিকেতন’। এই প্রবন্ধের সূত্র ধরেই বলছি, সি এফ এ্যান্ড্রুজ লিখছেন, ১৯১৩ তে তিনি যখন প্রথম শ্রীনিকেতনে যান – সেসময়ে জায়গাটি ছিলো আদতে একটি ম্যালেরিয়ার ডিপো। পুনর্গঠনের কাজে হাত দিয়েই, কবি ও তাঁর সহযোগীদের প্রথম ও প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়ায় ম্যালেরিয়া-দূরীকরণ। লিওনার্ড এলমহার্স্টের নেতৃত্বে কাজ শুরু হয়। ম্যালেরিয়া ও অন্যান্য ক্রান্তীয় রোগের বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ও বিখ্যাত গবেষক ডাক্তার হ্যারি টিম্বারের পরামর্শ ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানো হয়। লড়াইটা খুব মসৃণ ছিলো না মোটেই। হয়তো আপনাদের মনে থাকবে, ১৯০১-১৯০২তে যখন রবীন্দ্রনাথ পাকাপাকি ভাবে শান্তিনিকেতনে বসবাস করতে শুরু করেন, সেসময়েও একে একে সকলেই জ্বরে পড়েছিলেন। মৃণালিনী দেবী কঠোর পরিশ্রমে সকলকে সুস্থ করে তোলেন, এবং শেষটায় নিজে রোগাক্রান্ত হন। সে অসুখ আর সারেনি। রবিঠাকুর লিখেছিলেন, “মৃণালিনী দেবী – আশ্রমের প্রথম বলি”। শ্রীনিকেতনেও দুর্ভাগ্য পিছু ছাড়েনি রবীন্দ্রনাথের। রথীন্দ্রনাথের সহপাঠী সন্তোষ মজুমদার ১৯২৬ সালে প্রয়াত হন। অজস্র মানুষের পরামর্শ, অভিজ্ঞতা, পরিশ্রমের ফলে ক্রমশ শ্রীনিকেতনের অবস্থার উন্নতি ঘটে। ১৯৩৮ সালের প্রবন্ধে তথ্য দিয়ে এ্যান্ড্রুজ সাহেব জানাচ্ছেন যে, ৯০% থেকে এখন শ্রীনিকেতনে পিলেরুগীর সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৪%-এ। ম্যালেরিয়া রোগাক্রান্তের সংখ্যা ৩০% থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ১.৯%-এ। এভাবেই স্বাস্থ্যবিধি প্রচার ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পল্লী-পুনর্গঠনের ক্ষেত্রেও দিশা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ। প্রবন্ধকার থেকে বিজ্ঞানভাবনা প্রসার এবং পরবর্তীতে বিশ্বভারতীর মতো একটি প্রতিষ্ঠানকে চালিয়ে সমাজের উন্নতিতে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োগ – এভাবেই বিজ্ঞানশিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রেও দিশারী হয়ে উঠেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, আমাদের ২৫শে বৈশাখের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

জীবনসায়াহ্নে পৌঁছিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর বিবর্তন শেষ হতে পারেনি। তেজেশচন্দ্র বা জগদীশচন্দ্র যে ভাবনার ফুল ফুটিয়েছিলেন – সেই ভাবনা থেকেই জন্ম নিচ্ছে কাব্যগ্রন্থ ‘বনবাণী’ – যার প্রথম কবিতায় কবির আহ্বান, “অন্ধ ভূমিগর্ভ হতে শুনেছিলে সূর্যের আহ্বান – প্রাণের প্রথম জাগরণে, তুমি বৃক্ষ – আদিপ্রাণ, ঊর্ধশীর্ষে উচ্চারিলে আলোকের প্রথম বন্দনা, ছন্দহীন পাষাণের বক্ষ’পরে ... আনিলে বেদনা নিঃসাড় নিষ্ঠুর মরুস্থলে।” এরপরে, একই কাব্যগ্রন্থের কয়েকটি কবিতার নাম উল্লেখ করি – যথাক্রমে, দেবদারু, নীলমণিলতা, কুরচি, শাল, নারিকেল ও অন্যান্য। আর প্রথমটির পরে দ্বিতীয় কবিতাটির নাম ছিল, জগদীশচন্দ্র। বিবর্তন নয়? শেষ বয়সে এসে কেবল গাছ আর ফুলেদের উপর কবিতা। গাছেরও প্রাণ আছে – সেই কথারই কাব্যিক প্রকাশ। এই সময়েই ১৯৩৭এ প্রকাশিত হয় ‘বিশ্বপরিচয়’।

‘বিশ্ব-পরিচয়ে’র আখ্যানপত্রেই কবি লিখেছেন, “শিক্ষা যারা আরম্ভ করেছে, গোড়া থেকেই বিজ্ঞানের ভাণ্ডারে না হোক, বিজ্ঞানের আঙিনায় তাদের প্রবেশ করা অত্যাবশ্যক।” বইটি কবি উৎসর্গ করছেন – ‘শ্রীযুক্ত সত্যেন্দ্রনাথ বসু, প্রীতিভাজনেষু’কে। গুরুদেব লিখেছেন, “এর মধ্যে এমন বিজ্ঞানসম্পদ নেই যা বিনা সংকোচে তোমার হাতে দেবার যোগ্য ... কয়েকটি প্রামাণ্য গ্রন্থ সামনে রেখে সাধ্যমতো নিড়ানি চালিয়েছি। কিছু ওপড়ানো হলো।” বইটিতে উৎসর্গ, উপসংহার বাদ দিলে পরে পাঁচটি মাত্র অধ্যায় – যথাক্রমে, ১) পরমাণুলোক ২) নক্ষত্রলোক ৩) সৌরজগৎ ৪) গ্রহলোক এবং ৫) ভূলোক। ‘সাধ্যমতো নিড়ানি চালানো’-র কিছু নমুনাকে বোধহয় বক্তৃতার এই অংশে পেশ করা উচিত।

পরমাণুলোক অধ্যায়ে গুরুদেব লিখেছেন, “আকাশে আলোর এই চলাচলের খবর বেয়ে বিজ্ঞানে একটি প্রশ্ন উঠল, তার চলার ভঙ্গীটা কিরকম... উত্তর পাওয়া গেছে তার চলা অতি সূক্ষ ঢেউয়ের মতো... কিন্তু মানুষের মনকে হয়রান করবার সঙ্গে সঙ্গেই আরেকটা জুড়ি খবর তার সমস্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ নিয়ে হাজির হলো, আলো অসংখ্য জ্যোতিকণার সমাহার, অতি ছিটেগুলির মতো ক্রমাগত তার বর্ষণ।” বিজ্ঞানমনস্ক পাঠক কি অবাক হচ্ছেন, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের কলমে আলোর বিষয়ে তরঙ্গ-কণা দ্বিধর্মীতার মতো প্রসঙ্গ? একই অধ্যায়ের পরের পাতাতেই কবি লিখেছেন, “আপাতত আলোর ঢেউয়ের কথাই বুঝে নেওয়া যাক। এই ঢেউ একটি মাত্র ঢেউয়ের ধারা নয়, একসঙ্গে অনেক ঢেউ দল বেঁধেছে।” এ কি কেবল কবির কল্পনা বলে মনে হয়? বোধহয় তা নয়। কারণ ‘বিশ্ব-পরিচয়ে’র আখ্যানপত্রেই কবি উল্লেখ করেছেন একাধিক গবেষণা-প্রবন্ধ, জার্নাল ও বইয়ের কথাও, যেগুলির সাহায্যেই তিনি ‘বিশ্ব-পরিচয়’কে সাজিয়েছেন। কাজেই বিজ্ঞানমনা পাঠক অনায়াসেই বুঝে নিতে পারেন বিজ্ঞানের কোন জটিল তত্ত্বটির দিকেই এমন সহজ ভাষায়, সহজ পরিবেশনায় - গুরুদেব ইঙ্গিত করতে চেয়েছেন। কেমন অল্পেতে অল্পেতেই গড়ে তুলতে চেষ্টা করেছেন লোকশিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলায় বিজ্ঞানশিক্ষার এক আকর গ্রন্থকেই।

গ্রন্থের দ্বিতীয় অধ্যায় ‘নক্ষত্রলোক’ – গুরুদেব লিখছেন, “সূর্যই তো আমাদের কাছ থেকে যথেষ্ট দূরে, তার চেয়ে বহু লক্ষগুণ দূরে আছে নক্ষত্রের দল... (তাই) জ্যোতিষ্কলোকের মাপ এ সংকেতে কুলালো না, তাই আর এক সংকেত বেরিয়েছে। তাকে বলা যায় আলো-চলার মাপ।” এরপরেই আলোকবর্ষের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ। ক্রমশ ব্যাখ্যা করবেন দূরবীন যন্ত্রের বিষয়েও। ‘গ্রহলোক’-এর আলোচনায় উঠে আসবে বিভিন্ন গ্রহদের অবস্থান, তাদের আবহাওয়ার খবর ইত্যাদি। ‘সৌরজগৎ’ এবং ‘ভূলোক’-এর কথায় কবি চেনাবেন আমাদের আকাশ, আমাদের পৃথিবী – তার উপাদান এবং ভৌগোলিক স্তরসমূহের বিষয়। বাংলাভাষায় বিজ্ঞানবিষয়ক এমন প্রাঞ্জল অথচ লোকশিক্ষার নিমিত্তে উপযোগী এমন একটি গ্রন্থের প্রকাশ যে সেই সময়েতে এবং পরবর্তীতেও, যে কতখানি প্রয়োজন ছিলো তা আমরা অনেকেই কেবল উপলব্ধিই করতে পারি আজ। লেখকের নাম সেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ২৫শে বৈশাখের রবীন্দ্রনাথ।

প্রসঙ্গে ফিরে এসে, আজ গুরুদেবের বিষয়ে যে কথাটিই বোধহয় বিশেষ ভাবে বলা যায় সেটি হলো যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন আজন্ম-ছাত্রসুলভ এক মনের অধিকারী। পড়বার এবং জানবার প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিলো চিরকালীন – এবং হয়তো সেকারণেই তাঁর রচনার ধরণ ও বর্ণনায় এমন অনায়াস একটি সহজবোধ্যতা প্রকাশিত হয়ে এসেছে। এছাড়াও তাঁর লেখা থেকেই জানা যায়, জ্যোতির্বিজ্ঞানের বই পেলেই তা এক নিঃশ্বাসে পড়তেন তিনি। ছোটোবেলায় তাঁর পিতৃদেব নিজ-উদ্যোগে তাঁকে চিনিয়ে দিতে চাইতেন লুব্ধক, কালপুরুষ। সৈয়দ মুজতবা আলী কিংবা রানী চন্দের রচনা থেকে জানা যায়, কি বিপুল বিষয় বৈচিত্রের নানাবিধ বই পড়বারও শখ ছিলো রবীন্দ্রনাথের। জটিল গণিতবিদ্যাই হোক, রসায়নের গভীর তত্ত্বই হোক অথবা প্রাণতত্ত্বের উপর হক্সলের প্রবন্ধমালাই হোক – গুরুদেব তা পড়তেন এবং বুঝতেও চাইতেন। আর সহজ করে তাঁর নিজের উপলব্ধিকে বুঝিয়ে দেবারও তাঁর যে অনায়াস দক্ষতা, তাঁর মাধ্যমেই সাহিত্যিক পরিচয়কে ছাপিয়েও একজন সার্থক শিক্ষকরূপে তাঁর প্রকাশ ঘটেছে বারংবার। তাঁর অপার জ্ঞানভান্ডারকে তিনি যে কেবল অর্জন করেছিলেন তা নয়, সহজ পথে তাকে সহজ করে তুলে বিলিয়েও দিয়েছিলেন নির্দ্বিধায়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের চাইতেও শিক্ষক বা শিক্ষাপ্রচারক রবীন্দ্রনাথ, বিজ্ঞানশিক্ষক রবীন্দ্রনাথকেও তাই এতটুকুও ভুলবার অবকাশ নেই কোথাও – তাঁকে জানবার, জেনে চলবার যে যাত্রাপথ, তাও যে ফুরাবার নয় কোনোদিনেই। তিনি না থাকলে আমার তেজেশচন্দ্রকে পেতাম না, জগদানন্দকে পেতাম না – এলমহার্স্টকে পেতাম না – সন্তোষ মজুমদারকে পেতাম না, কালীগ্রামে নোবেলের টাকায় সমবায় ব্যাঙ্কটিও গড়ে উঠতো না। কাজেই, অধ্যাপক বুদ্ধদেব বসুর বক্তব্যে একটি প্রচ্ছন্ন ব্যক্তিগত আক্ষেপ লুকিয়ে থাকলেও, তাঁর লেখা সেই ‘কবিতার সাত সিঁড়ি’ নাম্নী প্রবন্ধের অন্তিম পরিচ্ছেদের কিয়দংশকেই এখানে উদ্ধৃত করতে চাইবো, “যদি তিনি (রবীন্দ্রনাথ), শুধু স্বল্পসংখ্যক উৎকৃষ্ট কবিতা লিখতেন তাহলে হয়তো পরবর্তী কবিদের পক্ষে আরও ভালো হতো, কিন্তু তাঁর (রবীন্দ্রনাথের) সমগ্র স্বজাতির মানসিক দারিদ্য ঘুচতো না...”

আমারে তুমি অশেষ করেছো, এমনই লীলা তব। ফুরায়ে ফেলে আবার ভরেছো জীবন, নব নব। কত যে গিরি, কত যে নদীতীরে – বেড়ালে বহি ছোটো এ বাঁশিটিরে, কত যে তান বাজালে ফিরে ফিরে, কাহারে তাহা কব? তোমারই ওই অমৃতপরশে আমার হিয়াখানি, হারালো সীমা বিপুল হরষে, উথলি উঠে বাণী। আমার শুধু একটি মুঠি ভরি, দিতেছো দান – দিবসবিভাবরী, হলো না সারা, কত না যুগ ধরি – কেবলই আমি লব...

[মে, ২০১৯ এ যাদবপুরের ইন্দুমতী সভাগৃহে, বঙ্গীয় জাতীয় শিক্ষা পরিষদের আলোচনা সভায় প্রদত্ত ভাষণের পরিমার্জিত রূপ]


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন